#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩১ (লুকোচুরি)
নিস্তব্ধ রাত, কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। রাত যতো বাড়ছে ব্যস্ত শহরটা আরো শান্ত হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। তবে দুর থেকে ভেসে আসছে গানের শব্দ হয়তো বা কারো বিয়ে না হলে জন্মদিনের অনুষ্টান হচ্ছে। খোলা আকাশে গোল তালা আকৃতির মতো চাঁদ উঠছে। চাঁদের আলোয় চারিদিক আলোকিত হয়ে আছে। চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে যাওয়া খোলা আকাশের নিচে দুটো মানব দেহ একজন আরেকজনের শরীরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে লেগে আছে আর একে অন্যের বুকের উঠানামা গভীর ভাবে অনুভব করছে।
হঠাৎ করে কারো পায়ের আওয়াজ আর শিস বাজানোর শব্দ ইশানের কানে পৌঁছাতে তীরের কাছ থেকে দুরে সরে দাঁড়ায়। তীর কিছুটা হচকিয়ে যায় এভাবে ইশান দুরে সরে যাওয়াতে। অন্য দিকে ইশান চোখ বন্ধ করে বুঝার চেষ্টা করে আওয়াজটা ঠিক কোথা থেকে আসছে। ক্রমশ পায়ের আওয়াজ আর শিসের আওয়াজ গাঢ় হয়ে আসছে। ইশান যখন বুঝতে পারলো তাদের চিলেকোঠা থেকে আওয়াজটা আসছে। তখন সাথে সাথে চোখ মেলে তীরের দিকে তাকায়। বেচারী তীর তো লজ্জায় লাল হয়ে আছে। লজ্জায় চোখ তুলে ইশানের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। ইশান প্রেয়সীর লজ্জামাখা মুখশ্রী দেখে মুচকি হাসে।
কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করলে চলবে না। যদি কেউ ওদের দুজনকে এক সাথে দেখে নেয় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ইশান চারপাশটায় নজর বুলায় কোথায় লুকানো যায়? লুকানোর জায়গায় পেতেই তীরের হাত ধরে চিলেকোঠার ঘরের পাশে গিয়ে লুকায়। তীর তো ভীষন আবাক হয় এমন করাতে। ইশানকে প্রশ্ন করে।
–কি হয়েছে? এখানে আনলেন কেন?
ইশান ফিসফিসিয়ে বলে।
–চুপ! একদম কথা বলবি না।
তীরের ভ্রু কুচকে আসে। মানে কথা বলবে না কেন? আর কি এমন হলো যে এখানে এসে লুকাতে হলো আজব। অন্য দিকে ইশান লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখে ইহান এসেছে ছাদে আর দু ঠোঁটের মাঝখানে সিগারেট। কি সুন্দর করে সিগারেট ফুকছে আর সেই ধোঁয়াটা খোল আকাশের দিকে ছেড়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন স্বর্গে আছে আহা কি শান্তি। তবে ইশান এটা ভেবে পাচ্ছে না ডাক্তার হয়ে কি করে একজন সিগারেট খেতে পারে তাও এত্ত পরম শান্তিতে মনে হচ্ছে যেন বি’ষ না আমৃত পান করছে। এই সিগারেটখোর ডাক্তার গুলাই আবার তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদেরকে ধূমপান সেবন করতে বারণ করে “হাউ ফানি”। তবে ইশানের এটা বুঝতে বাকি নেই যে তার ভাই বউয়ের ভয়ে এখানে এসে সিগারেট খাচ্ছে। বেচারা বিয়ে করে মনে হয় খুব কষ্টে আছে দেখাই বুঝা যাচ্ছে।
অন্যদিকে তীরের যেন ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। পাশে থাকা লোকটা এই লুকিয়ে থাকার বিষয়ে কিছু বলছেও না। বরং দেয়ালের আড়ালে থেকে উঁকি ঝুঁকি মারছে। এভাবে লুকিয়ে থাকার মানে কি? এই মধ্য রাতে কার সাথে লুকোচুরি খেলছে আজব। তীর অনেকটা জোরে বলে উঠে।
–এই আপনি….
তীর তার কথাটা আর সমাপ্ত করতে পারলো না তার আগে ইশান ঝড়ের বেগে ঘুরে তীরের কোমড় ধরে নিজের কাছে এনে অন্য হাত দিয়ে তীরের মুখ চেঁপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে।
–চুপ থাকতে বলছি না। তাহলে এভাবে জোরে কথা বলছিস কেন?
তীর ইশারায় বুঝায় কেন সে চুপ থাকবে? ইশান তীরের ইশারা বুঝে বলে।
–ভাইয়া এসেছে ছাদে তাই চুপ থাক একটু পরে যত পারিস পটর পটর করিস।
এই কথাটা শুনে যেন তীরের চোখ দুটো রসগোল্লার মতো বড় বড় হয়ে যায়। ইহান এসেছে ছাদে যদি ধরে পড়ে তাহলে শেষ। তীরের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দেখে ইশান তাড়াতাড়ি ওর মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে একটু দুরে সরে দাঁড়ায়। তীর নিজের বুকে হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বলে।
–মেরে ফেলছিলেন একে বারে এভাবে কেউ ধরে।
ইশান কিছু বলতে নিবে সাথে সাথে ইহানের কন্ঠস্বর ভেসে আসে।
–কে ওখানে?
ইশান আর তীর দু জন দু জনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। ইশান নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে ইশারা করে চুপ থাকার জন্য। অন্য দিকে ইহান ছাদের একটু সাইডে আসতেই পায়ের সাথে কিছু একটা বারি খায়। নিচে তাকিয়ে দেখে ইশার কেমিস্ট্রি বই। ভ্রু কুচকে আসে ইহানে এভাবে এখানে বইটা পরে আছে দেখে। মনে হচ্ছে যেন কেউ ছুঁড়ে ফেলেছে। হাত বাড়িয়ে বইটা তুলে নিয়ে বলে।
–এই হয়েছে আমার একটা বোন যেখানে খুশি সেখানে নিজের বই পত্র ফেলে রেখে চলে যাবে। পরে সারা বাড়ি মাথায় তুলবে চিল্লিয়ে। মানে একি কোনো দিন বড়ো হবে না সারা জীবন ছোট্ট ইশুই রয়ে যাবে। হয়তো জানেও না যে ওর বই এখানে পরে আছে।
বলেই যখন ঠোঁটের মাঝে সিগারেট নিতে নিবে ওমনি প্যান্টের পকেটে রাখা ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠে। ইহান ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখে কেয়া ফোন করেছে। নিশ্চয়ই তাকে খুজছে। ইহান বিরক্তিকর চেহারা নিয়ে বিড়বিড় করে ওঠে।
–উফফ! একটু শান্তুিতে সিগারেট টাও খেতে দিবে না মেয়েটা। ব্যাচেলার লাইফটাই বেটার ছিল বিয়ে করে জীবনটাই শেষ। ধ্যাত! ভাল্লাগেনা।
বলেই আধ পোঁড়া সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে চলে যায়।
_______
ইশান তীরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চাঁদের আলো মেয়েটার মুখে পড়াতে যেন অন্য রকম সুন্দর লাগছে। অন্য দিকে তীর চোখ বন্ধ করে ঠোঁটের উপরে ডান হাতের আঙ্গুলদ্বয় ভাঁজ করে রেখে এক মনে দোয়া করছে যাতে ধরা পড়ে না যায়। ইশান মুচকি হেসে ধীরে ধীরে তীরের কপালের দিকে হাত বাড়িয়ে ছোট ছোট অবাধ্য চুল গুলা সরিয়ে কানে গুঁজে দেয়। কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে তীর চোখ মেলে তাকায়। ইশানের গভীর চোখে চাওনি দেখে বুকের ভেতরটা ধ্বক করে। এভাবে কেন তাকায় লোকটা তার দিকে তার বুঝি কিছু হয় না। তীর সাথে সাথে নজর ফিরিয়ে নেয় ইশানের দিক থেকে। অন্য দিকে চলে যেতে নিলে ইশান তীরের হাত ধরে টান দেয়। তীর নিজের তাল সামলাতে না পেরে সোজা গিয়ে পরে ইশানের প্রশস্ত বুকে। ইশান সুযোগ পেয়ে তীরের কোমড় আঁকড়ে ধরে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। ইশানের শীতল দৃষ্টি তার প্রেয়সীর দিকে আর প্রেয়সীর দৃষ্টি ইশানের শার্টের বোতাম খোলার উন্মুক্ত বুকের দিকে।
–পালাচ্ছিস কোথায়? পালিয়ে কোথাও যেতে পারবি না এই ইশানের কাছ থেকে। একবার যখন নিজ থেকে এসে ধরা দিয়েছিস তাহলে এতো সহজে পালাতে পারবি না।
তীর কোনো কথা বলছে না দেখে ইশান নিজের মুখটা তীরের কাঁধের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে।
–তুই যখন আমার কাছে আসিস তখন না নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখতে পারি না। ইচ্ছে করে তোর মাঝে ডুবে যাই। কেন হয় এমন বলতো?
তীরের কাঁধে ইশানের গরম নিঃশ্বাস পড়ছে তাতে যেন তীরের গলা শুকিয়ে আসছে। তীর নড়াচড়া করাতে ইশান তীরের কোমড় আরো জোরে চেঁপে ধরে। তীর ভয়ে জপটে চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। ইশান তীরের কাঁধের কাছ থেকে মুখটা তুলে নিয়ে প্রেয়সীর ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকায়। ইশান ঢোক গিলে নিজেকে যেন কন্ট্রোল রাখা বড়ো দায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়েটা কাছে আসলে চুম্বকের মতো যেন তাকে টানে। নিজের অজান্তেই ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় তীরের ডান গালে আর ছুঁয়ে দেয় তীরের তিল জোড়া। ইশানের ছোঁয়া পেয়ে তীর সাপের মতো মোচরে উঠে। এমন করছে কেন লোকটা তার সাথে তার যে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে শ্বাস কষ্টে মরেই যাবে। ইশান হঠাৎ করেই তীরের কপালে নিজের কপাল রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে।
–তোর মাঝে না একটা নেশা আছে। যে নেশাটা সবসময় আমাকে তোর কাছে টানে। কি জাতীয় নে’শা আছে তোর কাছে বলতো? মদের নে’শা থেকেও তোর নে’শার প্রখরতা অনেক। যে নেশা’টা আমাকে কন্ট্রোললেস করে ফেলে। মন চায় ডুবে যাই তোর ওই নেশায় আর ভাসাতে চাই নিজেকে চিরকাল।
