প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-০১ | গল্প পোকা রোমান্টিক ধারাবাহিক গল্প

0
2220

#প্রণয়_প্রহেলিকা
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

খালাতো বোনের বিয়ে খেতে এসে আকস্মিকভাবে নিজের বিয়ে হবে যাবে তা কস্মিনকালেও ভাবতে পারে নি ধারা। এখনো যেনো সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্মুখে বসে থাকা অতিউৎসাহী মানুষদের দিকে। তাদের মুখে এতোটুকু অনুশোচনা নেই। একটি মেয়েকে জো/র/পূ/র্ব/ক বিয়ে দেওয়া হয়েছে অথচ তাদের আহ্লাদের সীমা নেই। অবশ্য জো/র/পূ/র্ব/ক কথাটি সম্পূর্ণরুপে ভুল। তারা মোটেই ধারাকে জো/র করে নি, করেছে ইমোশনাল ব্লা’ক’মে’ই’ল। কথাটা ভাবতেই হৃদয়ের অন্তস্থলে তিতকুটে অনুভূতিটা মাথাচড়া দিলো। এমনটা তো হবার কথা ছিলো না। খালাতো বোন আফিয়ার বিয়েতে বউ যাত্রী হয়ে এসেছিলো সে। অথচ আজ নিজের ই বিয়ে হয়ে গেলো।

ঘটনার সূত্রপাত হয় চারদিন আগে। বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিলো, হুট করেই ধারার নানাভাই জামাল আহমেদ বুক চেপে ধরেন। প্রচন্ড ব্যাথায় তার মুখ নীলাভ বর্ণ ধারণ করে। ছটফট শুরু করেন তিনি। অবস্থার অবনতি দেখে ধারার বড় মামা রাজ্জাক আহমেদ তাড়াতাড়ি প্বার্শবর্তী হাসপাতালে তাকে ভর্তি করান। বাড়ির সকলের মুখ থমথমে। শুভ অনুষ্ঠান না কালো প্রহরে পরিণত হয়! করিডোরে থমথমে মুখে বসে ছিলো ধারা। হৃদয়ের ভীষণ প্রিয় নানাভাইকে অসুস্থতা তাকে ভেতর থেকেই দূর্বল করে দিচ্ছিলো। ঘণ্টাখানেক বাদে ডাক্তার বের হন, তিনি জানান,
“উনার অবস্থা এখন মোটামুটি ভালো। ব্যাথা প্রশমিত করতে ঔষধ দিয়েছি। তবে আমার মনে হয় উনার হার্ট এট্যাক হয়েছে। কিছু টেস্ট দিয়েছি, রিপোর্ট আসলে বলতে পারবো”

ডাক্তারের কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন রাজ্জাক সাহেব। বয়স সত্তরের গোড়ায় হলেও বাবা তার যথেষ্ট স্বাস্থ্যসচেতন। দৃষ্টি খানিকটা ক্ষীণ ছাড়া তেমন কোনো রোগ-ব্যাধি জামাল সাহেবের নেই। সঠিক সময় ভোজন এবং নিয়মিত হাটাচলা করাই তার স্বভাব। সেখানে এতো বড় রোগ তার শরীরে জন্ম নিয়েছে, অথচ ছেলে হিসেবে তার এই সম্পর্কিত জ্ঞান নেই। বেশ ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। নিজেকে একজন ব্যর্থ ছেলে মনে হতে লাগলো। এর মাঝেই নার্স জানিয়ে যায় জামাল সাহেব নিজের পরিবারের লোকেদের সাথে দেখা করতে চায়। প্রথমে রাজ্জাক সাহেব এবং সুভাসিনী বেগম ভেতরে গেলেন। মিনিট পনেরো বাদে থমথমে মুখে বের হলেন। গম্ভীর রাশভারি কন্ঠে বললেন,
“বাবা অনল এবং ধারার সাথে দেখা করতে চান”

