#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_৩২
#তানজিলা_খাতুন_তানু
এতগুলো ধাক্কা একসাথে সহ্য করতে টাল সামলাতে হচ্ছে অতসী কে। সকাল থেকে একটার পর একটা ঘটনা সহ্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর আদৃতের কথা শুনে মাথাতে আকাশ ভেঙে পড়েছে।রুহি যদি আদৃতের স্ত্রী হয় তারমানে ওর দিদিভাইয়ের আর এই পৃথিবীতে নেই। কথাটা মাথাতে আসতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অতসী।
– এই অতসী কাঁদছ কেন?
– দিদিভাই..
অতসী আর পুরোটা বলতে পারল না, তার আগেই কান্নায় ভেংগে পড়ল। আদৃত অতসীর কথার মানে বুঝতে পেরে ভাঙা গলাতে বলল,
– আমরা সুখেই ছিলাম। আমাদের সুখটা আরো দ্বিগুন করতে আরু রুহির গর্ভে আসে আর আরুকে জন্ম দিতে গিয়েই রুহি আমাদের ছেড়ে চলে যায়।
অতসীর কান্নার মাত্রা আরো বেড়ে গেল। আদৃত অতসীকে কিছু বলল না। মেয়েটা না হয় আজ কেঁদেই নিজের কষ্টগুলোকে হালকা করুক।
অনেকক্ষন পর,
অতসী নিজেকে শান্ত করল। আদৃত অতসী কে থামতে দেখে বলল,
– ঠিক আছো তুমি।
– হুমম। আমি বাড়ি ফিরব।
– আচ্ছা চলো আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি।
আদৃত অতসী কে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসলো। অতসী নিজের ঘরে ঢুকে কাঁদতে শুরু করল, এতদিন অনেক সহ্য করেছে কিন্তু আজকে সবকিছুর বাঁধ ভেঙে গেছে, রুহিকে হারিয়ে ফেলার আঘাতটা সহ্য করতে পারছে না। অতসী কেঁদে উঠছে বারেবারে, কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সেইদিকে ওর খেয়াল নেয়।
পরেরদিন অতসী নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করেও পারছে না। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে, চোখটা পুরো ফুলে আছে। বিট্টু অতসী কে দেখে বলল,
– কি হয়েছে দিদিভাই তোমার।
– আরে কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।
– কিন্তু তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমাও নি কিংবা কান্নাকাটি করেছ।
– কিছু না। সর আমাকে কলেজ যেতে হবে।
অতসী ব্যস্ত হয়ে কলেজে যাবার জন্য রেডি হতে লাগল। বিট্টু কিছুক্ষন অতসীর দিকে তাকিয়ে বের হয়ে গেল। বিট্টু বেড়িয়ে যাবার পরেই অতসী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আজকে কতদিন পর নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। চোখগুলো কিরকম একটা অদ্ভুত লাগছে লাল হয়ে আছে, চোখগুলো ঢুকে আছে। সত্যিই কি ওকে অদ্ভুত লাগছে, দেখে মনে হচ্ছে কান্না করেছে? কে জানে।
অতসী নিজেকে সামলে নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। মাথাতে অনেককিছুই ঘোরাঘুরি করে চলেছে।
অতসী কলেজে গিয়ে ক্লাস করার পর রুমেই বসে ছিল। শাহানা দূর থেকে লক্ষ্য করছিল অতসীকে, ইচ্ছা করেই অতসীকে তাঁতিয়ে দিতে লাগল।
– ওই দ্যাখ, মনে হয় সত্যি ব্রেকাপ হয়ে গেছে। কেঁদে কাটে চোখ লাল হয়ে আছে।
কথাটা বলেই বন্ধুরা সবাই মিলে হাসতে শুরু করে দিলো। অতসী চুপচাপ নিজের মতো ব্যস্ত ছিল, তারপরেও শাহানারা ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও অতসীকে নিয়ে মজা করতে থাকে।
– কি রে অতসী, মুখে কি তালা দিয়ে রাখলি নাকি।
অতসী শাহানার কথাতে পাত্তা না দিয়ে কাউকে একজনকে কল করে বলল,
– হ্যালো
– হ্যাঁ, কে বলছেন?