তীর বার বার কেঁপে উঠা অধর জোড়া কামঁড়ে ধরছে। ইশানের প্রত্যেকটা স্পর্শ যেন তীরের ভেতর তোলপাড় করে দিচ্ছে। শরীরের প্রত্যেকটা শিরায় যেন অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে যাচ্ছে। তীর নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে অতি কষ্টে ইশানের চোখের দিকে তাকায়। ইশানের দিকে তাকাতেই যেন সারা শরীরের বৈদ্যুতিক শক খেয়ে গেলো তীরের। আর ইশান নেশা ভরা চোখে তাকিয়ে আছে তীরের কাপাকাপা ঠোঁটের দিকে। তীরের আর সহ্য হচ্ছে না মন বলছে এখানে বেশিক্ষন থাকলে কিছু অঘটন ঘটে যাবে। তাই ইশানের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছুটোনোর বৃথা চেষ্টা করে। ইশান মুচকি হেসে বলে।
–এভাবে বার বার ঠোঁট কামড়াছিস কেন? কি বুঝাতে চাইছিস আমাকে? আমি কি কিছু বুঝি না।
তীর বড় বড় চোখ করে তাকায় ইশানের পানে। মানে তাকে কি বুঝাইতে চাইবে ঠোঁট কামড়ে আজব। তীরের ভাবনার মাঝে ইশান নিজের ঠোঁট বাড়িয়ে দেয় তীরের ঠোঁটের দিকে। তীর ইশানের এগোনো দেখে ভয়ে ঠোঁটে জোড়ো চেপে ধরে। তীরের এমন কান্ডে ইশানের অধরের কোণে হাসির রেখা ফুঁটে উঠে।
ইশান হুট করে তীরের কপালে টুপ করে নিজের অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলে।
–চিন্তা করিস না এত তাড়াতাড়ি আমার প্রনয়ের বিষ তোর সর্বাঙ্গে ঢালবো না। যখন ঢালবো তখন তোর সারা সর্বাঙ্গে এক সুখের যন্ত্রণাময় বিষ ঢালবো যে যন্ত্রণা তুই নিজের ইচ্ছেই সহ্য করবি। তাই এখন থেকে নিজেকে তৈরি করে রাখ সেই সুখময় যন্ত্রণাটা সহ্য করার জন্য।
তীর বোকার মতো তাকিয়ে আছে ইশানের পানে। ইশানের কথার মানে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ইশান তীরের এমন চেহারা দেখে কিছু বলতে যেও থেমে গিয়ে উকি দিয়ে আগে থেকে ইহান এখনও আছে কি না। না ইহান চলে গেছে দেখে ইশান তীরের দিকে তাকিয়ে বলে।
–ঘরে যা অনেক রাত হয়েছে। বেশিক্ষন আবার নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখতে পারবো না। তাই আগে ভাগেই চলে না হলে বড়ো কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবো পরে কিন্তু আমার দোষ দিতে পারবি না।
তীর ধীর পায়ে হেঁটে ছাদ থেকে চলে যায়। ইশান তীরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। তীর যাওয়ার শেষে ইশানের দিকে একবার ফিরে তাকায়। ইশানও মুচকি হেসে চলে যাওয়ার জন্য ইশারা করে।
______
তীর যখনেই নিজের ঘরে ডুকতে যাবে তখনেই আয়েশা সুলতানা ওর ঘর থেকে বের। মাকে এসময় দেখে তীর থতমত খেয়ে যায়। গলা টেনে টেনে বলে।
–মা তুমি এখানে। এখনও ঘুমাও নি যে?
আয়েশা সুলতানা ভারী কন্ঠে বলে।
–কোথায় ছিলি তুই?
–আমি,,,
–হুম! তুই কোথায় ছিলি? তোর ঘরে এসে দেখি তুই নেই। এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলি?
–কোথায় আর যাবো আমি। আসলে পড়তে পড়তে বোর ফিল করছিলাম তাই একটু ছাদে গিয়েছিলাম মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য।
আয়েশা সুলতানা মেয়ের দিকে ছোট ছোট চোখে করে তাকিয়ে বলে।
–ওও! আচ্ছা! তাহলে মাইন্ড ফ্রেশ হয়েছে তোর।
–হুমহুম।
–ঠিক আছে যা শুয়ে পড় তাহলে মাইন্ড ফ্রেশ হয়ে থাকলে। রাত হয়েছে অনেক।
–না না ঘুমাবো না এখন। আরো পড়া আছে।
–ঠিক আছে। যাই কর রুমে যা এখন।
তীর ঝড়ের বেগে মায়ের সামনে থেকে চলে যায়। এতক্ষন মনে হচ্ছিলো যেন যমের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। তীর তো চলে গেছে কিন্তু রেখে গেছে আয়েশা সুলতানার মনে একরাশ সন্দেহের বীজ। মেয়েরে হাবভাব একদমেই ভালো লাগে নি ওনার কিছু তো একটা গড়বড় তো আছেই। আয়েশা সুলতানা নিজের ঘরে না গিয়ে পা বাড়ায় ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
এদিকে ইশান মনের আনন্দে হেলে দুলে নিজেদের ছাদে গিয়ে চিলেকোঠার দরজাটা টান দেয় খুলার জন্য। কিন্তু শত চেষ্টা করেও দরজা আর খুলতে পারলো না বেচারা কারন ভেতর থেকে দরজার সিটকানি লাগানো। এবার কি করবে ইশান? কি করে ঘরে যাবে? দরজাটা লক করা কি খুব বেশি দরকার ছিলো। ইহানের প্রতি ইশানের ভীষণ রাগ উঠছে। ছাদে এসে সিগারেট খেয়েছে ভালো কথা তা বলে দরজা লক করে দিবে। এটা কোনো কথা?
আবারও কারোর পায়ের শব্দ শুনা যাচ্ছে। এখন আবার কে আসছে? ইশান তাড়াতাড়ি করে পানির ট্যাংকির আড়ালে এসে লুকিয়ে উকি মেরে দেখে তীরের মা এসেছে ছাদে। মানে আজকে কি সবারেই ছাদে আসার রাত নাকি। একটু পরপর সবাই আসছে আর যাচ্ছে মানেটা কি? আর ইশানেরও কি লুকোচুরি করার রাত নাকি এটা। ইশান বিরক্তকর ভাব নিয়ে দাঁতে দাঁত চেঁপে বলে।
–আজকে কি আমাকে সবার সাথে লুকোচুরি খেলতে হবে নাকি। আর ভাইয়া এই অকাজটা করলো কি করে? আমি এখন ঘরে যাবো কি করে?
অন্যদিকে তীরের মা নিজেদের সারা ছাদ ছেক করে ইশানদের ছাদের দিকে নজর বুলিয়ে চলে যায়। আয়েশা সুলতানা যেতেই ইশান আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। মাথায় ঘুরছে কি করে এখন নিজের ঘরে যাবে। সাথে করে ফোনটাও আনে নি যে ইশাকে ফোন করে বলবে দরজাটা খুলে দিতে। ফোন একটা সাথে যাও আছে সেটাও তীরের ভাঙ্গা ফোন যেটা নিজের হাতে একটু আগে হত্যা করেছে।
#চলবে________
#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩২
তীর জড়োসড়ো হয়ে পড়ার টেবিলে বসে আছে। মাথাটা কেমন ভনভন করছে। বার বার ইশানের বলা কথা গুলা কানে ড্রামের মতো বাজছে। যখন ইশানের বলা কথা গুলার মানে বুঝতে পারলো তখন লজ্জায় দু’হাত দিয়ে মুখটা ঢেঁকে নিয়ে বিড়বিড় করে বলে।
–ছিহ! কি অসভ্য আপনি ইশান ভাই।
তীর পড়ার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ফোনটা খুজতে লাগলো। ইশাকে ফোন করে তো সবটা জানাতে হবে। বেচারী হয়তো অধীর আগ্রহ হয়ে বসে আছে জানার জন্য কি হয়েছে? কিন্তু যখনেই মনে পড়লো ইশান তো ওর অনেক শখের ফোনটা ভেঙ্গে দিয়েছে তখনেই মনটা বিষন্নে পরিণত হলো। বেডে মনমরা হয়ে বসে বলে।
–ধ্যাত! এবার আমার কি হবে? বাবা মাকে বললে তো আমাকে জীবনেও নতুন ফোন কিনে দিবে না। উল্টো আমাকে মা লাঠি পিঠা করবে যখন শুনবে ফোনটা ভেঙ্গে গেছে। ভাল্লাগেনা!
বলে শুয়ে পরে কম্বল গায়ে দিয়ে। আজকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। না হলে এই টেনশনে ভালো করে ঘুমাতেই পারতো বেচারী তীর। ইশাকে না হয় সকালেই বলবে। এখন ঘুমানোর দরকার অনেক রাত হয়েছে।
____
এদিকে ইশান দশ মিনিট ধরে পুরো ছাদ জুড়ে চক্কর মেরেছে। রাগে ভাইকে কতো গুলা গা*লিও দিয়েছে। মন চাইছে ইহানকে ছাদে এনে বন্দি করে রাখতে এই ঠান্ডা আবহাওয়ার মাঝে। শীতের প্রকোপ ভালো ভাবে কাটে নি এখনো। রাত গভীর হলেই হিম পড়া শুরু করে।
রাতে বেলা জীবনেও কোনো দিন ছাদের দরজা লাগানো হয় না আর আজকে লাগিয়ে গেছে। যত্তসব। ইশান অনেক বার ট্রাই করছে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামার জন্য। কিন্তু যখনেই নিচের দিকে তাকিয়েছে তখনেই ভয়ে পিছিয়ে এসেছে। ইশানদের বাড়িটা এক তলা তাই ছাদ থেকে লাফ দিলেও মা’রা টা’রা যাবে না। কিন্তু হাত পা ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ইশান নিচের দিকে তাকিয়ে বলে।
–না বাবা! আমার দ্বারা এখান থেকে লাফ দেওয়া ইম্পসিবল। হাত পা ভেঙ্গে পঙ্গু হয়ে বেডে বসে থাকতে পারবো না। তার চেয়ে ভালো এই ছাদেই সারা রাত কাটানো।
ইশান দু হাত এক সাথে ঘসে বলে।
–ঠান্ডাও লাগছে। মনে হয় না সারা রাত এই ছাদে থাকতে পারবে। তার আগেই আমি বরফে জমে যাবো। উফ! কি যন্ত্রণা।
ইশান ফোল্ডার করা শার্টে হাত গুলা নামিয়ে নেয় তাহলে যদি ঠান্ডাটা একটু কম লাগে। গুটিগুটি পায়ে হেটে গিয়ে দোলনায় বসে ইশান। দোলনা বসতে না বসতেই লাফিয়ে উঠে। লোহার দোলনা পুরো ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে। ইশান রাগের বশে দোলানায় একটা লা’থি মারে। কিন্তু লাথি মেরে লাভটা কি হলো উল্টো নিজেই ব্যাথা পেলো। শীতের দিনে ব্যাথা উফ! ইশানের মন চাইছে গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার করতে। মনের অজান্তেই বলে উঠে।
–আমি ফাইসা গেছি, আমি ফাইসা গেছি মাইকার চিপায়।
কিন্তু ইশানের এখন মনে হচ্ছে ছোট বেলার কাজটাই করতে হবে। ছোট বেলায় যেভাবে গাছ বাইতো এখন মনে হচ্ছে সেই কাজটা করেই নিচে নামতে হবে নিচে না হলে সারা রাত এখানে থাকতে হবে এই ঠান্ডার মাঝে। ওলরেডি হাঁচি কাশি শুর হওয়ার পথে। ইশান আস্তে আস্তে করে ছাদের রেলিং এর কাছে আসে। রেলিং এর একে বারে পাশেই দুইটা আমড়া গাছ আছে। একটা অনেক বড় আরেকটা সামন্য বড়ো। কিন্তু এই আমড়া গাছে উঠতে ভীষণ ভয় করছে। আমড়া গাছের ডাল যেই নরম যদি ভেঙ্গে টেঙ্গে যায় তাহলে তো গেলো।
–পৃথিবীতে কি আর কোনো গাছ ছিলো না যে এই আমড়া গাছেই লাগাতো হলো।