অনল ধারার মামাতো ভাই। সে রাজ্জাক সাহেব এবং সুভাসিনী বেগমের একমাত্র ছেলে এবং জামাল সাহেবের বড় নাতী। তৃতীয় প্রজন্মের বড় ছেলে বিধায় এই বাড়িতে তার দাপট ও বেশ কড়া। হবে নাই বা কেনো! সর্বদা ভালো ছাত্রের ট্যাগ যে লাগানো। শুধু তাই নয় সুদর্শন পুরুষ হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা আছে ধারার বান্ধবী মহলে। কেউ কেউ তার জন্য প্রেমপত্র লিখেছে। কিন্তু সে নির্বিকার চিত্তে তা প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। তার মনে কেউ তার যোগ্য নয়। ধারার ঠিক কারণেই লোকটিকে অপছন্দ। নিজেকে যথারীতি প্রিন্স উইলিয়াম ভাবা ব্যাক্তিটি সর্বদাই যেনো তার উপর নিজের আধিপত্য খাটাতে চায়। ধারা আড়চোখে অনলের দিকে তাকালো। লোকটি যেনো নির্বিকার। মোবাইলটা পকেটে পুরেই দাদার কেবিনের দিকে পা বাড়ালো সে। ধারাও একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে পিছু নিলো তার। কেবিনে প্রবেশ করতেই শুভ্র বিছানায় শায়িত নানাভাইকে দেখে নিজেকে আটকাতে পারলো না ধারা। প্রিয়মানুষটিকে হারানোর অনুভূতি হুল্লোড় করলো। ধারা ছুটে গেলো নানার কাছে। সে চায় না মায়ের মতো নানাকেও হারাতে। নানাভাই নিস্প্রভ হাসি একে বললেন,
“কি গো ধারারানী, কান্দো নাকি! কাইন্দো না! সবার ই তো যাইতে হয়”
“এসব কথা না বললে নয় দাদাজান? আপনি যথেষ্ট ফিট। ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না”

নির্লিপ্ত স্বরে কথাটা বললো অনল। ক্ষীন বিরক্তিও ছিলো। তাকে বিচলিত দেখালো না। অপরদিকে ধারার কেঁদে কেটে একসার। আর তার কান্না যেনো অনলের বিরক্তির উৎস। এবার বেশ আবেগী কন্ঠে জামাল সাহেব বললেন,
“আমার ম/র/তে ভয় নেই। শুধু একখান চিন্তাই দূর্বল করে দিচ্ছে৷ আমি চলে গেলে আমার ধারারানীর কি হইবো?”
“নানাভাই, এভাবে বলবেন না”

জড়ানো কন্ঠে ধারা কথা বলছে, কাঁদতে কাঁদতে তার হিচকি উঠবার জোগাড়। এদিকে ভ্রু কুচকে উঠে অনলের। সে খানিকটা বিস্মিত স্বরে বলে,
“ধারার কি হবে! ও তো বানের জলে ভেসে নেই। এতোকাল যেমন আমাদের কাছে থেকেছে আজ ও তাই থাকবে”
“তুমি বোঝো না অনল, এতোকাল ওর বাপ আমার উপরে কথা কইতে পারে নি। তাই ওরে নিতে পারে নি। কিন্তু আমি ম’র’লে ও হয়ে যাবে লাগাম ছাড়া ষা’ড়। জো’র করে ধারারানীকে লয়ে যাবে। আর তুমি কিছু করতেও পারবা না। ধারারানী ওই মহিলার কাছে থাকতে পারবে না। আমার ভাইবেই মন বইসে যায়। তাই আমি একখান সিদ্ধান্ত নিছি। ধারারানী, আমারে তুমি ভালোবাসো না?”
“খুব খুব, ভালোবাসি নানাভাই”
“তাইলে আমার এক খান কথা রাখবা? নানাভাই কে শেষ কথা”
“আপনি যা বললেন তাই রাখবো”
“তাইলে তুমি অনলরে বিয়া করবা। কথা দাও, তোমাদের সুখী সংসার দেখে ম’ই’রেও শান্তি পাবো”

