প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-২৯+৩০

0
1136

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৯তম_পর্ব

ধারার কপালে গভীর চুম্বন একে বললো,
“এসবের ভয় আমার নেই। তবে একটা ভয় আছে। জানিস সেটা কি?”
“কি?”
“তোকে হারানোর ভয়”

অনলের স্বর ঈষৎ কাঁপছে। টলমলে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ধারার হাতজোড়া নিজের রুক্ষ্ণ বিশাল হাতের ফাঁকে নিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কপাল ঠেকালো সে। তার ঘননিশ্বাস জানান দিচ্ছে হৃদয়ের অন্তস্থলের আশংকা। না চাইতেও ক্ষীন ভয় হৃদয়ে জড়ো হয়েছে তার। সবকিছু যেনো এলোমেলো লাগছে। শান্ত জীবনটা যেনো মূহুর্তেই অশান্ত হয়ে উঠেছে। ধারা নিজের হাত জোড়া ছাড়ালো অনলের থেকে। আলতো হাতে তুলে ধরলো অনলের মুখখানা। অনলের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে বললো,
“আমার পিছু ছাড়ানো এতো সোজা নয়। ঐ লোক বলবে আর আমি তার পিছু পিছু চলে যাবো ভাবলে কি করে! আমি জানি বিপদের মাত্রা বেশি, আমারো ভয় করছে। কিন্তু আমার ভয় তোমাকে নিয়ে, তোমাকে হারাবার নয়। পরিস্থিতি যাই হোক আমি তোমার পাশে থাকবো ইনশাআল্লাহ। যখন ই তোমার মনে হবে তুমি দূর্বল, তোমার ধারাকে পাশে পাবে।”

অনল কিছুসময় তার ছোট বউ এর দিকে তাকিয়ে রইলো। তার দৃষ্টিতে একরাশ মুগ্ধতা। ধারার দৃঢ়তায় সে বিস্মিত। নিজের হাতদিয়ে ধারার হাতগুলো আঁকড়ে ধরলো অনল। ঠোঁট ছোঁয়ালো অগণিতবার। তারপর অমলিন কন্ঠে বললো,
“আমি জানি, আমার ধারা আমার পাশে আছে। তাই তো এতোটা শক্ত পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে আছি।”

ধারাও তার প্রণয়নের বুকে মাথা ঠেকালো। অনল চুপ করে রইলো কিছু সময়। ধারাও নিঃশব্দে তার হৃদস্পন্দন শুনতে লাগলো। কাজটি ধারার খুব পছন্দের একটি কাজ। প্রিন্স উইলিয়ামের বেসামাল হৃদস্পন্দনের ধ্বনি তাকে বার বার বুঝায় সে ধারাকে কতোটা ভালোবাসে। এর মাঝেই হুট করে অনল ম্লান কন্ঠে বললো,
“যদি মানুষটা তোর বাবা না হতো আমি হয়তো ভয় পেতাম না। যতই হোক, রক্তের একটা টান তো কাজ করেই”

কথাটি কর্ণকুহরে ঝংকার তুললো। ধারা উত্তর দিলো না। নিস্তব্ধতা ঘিরে রইলো শীতল ঘরটিতে। বুক চিরে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো তার। হ্যা, বাবা। কিন্তু এই শব্দটির সাথে তার পরিচিতি খুব স্বল্প। যখন সেলিম দেশ ছাড়েন তখন ধারার বয়স পাঁচ। স্মৃতিগুলো খুব ই ঝাপসা। তার মনেও নেই বাবা কবে তাকে কোলে নিয়েছিলো। কবে তাকে ঘাড়ে করে মেলায় নিয়ে গিয়েছিলো। তার মনেও নেই তার বাবা আদৌ তাকে ঘুম পাড়িয়েছে কি না! তার মনে নেই যখন হাটতে শিখেছিলো তখন তার বাবা তাকে ধরেছিলো কি না। আচ্ছা, যখন সে ব্যাথা পেতো বাবা তাকে জড়িয়ে আদর করতো? ব্যাথায় মলম লাগিয়ে দিতো! মনে নেই। মস্তিষ্কে জড়ো সেই স্মৃতিগুলো কোন সিন্দুকে বন্দি কে জানে! ধারা খানিকটা ধরা গলায় বললো,
“ঘৃণা শব্দটি অনেক ছোট জানো তো! আমার মনে সেলিম আহমেদের জন্য ঘৃণাও অবশিষ্ট নেই। বাবা শব্দে নাকি অনেক স্নেহ জড়িয়ে আছে। বাবারা নাকি বটগাছের মতো! কিন্তু সেই ছায়াটা আমার জন্য নয় বোধহয়। জানো! ছোটবেলায় না স্কুল শেষ হলে দেখতাম সবার বাবা-মা তাদের নিতে আসতো! আমার না খুব হিংসে হতো জানো। আমার না খুব জানার ইচ্ছে হতো কেমন লাগে বাবার হাত ধরে বাড়ি ফিরতে। এখন আর মনে হয় না। এখন আর আফসোস হয় না। উনি উনার বাবা হবার সুযোগ হারিয়েছেন। আমার জীবনের সেই মূহুর্তগুলো সে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সেলিম আহমেদের সাথে কথা বলতেও আমার ঘৃণা হয়। বাবা ডাকটা আমার কাছে খুব বিশ্রী লাগে জানো তো! আমি না ভেবেছিলাম উনি সামনে আসলে আমি উনাকে অনেক কথা শুনাবো, ইচ্ছেমতো অপমান করবো। কিন্তু যখন উনি সামনে এলেন উনার সাথে হিসেব মিটানোর ইচ্ছে হলো না। থাকুক হিসেব জমা। থাকুক কিছু অভিমান। বলে দিলে তো শেষ হয়ে যাবে। ঘৃণা শেষ হয়ে যাবে। থাকুক না অভিমান গুলো জড়ো।”