কিন্তু কিচ্ছু করার নেই বেচারা ইশানের এখন একটা রিস্ক নিতেই হবে। ইশান নিজেকে রিলেক্স করার জন্য জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে শার্টের হাতা দুটো ফোল্ডার করে নেয় পুনরায়। পায়ের জুতো গুলা নিচে ফেলে দিয়ে রেলিং এর উপরে উঠে আমড়া গাছের একটা ডালে পা রেখে চেক করে দেখে ডালটা মজবুত আছে কিনা। নাহ ডালটা মুজবুতেই আছে। তাই আস্তে আস্তে করে শরীরের সমস্ত ভর দিয়ে দেয় ডালের উপর আর খুব সাবধানে গাছ বেয়ে নিচে নেমে আসে। ইশান মাটিতে পা রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে শার্টের গায়ে গাছের ময়লা গুলা পরিস্কার করে বলে।
–আমার জীবনের এই ঐতিহাসিক দিনটা না রাতটা সারা জীবন মনে থাকবে। জীবনেও ভুলবো না।
পায়ে জুতা পড়ে সদর দরজার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। সদর দরজার সামনে এসে কলিং বেল বাজায়। ইশার কানে বেলের শব্দ পৌঁছাতে ভ্রু-কুচকে নেয়। এতো রাতে কে এলো? বাড়ির সবাই মরার মতো ঘুমালেও ইশা জেগে আছে। তার একটাই কারন ভাই আর বেস্ট ফ্রেন্ডের মাঝে কি হয়েছে? সেটা জানার জন্য কিন্তু এতক্ষন হয়ে গেলো তীর ফোন করছে না দেখে নিজেই রাগে তীরের ফোনে ফোন দিচ্ছে কিন্তু বন্ধ আসছে। এর মাঝে কলিং বেল আবারো বেজে উঠে। ইশা নিজের মনে বলে উঠে।
–এতো রাতে কে এসেছে? বাড়ির সবাই তো আজ বাড়িতে আছে। তাহলে এ সময় কে এলো? বাবা মাকে ডাকবো না থাক ঘুমাক ওরা। বরং আমিই যাই, যেহেতু দরোয়ান চাচা আটকাই নি তার মানে পরিচিত কেউ হবে। যাই গিয়ে দেখে আসি কে এসেছে?
কলিং বেল দু তিন বার বাজার পরেই ইশা এসে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে ইশানকে দেখে ইশার মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে যায়। ইশানকে দেখে এতটাই আবাক হয়েছে বেচারীর মুখ দিয়ে কথাই ফুটছে না। ইশান ইশার এমন চেহারা দেখে বলে।
–কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? মনে হচ্ছে যেন ভুত দেখেছিস।
ইশা তোতলিয়ে বলে।
–ভা.. ভা.. ভাইয়া তু… তুমি বাইরে কি করে? তুমি না…
–তোর এতো সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না আমি। দেখি সর সামনে থেকে।
ইশান ইশাকে নিজেই সরিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে যায়। ইশা তো বেচারী আবাকের চূড়ান্তে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠে।
–এটা কি করে সম্ভব? ভাইয়া তো ছাদে গিয়েছিলো তাহলে বাইরে কি করে? মানে কি হচ্ছে এসব?
ইশান নিজের ঘরে ডুকতে নিলে আবারও ফিরে আসে। ইশান জানে তার আদরের ছোট বোন যে এখন বাড়ির দরজা খুলে আকাশ কুসুম ভাববে এটা সে নিশ্চিত। তাই সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে থেকে বলে।
–ইশু তোর যদি কল্পনা জল্পনা করা শেষ হয়ে থাকে তাহলে দরজাটা বন্ধ করে ঘরে আয় প্লিজ।
বলেই নিজের ঘরে চলে যায়। ভাইয়ের ডাকে ইশা নিজের সম্মতি ফিরে পেয়ে দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিয়ে দৌঁড়ে ভাইয়ের দরজার সামনে এসে দরজায় টুকা দেয়। ইশার টুকা দিতে দেরি কিন্তু ইশানের কথা বলতে দেরি হলো।
–ইশু আমাকে এখন এই রাত বিরাতে ডিস্টার্ব করবি নিজের ঘরে যা।
ভাবুক ইশা ভাইয়ের কথা শুনে নিজের ঘরে চলে যায়। ওদিকে তীরের ফোন বন্ধ আসছে আর এদিকে তার ভাই বাইরে থেকে এসেছে। মানে এতো কিছু ভাবতে ভাবতে ইশা যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে।
_______
ইশা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই আহমেদ ভিলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সারা রাত বেচারী দু চোখের পাতা এক করতে পারি নি নানা রকমের চিন্তায়। আয়েশা সুলতানা ইশাকে এতো সকালে দেখে অবাক হয়ে বলে।
–একি ইশা! তুমি এতো সকালে?
–আসলে আন্টি আমি তীরের সাথে দেখা করতে এসেছি।
–ও তো মনে হয় এখনো ঘুমাচ্ছে।
–সমস্যা নেই আন্টি আমি গিয়ে ডেকে তুলছি।
বলেই চলে যায় তীরের রুমে। তীরের রুমের দরজা ভেতর থেকে লাগানো। তাই ইশা জোরে জোরে দরজায় শব্দ করতে শুরু করে। তীর এমন হাঁকডাক শুনে আর ঘুমাতে পারলো না ঘুমঘুম চোখ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে।
–উফফ মা। এভাবে এভাবে দরজা ধাক্কাধাক্কি করছো কেন এতো সকাল সকালে? তুমি না একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দেয় না।
বলে দরজা খুলার সাথে সাথে হুড়মুড়িয়ে ইশা ঘরে ডুকে দরজা বন্ধ করে বলে।
–ওই তোর ফোন ওফ কেন?