কথাটা বজ্রপাতের মতো ঠেকলো ধারার কাছে। স্নায়ুকোষ কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কথাটা মস্তিষ্কে পেন্ডুলামের ন্যায় ঘুরতে লাগলো। বিমূঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,
“জ্বী?”
“এইটাই একমাত্র উপায়। তোর বাপ আজ কখনো তোরে জো’র করতে পারবো না। আর রাজ্জাকের ও জো’র থাকবে। তার ভাগনীরে নিতে পারবে, পুত্রবধুরে না”
“অসম্ভব”

জামাল সাহেবের কথার তীব্র প্রতিবাদ জানালো অনল। ক্ষীন কন্ঠে বলে উঠলো,
“পা’গ’ল নাকি! ধারা আর আমি, অসম্ভব। আমি এই বিয়ে করবো না। আমাদের বয়সের ডিফারেন্স দেখেছেন। ও কেবল উনিশে পা রেখেছে। আর এদিকে আমি আঠাশ। এতো বয়সের ডিফারেন্সে বিয়ে করা অসম্ভব। উপরন্তু ও এখন কেবল ভার্সিটিতে উঠেছে। বিয়ে করে সংসার করার থেকে ওর এখন পড়াশোনা করা বেশি জরুরি। আর আপনার নাতনীর মতো একটা স্টু’পি’ড মেয়েকে বিয়ে করে নিজের জীবনের জ্বলাঞ্জলি দেবার ইচ্ছে নেই। আমি এসব আবদার মানতে পারবো না। আপনি রেস্ট নেন৷ ইনশাআল্লাহ আপনার কিছু হবেও না”

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো অনল। অনলের স্টু’পি’ড কথাটা কর্ণপাত হতেই কান গরম হয়ে গেলো ধারার। অন্যসময় হলে চার কথা শুনিয়ে দিতো। কিন্তু অবস্থা অনুকূলে নেই। তাই চুপ থাকাই শ্রেয়। উপরন্তু সে যে মূর্তি রুপে সে বের হয়েছে তাতে বিয়ে হবে না। তাই মূহুর্তে উঠা রাগ জল হয়ে গেলো। অপরদিকে জামাল সাহেব নাতির ঝাড়ি খেয়ে চুপ মেরে গেলেন। ধারা স্মিত হেসে বললো,
“নানাভাই, ঘুমান। আমি আসছি”

ধারা ভেবেছিলো বিয়ের ফাড়াটা হয়তো কেটে গেছে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করলেন জামাল সাহেব। তিনি কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন, বিয়েটা দিয়েই ছাড়বেন। জামাল সাহেবের রিপোর্ট এলো, হার্টে ব্লক ধরা পড়লো। এই বয়সে অপারেশন করা অসম্ভব। অপারেশনে মৃ’ত্যু ঝুকি আছে বিধায় ডাক্তার মানা করে দিলেন। এদিকে জামাল সাহেব ছেলে ও ছেলের বউ এর উপর আবেগী অত্যাচার চালান। ফলে রাজ্জাক সাহেব এবং সুভাসিনী বেগম আবেগের তাড়নায় তার দলে ভিড়লেন। অনল অবিচল, সে বিয়ে করবেই না। কিন্তু বিধিবাম, জামাল সাহেবের আবার বুকে ব্যাথা শুরু হলো। ডাক্তার ও তাকে চিন্তামুক্ত রাখতে নির্দেশ দিলেন। ফলে সত্তর বছরের বৃদ্ধের জিদের সামনে হেরে গেলো আঠাশ বছরের যুবকের নীতি। বাধ্য হয়ে নিজ বধুরুপে গ্রহণ করতে হলো ধারাকে। একই মঞ্চে বিনা নোটিশে বিয়ে হয় আফিয়ার এবং অনল ধারার। এখন লাল বেনারসী পড়ে ঘোমটা দিয়ে ফুলসজ্জিত বিছানায় বসে রয়েছে সে। তাও এমন এক ব্যাক্তির প্রতীক্ষায় যাকে দু চোখে সহ্য হয় না।

ধারার বড় মা সুভাসিনী বেগম প্রসন্নমুখে ঘরে প্রবেশ করলো। ধারা টলমলে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তিনি ধারার মনোস্থিতি ঠাহর করতে পারলেন হয়তো। সবাইকে বের হতে বললেন কয়েক মূহুর্তের জন্য। তারপর ধারার পাশে বসলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম স্বরে বললেন,
“রাগ করেছিস বড় মার উপর?”
“হু, খুব রাগ করেছি। কেনো করলে তোমরা এমন? এভাবে ইমোশনাল ব্লা’ক’মে’ই’ল কেনো করলে?”
“কি করবো বল, বাবার শরীরটা তো ভালো নেই। তার ইচ্ছের দামটুকু যদি না দিতে পারি সারাজীবন দায়ী থেকে যাবো। আর সত্যি বলতে, আমিও মনে মনে চাচ্ছিলাম যেনো তুই আমাকে ছেড়ে কোথাও না যাস। তোকে বিয়ে দেবার কথা ভাবলেই বুক কাঁপতো। তাই অমত করলাম না। জানি আমার ছেলেটা একটু দাম্ভিক, একটু তেতো স্বভাবের। কিন্তু ও তোকে খুব সুখে রাখবে দেখিস! আচ্ছা তুই খুশি নস, আমার কাছেই সারাজীবন থাকবি”

বড়মার আবেগী স্বরে বলা কথাটার সম্মতি না দিয়ে পারলো না। ধারার বয়স তখন কেবল ছয় যখন তার মা সুরাইয়া বেগম ইন্তেকাল করেন। তখন থেকেই নানাবাড়িতে তার বেড়ে উঠা। মায়ের মৃ’ত্যুর পর অনাথ ধারাকে সামনে বসে থাকা নারীটি মাতৃস্নেহে মানুষ করেছে। তাই তাকে কষ্ট দেবার কথা ভাবতেই অস্থিরতা সৃষ্টি হয় ধারার মাঝে। মনে হাজারো অভিযোগ থাকলেও কিছুই বলে না সে। সুভাসিনী বেগম ধারার ললাটে চুমু একে বলেন,
“চিন্তা করিস না, ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে”

সুভাসিনী বেগমের প্রস্থানের পর ডুকরে উঠে ধারা। অনুভূতিগুলো লাগাম ছাড়া হয়ে যায়। কিশোরী হৃদয়ের মাঝে যে প্রণয়ের অঙ্কুরোদগম হয়েছিলো তা এখন পরিস্ফুটিত হয়ে ফুটন্ত গোলাপের রুপ নিয়েছে। সেখানে অনলের আগমন সে ফুলটিকে ঝড়িয়ে দিতে সক্ষম। এই অযাচিত সম্পর্কটিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ধারা৷ মুখশ্রীতে হাত দিয়ে কিছুসময় কাঁদে সে। ভাগ্যের এমন প্রহেলিকায় যেনো নিজেকে অসহায় লাগছে ধারার, বড্ড অসহায়!

সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছে টেরটিও পায় নি। সেই বেনারসী, সেই সাজেই বিছানায় উপর হয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো সে। অবশ্য ঘুমাবে নাই বা কেনো, এই চারদিন বিয়ের টেনশনে এক বিন্দুও ঘুম হয় নি। ধারার মনে হচ্ছিলো এসব একটা বিশ্রী দুঃস্বপ্ন হলে মন্দ হতো৷ ঘুম থেকে চোখ খুলতেই দেখবে সব মিথ্যে, কিছুই ঘটে নি। কিন্তু তা হলো না। তন্দ্রা কাটতেই ধাতস্থ হলো, সে ভারী কিছুর উপর শুয়ে আছে। চোখ না খুলেই হাতড়ালো কিছু সময়। কিন্তু বুঝতে পারলো না এটা কি বিছানা নাকি মেঝে। তখন ই শীতল কন্ঠ কানে এলো,
“স্পর্শ করা শেষ হলে হাতটা সরা”

শীতল কন্ঠ কর্ণপাত হতেই ঘুম পেছনের জানালা দিয়ে পালালো। শিরদাঁড়া বেয়ে হীম বয়ে গেলো। তড়াক করে চোখ খুললো ধারা। চোখ খুলতেই দেখলো যাকে সে মেঝে ভাবছিলো সেটা ছিলো অনলের বলিষ্ঠ বুক…………

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে