#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৪
আসরের আজানের পরপরেই ইশান বাড়িতে এসে পৌঁছায় হাতে দুটো শপিং ব্যাগ নিয়ে। কিন্তু পাঁচ মিনিট যাবত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ এসে দরজা খুলছে না। রেগে গিয়ে আবার যখন কলিং বেল চাপতে যাবে ওমনি দরজাটা খুলে দেয় রেহালা খালা। ইশান রেহালা খালাকে দেখে বলে।
–এত দেরি হলো কেন দরজা খুলতে? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি!
–আসলে ছোট ভাই জান আমি ঘরে শুয়ে ছিলাম আর আমি ভেবেছিলাম ইশা আপায় দরজাটা খুলে দিবে তাই একটু দেরি হয়ে গেলো।
ইশান ড্রয়িং রুমে তাকিয়ে দেখে ইশা সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে টিভি দেখছে মনের শান্তিতে আর চানাচুর খাচ্ছে। মানে এই মেয়ে এতক্ষণ এখানে বসে ছিলো আর কলিং বেলের আওয়াজ শুনেও দরজা খুললো না। ইশান রেহালা খালাকে কিছু না বলে সোজা টিভির কাছে গিয়ে দেখে “সানাম তেরি কসম” মুভিটা চলছে টিভির পর্দায়। যেই মুভিটা ইশা কতবার যে দেখেছে তার কোনো হিসাব নেই। আর দেখে কি আহাজারি নায়িকাকে কেন মারলো ডিরেক্টর এভাবে না মারলেও পারতো এসব বলে একা একা বিড়বিড় করবে আর পরিবারের সকল সদস্যকে জ্বালাবে বিশেষ করে রেহালা খালাকে। ইশান রেগে গিয়ে দিলো টিভি বন্ধ করে। আচমকা এমন হওয়াতে ইশা হতভম্ব হয়ে যায় রেগে গিয়ে ভাইকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইশান বলে উঠে।
–একদম চুপ। একটাও কথা নয় এতক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছিলাম আর তুই এখানে বসে থেকেও দরজা খুলছিলি না কেন হুম?
–উফফ ভাইয়া সরো তো। মুভিটার একটা ইম্পর্টেন্ট পার্ট আসলো আর তখনেই তুমি দিলে টিভিটা বন্ধ করে। নায়িকা এখন মারা যাবে আর তুমি… দেখি সরো।
ইশা টিভিটা আবার ওন করতে নিলে ইশান বলে।
–একদম টিভি ছাড়বি না আর বলে দিলাম।
–তাহলে কি করবো আমি?
–কি করবি মানে পড়তে বসবি আর কয়েকদিন পরেই তো বোর্ড পরীক্ষা তার জন্য তো তোর মাথায় দেখি কোনো চিন্তাই নেই।
–ভাইয়া শুনো একদম পরীক্ষার কথা মনে করিয়ে দিবে না এমনি টেনশন কমানোর জন্য টিভি দেখতে বসেছিলাম কিন্তু তুমি দিলে আরও টেনশন বাড়িয়ে।
–পরীক্ষার টেনশন কমাতে চাইলে টিভি না দেখে পড়তে বস গিয়ে।
–এতো জ্ঞান দিও না তো তুমি। অফিস থেকে এসেছো ফ্রেশ হও গিয়ে তোমার গা থেকে ঘামের দু’র্গন্ধ আসছে।
নাক মুখ ছিটকে কথাটা বলে ইশা।
–একটা চড় দিবো বেয়াদব মেয়ে বড়ো ভাইয়ের মুখে মুখে তর্ক করিস।
–উফফ ভাইয়া যাও তো তুমি।
বলেই টিভিটা অন করে দেয়। অন্য দিকে ইশান চলে যেতে নিলে আবারও ফিরে আসে বোনের কাছে। ভাইকে আবার আসতে দেখে ইশা বলে।
–আবার কি হলো?
ইশান কিছু না বলে শপিং ব্যাগ দুটো বোনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে।
–নীল ব্যাগটা তোর আর হলুদ ব্যাগটা… মানে হলুদ ব্যাগটা তীরের।
ইশা বিস্মিত নয়নে ভাইয়ের দিকে তাকায় এটা ভেবে তার ভাই হঠাৎ করে তার জন্য আর তীরের জন্য শপিং করতে গেলো কোন দুঃখে? ইশার এমন চাহনি দেখে ইশান শ’ক্ত কন্ঠে বলে উঠে।
–কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
–না মানে হঠাৎ এসব কেন?