ধারা ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যার্থ হলো। অনুভব করলো কোমল গাল জোড়া লবনাক্ত পানিতে ভিজে গেছে। অনল বা হাত ডুবালো ধারার কেশে। আলতো পরশ বুলিয়ে দিলো ক্ষতহৃদয়ে। ধারা ধীর স্বরে বললো,
“তুমি ভয় পেও না, সেলিম আহমেদ এবারও হার মানবেন। ওবারের মতো এবার ও উনাকে হার মানতে হবে। আমি কোথাও যাবো না”

অনল এর বাহুর বেষ্টনী শক্ত হলো। নিবিড়ভাবে ধারাকে বুকের সাথে লেপ্টে রাখলো। ধারা কিছু সময় নিঃশব্দে কাঁদলো। তার নোনাজলে অনলের নগ্ন বুক ভিজলো কিছুটা। কিছু অনল বাঁধা দিলো না। তখন ধারা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সেলিম সাহেবের দিকে। কিশোরীর মনে কতোটা ঝড় বইছিলো সেটা কেউ না বুঝলেও অনলের বুঝতে সময় লাগে নি। তাই ধারাকে আজ কোনো বাঁধা দিলো না। কাঁদুক, কাঁদলে মন হালকা হবে। বাহিরে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে, হয়তো তুফান উঠবে। হয়তো আবার বৃষ্টি শুরু হবে, হয়তো আবারো ভিজবে এই আঁধারে ডুবে থাকা শহর।

ধারার ভার্সিটি বন্ধ। পরীক্ষা শেষে দশদিনের ছুটি দিয়েছে। বন্ধুদের সাথে তার কথা হয় না। সহজ বাংলাভাষায় ধারার ইচ্ছে হয় নি। মাহি ফোন দিয়েছিলো। তার সাথেই কথা হয়েছিলো। এছাড়া দিগন্ত একবার ফোন করেছিলো কিন্তু ধারা তার ফোন ধরে নি। উপরন্তু তাকে ব্লক লিষ্টে দিয়ে রেখেছে। তাই সারাদিন ই বাসায় সে। বাসায় বসে বসে পুরোনো বাংলা সিনেমা দেখছে। তাও বহু পুরানো, উত্তম কুমারের। এই স্বভাবটি নানাভাই এর কাছ থেকে প্রাপ্ত। নানাভাই যখন ই সিনেমা দেখেন নাতি নাতনীদের বসিয়ে রাখবেন। যেনো এটা কোনো শাস্তি! অবশ্য এতে লাভ ই আছে। যেমন উত্তম কুমারের অভিনয়ের কাছে ধারার কাউকেই ভালো লাগে না। তার মনে হয় মহানায়ক সত্যি ই মহানায়ক। তবে একা একাই তাকে সিনেমা দেখতে হয়। কারণ অনল খাতা দেখতে ব্যাস্ত। সে এই বার মোট ৩খানা কোর্স নিয়েছে। সেই সব খাতা সে বাড়ি নিয়ে এসেছে। এক এক করে দেখে শেষ করছে। ধারার ইচ্ছে করছিলো শুধাতে, “আমাকে কত দিলে? পাশ কি করলাম?” কিন্তু অনলের কাছে প্রশ্নটি করা আর ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে নৃত্য করা একই। ধারা উত্তর কুমারের “পথে হলো দেরী” সিনেমাটি দেখছিলো তখন ই সুভাসিনী বেগমের আগমণ ঘটলো। তিনি ইতস্তত স্বরে বলে উঠলেন,
“ধারা মা তুই কি ব্যস্ত?”
“না বড়মা, এই তো সিনেমা দেখছি”
“একটা কাজ করতে পারবি?”
“বলো”
“আমি শুটকি রেধেছিলাম৷ একটু পাশের বাসার খালাম্মাকে দিয়ে আসবি? এশা আর আশাটা দরজা আটকে কি জানে করছে। বললাম বলে, ব্যাস্ত৷ তুই একটু যাবি?”
“ব্যাস্ত না ছাই। যেয়ে দেখো কিছু একটা আকাম করছে। ওদের বিশ্বাস নেই। দাও আমাকে আমি দিয়ে আছি”
“সোনা মা আমার”