– আঙ্কেল আমি শাহানার ক্লাসমেট।
– ওহ। কিছু কি হয়েছে?
– আঙ্কেল আমি না আপনাকে একটা ছোট্ট ভিডিও পাঠিয়েছি একটু কষ্ট করে ওটা দেখবেন প্লিজ।
– ওকে।
শাহানার বাবা ভিডিওটা দেখে রেগে গেলেন। অতসী ফোনটা লাউডস্পিকারে দিতেই শাহানারা নড়েচড়ে বসলো।
– এই তুমি আমাকে কিসব ভিডিও পাঠিয়েছ।
– কেন আঙ্কেল আপনার মেয়ের কাজকর্মের প্রমান পাঠিয়েছি, ভালো না।
– তুমি কে বলছো, তোমার সাহস কিভাবে হয়।
– আরে আঙ্কেল রেগে যাচ্ছেন কেন? আপনার মেয়ে কলেজে পড়াশোনার নাম করে কি করে বেড়াচ্ছে সেটা তো আপনার জানা দরকার।
– আমার মেয়ে আমি বুঝে নেব, তুমি বাইরের মেয়ে হয়ে এইসবে মাথা গলাবেন না।
– এই আপনাদের মতো গার্জেনদের জন্যই বর্তমানে স্টুডেন্টদের এই অবস্থা হয়েছে। কলেজটা পড়াশোনা করার জায়গা আড্ডা দেবার কিংবা কারোর পেছনে পড়ে থাকার জায়গা নয়। আর আমি কে?
কথাটা বলেই বাঁকা হাসল অতসী। তারপরে শাহানার দিকে তাকিয়ে বলল,
– আমি কে সেটা নয় একদিন সামনাসামনি দেখা হলেই বলব। আর আঙ্কেল আপনার মেয়েকে সাবধান করে দিন, নাহলে বড্ড পস্তাতে হবে।
কথাটা বলে অতসী ফোনটা কেটে দিলো। ফোনটা কেটে দিতেই শাহানা অতসীর দিকে তেড়ে এসে বলল,
– এই তোর সাহস কিভাবে হলো আমার পাপাকে কল করে এত কথা শোনানোর।
– আমার সাহস নিয়ে কোনো কথা হবে না শাহানা। আর এখনো অনেক ধামাকা বাকি আছে, ওয়েট এন্ড ওয়াচ।
অতসী শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল। শাহানা রাগে ফুঁসতে লাগল।
২দিন পর,
অতসী আর আদৃত আবারো আগের জায়গাতে মুখোমুখি হয়েছে তবে এইখানে আসার কারনটা আদৃতের অজানা। অতসী হুট করেই ওকে ডেকে পাঠিয়েছে।
– কি হলো চুপ করে থাকবে।
– হুমম।
– কি বলবে বলো।
অতসী তবুও চুপ করে থাকল। আদৃত সামনের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,
– আমাকে আর রুহিকে না হয় তোমার বাবা ফিরিয়ে নিতে চাইনি। কিন্তু তুমি কেন ওই বাড়িতে ফিরে যাওনি?