–ঠিক আছে তোর লাগবে না তো।
বলেই ইশান চলে যেতে নিলে ইশা তাড়াতাড়ি করে ভাইয়ের কাছ থেকে শপিং ব্যাগগুলো কেঁ’ড়ে নিয়ে বলে।
–লাগবে না কে বললো! লাগবে তো তুমি একটু বেশি বুঝো।
–ঠিক আছে তীরকে তীরের ব্যাগটা দিয়ে দিস।
ইশা ব্যাগ দুটো চেক করে দেখে দুটো ব্যাগের ভেতরেই লাল রেপিং পেপার দিয়ে একটা করে বক্স মুড়ানো। এটা দেখে ভাইকে প্রশ্ন করে।
–কি আছে এতে ভাইয়া।
–নিজেরাই খুলে দেখে নিস।
বলেই দ্রুত কদমে চলে যায় ইশান। ইশা আর কোনো কিছু চিন্তা না করে টিভির পাওয়ার অফ করে দৌঁড় লাগায় তীরদের বাড়ির উদ্দেশ্য। তীরদের বাড়ির সদর দরজা খুলাই ছিলো তাই সোজা কাউকে কিছু না বলেই সিঁড়ি বেয়ে তীরের রুমে চলে যায়।
ড্রয়িং রুমে তীরের বাবা বসে ছিলেন ক্লান্ত শরীরের নিয়ে মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছেন। ইশাকে এমন ঝড়ের বেগে দৌঁড়ে যেতে দেখে ওনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। এমন সময় আয়েশা সুলতানা পানির গ্লাস নিয়ে এসে স্বামীর সামনে এসে দাঁড়ায়। স্বামীর এমন চেহারা দেখে বলেন।
–কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
–একটু আগে ইশা গেলো। মানে এমন ভাবে গেলো ঝড়ের বেগে যা বলার বাহিরে।
–ও এই ব্যাপার এই মেয়ে তো হাওয়ার সাথে চলে নিশ্চয়ই তোমার মেয়ের সাথে দেখা করতে এসেছে। তাই এতো চিন্তা করো না তো তুমি পানি খেয়ে ফ্রেশ হও গিয়ে।
______
ইশা তীরের রুমে এসে দেখে তীর মনের শান্তিতে ঘুমাচ্ছে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে। ইশা কিছু না বলেই বেডের পাশে এসে নিজের পা দিয়ে তীরের পিঠে গু’তো মারতে মারতে বলে।
–এই উঠ কুম্ভকর্ণ। আর কতো ঘুমাবি এবার উঠে দেখে পৃথিবীটা কতো রঙিন।
তীরের ঘুম উবে গেছে ইশার গু’তো খেতে খেতে। তারপরও দু’চোখের পাতা বন্ধ রাখা অবস্থায় ইশার পা’টা সরাতে সরাতে বলে।
–উফফ ইশু যা তো এখান থেকে আমাকে একটু ঘুমাতে দে। সকালেও তুই এসে আমার ঘুমের বারোটা বাজালি আর এখন আবারও চলে আসলি ঘুমের বারোটা বাজাতে। তোর কি অন্য কোনো কাজ নেই আমার ঘুম নষ্ট করা ছাড়া।
–এতো ভাব না ধরে উঠ। তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
–তোর সারপ্রাইজ তোর কাছে রাখ। আর তুই যখন খুশি তখন আমাদের বাড়িতে চলে আসিস কেন রে? তোর কি নিজের বাড়ি টাড়ি নিয়ে নাকি।
–না নেই। এবার উঠ উঠে দেখ তোর জন্য ভাইয়া কি এনেছে?
তীর ভ্র কুচকে বলে।
–কোন ভাইয়া?
–আরে ইশান ভাইয়া।
ইশানের নামটা শুনার সাথে সাথে তীর তড়িৎ বেগে শুয়া থেকে উঠে বসে। এলোমেলো চুল গুলা ঠিক করতে করতে বলে।
–কার নাম বললি?
–আরে ইশান ভাইয়া। তোর ভবিষ্যৎ সোয়ামী।
তীর ইশার মুখে সোয়ামী কথাটা শুনে লজ্জা পেলো। তীরের লজ্জা রাঙা মুখটা দেখে ইশা তীরের চিবুক ধরে বলে।
–ওলে বাবালে মেয়ে তো লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। ভাইয়া যদি তোর এই লজ্জা রাঙা মুখটা দেখতো নিশ্চিত হার্ট অ্যা’টাক করতো ভাইয়া।
–ধ্যা’ত! তুই না একটু বেশি বেশি বকছিস।
–আচ্ছা বাদ দে। এবার দেখ ভাইয়া তোর জন্য কি এনেছে?
তীর উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে।
–কই দেখি কি এনেছেন ওনি আমার জন্য।
তীর রে’পিং করা বক্সটা তাড়াতাড়ি খুলে দেখে এর ভেতরের দুটো বক্স। একটা বক্স নতুন ফোনের আরেকটা খুললে বুঝা যাবে কি আছে এর ভেতরে। ইশা এসব দেখে বলে।
–কিরে ভাইয়াকে না বলতে বলতে ভাইয়া তোকে ফোন গিফট করে দিলো। দেখলি তো আমার ভাইয়াটা কত্তো ভালো।
তীর মুচকি হেসে অন্য বক্সটা খুলে দেখে এর ভেতরে তিনটা গোলাপ ফুলের গাজরা আরেকটা চিরকুট। তীর চিরকুট’টা নিতে যাবে ওমনি ইশা নিয়ে বলে।
–প্রেমপত্র! ভাইয়া তোকে প্রেমপত্র দিয়েছে রে তীর। এটা তো আমাকে পড়তেই হবে। দেখি আমার ভাইয়া কেমন প্রেমপত্র লিখতে পারে।
তীর অস্থির কন্ঠে বলে।
–প্লিজ ইশু চিরকুট’টা আমাকে দিয়ে দে না। এমন করছিস কেন?