বলেই সুভাসিনী বেগম চলে গেলেন। ধারা আড়চোখে অনলকে দেখলো। লাল কলমে খাতায় কাটাকুটি করছে সে। খানিকটা জোরে বললো,
“আমি কিন্তু পাশের বাড়ি যাচ্ছি”
“তো আমি কি করবো? ভাব এমন দেখাচ্ছিস যেনো যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছিস।”
“না পরে আবার বলতে পারবে না, আমাকে না জানিয়ে কেনো গেসিস”

এবার চোখ তুলে তাকালো অনল ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
“আমি কি কানে কালা?”
“বালাই ষাট তা হবে কেনো?”
“তাহলে তোর কেনো মনে হলো মায়ের কথা আমি শুনি নি!”
“তাহলে গেলাম আমি”

বলে যেতে ধরলেই অনল বলে উঠলো,
“শোনো, বেশি দেরি করবা না। ওখানে যেয়ে গল্প জুড়ে বসবা না। তরকারি দিয়েই চলে আসবে”
“যথাআজ্ঞা প্রিন্স উইলিয়াম”

বলেই বেড়িয়ে গেলো ধারা। অনল বাঁকা হাসলো। হয়তো এই ছোট ছোট সুখগুলোকে খুজে নেওয়াকেই জীবন বলে।

বাড়ি থেকে বের হতেই সূর্যের তীব্র ঝলসানো রোদটা মুখের উপর এসে পড়লো আর চোখ মুখ কুঞ্চিত হলো ধারার। বাসায় থেকে এই জ্বালাময়ী তেজটা আন্দাজ করতে পারে নি সে। সাথে সাথে মাথায় ঘোমটা টানলো। পাশের বাড়ির এই ভদ্রমহিলার নাম শিল্পী। ধারা তাকে শিল্পী দাদী বলে ডাকে। এই শিল্পীদাদীর সাথে বড়মার ভাব ই আলাদা। তিনি কুমিল্লার মানুষ আর বড় মার বাবার বাড়িও কুমিল্লা। তাই দেশের মানুষ বিধায় এনাদের মাঝে সখ্যতা গড়ে উঠেছে। যখন এ বাড়িতে নতুন বউ হয়ে আসেন সুভাসিনী তখন থেকেই মহিলাটি বেশ স্নেহ করতেন তাকে। প্রায় দেখা যেতো মহিলাটি সুভাসিনীর জন্য বিভিন্ন পিঠে বানিয়ে পাঠাতো। সুভাসিনীও বিভিন্ন খাবার রান্না করে পাঠাতো তাকে। এবং এই সখ্যতা আজ ও অটুট আছে। তাই তো এখনো শুটকি বা ম্যারা পিঠে বানালে এই খালাম্মাকে দিতে ভুলে না সুভাসিনী। এই ব্যস্ত ঢাকা শহরে এই দৃশ্য এখন বিরল। পাশের ফ্লাটে মানুষ ম’রে থাকলেও তাদের খোঁজ নেবার সময়টি হয় না। শিল্পী দাদীর বাসায় ঢুকতেই দেখা গেলো বাহিরে মালামাল সমেত ট্রাক দাঁড়ানো। হয়তো নতুন ভাড়াটে এসেছে অথবা কেউ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ধারা বেশি ঘাটালো না। সে বাড়িতে ঢুকতেই ২ জন শ্রমিক দেখতে পেলো। তারা ঘরে মাল ঢুকাচ্ছে। এর মাঝেই একটা পরিচিত মুখ দেখে থমকে গেলো। ছেলেটি শ্রমিকের সাথেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ধারাকে দেখতেই এগিয়ে এলো সে। মুচকি হেসে বললো,
“কেমন আছো ধারা? আমাদের দেখা হয়েই গেলো”

মানুষটি দীপ্ত। দীপ্তকে প্রায় মাস খানেক পর এখানে দেখবে আশা করে নি ধারা। তাকে দেখতেই ভেতরের সব আনন্দগুলো মাটি হয়ে গেলো। সাথে সাথেই এক অসামান্য বিরক্তি ঘিরে ধরলো তাকে। সে দীপ্তের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই উপরে চলে গেলো। দীপ্ত ধারার যাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। ধারার আচারণ তাকে খুব অবাক করলো না। সে জানে ধারা তাকে অপছন্দ করে। শুধু মলিন হাসি হাসলো সে৷ তারপর শ্রমিকদের সাথে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

