#প্রণয়
#১৪তম
#শেষ পর্ব
#Abir Hasan Niloy
…
পুলিশ অফিসার নিজের ফোনে নাম্বারটি পাতাতে থাকে। কল দিতে দিতে বলে “এখনো বেঁচে আছে। হাসপাতালে নিয়ে যাও জলদি। জেলা হসপিটাল কাছেই আছে। আমি দেখি কার নাম্বার এগুলো। যাও।” অফিসার কথাগুলো দুজন পুলিশকে বললো। ওদিকে আরিনা বেগমসহ বাসার সবাই কান্না করছে। হঠাৎ আরিনা বেগমের ফোন বেজে উঠল। দৌড়ে যায় অবনি। রিসিভ করে সে। ওপাশ থেকে একজন পুরুষ কণ্ঠে বলে..
– আপনি কি আরিনা বেগম বলছেন? (পুলিশ)
– আমি ওনার ছেলের বউ। আপনি কে? (অবনি)
– ওনার ছেলের নাম? (পুলিশ)
– অর্ন, আবিদ হাসান অর্ন। কিন্তু আপনি কে? (অবনি)
– ওহ.. মানে আপনি কি ওনার স্ত্রী? (পুলিশ)
– জ্বি। উনি কোথায়? (অবনি)
– আমি পুলিশ আকরাম খান। সদর থানার অফিসার। সদর থানার এরিয়াতে একটা বিরাট এক্সিডেন্ট হয়েছে। অর্ন সাহেব রাস্তার পাশে পড়ে ছিল। দেখে যতদূর মনে হয়েছে কন্ডিশন ভালো না। হয়ত মারা যেতে পারে। হসপিটালে পাঠানো হয়েছে। আপনাদের কেউ আমাদের থানায় এসে যোগাযোগ করবেন। আর জেলা হাসপাতালে আসুন দ্রুত। (পুলিশ অফিসার)
– অর্ন…
পুলিশ অফিসার ফোন কেঁটে দিল। অবনি ফোন হাতে নিয়ে দৌড়ে সবার সামনে আসলো। হাপাতে হাপাতে বললো “অর্ন হাসপাতালে। এক্সিডেন্ট করেছে। পুলিশ বলছে কন্ডিশন ভালো না। কাউকে থানায় যেয়ে কথা বলতে বলেছে আর হাসপাতালে যেতে বলেছে।”
.
এক ঘন্টার ভিতর বাড়ির সবাই হাসপাতালে এসে পৌছেছে। ইমার্জেন্সির সামনে এসে দাঁড়ায়। পুলিশদের সাথে আনাফ, আর তার বাবার কথা হয়েছে। পুলিশি সব ঝামেলা শেষ করে তারাও ইমার্জেন্সির কেবিনের সামনে এসে অপেক্ষা করে। কিছু সময় পর একজন নার্স এসে দাঁড়ালো। অবনি ছুটে যায়। নার্সকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই নার্স বলে “এ পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন। ছিল তবে ফুরিয়ে গেছে। আপনাদের কারো এ পজেটিভ রক্ত আছে?”
অবনি বলে “আমার আছে। আমি রক্ত দেবো।” নার্স একটা কেবিনে নিয়ে যায় তাকে। অর্নের অনেক রক্ত বের হয়েছে। মাথায় হেলমেট না থাকায় পিছনের অংশ ফেঁটে গিয়েছে। রক্তের প্রয়োজন এখন। নার্স অবনির থেকে রক্ত নিয়ে চলে যায়। অবনি একটি চেয়ারে এসে বসলো। সিফাত এসে তার পাশে বসে। অবনির দিকে তাকিয়ে আস্তে গলায় বললো..
– আমি কখনো ভাবিনি এমনটা হবে। অর্ন এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেবে জানতামই না। ইরার থেকে কষ্ট পেয়েছে। আমাদের থেকে কষ্ট পেয়েছে। সব মিলিয়ে সে হয়ত নিজেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। হয়ত উপর ওয়ালা তা চায়নি। তিনি ঠিকিই একটা এক্সিডেন্টের মাধ্যমে অর্নকে সুসাইড থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বাকিটা তারই ইচ্ছে। তবে আমি সরি অবনি। আমি বুঝিনি এতকিছু ঘটে যাবে অর্নের মধ্যে। (সিফাত)
অবনি কাঁদতেই থাকে। সে কোনো কথা বলেনা। আরিনা বেগম অবনিকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নিল। অবনির চোখে মুখে ভয় আর চিন্তার ছাপ অনেক বেশি। ভোর রাত হয়ে গেছে। ভোর রাতে ছোটন আনাফের সাথে হাসপাতালে আসলো। ছোটন দৌড়ে আরিনা বেগমের কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে..