অতসী আদৃতের দিকে একপলক তাকিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,
– ওই মানুষটাকে নিজের বাবা বলতেও আমার বিবেকে বাধে। মানুষটি শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে আমাকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। নিজের রাগের বশে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। আমি জীবনে ৭টা বছরে কম যুদ্ধ করিনি। তবুও যতদিন নানুভাই বেঁ/চে ছিলেন ততদিন আমাদের কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু নানুবাড়ি চলে যাবার পর আমাদের জীবনে অনেককিছুই ঘটে যায়। সবকিছু হারিয়ে আজকে আমি একা।
অতসী ভাঙা গলাতে কথাগুলো বলল।
– অতসী। তবুও তোমার ফিরে যাওয়া উচিত ছিল।
– ফিরে যাবো? কেন ফিরে যাবো। যে মানুষটার জন্য আমার ইচ্ছাগুলো, স্বপ্নগুলো নিমিষে ভেঙ্গে গিয়েছিল সেইগুলো কি আমি কখনোই ফিরে পাবো। আমার জীবন থেকে সুখের ৭টা বছর আমি কি কখনো ফিরে পাবো। বলুন।
আদৃত কিছু বলল না। অতসী আবারো বলতে শুরু করল,
– জানেন আমার খুব ইচ্ছা ছিল, ডাক্তার হবো। নানুভাই বলেছিল তিনি আমাকে পড়াবেন, কিন্তু হঠাৎ করে তিনি চলে যাওয়াতে আমার জীবনটা পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেল। মায়ের দিকে মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরে গেলাম, কিন্তু সেইখানে গিয়ে জানতে পারলাম আমার বাবা আমাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে। সেইদিনই কাউকে কিছু না বলে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। শুরু হলো আমার জীবনের নতুন অধ্যায়। সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে শুরু করলাম।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। হয়তো রাস্তায় নরপশুদের সাথে শে’ষ হয়ে যেতাম তখনি আমার জীবনে একজন মানুষ আসে..
#চলবে…
#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_৩৩
#তানজিলা_খাতুন_তানু
অতসী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল,
– রাস্তাতে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কোথায় যাবো কি করব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রাত বেড়ে চলেছে, মানুষের আনাগোনাও কমে গেছে, দূরে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। ভয়েতে হাত পা কাঁপছে,তবুও হেঁটে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছি, তবে কোথায় যাচ্ছি সেইদিকে আমার খেয়াল নেয় আর না কোনো রাস্তা জানি। দীর্ঘ ৫বছর এই এলাকায় না থাকার কারণে কোনো কিছুই আমার ঠিক মতো চেনা ছিল না। দূরে দেখলাম একটা আলো জ্বলছে, ভয়ও লাগছে আবার সাহসও পাচ্ছি কিছুটা,যদি কোনো মানুষ আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তো।
কিছু হেঁটে এগিয়ে আসার পর বুঝলাম আলোটা একটা শ্মশানের। আর কিছু লোক শ্মশানের পাশে বসে মদ খাচ্ছে। ভয়ে গা কাঁটা দিয়ে উঠল, যথারীতি ওইখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। তাড়াতাড়ি করে পা চালিয়ে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে ডাক পড়ল,
– আরে মামনি একা একা এত রাতে কোথায় যাচ্ছো।
বুঝলাম শয়তানগুলোর নজরে পড়েছি, তাই পেছন ফিরে না তাকিয়েই জোরে হাঁটতে শুরু করলাম। পেছনে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমার পেছনে ওরাও আসছে। অপেক্ষা না করে নিজের হাতের ব্যাগটাকে শক্ত করে চেপে ধরে দৌড়াতে শুরু করালাম। কোনদিক থেকে কোনদিকে যাচ্ছি সেইদিকে আমার খেয়াল নেয়, আমার শুধু একটাই চিন্তা জী/বন থাকতে কখনোই ওই নরপশুদের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেব না। যেভাবেই হোক ওদের হাত থেকে আমাকে পালাতেই হবে।
দৌড়াতে দৌড়াতে বাসস্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে পৌছালাম। যাত্রীদের বসার সিটে বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম তখনি একটা বাস আমার সামনে এসে দাঁড়াল। কি করব, না করবে অনেক ভেবেই বাসে উঠে পড়লাম। বাসটা মোটামুটি ভর্তিই ছিল। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়লাম। অন্ধকারে আমার পাশে কে আছে সেটা ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। তবে যতটুকু আন্দাজ এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন।
বাস জার্নি করার অভ্যাস না থাকাতে কিছুক্ষণ পর থেকেই শরীর খারাপ হয়ে আসতে লাগল। আমাকে উশখুশ করতে দেখে ভদ্রলোকটি বলে উঠলেন,
– মা তোমার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে।
কথা বলার মতো শক্তি ছিল না। তবুও অনেক কষ্টে মাথা নাড়ালাম। লোকটি সেটা দেখতে পেল নাকি জানি না, তবে তিনি বলেন উঠলেন
– তুমি এইদিকে এসে বসো। ভালো লাগবে।
ওনার কথাতে আমি জায়গা অদলবদল করে বসলাম। জানালার পাশে বসার পর সত্যি ভালো লাগছিল কিছুটা। জানলার পাশে বসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেইদিকে আমার খেয়াল ছিল না। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম গোটা বাস ফাঁকা, শুধুমাত্র একটা ভদ্রলোক বসে আছেন। আমাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে তিনি বললেন,
– তোমার ঘুম ভেঙে গেছে মা।
চেনা কন্ঠস্বর শুনে আমি লোকটার দিকে দৃষ্টি দিলাম। লোকটিকে চেনা চেনা লাগলেও বুঝে উঠতে পারলাম না।আমাকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটি বললেন,
– আসলে সবাই চলে নেমে গেছে, তুমি কোথায় যাবে মা।
– কোথায় যাবো আমি!
আমি নিজের মনে মনেই প্রশ্নটা করলাম। আমি তো জানি না আমি কোথায় যাবো।
– এটা কোথায় কাকাবাবু।
– এটা কলকাতা শহর।
– কলকাতা?
– হুমম। তুমি কোথায় যাবে।
– আমি জানি না।
– জানি না মানে? এত রাতে একা বাসে উঠলে, শরীরটাও ভালো না। এখন বলছো কোথায় যাবে জানো না।
– হুমম।
– যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা বলব।
– কি কথা।
– আমার সাথে আমার বাড়িতে যাবে।
– আপনার বাড়ি?
– তুমি আমার মেয়ের বয়সীই আমি এই শহরে তোমাকে একাকে রেখে যেতে পারব না। দয়া করো চলো আমার সাথে।
নিজের মনটাকে শক্ত করে লোকটির সাথে যেতে রাজি হয়ে গেলাম আমি। আমি জানি না কি হবে,তবে লোকটিকে ভরসা করাই যায়। আমার সম্মতি পেয়ে লোকটিকে খুশি মনে আমাকে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
বাড়িটা বেশ বড়ো আর সুন্দর ছিল। আমাকে নিয়ে লোকটি তার ঘরে আসতেই তার স্ত্রী বলল,
– এটা কাকে নিয়ে এসেছ তুমি।
লোকটি কাচুমাচু হয়ে উত্তর দিলো,
– নতুন ভাড়াটিয়া।
বুঝলাম বাড়ির কর্ত্রী তার স্ত্রী। এই বাড়িতে তার কথা ছাড়া আর কারোর কথা চলে না, লোকটি ভীত হয়েই আমাকে তার ভাড়াটিয়া বলেই পরিচয় দিয়েছে। লোকটি আমাকে একটা ঘরে থাকতে দিয়ে বলল,
– আজকে থেকে তুমি এইখানেই থাকবে। আর ভাড়ার বিষয়টা সিরিয়াস নিয়ো না। তোমার কাকিমা একটু বদমেজাজি স্বভাবের কিছু মনে করো না।
সেইদিন মুচকি হাসি দিয়ে থাকতে শুরু করেছিলাম। তবে মনে ঠিক করেছিলাম থাকলে বাড়িতে ভাড়া দিয়েই থাকব।
কাকাবাবু আমাকে অনেক ভাবেই সাহায্য করতে লাগলেন। তবে সবটাই তার স্ত্রীয়ের চোখের আড়ালে।
– কাকাবাবু আমার একটা সাহায্য করবেন।
– কি সাহায্য মা।
– একটা টিউশনি খুঁজে দেবেন।
– আচ্ছা দেখছি।
কাকাবাবুর সাহায্য নিয়ে টিউশনি জোগাড় করে নিজের খরচ চালাতে শুরু করলাম। আর সবকিছুর মধ্যে কখন যে মেডিকেলে ভর্তির ডেট চলে গেল সেটা বুঝতেই পারলাম না। ভেবেছিলাম পড়াশোনা করব না চাকরি করব। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক পাসে কে চাকরি দেবে আমাকে। চাকরিও পেলাম না। টিউশনি পড়িয়ে নিজের জীবন চালাতে লাগলাম। আমার ডিগ্রির প্রচন্ড প্রয়োজন ছিল, বেড়িয়ে আসার আগে বাবাকে বলেছিলাম নিজের পরিচয়ে কিছু করে দেখাব। পড়াশোনা ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারব না। তাই ডিগ্রি নেবার জন্য অর্নাসে ভর্তি হলাম আর চলতে শুরু করল জীবনটা নিজের গতিতে।