শিল্পী দাদীকে খাবার দিয়ে নিচে নেমে দীপ্তকে দেখতে পেলো না ধারা। কিছু স্বস্তির নিঃশ্বাস ও ফেললো সে। এ বাড়ির মানুষদের কাছ থেকে জেনেছে দীপ্তরা এই বাড়ির নিচ তলা ভাড়া নিয়েছে। ধারার বুঝতে বাকি রইলো না, এটাও সেলিম সাহেবের কাজ। সে ধারার আশেপাশে থাকার জন্যই এই ফন্দি এটেছেন। সুতরাং এখন থেকে এই লোকটির সাথে দেখা হবার মাত্রা অনেকটাই বাড়বে যা ধারাকে খুব ই বিরক্ত করছে। বাসায় যেয়েই অনলকে বিষয়টা জানাতে হবে। সর্বদা নাকের উপর রাগ জমিয়ে রাখা নানাভাই শুনলে ঘর মাথায় করবেন। তিনি বাড়ি ছেড়েও চলে যেতে পারেন৷ এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির কেঁচিগেট দিয়ে ঢুকছিলো ধারা তখন ই একটি রাশভারী কন্ঠ কানে এলো তার। পেছনে ঘুরতেই বিরক্তি আসমান ছুলো। সেলিম সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ধারার কাছে এগিয়ে আসলেন। গম্ভীর কন্ঠটি নরম করে বললেন,
“দীপ্ত বললো তুমি নাকি ওই বাড়িতে এসেছিলে। তাই ছুটে বের হলাম আমি, কিন্তু তুমি তো তার আগেই চলে এসেছো। যাক তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো। সেদিন তো কথা বলতে পারি নি। তো কেমন আছো?”
“আপনি আসার আগে ভালো ছিলাম। এখন ভালো নেই। আপনার আর কোনো কথা না থাকলে আমি ভেতরে গেলাম”
“তুমি কি এখনো আমার উপর রেগে আছো ধারা?”

ধারা শীতল দৃষ্টিতে নিজের বাবার দিকে কিছুসময় তাকিয়ে রইলো। একটা মানুষ এতোটা নির্লজ্জ কিভাবে হয়! কিভাবে এতোটা আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে! সে অবাক হয় নিজের পিতাকে দেখে। একটা মানুষের মাঝে একবিন্দু আত্মগ্লানি নেই। ছিটেফোঁটাও অনুতাপ নেই। অথচ সেই মানুষটি গর্বের সাথে দাবি করে সে মানুষ। ধারা গাল ফুলিয়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর বললো,
“আপনি কে হন, যে আপনার উপর আমি রাগ করতে যাবো? দেখুন মিষ্টার সেলিম আহমেদ আপনার হয়তো অজস্র খালি সময়, কিন্তু আমার নেই। দয়া করে আমাকে এমন ভাবে বিরক্ত করা বন্ধ করুন৷ এতোদিন যেমন অস্তিত্বহীন ছিলেন আজও তাই থাকুন প্লিজ”
“আমি তোমার বাবা ধারা, বাবাটুকু তো বলতেই পারো। আমি কিন্তু আমার দায়িত্ব কখনো এড়াই নি ধারা। আমি তোমাকে নিতে চেয়েছি, বার বার। বহুবার। তোমার নানা সেটা হতে দেয় নি। তোমার জন্য প্রতিমাসে আমি খরচ পাঠিয়েছি। ভেন এখনো তোমার মা তোমার জন্য অজস্র শপিং করে এনেছে। তোমাকে প্রথম দেখবো এতো বছর পর, খালি হাতে কিভাবে আসি”
“প্রথমত সে আপনার স্ত্রী, আমার মা নন। আমার মা মারা গেছেন। আর দ্বিতীয়ত টাকা দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আপনার উপর ঘৃণাও করতে ইচ্ছে হয় না জানেন কেনো? কারণ আপনার মতো অভাগা আমি জীবনেও দেখি নি। যাক গে, আপনি তো আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী তার সন্তানদের নিয়ে সুখে আছেন আমার জীবনটাতে আ’গু’ন না জ্বালালেই কি নয়? আমি তো সুখে আছি। কেনো আপনি উঠে পড়ে লেগেছেন বলুন তো আমার জীবনটা নষ্ট করতে। আমার মার জীবন ছারখার করে কি শান্তি পানি নি? আমি অনুরোধ করছি প্লিজ আমাকে উত্যোক্ত করবেন না। আপনার এই দেখানো ভালোবাসায় আমার ঘৃণা হয়, দমবন্ধ লাগে। ছোটবেলায় বড়মামু ই আমার সব গার্ডিয়ানশীপে সাইন করতো। আজ ও আমি তাকে বাবার স্থান দিয়েছি। যখন ছোটবেলায় সি সো খেলতে যেয়ে আমার হাতে ফ্রাকচার হয়, বড়মামু সারারাত আমাকে কোলে নিয়ে রেখেছিলেন। কোথায় ছিলেন তখন আপনি? জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না! যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসতেন নিজের সুখের আগে আমার কথাটা ভাবতেন”