– ভাইয়ার কি হয়েছে? ভাইয়া চলে গেলে আমি মরেই যাবো। আমার মা মারা গিয়েছে। আমার পাশে একমাত্র তিনিই ছিলেন। আমার কিছু লাগবে না। আমার তাকেই চাই। অবনি ভাবী.. জানেন আপনি? ভাইয়া আপনাকে এখন কতখানী চায়? আমি সব জানি। আমার ভাইয়াকে এনে দেন।
– ছোটন, চিন্তা করিস না। তোর ভাইয়া ঠিক আছে। দোয়া কর।(আনাফ)
কেবিনের সামনে সবাই অপেক্ষা করতে থাকে। ভিতরে ডাক্তাররা অর্নের মাথা সেলাই করেছে। ব্যান্ডেজ করেছে। এখন অর্নের জ্ঞান ফেরা বাকি। ভোরের দিকে ডক্টর বের হল। বাইরে আসতেই সবাই ঘিরে ধরে তাকে। ডাক্তার জানায় “চিন্তা করার কারণ নেই। উনি সুস্থ তো আছেই। বাকিটা উপরওয়ালার ইচ্ছে। জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করুন। হাত ভেঙে গেছে। আমরা সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে চেক করেছি। ট্রিটমেন্টও করেছি। আপনারা জ্ঞান ফিরলে দেখা করতে পারবেন।” ডাক্তার কথাগুলো বলে চলে যায়।
.
অর্ন আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। উপরে ফ্যান ঘুরছে। হাতে পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ করা। ঠিকমত নড়ার উপায় যেন নেই। অর্ন চোখ খুলে মনে মনে বলে “আমি এখানে কিভাবে এলাম। জ্ঞান হারানোর আগে অবনির কথা ভাবছিলাম। চেয়েছিলাম তো মরতে। কিন্তু বেঁচে আছি এখনো? যদিও এক্সিডেন্টটা হঠাৎ করেই হয়ে গেছে।” ছোটন অর্নের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ন চোখ মেলতেই ছোটন দেখে আনন্দের সাথে চিৎকার দিয়ে বলে “ভাবি… ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে। চোখ মেলে তাকিয়েছে।” সবাই ছুটে আসে অর্নের চারপাশে। নার্স এসে সবাইকে একটু দূরে সরিয়ে দিল। অর্ন ধীর গলায় ছোটনকে উদ্দেশ্য করে বললো..
– ছোটন.. তুই এখানে? আমি কোথায়? (অর্ন)
– তুমি, হাসপাতালে আছো। পুলিশ নিয়ে আসছে। এখন কেমন আছো? (অবনি)
অর্ন অবনির কথা শুনে চমকে গেলো। নার্সের উদ্দেশ্যে বলে “আমাকে একটু উঠাবেন? আমি হেলান দিয়ে বসবো।” নার্স সাবধানতার সাথে অর্নকে বসালো। সবাইকে দেখতে পায় অর্ন। সবার সাথে কথা বলে নিল। আরিনা বেগম এসে অর্নের কপালে চুমু দিলেন। সবাই অর্নকে পেয়ে যেন খুশি হয়েছে। বেশ কিছু সময় অর্নের সাথে টুকটাক সবাই কথা বলে। কিন্তু অর্ন এখনো অবনির সাথে কথা বলেনি। ডাক্তার এসে জানালো.. “উনি এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ নন। আপনারা ভীড় করলে, সমস্যা আছে। আপনারা একজন করে দেখতে আসুন।”
ডাক্তারের কথা শুনে আরিনা বেগম বলে “সবাই তো অর্নকে দেখলে। চলো সবাই বাহিরে থাকি। অনেক কাজ আছে। অবনি থাকুক এখানে। ওদের একটু আলাদা কথা বলার প্রয়োজন আছে।” আরিনা বেগমের কথা শুনে সবাই রুম থেকে বের হলো। অবনি একা রুমে বসে আছে। অর্নের সামনে, টুলের উপর বসা সে। অবনি কোনো কথা বলছে না। একাধারে কেঁদেই যাচ্ছে। অর্ন চুপচাপ অবনির কান্না দেখছে। কাঁদলেও যে মানুষের সুন্দর দেখায় হয়ত অর্নের এর আগে দেখার চোখ ছিল না। অর্ন বেশ কিছু সময় পর বলে..