ডাক্তার হবার স্বপ্নটা নিমিষেই হারিয়ে গেল। যেদিন জানতে পারলাম আমার আর ডাক্তারি পড়া হবে না তখন প্রচন্ড কেঁদেছিলাম।সেই কষ্টটা আজও আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। তবে আমি কাকাবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ, তার কারনেই আমি আজকে এখনো পর্যন্ত সুস্থ স্বাভাবিক আছে। সেইদিন আমাকে আশ্রয় না দিলে আমার কি হতো কে জানে।
কথাগুলো বলতে বলতে অতসীর চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
– জানেন অর্থ ছাড়া কেউ কারোর আপন হয় না। কিছু অর্থের জন্য আমার ডাক্তারি পড়া হয়ে উঠল না। আমার ডাক্তার হওয়া হলো না।
– খুব কষ্ট হয় তাই না।
– হুমম।
– কিন্তু অতসী পুরানো কথাগুলো ভেবে মন খারাপ করার কোনো মানে হয় না। পুরানো কথাগুলো তোমাকে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দেবে না তাই এইগুলো বাদ দাও, বর্তমান নিয়ে ভাবো।
– হুম সেটাকেই ভাবতে চাই।
– হুমম।
কিছুক্ষন নিশ্চুপ। তারপরে অতসী বলে উঠল,
– আমার একটা প্রস্তাব আছে।
– কি প্রস্তাব।
– আমি আরুর দায়িত্ব নিতে চাই।
– হ্যাঁ নাও আমাদের কোনো অসুবিধা নেয়।
– ওইভাবে নয়।
– তাহলে।
– আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
– কি?
#চলবে…
#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_৩৪
#তানজিলা_খাতুন_তানু
– আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
অতসীর শান্ত কন্ঠে বলা কথাটা শুনে আদৃত চমকে উঠল।
– কি বলছো তুমি এইসব।
– আমি ঠিকই বলছি, প্লিজ।
আদৃত কি করবে সেটা বুঝতে পারল না। চুপ করে থাকল।
– আপনি ভেবে চিন্তে আমাকে সিদ্ধান্তটা জানাবেন। আর আশা করব উত্তরটা যেন হ্যাঁ হয়।
আদৃত দূরে সমুদ্রের দিকে তাকাল। কি সিদ্ধান্ত নেবে সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।
– এইখানেই কি সারারাত কাটানোর ইচ্ছা আছে নাকি?
– না। চলো।
আদৃত অতসী কে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। খাবার সময়েও আনমনা হয়েছিল। আদৃতকে আনমনা হয়ে থাকতে দেখে ওর মা জিজ্ঞাসা করল,
– বাবু কিছু হয়েছে, তোকে আনমনা লাগছে কেন?
– হুমম।
– কি বল।
আদৃত আরুর দিকে ইশারা করল। উনি বুঝছেন আরুর সামনে আদৃত কথাটা বলতে চাইছে না,তাই চুপ করে গেলেন। খাওয়া শেষ করার পর আদৃত আরুকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে লাগল।
– বাবা একটা কথা বলব।
– হুম সোনা বলো।
– আমার না আন্টিকে খুব ভালো লাগে। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় আন্টি যদি আমার মা হতো খুব ভালো হতো।
আরুর কথা শুনে আদৃত থমকে গেল। আরুর কথাগুলো বারবার নিজের কানে বাজতে লাগল। নিজের সাথে নিজের লড়াই আরো কিছুটা বেড়ে গেল। আরু অতসীর সাথে কাটানো আরো অনেক গল্প আদৃতের সাথে করতে লাগল।
আরু ঘুমিয়ে যেতে আদৃত ওর মায়ের ঘরে গিয়ে টোকা মারল।
– মা আসব।
– হুম,তোর জন্যেই জেগে আছি।
– হুমম।
আদৃত মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল, আদৃতের মা আদর করে ছেলের মাথাতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
– কি হয়েছে, কোনো সমস্যা।
– মা, আজকে অতসী আমাকে ডেকেছিল।
– কি বলল।
– আমাকে বিয়ে করতে চাই।
আদৃতের মায়ের মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠল আবার পরক্ষনেই খুশিতে চকচক করে উঠল। অতসীকে দেখার পর থেকে তিনি মনে মনে এটাই চাইতেন যাতে অতসী তার বাড়ির বউ হোক। রুহির বোন এই কথাটা জানার পর একটু দোটানায় পড়ে গিয়েছিলেন,তবে আজকের কথাটা শুনে খুব খুশি হলেন।
– এটা তো খুব ভালো কথা।
মায়ের কথা শুনে আদৃত চোখ খুলে চট করে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল,মায়ের মুখে খুশির ঝলক। আদৃত ভ্রু কুঁচকে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করল, নিজের মাথাটা একটু খাটাতেই বুঝে গেল তার মাও চাই এই বিয়েটা হোক।
– দ্যাখ বাবা অতসী নিজে থেকে যখন সবকিছু জেনে তোকে বিয়ে করতে চাইছে। তখন আমার মনে হয় তোর রাজি হয়ে যাওয়া উচিত। আর এটা তো অস্বীকার করতে পারবি না, তোর মনে কোথাও না কোথাও অতসীর জন্য একটা জায়গা আছে।
আদৃত ভাবুক হয়ে পড়ল। কথাটা মিথ্যা নয়, সত্যি অতসী কে প্রথম থেকেই ওর ভালো লাগত। আরুর প্রতি অতসীর কেয়ার,ভালোবাসা গুলোই আদৃতের মনে অতসীর জন্য জায়গা করে নিতে বাধ্য করেছিল।
– আমি শুধু নিজের কথাটা বললাম বাকিটা তোর সিদ্ধান্ত।
– আচ্ছা মা অনেক রাত হয়েছে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো আমি গেলাম।
আদৃত মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আদৃতের মা ওর যাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– কথাগুলো থেকে পালিয়ে যাচ্ছিস, কিন্তু সেটা কি আদৌ পারবি?
সত্যি আদৃত কথাগুলো থেকে পালিয়ে যেতে চাইলেও পারল না। মাথাতে ঘুরপাক খেতেই লাগল, কি করবে না করবে সবকিছুর চিন্তাতে ঘুম আসছে না। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে, হঠাৎ করেই মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা ধরা দিলো। আদৃত নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে দোটানায় ভুগতে ভুগতে কি যেন মনে করে অতসী কে কল লাগিয়ে দিয়ে ফোনটা নিজের কানে চেপে ধরল।
ফোনটা কিছুক্ষণ বাজার পর অতসী ঘুম ঘুম গলাতে কথা বলে উঠল,
– হ্যালো কে?
– আমি।
চেনা কন্ঠস্বর শুনে অতসীর ঘুম পালিয়ে গেল। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল, আরুর বাবা নামে সেভ করা ব্যক্তি ফোন করেছে। অতসীর বুঝতে অসুবিধা হলো না ব্যক্তিটি কে। বোঝার সুবিধার্থে আদৃতের নামটা আরুর বাবা বলে সেভ করেছিল, সেটা আর পরির্বতন করা হয়ে উঠে নি।
– হ্যালো আছো?
ওপাশ থেকে আবারো আদৃত কথা বলে উঠতে অতসী নড়েচড়ে বসে বলল,
– হ্যাঁ বলুন। এত রাতে কল করলেন সব ঠিক আছে তো।
– সব ঠিক আছে কিন্তু আমি ঠিক নেই।
– মানে?
– সন্ধ্যায় ফিরে আসার পর থেকে নিজের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছি, কখনো মনে হচ্ছে হ্যাঁ আবার কখনো মনে হচ্ছে না।
সহজ ভাবেই নিজের মনের কথাগুলো স্বীকার করে নিলো আদৃত। অতসী মৃদু হেসে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। এই বাড়িটা খুব সুন্দর, হয়তো ভাড়া দেবার জন্যই এতটা সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। প্রথম ৩মাস এই বাড়িতে অতসী বিনা ভাড়াতে থাকত তারপর থেকে প্রতিমাসেই ভাড়া দিয়ে দেয়, আগের তিন মাসের ভাড়াও দিয়ে দিয়েছে। বাড়িওয়ালা কাকাবাবু অতসীর থেকে ভাড়া নিতে চাইনি, আর নিলেও অর্ধেক ভাড়া দিতে বলেছিল। আর্থিক সংকটের কারণে অতসী ১বছর পর্যন্ত অর্ধেক ভাড়াই দিয়েছিল কিন্তু গত ১ বছর ধরে বাড়ির ভাড়ার তুলনায় কিছুটা বেশিই টাকা দেয়। ওই মানুষটার প্রতি অতসী কৃতজ্ঞ। বর্তমানে এই শহরে একটা বাড়ি ভাড়া কত সেটা ভালো করেই জানে অতসী। আর এই বাড়িতে সবকিছুই আছে, তাই ন্যায ভাড়াটাই দেয়।
অতসী দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
– যাকে এতরাতে কল করতে দ্বিধাবোধ করেন না, তাকে বিয়ে করতে এত দ্বিধা!
আদৃত থমকে গেল। কি বলবে কিছু বুঝতে পারল না।
– কি হলো চুপ করে গেলেন কেন?
– কিছু না।
কিছুক্ষন দুজনে নিশ্চুপ। অতসী নিরবতা ভেঙে বলল,
– সারারাত কি এইভাবেই চুপচাপ ফোন করে বসে থাকবেন নাকি?
– না। সরি বিরক্ত করার জন্য রাখছি।
– একদম না।
– কি?
– কল করেছেন আপনি তাই কল কাটবেন আমার ইচ্ছাতে।
– আচ্ছা।
আবারো কিছুক্ষণ চুপচাপ। অতসী আবারো নিরবতা ভেঙে বলল,
– আরে চুপ করে আছেন কেন? কথা বলুন।
– কি বলব।
– প্রেম করুন। এমন রসকষহীন মানুষকে দিদিভাই কিভাবে বিয়ে করল কে জানে।
কথাটা বলে অতসী চুপ করে গেল। আদৃতও থমকে গেছে, অতসীর কথাটা শুনে। অতসী ভীষন অস্বস্তিতে পড়ে গেছে, উশখুশ করতে করতে বলল,
– রাখছি আমার ঘুম পাচ্ছে।
উত্তরের আশা না করেই অতসী খট করে কলটা কেটে দিলো। আদৃত বুঝল অতসী হঠাৎ করেই কথাটা বলে অস্বত্বিতে পড়ে গেছে, আদৃতও বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
অন্যদিকে..
জিনিয়া মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে আছে। এখনো পর্যন্ত মিহানের সাথে জিনিয়ার সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি। জিনিয়া মানিয়ে নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আর ভালো লাগছে না কোনো কিছু।
– কি হলো এইভাবে শুয়ে আছো কেন?
– আমি আর পারছি না। এইরকম একটা সম্পর্কের থেকে বিয়ে না হওয়াটাই বেটার ছিল।
জিনিয়া অভিমানী কন্ঠে কথাগুলো বলল। মিহান চুপ করে আছে, জিনিয়ার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলা উচিত সেটা বুঝতে পারছে না।
মিহানের মা ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক পায়চারি করে চলেছেন। স্ত্রীকে অস্থির হতে দেখে মিহানের বাবা বললেন,
– কি হলো এইভাবে পায়চারি করছ কেন?
– সবকিছু হিসাব গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে।
– কিসের হিসাব।
– আরে যেটার জন্য জিনিয়ার সাথে মিহানের বিয়ে দিলাম সেই হিসাব।
কথাটা বলেই মিহানের মা জিভ কাটলেন। মিহানের বাবা কথাটার মানে বুঝতে না পেরে বললেন,
– মানে?
#চলবে…