ধারার কন্ঠ জড়িয়ে আসছে। সে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে মানুষ্টির প্রতি। মৌচাকের মতো জমে থাকা ক্ষততে আঘাত করলে তো কামড় খেতেই হবে। তাই ধারাও নিজেকে সংযত রাখলো না। সেলিম সাহেব কিছু সময় চুপ করে থাকলেন। মেয়ের কথাগুলো সুঁচের মতো ফুটছে। কিভাবে বোঝাবেন এই মেয়েটির জন্য সে আর সন্তানও নেন নি। হয়তো চাইলেও নিজের কৃতকাজের কোনো ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারবেন না। তিনি ব্যাখ্যা দিবেন ও না। কারণ ব্যাখ্যা গুলো অযৌক্তিক। তবে নিজের মেয়েকে দেখে বেশ ভালো লাগছে তার। সেদিন মনে হয়েছিলো মেয়েটি তার মায়ের মতো হয়েছে, শান্ত চুপচাপ, ধীর গতির একটি ঝিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সে ভুল, মেয়েটি তার মতোই জেদি হয়েছে, আত্মসম্মান তার প্রবল। সেলিম সাহেব স্মিত হাসলেন, তারপর বললেন,
“তুমি আমাকে বাবা মানো বা নাই মানো। আমি তোমার বাবা, এবং তুমি আমার একমাত্র মেয়ে। তাই তোমার বাবা হওয়া স্বত্তে আমি চাইবো একজন ভালো ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হোক। যেহেতু তুমি বলছো তুমি সুখে আছো আমিও সেই সুখের মাত্রাটুকু দেখতে চাই”
“মানে?”
“মানে টা খুব সোজা, তোমার জন্য অনল কতটা যোগ্য সেটার পরীক্ষা করতে চাই আমি। বলা তো যায় না সে আমার মতোই একজন অযোগ্য স্বামী প্রমাণিত হলো!”………..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩০তম_পর্ব

“মানে টা খুব সোজা, তোমার জন্য অনল কতটা যোগ্য সেটার পরীক্ষা করতে চাই আমি। বলা তো যায় না সে আমার মতোই একজন অযোগ্য স্বামী প্রমাণিত হলো!”

সেলিমের কথাটা শুনতেই ধারার হৃদয়ের অন্তস্থলে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যেনো উত্তপ্ত লাভা ছাড়তে লাগলো। রাগ, আক্রোশে গা রি রি করে উঠলো। তীব্র প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠলো,
“সবাইকে নিজের পাল্লায় মাপেন নাকি! আপনি অপদার্থ বলে সকলে সেই কাতারে পরবে? শুনে রাখুন, ওই মানুষটার পায়ের যোগ্য ও আপনি নন”

ধারার চঞ্চল আঁখিজোড়া তীব্র ক্রোধাগ্নি বর্ষন করছে। দৃষ্টির তেজ এবং কন্ঠের তীব্রতায় ম্লান নিস্প্রভ হাসি হাসলেন সেলিম সাহেব। তারপর বিদ্রুপের কন্ঠে বললেন,
“বড্ড বিশ্বাস করো বুঝি! ভালো, বিশ্বাস করা। সুরাইয়াও আমাকে বিশ্বাস করতো। কিন্তু কি বলোতো, পুরুষ মানুষেরা এমন ই হয়৷ আমি তার বিশ্বাসের মান কি রাখতে পারলাম? তাই আমি চাই না তোমার পরিণতিও তোমার মায়ের মতো হোক”

ধারার কিছুসময় চুপ হইলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মানুষটির দিকে। মানুষটিকে ঠিক দিয়ে উপরওয়ালা বানিয়েছেন ব্যাপারটা জানতে ইচ্ছে করছে ধারার। এই মানুষটাকে তার মা ভালোবাসতো। এই মানুষটার জন্য সে অপেক্ষা করতো। মৃ’ত্যু’র আগ অবধি পর্যন্ত হয়তো এই আশা করতো যে মানুষটা তার পাশে বসবে, তার সাথে কথা বলবে! কি বোকাটাই ছিলো! ধারা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,
“আপনার যা খুশি তাই করুন। আসলে কি, যে যেমন সবাইকে তাই ভাবে। কিন্তু আমি তো আমার মানুষটাকে চিনি। যে মানুষটা আমার জন্য উ’ম্মা’দ সে আপনাকে জিততে দিবে না। তাই আমিও দেখতে চাই আপনার ঝা’মা ঘ’ষা মুখখানা৷ আমি আপনাকে হারতে দেখতে চাই”

বলেই হনহন করে ধারা ভেতরে চলে গেলো। অপেক্ষা করলো না সেলিম সাহেবের উত্তরের। সেলিম সাহেব ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। তার চোখজোড়া তীর্থের কাকের ন্যায় তাকিয়ে রইলো ধারার যাবার পানে। স্মিত হাসি ফুটলো ঠোঁটের৷ কোনে। অস্পষ্ট স্বরে বললেন,
“আমিও তাই চাই”