–না না একদম না আগে আমি পড়বো তারপর তুই।
তীর আর কিছু না বলে গোমড়া মুখ করে অন্য দিকে ফিরে যায়। ইশা তীরের গোমড়া মুখ দেখে বলে।
–আচ্ছা বাবা আমি পড়ছি না। তদের পার্সোনাল বিষয়ে আমি নাক গলাচ্ছি না। নে ধর তুই পড় চিঠিটা আমি বরং আমার বক্সটা খুলে দেখি ভাইয়া আমার জন্য কি এনেছে।
ইশা রে’পিং পেপারটা ছাড়িয়ে দেখে পাওয়ার ব্যাংক যেটা ইশা কয়েকদিন যাবত ধরে চেয়ে এসেছে দুই ভাইয়ের কাছে কিন্তু পাত্তাই দিচ্ছিলো না কেউ। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে ইশা তো ভীষণ খুশি।
অন্য দিকে তীর চিরকুটটা হাতে নেয়। হার্টবিট’টা অ’স্বাভা’বিক ভাবে লাফাচ্ছে। এই প্রথম কারোর কাছ থেকে তীর প্রেমপ্রত্র পেয়েছে তাও আবার মিস্টার ইশান ফরাজীর থেকে। তবে তীরের মনে সন্দেহ কাজ করছে এটা কি অতোও প্রেমপত্র নাকি হু’ম’কি পত্র। মিস্টার ইশান ফরাজী যে প্রেমপত্র লিখবে কোনো মেয়েকে এটা যেন তীরের বিশ্বাস হচ্ছে না। তীর ঠোঁট দুটো গোল করে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে চিরকুট’টা পড়তে শুরু করে।
“আগেই সরি বলে নিচ্ছে গতকাল রাত্রে এমনটা করার জন্য। রাগের মাথায় তোর ফোনটা ভা’ঙ্গাটা আমার একদম উচিত হয় নি। ভেবেছিলাম তোকে অন্য কোনো মডেলের দামি একটা সেল ফোন কিনে দিবো। কিন্তু পরক্ষণে মনে পড়লো তোর হাতে যদি অন্য মডেলের ফোন দেখে তোর পরিবার তাহলে তোকে হয়তো সন্দেহ করবে। তাই তোর আগের ফোনের যে মডেলটা ছিলো সেই মডেলেরেই ফোন কিনে দিলাম সেইম টু সেইম। যখন আমার কাছে সারা জীবনের জন্য আসবি তখন না হয় তোকে আমার পছন্দে দামি একটা ফোন কিনে দিবো। ফোনে সবকিছু আমি সেট করে দিয়েছি তোর সুবিধার্থে যাতে তোর কোনো প্রবলেম না হয়। আর গোলাপ ফুলের গাজরা গুলা কিনার কোনো প্ল্যান ছিলো না। যখন ফোনটা কিনে দোকান থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠতে যাবো তখনেই পাশে দেখি ফুলের দোকান। তাই ভাবলাম তোর জন্য কিনে আনি। ভেবেছিলাম নিজের হাতে তোকে তোর হাতে গাজরাটা পরিয়ে দিবো কিন্তু মনে হয় না সেটা এখন পসিবল। তবে ইনশাল্লাহ একদিন আমার সকল মনের ইচ্ছে পূরণ করবো তোকে নিয়ে”।
তীর চিঠিটা পড়ে বুকের মাঝে চেঁপে ধরে। মুখে তার মিঠি মিঠি হাঁসি। ইশানের মতো একজন সুদর্শন আর পারফেক্ট একজন মানুষ যে তার মতো একটা আগোছালো মেয়েকে ভালোবাসবে সেটা কোনো দিন কল্পনাও করতে পারে নি।
তবে সেই ভালোবাসাটা কি চিরদিন স্থায়ী থাকবে নাকি অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে। ভবিষতে কি হতে চলছে কেউ হয়তো জানেই না। ভাগ্য তাদের যেখানে নিয়ে যাবে তারা সেখানে যেতে বাধ্য থাকবে। তবে কি ভালোবাসা হেরে যাবে নিষ্ঠুর ভাগ্যের কাছে।
#চলবে_____
#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৫
দিনটা একুশে মার্চ। দিন পেরিয়ে রাতের আধারের ডুবে গেছে খোঁটা পৃথিবী। ঘড়ির কাঁটায় বাজে রাত সাড়ে এগারোটা। আর আধ ঘন্টা পরেই ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘরে পোঁছালেই তীরের আটারো তম জন্মদিন। প্রত্যেকবারে তীর নিজের জন্মদিনটা নিয়ে ভীষণ এক্সাইটেড থাকে কিন্তু এবারের জন্মদিনে ওর মাঝে কোনো প্রকার এক্সাইটমেন্টই কাজ করছে না। তার এক মাত্র কারণটা হলো ইশান। ইশান প্রায় তিন দিন ধরে তীরকে ইগনোর করছে। কেন ইগনোর করছে কারণটা তার অজানা। তীরের জানা মতে এমন কোনো কাজ করে নি যাতে করে ইশান ওকে ইগনোর করতে পারে। যতো বারেই তীর ইশানের সামনে পড়েছে তত বারেই ইশান ইগনোর করেছে। এই ইগনোরটা যেন তীর মেনে নিতে পারছে না কোনো ভাবেই।
কিন্তু তারপরও তীর সকল অভিমান ভুলে অধীর আগ্রহে বসে আছে ইশানের কাছ বার্থডে উইশ শোনার জন্য। তীরের কাছে ওর এই আটারো তম জন্মদিনটা একটু স্পেশাল তার কারণ ইশানের সাথে প্রনয়ের সম্পর্ক হওয়ার পর এটা তার প্রথম জন্মদিন আর ইশান সেটা খুব ভালো করেই জানে মার্চের বাইশ তারিখে তীরের জন্মদিন। কারণ আজকে যত বারেই তীর ইশানের সামনে পড়েছে তত বারেই তীর আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে যে ওর জন্মদিন। তীর ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে জন্মদিনের প্রথম শুভেচ্ছাটা শুনতে চায়। এটাই একমাএ প্রত্যাশা ইশানের কাছে ওর। এখন দেখা যাক মিস্টার ইশান ফরাজী তার প্রেয়সীর মনের ইচ্ছেটা পূরণ করে কি না!
তীর পড়ার টেবিলে বসে বার বার ফোন চেক করছে ক’টা বাজে দেখার জন্য। ঘড়ির কাঁটা যেন আজ তীরের সাথে বেই’মানি’টা একটু বেশিই করছে ঘড়ির কাঁটা নড়ছেই না এক জায়াগাতেই স্থির হয়ে বসে আছে। তীরের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হচ্ছে না। তীর রেগে গিয়ে এবার ফোনটা উপুর করে রেখে দেয়। পড়ায় মনোযোগ দিতে পড়ছে না টেনশনে। হাতে রাখা কলমটা টেবিলের রেখে দিয়ে ফোনটা নিতে চাইলে বলে উঠে।
–নাহ আর চেক করবো না। ওনি ফোন দিলে দিবে, না দিলে না দিবে তাতে আমার কি?
মুখে এক কথা বলেছে ঠিকেই কিন্তু মন বলছে অন্য কথা। তীর মনেপ্রাণে চায় ইশান যেন তাকে ফোন দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। তীর যখনেই কলমটা নিয়ে আবার লেখা শুরু করবে ওমনি ফোনের রিং টোন বেজে উঠে। তীর ঝ’ড়ে’র বেগে ফোনটা তুলে দেখে ফোনের স্ক্রিনে ইশার নামটা জ্বল জ্বল করছে। তীর হাতাশ হয়ে ফোনটা পিক করতেই ইশা ওপাশ থেকে বলে।
–হ্যালো বার্থডেগার্ল! কি অবস্থা আপনার?
তীর মিনমিনিয়ে বলে।
–ভালো।
–তা ভাইয়া ফোন করে উইশ করেছে তোকে!
–নাহ।
–এখনো করে নি। আচ্ছা সমস্যা নেই বারোটা বাজতে আরো দশ মিনিটি’স বাকি আছে। আমি বরং এখন রাখি পরে যদি তোকে ভাইয়া ফোনে না পায়।
ইশা ফোন কেটে দেয়। তীর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় সাত মিনিট কম বারোটা বাজে। সময় চলে যায় কিন্তু ইশান আর কল দিলো না তীরকে। ঘড়ির কাঁটায় এখন বাজে আপাতত বারোটা পাঁচ। তীরের কিশোরী ছোট্ট নরম হৃদয়ের মনটা নিমিষেই কা’লো মেঘে ঘিরে গেছে। বুক ফেঁটে কান্না আসছে। ইশানের কাছ থেকে সে তো এমন কিচ্ছু চায় নি জাস্ট বারোটার সময় জন্মদিনের শুভেচ্ছা টুকু শুনতে চেয়েছিলো। ইশান সেই ইচ্ছেটাও পূরণ করলো না এত্ত নি’ষ্ঠু’র লোকটা। তীরের কি কোনো মূল্য নেই লোকটা কাছে। যদি মূল্য থাকতো তাহলে হয়তো এভাবে ক’ষ্ট দিতো না তাকে।
ঠোঁট ভে’ঙ্গে কা’ন্না আসছে তীরের। তারপরও তীর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। কিন্তু না চাওয়া শর্তেও চোখে নোনা জলে ভরে গেছে। চোখের পলক ফেললেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। জোরে জোরে কয়েক বার শ্বাস ফেলে হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা চোখের জল মুজতে মুজতে বলে।
–দরকার নেই আপনার উইশ আমার। কোনো দরকার নাই…
তীরের কথার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠে। তীর ঝপসা চোখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে ইশা ফোন করছে। ধরবে না তীর কারো ফোন ধরবে না আজকে আর। রিং হতে হতে কেটে গেল কল। পুনরায় ইশা কল করে কিন্তু আগের বারের মতোই এবারও কল ধরলো না তীর। কিন্তু তারপরও ইশা লাগাতার কল দিয়েই যাচ্ছে। এবার আর তীর কল না ধরে থাকতে পারলো না চোখের পানি মুজে নিজেকে সামলে কল ধরতেই ইশা অ’স্থি’র কন্ঠে বলে।
–কি হলোটা কি তোর? ফোন ধরছিলি না কেন?
তীর ফোনটা কানের কাছ থেকে দুরে সরিয়ে ঠোঁট দুটো গোল করে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে।
–আরে ওয়াসরুমে গিয়েছিলাম। তাই ধরতে লেইট হয়েছে আর তাতেই তোর ধৈর্যের বাদ ভেঙ্গে গেলো।
–একদম মিথ্যে কথা বলবি না তীর। তুই এতোক্ষন ফোনের কাছেই ছিলি আমি জানি।
–হুম তুই তোর একটা চোখ আমার রুমে রেখে গেছিস তাই সবকিছু দেখতে পারছিস আমি কি করছি না করছি।
ইশা কোমল কন্ঠে বলে।
–তুই কি কা’ন্না করেছিস তীর?
থমকে যায় তীর। মেয়েটা এত চালাক যে কিছু হলেই ধরে ফেলে। তীর ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে।
–কি সব উল্টা পাল্টা বকছিস তুই। আমি কোন দুঃখে কান্না করতে যাবো আজব।
ইশা তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলে।
–তোর কন্ঠ শুনেই বুঝা যাচ্ছে।
তীর চুপ করে যায়। কি বলবে সে ইশাকে সত্যিই তো সে না চাইতেও কান্না করেছে। তীরকে নিরব থাকতে দেখে ইশা আবারও বলে।
–বার্থডে গার্লদের কান্না করা মানায় না। তারা এসময় হাসিখুশি থাকে।
তীর অস্পষ্ট স্বরে বলে।
–হুম।
–আমি জানি কেন তোর মন খারাপ! ভাইয়া নিশ্চয়ই তোকে ফোন দেয় নি। এর জন্য মন খারাপ করিস না প্লিজ। ভাইয়া মনে হয় কাজের চাপে ভুলে গেছে তোর জন্মদিনের কথা।
তীর মনে মনে আওড়ায়।
–সত্যিই ভুলে গেছে ওনি আমার জন্মদিনের কথা। রাত বারোটার সময় কি এমন এতো কাজের চাপ থাকে যে নিজের ভালোবাসার মানুষটার জন্মদিনের কথাটাও ভুলে যায়।
অন্যদিকে ইশা তীরকে চুপ থাকতে দেখে বলে।
–কি রে কথা বলছিস না?
–কিছু নারে! এখন রাখি রাত হয়েছে অনেক ঘুম পাচ্ছে আমার।
ইশাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টাস করে কলটা কে’টে দেয়। ইশা অবাক নয়নে ফোনটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় আর সোজা ঘর থেকে বের হয়ে চলে যায় ইশানের রুমে সামনে। ইশান এখনও সজাগ ঘরের লাইট জ্বলছে। ইশা ভাইয়ের দরজা নক করতেই ইশান ভেতরে থেকে বলে।
–কে?
–ভাইয়া আমি!
–হুম আয়।
ইশা ঘরের ভেতরে ডুকতেই ইশান ল্যাপটপে কাজ করতে করতে বলে।
–কিছু বলবি?
–ভাইয়া এটা কিন্তু একদম তুমি ঠিক করছো না।
ইশান ভ্রু-কুচকে বোনের দিকে তাকিয়ে বলে।
–কোনটা?
–তীরকে এভাবে কষ্ট দেওয়াটা।
ইশান বোনের দিক থেকে নজর ফিরিয়ে ল্যাপটপে নজর নিবদ্ধ করে বলে।
–কেন? ও কেন কষ্ট পাচ্ছে?
–তুমি জানো না বুঝি ওর যে আজকে জন্মদিন। ও তো তোমার কাছ থেকে দামি কিচ্ছু চায় নি শুধু জন্মদিনের শুভেচ্ছা টুকু শুনতে চেয়েছে আর তুমি সেই আশাটাই পূরণ করলে না ওর।
–বলা শেষ।
ইশানের কথা শুনে ইশা হতভম্ব হয়ে বলে।
–মানে?
–বলছি তোর কি বলা শেষ হয়েছে নাকি আরো কিছু বলবি।
ইশা নাকের পাটা ফুলিয়ে নিচের ঠোঁট কাঁমড়ে ধরে। রাগে মাথার দু সাইডের রগ গুলা যেন ফেটে যাচ্ছে। তার বলা কথাগুলার কোনো মুল্যই দিলো না ইশান। ইশাকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে ইশান বলে।
–কি হলো এমন স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
–নাহ আমার আর কিছু বলার নেই।
–ওকে তাহলে তুই যা এখন আমার অনেক কাজ বাকি আছে।
ইশা এবার রেগেই বলে উঠে।
–শুধু কাজ আর কাজ, থাকো তুমি তোমার কাজ নিয়ে পড়ে। কিন্তু আমার বেস্টুর যদি কিছু হয় তোমার জন্য ভাইয়া তাহলে তোমার খবর আছে এই আমি বলে দিলাম তোমাকে।
ইশা রাগের বশে ঘর থেকে প্রস্থান নেওয়ার সময় দরজাটা এমন ভাবে বিকট এক শব্দ করে যার কারণে ইশান ভ’য়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। বোন যে ক্ষে’পে গেছে তা আর বুঝতে বাকি নেই। নারী জাতি একবার রা’গ আর অভিমান করলে সেটা যে কি পরিমাণ ভ’য়ংক’র আকারে রুপ ধারণ করে সেটা বলে বুঝানো যাবে না। নারী জাতি বরই র’হ’স্য’ম’য় এক জাতি। তাদের মনে যে কি চলে একমাএ উপরওয়ালা আর সে নিজে জানে।
ইশান ঘরের দরজাটা লক করে সোজা বেলকনিতে চলে যায়। বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েই প্রথমেই তাকায় তীরের বেলকনির দিকে। বেলকনিতে লাইট জ্বললেও তীরের ঘর অন্ধকার। ইশান দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছেড়ে তারা ভর্তি খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে।
–সরি জান! তোকে এভাবে আঘাত দেওয়ার জন্য। খুব বেশি আঘাত দিয়ে ফেলেছি কি তোকে আমি? কথায় আছে যে ভালোবাসতে পারে সে নাকি আঘাত দিতেও পারে। একটু দূরত্ব বাড়িয়ে দেখলাম তোরে মনে কি আসলেই আমার জন্য জায়গা আছে নাকি এটা শুধুই মোহ। কিন্তু এখন যেটা বুঝতে পারলাম তুই তো দেখি আমার থেকেও বড় পাগল। যাই হোক যেই আঘাত গুলা দিয়েছি সেই আঘাত গুলা না হয় আজকেই তোর মন থেকে নির্মূল করে দিবো ইনশাল্লাহ।
বলেই চোখ বন্ধ করে প্রেয়সীর মিষ্টি মুখখানা চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলে।
________
সকালে তীর ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতেই পরিবারের সকল সদস্যরা হ্যাপি বার্থডে বলে চিৎকার করে উঠে। হঠাৎ এমনটা হওয়াতে তীর অবাক হয়ে যায়। তার পরিবারের লোকজন তাকে একেকবার একেক ভাবে সারপ্রাইজ দেয়। আজিজুল আহমেদ মেয়ের কাছে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে।
–কি হয়েছে মা? মুখটা এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন এমন একটা দিনে?
তীর মলিন হাসি দিয়ে বলে।
–তেমন কিছু হয় নি বাবা। আসলে আর ক’দিন পরে এক্সাম তো তাই একটু চিন্তিত।
–এতো চিন্তা করার কিচ্ছু হয় নি আমার মায়ের পরীক্ষা খুব ভালো হবে।
–তোমাদের সকলের দোয়া মাথায় থাকলে ইনশাল্লাহ ভালো হবে।
–হুমম। এবার যাও দাদুকে গিয়ে সালাম করো।
তীর দাদুর কাছে গিয়ে সালাম করতে নিলেই বলে।
–সালাম করতে হবে না আমাকে দাদু আমার দোয়া সবসময় তোমার উপরে আছে।
এমন সময় ছোট অভি বোনের সামনে এসে একটা ক্যাডবেরি চকলেট এগিয়ে দিয়ে বলে।
–আপু এটা তোমার জন্মদিনের গিফট। আমি তো চাকরি করি না তাই বাবার টাকা দিয়েই তোমাকে গিফট দিলাম। যখন আমি চাকরি করে এত্ত টাকা কামাবো তখন তোমাকে আমি অনেক কিছু গিফট করবো তোমাকে।
তীর ভাইয়ের কথা শুন মুচকি হেসে হাঁটু গেড়ে বসে ভাইয়ের সরু নাকটা টেনে বলে।
–থাঙ্কু আমার ভাইয়া। আর আমি তোর চাকরি পাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম তখন কিন্তু অনেক গিফট কিনে দিতে হবে আমাকে।
–হে দেবো তো।
তীর ভাইয়ের কথা শুনে ভাইয়ের মাথা ভর্তি চুল হাত বুলিয়ে দেয়। অভি আবারও বলে।
–আপু জানো আম্মু তোমার জন্য তোমার প্রিয় খাবার পায়েস রান্না করেছে। চলো খাবে চলো।
এর মাঝে আয়েশা সুলতানা বলে।
–ওখানে বসো সবাই আমি আনছি সবার জন্য পায়েস।
পায়েসের বাটি সেন্টার টেবিলের উপর রাখতে সবাই একএক করে পায়েসের বাটি তুলে নেয়। আয়েশা সুলতানা আগ্রহ নিয়ে সকলকে প্রশ্ন করে।
–কেমন হয়েছে?
তীর ধীর কন্ঠে বলে।
–ওই প্রতিবার যেমন হয়।
মেয়ের কথা শুনে আয়েশা সুলতানা মুখটা কা’লো করে বলে।
–এবারও
–সমস্যা নেই মা তোমার তো এই একটাই সমস্যা বেশি মিষ্টি দিয়ে ফেলো পায়েসে কিন্তু এছাড়া খুব মজা হয়েছে খেতে।
আয়েশা সুলতানা হাতাশ কন্ঠে বলে।
—আর মজা বেশি মিষ্টি হয়ে গেলে আর খাওয়া যায় নাকি।
#চলবে_______
#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৬
তীর বেলকনির ঝুলন্ত দোলনায় বসে আছে মনমরা হয়ে। দৃষ্টি তার টবে ফুটে থাকা ফুটন্ত সাদা গোলাপের দিকে। এই সাদা রংয়ের গোলাপের কলি যেদিন থেকে এসেছে সেদিন থেকে এক্সাইটেড হয়ে আছে কবে তার বেলকনির ছোট্ট বাগানটায় এই সাদা গোলাপ ফুলটা ফুটবে। আজকে সেই দিনটা এসেছে কিন্তু মনে এক ফোঁটাও আনন্দ নেই। বার বার দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস বের হয়ে আসছে বুক ছিঁড়ে আর ক্ষণে ক্ষণে চোখ বন্ধ করে নিচ্ছে।
এর মাঝেই ইশা কখন যে এসে তীরের পাশে এসে দাঁড়ায় সেটা টেরেই পায় নি। তীরকে এমনভাবে মনমরা হয়ে থাকতে দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ইশার। মন চাইছে রেগে গিয়ে ভাইয়ের মাথা ফাঁটিয়ে ফেলতে। যত্তসব। ইশা তীরকে ডাক দেয়। তীর চমকে পাশ ফিরে ইশাকে দেখে বলে।
–তুই! তুই কখন এলি?
–অনেক্ষণ হয়েছে এসেছি কিন্তু আপনি এতক্ষণ আপনার ভাবনায় ব্যস্ত ছিলেন। তাই টের পান নি।
তীর আগের ন্যায় গোলাপ ফুলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে।
–সরি রে! বুঝতে পারি নি।
–ঠিক আছে সরি বলতে হবে না। এখন চল।
তীর ইশার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে বলে।
–কোথায় যাবো?
–এটা না হয় সারপ্রাইজ থাক।
তীর এতক্ষণ ইশাকে ভালো করে লক্ষ্য করে নি। কিন্তু এবার ইশার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বলে।
–তুই হঠাৎ এভাবে সাজু্গুজো করেছিস কেন?
–শুধু আমি না এখন তুইও সাজবি।
তীর ভ্রু-দ্বয় কিঞ্চিৎ কুচ করে বলে।
–মানে! আমি কোন দুঃখে সাজবো?