ইশাকে এতো সকালে দেখে তীর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে।
–তুই এতো সকালে এখানে।
–না এসে পরলাম না। যা সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে আমার সাথে।
তীরের ঘুম যেন উবে যায় ইশার কথা সাথে। অবাক হয়ে বলে।
–তোর সাথে আবার কি ঘটনা ঘটলো?
–ওই তোকে বলেছিলাম তোর আর ভাইয়ার কি কি হবে সব আমাকে বলবি ফোন করে। কিন্তু তুই তো তুই তোর ফোনটা বন্ধ করে রেখে দিলি।
তীর আফসোসের সুরে বলে।
–আর ফোন! ফোনটা আস্তো থাকলে তো তোকে ফোন করে সবটা বলব নাকি।
–মানে তোর ফোনের আবার কি হলো?
–তোর ভাই আমার শখের ফোনটাকে রেগে আছাড় মেরে ভেঙ্গে দিয়েছে।
–মানে! কি করে?
তীর ইশাকে গতকাল রাতের সবটা ঘটনা খুলে বলে। ইশা বিস্ফোরিত নয়নে তীরের দিকে তাকিয়ে বলে।
–গতকাল রাতে এতো কিছু হয়ে গেলো।
–হুম এতো কিছু হয়ে গেছে। তার মাঝে আমার ফোনটা।
বলেই ন্যাকা কান্না শুরু করে দিলো। ইশা তীরকে জড়িয়ে ধরে বলে।
–কান্দিস না আমার মেরি জান। ভাইয়াকে বলে নতুন একটা ফোন কিনে দিতে বলবো।
–হুম তুই বলবি আর তোর ভাই ফোন কিনে দিবে আমাকে।
–আরে দিবে দিবে মিলিয়ে নিস আমার কথা।
–আচ্ছা বাদ দে এবার বল তোর সাথে আবার কিসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে?
ইশা তীরকে রাতের ঘটনাটা বলতে তীর বাজখই কন্ঠে বলে।
–কি বলছিস এসব?
–হুম আমার স্পষ্ট মনে আছে ভাইয়া ছাদে যাওয়ার পরে ভাইয়াকে নিচে নামতে দেখে নি। তাহলে বাইরেই বা কখন গেলো? মাথা কাজ করছে নারে আমার।
–আমারোও না তোর ভাই কি ভুত টুত হয়ে গেলো নাকি রে।
#চলবে________
#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৩
ইশান হাঁচি দিতে দিতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। গতকাল রাতে ছাদে অনেকটা সময় হিমের মধ্যে থাকার কারণে ঠান্ডা লেগে গেছে বেচারার। নাক, মুখ লাল হয়ে গেছে ঠান্ডা লাগার কারণে। তার মধ্যে রাত তিনটে পর্যন্ত জেঁগে সকল কাজ শেষ করতে হয়েছে অফিসের। রাত পর্যন্ত ইশান ঠিকেই ছিলো। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই শুরু হলো হাঁচি, কাশি আর নাক টানাটানি।
নেহা বেগম ব্রেকফাস্ট টেবিল গোছাচ্ছেন। ছোট ছেলের এমন করুন অবস্থা দেখে ছেলের কাছে এসে বলেন।
–ইশান! কি হয়েছে বাবা তোর?
ইশান সোফার উপরে অফিসের ব্যাগ আর কোর্টটা রাখতে রাখতে বলে।
–কিছু হয় নি মা! ওই একটু ঠান্ডা লেগেছে।
কথাটা বলতে বলতে দিলো একটা হাঁচি। নেহা বেগম চিন্তিত স্বরে বলেন।
–কিছু হয় নি বলছিস। আমি তো স্পষ্ট দেখতে পারছি তোর মারাত্মকভাবে ঠান্ডা লেগেছে।
–মা এতো টেনশন করো না তো ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।
–ঠিক আছে নাস্তা করে ঔষধটা খেয়ে নে তাড়াতাড়ি।
–হুমম।
ইশান ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসার কিছুক্ষণ পরেই ইহান আর সোহেল ফরাজী এসে বসে। ইশানের এমন নাক টানাটানি দেখে ইহান প্রশ্ন করে।
–কি রে তোর কি ঠান্ডা লেগেছে নাকি।
–হুমম।
–কিভাবে?
ইশান মনে মনে বলল।
–আর কিভাবে নিজে যদি ছাদের দরজাটা লক না করে যেতে তাহলে আমার আছে এই বেহাল অবস্থা হতো না। এতো পরিমাণ নাক মুখ কামড়াচ্ছে। উফফ!
ইশানকে অন্যমনস্ক দেখে ইহান জোরে বলে।
–কি রে কোথায় হারিয়ে গেলি?
–এমনি.. এমনি ঠান্ডা লেগে গেছে।
–এমনি এমনি কি করে ঠান্ডা লেগে যায়।
–সিজন চেইন্জ হচ্ছে তাই ঠান্ডা লেগেছে।
–ওও আচ্ছা তাহলে ঔষধ খা ঠিক হয়ে যাবে।
–হুমম। আর ভাইয়া তুমি গতকাল একটা কাজ একদম ঠিক করো নি।
নাক টানতে টানতে কথাটা বলে আর অন্য দিকে ভাইয়ের কথা শুনে ইহানের ভ্রু কুচ করে বলে।
–আমি আবার কোন কাজটা ঠিক করেনি?
–ভাবো তাহলেই বুঝতে পারবে কোন কজাটা ঠিক করো নি তুমি।
ইহান ভাবতে শুরু করে ও কোন কাজটা ঠিক করে নি গতকাল।এর মাঝে সোহেল ফরাজী বলেন।
–ইশান তুমি কি আজকে অফিসে যাবে।
–হুম বাবা আজকে থেকে অফিসে যাওয়া শুরু করব। অনেক কাজ পেন্ডিং হয়ে পড়ে আছে যেগুলা আজকের মধ্যে কমপ্লিট করতে হবে।
–তোমার এই অবস্থায় কিভাবে?
–কিছু হবে না বাবা। আই উইল ম্যানেজ!
–ঠিক আছে যেটা ভালো মনে হয় তোমার।
এর মাঝে ইশা বাড়িতে আসে। ইশাকে দেখে নেহা বেগম বলেন।
–কি রে তদের দুই বান্ধবীর মিটিং সম্পূর্ণ হলো।
ইশা ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে ইশানের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসে বলে।
–হে মা খুব ভালো ভাবেই মিটিংটা সম্পূর্ণ হল। আসলে রাতের অনেকগুলা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হয়েছে আমাদের। জানো মা রাতে কি হয়েছে…?
ইশান চকিতে বোনের দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকায়। আসলে চোরের মন তো তাই পুলিশ পুলিশ করছে আর এই মেয়ের পেট যেই পাতলা না জানি কখন কি বলতে বলে দেয় তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। ইশা কিছু বলছে না দেখে নেহা বেগম বলেন।
–কি হলো তুই চুপ করে গেলি কেন? আর তোরা দু ভাই বোন চোখে চোখে কি কথা বলছিস?
ইশান মায়ের কথা শুনে সাথে সাথে ইশার দিকে থেকে নজর ফিঁরিয়ে নেয়। ইশা ভাইয়ের এমন চাহনি দেখে মাথা নেঁড়ে মেকি হাসি দিয়ে বলে।
–না মা কিছু হয় নি আমি তো মজা করছিলাম।
—ঠিক আছে মজা করা শেষ হয়ে থাকলে তাহলে খেতে বস।
–না না মা আমি খাবো না। আমি খেয়ে এসেছি আন্টি না খাইয়ে ছাড়বেনা। তাই বাধ্য হয়ে খেতে হলো।
এর মাঝে ভাবুক ইহান ইশানকে বলে।
–এই ইশান এতো হেয়ালি না করে সরাসরি বলতো কোন কাজটা ঠিক করে নি আমি।
ইশান আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না। ইশান খুব ভালো করেই জানে ইশা যে তার সাথে ফাজলামি করছে। এই মেয়েকে ও রগে রগে চিনে। এই মেয়ে সুযোগ পেলেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা শুরু করে দেয়। এমন অনেক সিচুয়েশনে ফেলেছে দু ভাইকে ইশা। তাই বোনকে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে।
–ভাইয়া তুমি ভাবতে থাকো বসে বসে আমি অফিসে গেলাম। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
নেহা বেগম ছেলের কথা শুনে বলেন।
–কিন্তু তুই তো কিছু খেলি না। আর ঔষধটাও তো খেতে হবে নাকি।
–আমি অফিসের যাওয়ার পথে ঔষধ কিনে খেয়ে নিবো এখন আমি আসি।
ইশান ঝড়ের বেগে অফিসের ব্যাগ আর কোর্ট হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। পার্কিং লট থেকে নিজের গাড়ি বের করতে নিলে কিছু একটা মনে করে প্রেয়সীর বেলকনির দিকে তাকায় প্রেয়সীকে এক নজর দেখার জন্য। মন বলছিলো তীর হয়তো বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু না বেলকনি পুরাই ফাঁকা। ইশানের মনটা নিমিষেই কালো মেঘে ছেয়ে গেল। মনটা ছটপট করছে প্রেয়সীর মায়বী মুখটা এক পলক দেখার জন্য কিন্তু চাইলেই তো আর সব কিছু পাওয়া যায় না। ইশান দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
ইশান চলে যাওয়ার পরপরেই তীর পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। তীর এতক্ষণ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সকালের মিষ্টি রোদ সারা গায়ে মাখছিলো। এর কিছুক্ষণ পরেই ইশানের দেখা পেতেই পর্দার আড়ালে চলে যায়। তীর ইশানের সামনে পড়তে চাইছে না। ইশানের চোখের সামনে পড়লে হয়তো লজ্জায় মরেই যাবেই। কিন্তু এক বার না এক বার তো তাকে ইশানের সামনে পড়তেই হবে। তীরের রাতের ঘটনা মনে পড়তে বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠে। মনের অজান্তে নিজের কপালে হাতটা চলে যায়। এই কপালের মাঝখানটায় ইশানের নরম অধর জোড়া ছুঁয়ে ছিলো এটা ভেবেই তীরের সারা গায়ে শিহরণ বয়ে যায়। আনমনে ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি।
________
ইশান আর রিফাত মুখোমুখি বসে আছে কাচ যুক্ত দু তলার বিশাল বড় এক রেস্টুরেন্ট। ইশানের দৃষ্টি দুর আকাশের টুকরো টুকরো তুলোর মতো সাদা মেঘের পানে। যে মেঘগুলো বাতাসের দ্বারা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে আর অন্য মেঘ গুলা জায়গা করে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে খোলা আকাশে কয়েকটা নাম না জানা পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে।
রিফাতের মুখে সারা রাজ্যের বিরক্তের চাপ প্রকাশ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রায় এক ঘন্টা যাবত বসে আছে এই রেস্টুরেন্টে ওরা। ইশানের কল পেয়ে রিফাত অফিস থেকে চলে আসে প্রাণ প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু প্রাণ প্রিয় বন্ধু যে স্তব্ধ হয়ে বসা দিয়েছে তো দিয়েছেই একটা কথাও মুখ ফুটে বলছে না। আজব বোবা টোবা হয়ে গেলো নাকি এই ছেলে। কোমড় ধরে গেছে রিফাতের বসে বসে থাকতে থাকতে তাই আর সহ্য করতে না পেরে ইশানকে রেগে বলে।
–ওই তুই কি আমাকে তোর মনব্রত পালন করা দেখার জন্য ডেকেছিস। এক ঘন্টা যাবত তুই তোর মনব্রত পালন করচ্ছিস। সেটা আর কতক্ষণ পালন করবি আমাকে একটু কাইন্ডলি বলবি প্লিজ?
ইশান রিফাতের দিকে ফিরে তাকায়। ইশানের চোখে, মুখে চিন্তার চাপ স্পষ্ট ফুঁটে উঠছে। ইশানের এমন রুপে থেকে রিফাত মেকি হাসি দিয়ে বলে।
–না মানে বললে আমার একটু সুবিধা হতো এই আর কি। অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে তো। তাই তোর মনব্রত শেষ হলে আমি আবার তোর সাথে এই জায়গাতে দেখা করতাম।
ইশান কালো কাচ যুক্ত টেবিলের উপর দু হাত রেখে নিজের প্রতিবিম্বর দিকে দৃষ্টিপাত করে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছাড়ে। ইশানের এমন অবস্থা দেখে রিফাতের একটু সন্দেহ হতে শুরু করে তার বন্ধুর নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে যেটা নিয়ে খুব চিন্তিত। রিফাত গলার স্বর নিচে নামিয়ে বলে।
–কি হয়েছে ইশান?
ইশান নিচের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে।
–আমি কোনো ভুল করছি না তো।
রিফাতের ভ্রু-কুচকে আসে ইশানের কথা শুনে। ভুল করছি না তো মানে কি ভুলের কথা বলছে ছেলেটা।
–কি ভুলের কথা বলছিস তুই ইশান খুলে বল আমাকে।
ইশান রিফাতকে গতকাল রাতের সবটা ঘটনা খুলে বলে। রিফাত খুশি হয়ে বলে।
–এট লাস্ট তাহলে আমার বন্ধু তার প্রেয়সীকে তার মনের কথা বলতে পারলো। তাও আবার প্রেয়সীর ফাঁদে পা দিয়ে। না শুধু প্রেয়সীর না সাথে ছোট বোনও আছে। মানে এই দুটো পুচঁকের মাথায় এমন ভাবনা আসতে পারে তা আমার কল্পনার বাহিরে।
রিফাত কথার মাঝেই ইশানের মুখ পানের দিকে তাকায়। ইশানকে দেখে বুঝা যাচ্ছে না ওর ভেতরে ঠিক কি চলছে। ও কি খুশি নয় নিজের মনের কথাটা প্রেয়সীকে বলতে পেরে। রিফাত ইশানের হাত ধরে বলে।
–এই ইশান কি হয়েছে তোর? তোকে এতো চিন্তিত দেখা যাচ্ছে কেন?
–আমাদের সম্পর্কটা যদি কেউ মেনে না নেয় তাহলে।
–কি বলচ্ছিস এসব? কেন মেনে নিবে না অব্যশই মেনে নিবে সবাই। তোর বাড়ির লোকজন তো নিশ্চয়ই মেনে নিবে এটা সিউর আর রইলো তীরের বাড়ির লোকজন ওরা নিশ্চয়ই তোকে মেনে নিবে। তোর মতো ভালো একটা ছেলেকে নিশ্চয়ই ওরা হাত ছাড়া করবে না।
রিফাতের কথা শুনে ইশানের ঠোঁটের কোণে হঠাৎ করেই তাচ্ছিল্য পূর্ণ এক হাসির রেখা ফুটে উঠে আর বলে।
–জানি না ভবিষ্যতে কি হবে? কি লেখা আছে আমার ভাগ্যে।
–সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেঁড়ে দিবি কেন তুই? নিজেও চেষ্টা করবি ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে।
–আমি জানি আমার পরিবার তীরকে খুব ভালোবাসে। ওরা তীরকে হাসিমুখে মেনে নিবে কিন্তু তীরের পরিবার ওরা যদি আমাদের এই সম্পর্কটা মেনে না নেয়। তাহলে আমি ওদের ওমতে তীরকে নিজের করতে পারবো না। আমি চাই সবার দোয়াতে একটা নতুন সম্পর্কের সূচনা করতে।
–তুই অযথাই চিন্তা করছিস তীরের পরিবারও তোকে মেনে নিবে দেখিস। আর যদি মেনে নাও নেয় তাহলে তাদের অমতেই তীরকে বিয়ে করে নিবে।
–আমি চাইলেই এমনটা করতে পারবো কিন্তু এমনটা করবো না কারণ এতে তীরের প্রতি অবিচার করা হবে। আমি চাই না ও আমার জন্য ওর পরিবারের কাছ থেকে দুরে সরে যাক।
–বুঝলাম। আর এতো টেনশন করিস না তো সব কিছু ঠিকেই হবে ভবিষতে দেখে নিস।
–কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে তীরের মা আমাকে মেনে নিবেন না কোনো ভাবে।
–তোর এমনটা মনে হচ্ছেই বা কেন?
–জানি না। কিন্তু সামনের দিনগুলা হয়তো খুব একটা সুখকর হতে যাচ্ছে না আমার জন্য।
#চলবে_____