ধারাকে দেখা যাচ্ছে না। সে বাড়তে ঢুকে গেছে। সেলিম সাহেব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন। নীলাম্বরের পানে মাথা তুলে চাইলেন। তপ্ত সূর্যটি মাথার উপর। দক্ষিণ কোনে শুভ্র মেঘেরা জড়ো হয়েছে। হয়তো কোনো ফন্দি আটছে। কি ফন্দি আটছে! কে জানে! তার হাসিটা প্রসারিত হলো। এর মাঝেই দীপ্ত ছুটে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“আংকেল ভেতরে চলুন। এখানে অনেক রোদ”
“হু, যাবো। কাজ কতদূর!”
“বিকেল হবে, ওরা এতো আলসে বলবেন না। এখন টি ব্রেক নিচ্ছে”
“এটাই বাংলাদেশ। হাজার দুয়েক বেশি দিয়ে দিও”
“সে ঠিক আছে, আপনি ভেতরে চলুন৷ নয়তো অসুস্থ হয়ে যাবেন”

সেলিম সাহেব দাঁড়ালেন না। তিনি পা বাড়ালেন নিজ গন্তব্যে।

ধারা হনহন করে বাসায় ঢুকলো। তার সারা শরীর কাঁপছে অসহনীত ক্রোধে। লোকটি নিজেকে কি ভাবে! নিজে একজন অযোগ্য স্বামী বিধায় সবাই কি তাই! অনল আত্মদাম্ভিক, নিরস, খা’টা’স, জেদী, রাগী একজন মানুষ কিন্তু প্রিন্স উইলিয়াম স্বামী হিসেবে দশ এ একশ। ধারা সেটা বিশ্বাস করে। অযাচিত মানুষের মতো শান্ত জীবনকে অশান্ত করে সে কি প্রমাণ করতে চাইছে! পরমূহুর্তেই ভাবলো ধারা এতোটা কেনো ভাবছে, সে জানে তার সর্বগুনী প্রিন্স উইলিয়ামকে কখনোই হারবেই না। হারতেই পারে না। এসব ভাবতে ভাবতেই বেখেয়ালী ধারা হাটছিলো। এর মাঝেই ধাক্কা খেয়ে বসলো জমজদের সাথে। সাথে সাথেই চিন্তার ঘোরে ছেদ পড়লো। ধারা সামনে থাকাতেই দেখলো। জমজদ্বয় খালি হাতে কিছু ছোট পোকার মতো কিছু একটি ছোট পুটলিতে ভরছে। তাদের চোখে মুখে ধরা পড়ার আতঙ্ক। ধারা চোখ কুচকে বললো,
“এই ওগুলো কি রে”

সাথে সাথেই তারা একত্রে বলে উঠলো,
“কিছু না”
“দেখি, লুকাচ্ছিস কেনো? আমি দেখবো সামনে আন”

আশা রীতিমতো কাঁপা কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাদের সন্দেহ করছো?”
“না করার একটা কারণ দে”

আশা বুঝলো কাজ হবে না। ধারাপু তাদের চালাকি ঠিক ই ধরে ফেলবে। এর মাঝেই এশা ধারা সামনে পুটলিটা এগিয়ে দিলো। নির্ভীক কন্ঠে বললো,
“তেলাপোকা জোগাড় করছিলাম, আমাদের বায়োলজি প্রাকটিক্যালের জন্য। তুমি আর মা না বেশি করো। দিলে তো তেলপোকা গুলো ছেড়ে”

ধারা সাথে সাথেই সিড়ির উপর উঠে দাঁড়ালো। এই ক্ষুদ্র প্রাণীটিকে প্রচন্ড ভয় পায় সে। তার ওজনের শতভাগের এক ভাগ ও নয় এই তেলাপোকা৷ অথচ তার ভয়ে রীতিমতো শিটিয়ে যায় সে। দেখলেই তার গা ঘিনঘিন করে। ধারার এখনো মনে আছে একবার এক উড়ন্ত তেলাপোকা উড়ে এসে ধারা কাঁধে বসেছিলো। চিৎকার করে সারাঘর মাথায় তুলেছিলো সে। চোখ মুখ কুচকে বললো,
“এখন ওই তেলাপোকা নিয়ে চোখের সামনে থেকে সরে যা। এখন ই”
“ঠিক আছে”

বলেই মাথা নত করে জমজেরা চলে গেলো। ধারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো৷ এদের বিশ্বাস নেই। একবার ওই পুটলি ছেড়ে দিলেই ধারাকে কে পায়। দেখা যাবে, ভয়ে সেখানেই সে কুপোকাত। বাহিরে যেতে যেতে আশা এশাকে বললো,
“তুই যে ধারাপুকে মিথ্যে বললি, ধরা খেলে”
“ওই ভীতু মহিলা জীবনেও চেক করতো না। দেখলি না তেলাপোকার নাম শুনেই সিড়িতে উঠে গেছে। বুদ্ধি খাটা, মাথায় তো গোবর ভরা”
“আর তোমার মাথায় তো আলিবাবার খাজানা আছে”
“ঝগড়া কর তুই, আর ওখানে ঘুঘু উড়ে যাক”