ইশা তীরের হাত ধরে টানতে টানতে বলে।
–কোন দুঃখে সাজবি নাকি কোন সুখে সাজবি সেটা পরে বুঝা যাবে। এবার উঠ তৈরি হতে হবে তোকে হাতে বেশি সময় নেই।
তীর ইশার কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বলে।
–আমি সাজতে টাজতে পারবো না। এমনেই মন মেজাজ ভালো নেই। তাই প্লিজ বিরক্ত করিস না তো।
ইশা হার মেনে নেয় তীরের জেদের কাছে। এই মেয়েকে এভাবে মানাতে পারবে না অন্যভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে। সেটা “ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল” একমাএ এটার মাধ্যমে তীরকে রাজি করানো যাবে না হলে কিচ্ছু হবে না। ইশা ঠোঁট দুটো গোল করে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ছোট বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে বলে।
–বুঝতে পেরেছি তোর কাছে আমার কথার কোনো ভেলুই নেই তাই তো।
তীর দোলনা থেকে সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বলে।
–তুই আমায় ভুল বুঝছিস ইশু এমনটা নয়।
–তাহলে কেমনটা শুনি একটু?
–দেখ অবুঝ হোস না। আমার মুড এমনেই ভালো নেই তাই এখন এসব সাজ…
তীরের কথার মাঝেই ইশা মন খারাপের ভাব ধরে বলে।
–বুঝতে পেরেছি তোকে আর এক্সপ্লেইন করতে হবে না আমাকে।
তীর ভেবে পাচ্ছে না কি করবে এখন? ইশার কথা না মানলে মেয়েটা হয়তো মন খারাপ করবে। কত্তো আশা নিয়ে সাজুগুজো করে এসেছে ওর কাছে সব কিছু তো ওর জন্যই। হয়তো কোনো সারপ্রাইজ দিয়ে তার মনটা ভালো করতে চায় মেয়েটা। কিন্তু! তীর মাথা দুলিয়ে চারপাশটায় নজর বুলিয়ে মুখ দিয়ে “চ” উচ্চারণ করে।
অন্য দিকে ইশা চোরা চোখে বান্ধবীর দিকে তাকায় আর মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়তে থাকে যেন তীর রাজি হয়ে যায়। তীর যদি রাজি হয়ে যায় তাহলে তো কেল্লাফাতে। ও যা চাইবে তাই পাবে উফফ। ইশা মনে মনে বিরক্ত নিয়ে বলে।
–উমমম! মনে হচ্ছে যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ করার প্লান করছে। আরে বাপ তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যা না। নাহ মনে হচ্ছে আরেকটু ড্রামা করতে হবে।
ইশা উচ্চস্বরে হতাশ কন্ঠে বলে।
–ঠিক আছে তাহলে আমি আসি এখন। আগেই তোর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমার রেডি হওয়া উচিত ছিলো। আসলে আমারেই ভুল ভেবেছিলাম আমার কথা তুই ফেলতে পারবি না কিন্তু না তুই আমাকে ভুল প্রমাণিত করে দিলে।
বলেই মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতে নিলে তীর বলে উঠে।
–দাঁড়া।
থেমে যায় ইশা। ইশা নিচের ঠোঁট কাঁমড়ে ধরে, প্ল্যান তাহলে সাকসেসফুল একদম মেইন পয়েন্টে ধনুকের তীরটা লেগেছে। ইশার মুখে কুটিল হাসি ফুটে উঠে কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে ইন্নোসেন্ট রুপে নিয়ে আসে। তীর ইশার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে।
–আর ভাব ধরতে হবে না তোর এই এইন্নোস্টেন মার্কা মুখটা ঠিক কর। আমি সাজবো খুশি এবার।
ইশা খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে।
–সত্যিই।
–কিন্তু কোন সাজবো? আর যাবো কোথায়?
–এটা সারপ্রাইজ থাকে। তুই বরং জলদি রেডি হো গিয়ে।
ইশা সোজা গিয়ে বেডে বসে পা দুটো দুলাতে থাকে মনের খুশিতে আর তীর আলমারি খুলে ড্রেস কোনটা পড়বে সেটা ভাবচ্ছে। তীরকে লক্ষ্য করে ইশা বলে।
–তীর সাদা গোলাপি রং মিশ্রিত কোটি সিস্টেম লং ড্রেসটা পড় এটাতে তোকে খুব সুন্দর লাগে।
তীর ড্রেসটা বের করে বলে।
–এটা পড়বো!
–হুম যাহ পড়ে আয় জলদি।
তীর সোজা ওয়াসরুমে চলে যায়। তীর ওয়াসরুমে চলে যাওয়ার সাথে সাথে ইশা কাউকে কল করে বলে।
–প্ল্যান সাকসেসফুল। একটু পরেই আমরা আসছি সব কিছু রেডি করে রাখো।
কথাটা বলেই ইশা কল কেটে দেয়। কিছুক্ষণ পর তীর ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে আসে। ইশা তীরের কাছে এসে বলে।
–চল আজকে আমি তোকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিবো।
তীর অবাক নয়নে ইশার দিকে তাকায়। এ মেয়েকে আজকে বরই অদ্ভুত লাগছে। কিছু তো একটা ঘপলা আছে এই মেয়ের মাঝে নিশ্চিত। তীরকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশা বলে।
–কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আচ্ছিস কেন?
তীর চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলে।
–কি খিচুড়ি পাকাচ্ছিস তুই?
ইশা মেকি হাসি দিয়ে বলে।
–কি যে বলিস না তুই! আমি আবার কি খিচুড়ি পাকাবো।
–আমি সিউর তোর মনে কিছু একটা চলছে।
–উফফ! এতো কথা না বলে চল তো রেডি হবি।
ইশা তীরকে ড্রেসিং টেবলের টুলে বসিয়ে দিয়ে নিজের মতো করে সাজাতে শুরু করে। তীরের সাজ কমপ্লিট করে তীরকে দাঁড় করিয়ে ইশা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বলে।
–উফ! তোকে যা লাগছে না আজকে ভাইয়া তো পুরা পাগলেই হয়ে যাবে তোকে দেখে।
ইশার এমন কথা শুনে তীরের ভ্রু-কুচকে আসে আর বলে।
–কি বললি? ভাইয়া পাগল হয়ে যাবে মানে।
ইশা শুকনো ঢোক গিলে মনে মনে বলে।
–এই সেড়েছে কি বলতে কি বলে ফেললাম। উফ ইশা কন্ট্রোল ইওর সেলফ।
ইশাকে নিরব থাকতে দেখে তীর ইশার বাহু ধরে বলে।
–কি হলো কথা বলচ্ছিস না কেন?
ইশা মুচকি হাসি দিয়ে বলে।
–না মানে আসলে ভাইয়া যদি তোকে দেখতো তাহলে হয়তো পাগল হয়ে যেত এটা বলচ্ছিলাম আর কি। কিন্তু ভাইয়া তোকে দেখবে কি করে ভাইয়া তো অফিসে।
–কিছু কি লুকাচ্ছিস আমার কাছ থেকে ইশু তুই।
ইশা তীরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে।
–কোনো কিচ্ছু লুকাচ্ছি না আমি তোর কাছ থেকে। তবে হে তোকে যে সারপ্রাইজটা দিবো সেটা লুকাচ্ছি।
–সারপ্রাইজটা কি?
–বোকা মেয়ে! সারপ্রাইজের কথা বলে দিলে কি আর সেটা সারপ্রাইজ থাকে। এটা আমার তরফ থেকে তোর বার্থডে সারপ্রাইজ বুঝলি। এবার চল তাড়াতাড়ি লেইট হয়ে যাচ্ছে।
প্রয়োজনীয় জিনিস গুলা ব্যাগ ভরে নিয়ে ওরা নিচে যায়। বাড়িতে শুধু তীরের মা আর দাদু আছে। তীরের ছোট ভাই স্কুলে আর বাবা অফিসে চলে গেছে। তীরকে আসতে দেখে আয়েশা সুলতানা মেয়েরে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে।
–মাশআল্লাহ! আমার মেয়েকে তো আজকে ভারী সুন্দর লাগছে।
পাশ থেকে ইশা বলে উঠে।
–দেখতে হবে না কে সাজিয়েছে!
আয়েশা সুলতানা ইশার কথায় মুচকি হাসি দিয়ে বলে।
–আমার দুই মেয়েকেই খুব মিষ্টি লাগছে আজকে। কারো নজর যেন না লাগে।
–ঠিক আছে তাহলে আন্টি আমরা এখন আসি না হলে দেরি হয়ে যাবে। আর তোমার মেয়ের মন ভালো করার দায়িত্ব যখন আমার উপর দিয়েছো। তাহলে দেখে নিও বাইরে থেকে এসে তোমার মেয়ের মন একদম ফুরফুরে হয়ে যাবে।
–ঠিক আছে দু’জনেই সাবধানে যাবে।
তীর ঘর থেকে বের হতে হতে বলে।
–কোথায় যাচ্ছি আমরা ইশু?
–উফফ! কখন থেকে বলছি এটা সারপ্রাইজ তাও তুই এক কথা বার বার বলেই যাচ্ছিস। আর তুই তো দেখতেই পারবি কোথায় যাবো আমরা।
–কিন্তু…
–আর একটা কথাও নয়।
তীর চুপ হয়ে যায়। গেইটের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখে রিফাত তার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রিফাত ওদেরকে দেখার সাথে সাথে কিছুটা এগিয়ে এসে বলে।
–এতক্ষণ লাগলো তোমাদের আসতে।
তীর অবাকের চূড়ায় পৌঁছে গেছে রিফাতকে দেখে। রিফাতকে একদমেই আশা করেনি এখানে এই মুহূর্তে। কি হচ্ছে এসব কেন হচ্ছে কিচ্ছুই বুঝতে পারছে না। কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। তীর রিফাতকে প্রশ্ন করে।
–ভাইয়া আপনি এখানে কেন?
রিফাত মুচকি হাসি দিয়ে বলে।
–সাহায্য করতে আসলাম তোমাদের।
–সাহায্য! কিন্তু কিসের সাহায্য?
রিফাতকে ইশা কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তীরকে বলে।
–আসলে কি বলতো আমরা যেখানে যাবো সেখানে তো একাএকা যেতে পারবো না। তাই ওনি আমাদের পৌঁছে দিয়ে আসবে।
–কোন দেশে যাবো যে ভাইয়াকে দিয়ে আসতে হবে আমাদের?
–এতো কথা না বলে গাড়িতে উঠ।
রিফাত হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলে।
–হে হে গাড়িতে উঠো এমনিতে অনেকটা লেইট হয়ে গেছে। আরো লেইট হলে হয়তো খবর করে ছাড়বে আমার।
তীর সন্দেহের দৃষ্টিতে রিফাতের দিকে তাকিয়ে বলে।
–কে খবর করে ছাড়বে আপনার?
রিফাত ঢোক গিলে কি বলতে কি বলে ফেলেছে। টেনশনে থাকলে যা হয় আর কি! রিফাত আমতা আমতা করে বলে।
–ও কিছু না তুমি গাড়িতে বসো।
সকলে গাড়িতে উঠে বসে। তীরের মনে সন্দেহের বীজটা যেন গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। কিছু তো একটা গন্ডগোল আছেই যেটা ওর কাছ থেকে লুকানো হচ্ছে। কিন্তু সেটা কি বুঝতে পারছে না? তীর ইশার দিকে তাকায়। ইশার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি লেগে আছে। কি এমন সারপ্রাইজ দিবে যে এতো সব আয়োজন!
#চলবে______