– সরি… (অর্ন)
– সরি? সরি কেনো বলছো? (অবনি)
– তোদের মাঝে ফিরে এলাম। আমি আসলেই চাইনি এমনটা। একবারে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। বাট হলো না। সরি..(অর্ন)
– চুপ করো তো তুমি? এত বেশি কেনো বোঝো? আর আমাকে তুই করে কেনো বলছো? (অবনি)
– হিহিহি… তুই তো আমার কাজিন। আর তুমি বলার জন্য আমার কাছে একটা সুনির্ধারিত সম্পর্কের প্রয়োজন। যেটা নেই। (অর্ন)
– হা কাজিন। সাথে তোমার বউও আমি। বেশি বোঝে। (অবনি)
– হুম, বুঝি বলেই তো সবাইকে মুক্তি দিতে চাইছিলাম। (অর্ন)
– কিসের মুক্তি হ্যা? কি ভাবোটা কি আমাকে? এত সহজে ভালোবাসা শেষ হয়ে যাবে? নিজেকে বড্ড মহৎ ভাবো তাইনা? ঐ তুমি দেখেছো আমি কখনো সিফাতকে ভালোবাসি বলেছি? আজাইরা চিন্তা ভাবনা করো খালি। (অবনি)
– সবকিছু মুখে বলতে নেই। বোঝা যাই। (অর্ন)
– সেটাই তো, বেশি বোঝো।
অবনিকে রাগতে দেখে অর্নের বেশ হাসি পাচ্ছে। হাসিটা ভালোবাসার। তাচ্ছিল্যের নয়। কিন্তু অবনি কেনো রাগছে? অর্ন রাগের মানে খোজার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু যুক্তিগত কোনো কারণও পাচ্ছে না অর্ন। অবনি আবার কাঁদতে কাঁদতে বলে..
– আমি তোমাকে জেলাস ফিল করানোর জন্য সিফাতের সাথে মিশেছিলাম। ইরার কথা শুনে আমার যেমন রাগ হতো, তেমনি তোমাকে ইগ্নোর করে সিফাতের সাথে মিশে রাগ ওঠানোর চেষ্টা করেছি। আর রইল সিফাতের কথা.. সে আর খালামনি মানে তোমার মা প্ল্যান করেই আমার সাথে মিশিয়েছে সিফাতকে। যেন আমার মাঝে তোমার প্রতি অনূভূতিটা কেমন, আর আদৌ আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য সিফাতকে পাঠায়।
সত্য বলতে আমি একটা সময় ভাবছিলাম তোমাকে ছেঁড়ে সিফাতের সাথে থাকবো। কিন্তু তোমার কল্পনা আমি কখনো মাথা থেকে ফেলতে পারিনি। সবসময় তুমি আমার ভাবনাতে এসে ভিড় জমিয়েছো। তোমাকে ইগ্নোরেন্স দেখাতে গিয়ে নিজেই আরো তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। সিফাতেন কথা যতটুকু মনে পড়েছে, তার থেকে শতগুন তোমার কথা মনে পড়েছে আমার। বিশ্বাস করতে হবেনা আমাকে। তবে তুমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে, তা খুবিই জঘন্য। (অবনি)
– হুম ভাইয়া.. অবনি তোমাকে ভালোবাসে। শুনলাম তিনি রক্তও দিয়েছে। সারারাত ঘুমায়নি। দেখো সকাল দশটাই তুমি চোখ খুলেছো। অবনি ঘুমায়নি একটুও। সারারাত কেঁদেছে। সব শুনে বুঝলাম তুমি একটা বোকাসোকা লোক। মেয়েদের মন বোঝার মত তোমার ক্ষমতা নেই। (ছোটন)
– এহ, তুই খুব বুঝিস? আর এখানে কি তোর? যা বাইরে যা। (অর্ন)
– ওকে বস। এখন তো তোমাদের সময়। হয়ে গেলো ডাক দিও। (ছোটন)
– ফাজিল। (অর্ন)
ছোটন রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অর্ন আর অবনি মুচকি হাসছে। অবনির দিকে তাকালো অর্ন। কালো মেয়েটার মুখে এত মায়া জড়িয়ে আছে। সে মায়াতে কেবল একজনের জন্য আকাশ বিশাল ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। আসলে সত্য বলতে কিছু মানুষ বা কালো মানুষ আছে যারা ভালোবাসে, একজনেই পৃৃথিবীর সমান ভালোবাসে। সেই ভালোবাসা কেবল তার জন্যই জমা থাকে সবসময়। কালো ছেলে বা কালো মেয়ে সঙ্গী পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। আবার অগাধ ভালোবাসা পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার।
– তুই আমাকে কষ্ট দিয়েছিস। (অর্ন)
– এখনো তুই করে বলছো? আর আমি কষ্ট দিছি? তুমি দাওনি আমাকে? (অবনি)
– আচ্ছা, কষ্ট বিয়োগ কষ্ট। কাটাকাটি। (অর্ন)
– তুমি কেনো এমন করলা? যদি সত্যিই মরে যেতা? কি হতো আমার? (অবনি)
– কি আর হতো, সিফাতকে নিয়ে থাকতা। (অর্ন)
– কখনো ওর প্রতি ভালোবাসা আসতো না। আর তুমি বারবার সিফাতকে কেনো টানছো। আজব.. ইরার কথা বলেছি একবারো?(অবনি)
– তুমি কেন ইরার কথা তুলেছো? আজব.. (অর্ন)
– এই তুমি আগে সিফাতের কথা বলেছো। (অবনি)
– তুমি ইরার কথা বলেছো। (অর্ন)
– উফ… তুমি এমন ঝগড়াটে ছিলা না তো। ইরা কি ঝগড়া শিখিয়েছে তোমার? (অবনি)
– আবার ইরার কথা? তুমি তো আগে এত কথা বলতে না। সিফাত কি কথা শিখিয়ে তোমার? (অর্ন)
– আরে… কিসের সিফাত? চুপ করো তো। (অবনি)
– হু…
দুজনে রাগি দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকায়। কিছু সময় তাকিয়ে থেকে দুজনেই হেঁসে ওঠে। অবনি আরো অর্নের দিকে এগিয়ে গেলো। ভাঙা হাত একটু মেলে দিতেই অবনি অর্নের বুকে মাথা রাখলো। অর্ন অবনিকে জড়িয়ে ধরে। অবনি কাঁদতে কাঁদতে বলে..
– তোমার বন্ধুগুলো ভালো না। দেখো, তোমাকে একবারো দেখতে আসেনি। (অবনি)
– ওদের আর প্রয়োজন নেই। তুমি আছো তো আমার পাশে। (অর্ন)
– হুম, আমি আছি সবসময়। তোমাকে হারাতে দেবো না একদমই। (অবনি)
– আমিও না। বাচ্চা কাচ্চা নিতে হবে তো, হারিয়ে আর কি করবো? (অর্ন)
– ফাজিল… হাত পা, মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছে। এখন বাচ্চার চিন্তা শুরু করে দিয়েছে। (অবনি)
– বুঝবানা এসব। (অর্ন)
– চুপ, বকো কেন এত? এই প্রথম তোমার বুকে মাথা রাখছি। আহ কি শান্তি। (অবনি)
অর্ন আর কিছু বললো না। সে অবনিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিল। আসলেই প্রিয় মানুষদের বুকে মাথা রাখার যে শান্তি, সেটা কেবল যার আছে, সেই জানে। সবার ভালোবাসার পূর্ণতা পাক। এখন অর্নকে অবনি সেবা, ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করে তুলবে। অর্নও এখন অবনিকে নিজের প্রিয় মানুষ হিসেবে গ্রহন করে নিয়েছে। ওদের ভালোবাসা ভালো থাকুক। সবার ভালোবাসা এভাবেই ভালো থাকুক।
——<সমাপ্ত>—–