আশা থামলো। সে বুঝলো এখানে ঝগড়া করাটা এখন জরুরি নয়। আপাতত তাদের তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে। পুটলির ছোট ইঁদুরছানা গুলোও বেশিক্ষণ পুটলিতে থাকবে না। কেঁটে ঠিক বেঁড়িয়ে যাবে। এশা, আশা চুপিসারে পাশের বাসার নিচে দাঁড়ালো। এখনো সেলিম সাহেবদের মালামাল তোলার কাজ শেষ হয় নি। কারণ চা খাবার নামে শ্রমিক দুজন কোথায় গেছে জানা নেই। দীপ্ত বা সেলিম সাহেব কাউকেই দেখা গেলো না। তারা হয়তো ভেতরে। এশা আশা সকালে যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো তখন ই তাদের চোখে পড়ে এই ট্রাকটি। ট্রাকের পেছনে অস্ট্রেলিয়ান ফুপার গাড়িটি দেখেই তাদের বুঝতে বাকি থাকে না ফুপা তাদের পাশেই ভাড়া নিয়েছে। তখন ই বুদ্ধি আটে “মিশন অস্ট্রেলিয়ান ফুপা” চালাবে। তাদের ঘরের সদ্য জন্মানো ৭টি ইঁদুরের বাচ্চাকে বেশ আদরের সাথে পালছিলো তারা। সেই ইঁদুরের বাচ্চাগুলোকেই এই পুটলিতে ভরেছে। এখন তাদের প্লাণের পরিণতির পালা৷ এশা আশার খুব একটা কষ্ট হলো না। গেটের ভেতরেই তিনজনের সিল মারা তিনটি কার্টুন দেখতে পেলো তারা। সাথে আনা এন্টিকাটার দিয়ে খুব নিপুনভাবে তারা তিনটে বক্সে ইঁদুরগুলো পুড়ে দিবে। এখন কাজগুলো ইঁদুর ছানার উপর। গোলবাঁধলো অন্য জায়গায়, যখন পুরুষ কন্ঠ কানে এলো। সটান হয়ে দাঁড়ালো তারা৷ সামনে তাকাতেই দীপ্তকে দেখতে পেলো তারা৷ দীপ্ত এগিয়ে এলো তাদের দিকে। তার চোখের ভাষা বুঝতে পারলো না এশা আশা। ভাবলো এবার বুঝি ধরা খেলো। কিন্তু তাদের অবাক করে দীপ্ত হাসি হাসি মুখে বলে উঠলো,
“এ কি টুইন্স এখানে? তোমাদের মিস করেছি”
“আমরাও আপনাকে অনেক মিস করেছি দীপ্ত ভাই। আপনাকে এখানে দেখবো কল্পনাও করি নি”
“হ্যা, সাডেন প্লান। কি করছিলে ঝুকে”
“বক্স দেখছিলাম, আসলে আপনি তো যেভাবে আমাদের বাসায় এসেছিলেন বিশ্বাস ই হচ্ছে না আপনার এতো কাপড় চোপড়। এখন বিশ্বাস হয়ে গেছে। আসি তাহলে?”

বলেই দেরি না করেই ছুট লাগালো এশা আশা৷ দীপ্ত বিস্মিত নজরে দেখলো তাদের যাওয়া। মেয়ে দুটো সত্যি অদ্ভুত, কি বলে, কি করে মাথার উপর দিয়ে যায়।

******
ধারা ঘরে ঢুকেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। তার মাথায় এখনো সেলিম সাহেবের কথা ঘুরঘুর করছে। নানাভাই হয়তো জানেন না, সেলিম সাহেবের পাশের বাসায় ভাড়া নেবার কথা, জানলে উনিও ঘর মাথায় করতেন। এদিকে অনল এখনো তার জায়গায় বসা। মাথা তুলেই শুধালো,
“এতো দেরি হলো যে? বলেছিলাম না গল্প জুড়বি না।”
“গল্প জুড়ি নি, চ্যালেঞ্জ করে এসেছি”

ধারার কথাটা মস্তিষ্কে অনুধাবন হতে সময় নিলো। তড়াক করে মাথা তুললো অনল। অবাক কন্ঠে বললো,
“কি?”
“সেলিম আহমেদের সাথে দেখা হয়েছে”

খাতা ছেড়ে উঠে আসলো অনল। ধারার পাশে বসে বললো,
“খুলে বলতো, কি হয়েছে?”

ধারা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর সিলিং এর দিকে তাকিয়ে সবটুকু খুলে বললো অনলকে। অনল শান্ত চিত্তে সবটুকু শুনলো। কিঞ্চিত অবাক ও হলো, অবাক হলো সেলিম সাহেবের নিচু চিন্তায় নয়। অবাক হলো ধারার আত্মবিশ্বাসে। কথাটি ভাবতেই ঠোঁটের কোনে হাসির উদয় হলো। ধারার চুলে আলতো হাতে বিলি কাটতে কাটতে বললো,
“আমার বউ যখন চ্যালেঞ্জ করেই এসেছে, পরীক্ষা তো দিতেই হবে! দেখি শ্বশুরমশাই কি পরীক্ষার আয়োজন করছে”
“ফাজলামি করছো?”
“একেবারেই না, আমি একদম লোহার মতো সিরিয়াস”
“সেটা কিভাবে হয়?”
“দেখ লোহা যেমন সব কিছুর মাঝেও অভঙ্গুর থাকে, আমিও তেমন শ্বশুরমশাই এর ব্যাপারেও আমার সিরিয়াসনেস অভঙ্গুর। দরকার হলে আমিও নায়কদের মতো গলা তুলে বলবো, চৌধুরী সাহেব টাকা দিয়ে আপনি সব কিনতে পারলেও আমার ভালোবাসাকে কিনতে পারবেন না, পারবেন না। এখন তুই চৌধুরী সাহেবের জায়গায় আহমেদ সাহেব বসিয়ে নে”

অনলের কথাটি শুনতেই হো হো করে হেসে উঠলো ধারা। এতো সময়ের ক্রোধ, রাগ, বিষাদ, চিন্তাগুলো যেনো বাস্পায়িত হয়ে গেলো। মনের আঙ্গিনায় জমে থাকা ধুলো উড়ানো নিকষকালো মেঘগুলো নিমেষেই যেনো সরে গিয়ে এক উজ্জ্বলিত কুসুমপ্রভা বিস্তার করলো। ধারাকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখে অনল নরম গলায় বললো,
“এভাবে হাসবি, প্যাঁচামুখো বউ আমার ভালো লাগে না”
“কি করবে, খুঁজে খুঁজে এই পেঁ”চি’মু’খী’কে’ই বিয়ে করেছো!”

অনল উত্তর ই দিবে তার পূর্বেই তার ফোন বেজে উঠলো। প্রথমে না ধরতে চাইলেও শেষে বাধ্য হয়ে ফোনটি ধরে অনল। কথা শেষে যখন শুধালো, “কে ফোন করেছে?” তখন উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে অনল বলে,
“আমাদের ব্যাঁচের রিইউনিয়ন হচ্ছে যাবি?”
“তোমাদের বন্ধুমহলে আমি যেয়ে কি করবো?”
“স্মৃতিও যাচ্ছে। রবিন ও তার নতুন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আসছে। চল ভালো লাগবে।”
“কবে সেটা?”
“এইতো সামনের রবিবার। চল, একটু বউকে দেখিয়ে শো অফ করতে চাই। নয়তো সব ফুটেজ প্লাবণ ই নিয়ে যাবে। চল প্লিজ। তোর ভালো লাগবে”

অনলের আবদারে মানা করতে পারলো না ধারা। কিন্তু মূহুর্তটাও ছাড়লো না, ঠেস মেরে বললো,
“শুধু শো অফ করতেই নিয়ে যাবে আমাকে! ছি ছি, এই আমার বরভাগ্য!”
“অবশ্যই। সবাইকে দেখাতে হবে তো যে আমার একটা পুতুল বউ আছে! মাঝে মাঝে নিজের সৌভাগ্য দেখাতেও শান্তি লাগে। তুই বুঝবি না”

ধারার নাক টেনে কথাটা বললো অনল। ধারা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মানুষটির দিকে। এতো দেখলেও কেনো যেনো মন ভরে না। মন চায় আরোও দেখি, শুধু দেখতেই থাকি। এই প্রিন্স উইলিয়ামটি যে শুধু তার________

রবিবার,
একটা বিশাল হোটেলের কনফারেন্স রুম ভাড়া করা হয়েছে। ভার্সিটির ১৩ ব্যাচের সবাই একত্র হয়েছে সেখানে। যে যার পরিবার নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট, বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি। কত বছর পর মতে হচ্ছে সেই যৌবন যেনো ফিরে এসেছে। ধারাও অনলের সাথে এসেছে এখানে। প্লাবণ এবং স্মৃতির সাথে তাদের আগেই দেখা হয়েছে। রবিন ও তার নতুন বান্ধবীকে পরিচয় করিয়ে দিলো। তাদের নাকি বিয়ের কথা চলছে। রবিনটির ও যে একটা হিল্লে হলো এটাই বেশ অদ্ভুত। ইকরাম এলো একা, তার বউটি এখন বাপের বাড়ি। তাই তাকে একাই আসতে হলো। আড্ডা হলো জম্পেস। ধারার সাথে পরিচিত হলো অনেকে। সকলের একটাই কথা,
“শেষমেশ বাচ্চার কাছেই হৃদয় হারালি?”

অনল তখন গর্বের সাথে বললো,
“তাহলে বুঝে দেখ আমার বউটি কতো গুণী, আমার হৃদয় চুরি করা যার তার কাজ নয়।”

ধারা তো লজ্জায় পারলে মিশে যায়৷ না চাইতেও এতোবড় অনুষ্ঠানের মধ্যমনি সে৷ এর মাঝেই একজন বলে উঠে,
“অনন্যা দেশে ফিরেছে, জানিস?”…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে