প্রণয় পাড়ে সন্ধি পর্ব-১০

0
341

#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ১০|
লাবিবা ওয়াহিদ

নোমান সাহেব ফেরার সময় ছানার সন্দেশ এবং দই এনেছেন। আগামীকাল শতাব্দদের পুরো পরিবারের দাওয়াত এ-বাড়ি। এ নিয়ে টুকটাক কাজে ব্যস্ত সাবরিনা। সকালের নাস্তা শতাব্দ’রা এ-বাড়িতেই করবে। বিকাল পর্যন্ত তারা থাকবে। এমনটাই জানিয়েছেন নোমান সাহেব। এরকম দাওয়াত তাদের দু’পরিবারের মাঝে নতুন কিছু নয়। নির্দিষ্ট কোনো উপলক্ষ্য ছাড়াই দাওয়াত আদান-প্রদান হয়।

সব-ই ঠিক আছে, তবে কালকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে। টিনেজ কিংবা ইয়ং জেনারেশনের মধ্যে এই দিনটা নিয়ে বেশ উত্তেজনা দেখা যায়। এই প্রথমবারের মতো নম্রের মধ্যেও সেই উত্তেজনার কিছুটা লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। কাল ভ্যালেন্টাইন এবং কাল-ই শতাব্দ’রা দাওয়াতে তাদের বাড়ি আসবে। ভেতরটা কেমন অনুভূতিতে নেতিয়ে পড়ছে। নম্র মনে মনে ভেবে নিয়েছে আগামীকাল সেও এক পদ রাঁধবে৷ লবণের ব্যাপারটা নাহয় মা-ই ঠিক করে নিবে। সমস্যা কী!

এই লবণ নিয়ে নম্র আরেকবার বিপদে পড়েছে। শতাব্দের জন্যে সে চপ বানিয়েছিল। শতাব্দ ঝাল খেতে পছন্দ করে। সেটা নম্র বেশ ভালো করেই জানে। এজন্য সখ করে চিকেনের চপ করেছিল। সেদিন সাবরিনা বাড়ি ছিল না। যার ফলস্বরূপ নম্র-ই রান্নার দায়িত্ব নিয়েছিল। মনে মনে পণ করেছিল এবার লবণ ঠিক রাখবে। সবই ঠিক ভাবে হলো, সুন্দর ভাবে পরিবেশনও করল। নম্র চলে আসে। কিন্তু কেমন হয়েছে জানার জন্যে মনে খুঁতখুঁত লেগেই ছিল। তাই বেশি অপেক্ষা না করে মিনিট দশেকের মাথায়-ই শতাব্দের কাছে গেল। নিঝুম তখন কিছু লেখায় ব্যস্ত! নম্রের উপস্থিতি টের পেয়ে শতাব্দ তাকাতেই নম্র থমকে দাঁড়াল। শতাব্দের চাহনি হৃদপিন্ডে গিয়ে বিঁধেছিল যেন। নম্র আমতা আমতা করে বলল,
–“চপটা ঠিক ছিল তো?”

শতাব্দ এবার কিছুটা সময় নিল নিঝুমের দিকে তাকিয়ে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“ঠিক থাকত, যদি না লবণটা স্বাদমতো দেওয়া হত! এবার লবণটা বেশি হয়ে গেছে!”

শেষ! আবারও সেই লবণ-ই তার মুখে ঝামা ঘঁষে দিল। শতাব্দের এরূপ কথায় নিঝুম বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে রাখে কিছুক্ষণ। পরে না পেরে শতাব্দের সামনেই শব্দ করে হেসে দেয়। শতাব্দ তখন নিঝুমকে থামিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু শতাব্দ যেতেই সেই হাসি ঘুমানোর আগ অবধি কারণে, অকারণে চলতে লাগল। নম্র ক্ষেপে গিয়ে কয়েক ঘা নিঝুমের পিঠে বসিয়ে দিলেও বিশেষ লাভ হয়নি। সে বারবার শতাব্দের বলা কথাটা রিপিট করে মজা নিয়েছে। তখন নম্র রেগে তার ফোনের পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করেছে, সঙ্গে মায়ের ফোন থেকে সব ধরণের অনলাইন, অফলাইন গেম ডিলিট করে ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড ফরগেট চেপে দিয়েছে। ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড নিঝুম জানত না। তাই সেবার বেশ ভালো ভাবেই জব্দ করা গেছিল নিঝুমকে। কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে যেই সম্মানহানি তার হচ্ছে, সেটা কিছুতেই নম্র হজম করতে পারছে না। শতাব্দ এমন কেন? একটু মিথ্যে প্রসংশা করলে কী এমন ক্ষতি হয়? সব সত্যি বুলেটের মতো করে প্রকাশ করা কী জরুরি? শতাব্দ যখন নম্রকে কিছু বলে তখন নম্রের মনে হয় শতাব্দ তার গায়ে কাঁটা ফুটাচ্ছে। সে কী এক যন্ত্রণা! এমন ঠোঁটকাঁটা মানুষ নম্র তার বাইশ বছরের জীবনে কখনোই দেখেনি।

চাপা উত্তেজনায় রাতে নম্র দেরী করে ঘুমালো। তবে উঠতে হলো সকাল সকাল-ই! সাবরিনা ডেকে দিয়েছেন নম্রকে। মেহমান আসার আগে ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করারও ব্যাপার আছে। নম্র চোখ কচলে উঠে বসতেই তার মাথায় এলো আজ অতিথি আসবে। অতিথি তারই প্রাণ-পুরুষ। নম্র চটজলদি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। অতঃপর দ্রুত হাতে ঘর গোছানোর কাজে লেগে পড়ল। এমনিতে তাদের ঘর অগোছালো থাকে না। বেশ গোছালোই। তবুও হালকা-পাতলা ঝাড় দিয়ে ধুলো-বালি ছাড়ল। অতঃপর বাদ-বাকী গোছানো শেষে মায়ের কাছে চলে এলো রান্নাতে সাহায্য করতে।

শতাব্দ’রা স্ব-পরিবারে আসল সকাল ন’টা নাগাদ। তাদের সাথে আনিশা এবং দীপালি বেগমও রয়েছে। আনিশা শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে সপ্তাহখানেক হলো। এবার একদম নতুন অতিথি নিয়েই শ্বশুরবাড়িতে ফিরবে। দীপালি বেগমের হাঁটুর শক্তি কমে এলেও এতটা কমেনি যে হাঁটতে পারে না। তবে এখন একটু হাঁটলে হাঁপিয়ে যায়, যা এই বয়সে তার জন্যে স্বাভাবিক।

দুই পরিবার মিলেমিশে নাস্তা সেরে নিলো। শতাব্দ’রা আসার আগেই নম্র নিঝুমকে তুলে নাস্তা করিয়ে দিয়েছিল। দশটার দিকে চঞ্চল এবং তার বাবা-মা এলো। নোমান সাহেব তার ছোটো ভাই নাফিজকেও দাওয়াত করেছে। একই বিল্ডিং-এ পাশাপাশি দুই ফ্ল্যাটে থাকলেও কাজের ব্যস্ততায় সেভাবে দুই ভাই মিলে বসতে পারে না। এজন্যে ছুটির দিনটাই ভরসা।

চঞ্চল তার ছুটি কাটাতে মায়ের সাথে নানুবাড়ি ছিল প্রায় দেড় মাসের মতো। ফিরেছে কিছুদিন হলো। আসার পর থেকেই ঠান্ডা পরিবেশ গরম করে রেখেছে সে। শতাব্দ সোফার এক কোণায় বসে ফোন দেখছিল। এমন সময় চঞ্চল শতাব্দের পাশে বসে ফোনে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। মিনমিন করে বলল,
–“তুমি ওই বেকারীর ভাইয়াটা না?”

শতাব্দ চোখ তুলে তাকাল চঞ্চলের দিকে। চঞ্চল ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। শতাব্দ হালকা গলা খাকারি দিয়ে বলল, “হুম!”
–“আপুর সাথে তোমার কী ইটিসপিটিস চলে?”

শতাব্দের কাশি উঠে গেল। শতাব্দের কাশি শুনে নোমান সাহেব শতাব্দের কাশি শুনে বিচলিত হয়ে ডাকল সাবরিনাকে পানির জন্যে৷ শতাব্দ নিজেকে সামলে নোমান সাহেবকে থামালো। এবং জানালো সে ঠিক আছে। চঞ্চল তখনো সন্দিহান চোখে চেয়ে আছে শতাব্দের দিকে। শতাব্দ চঞ্চলের দিকে চেয়ে বলল,
–“এসব উলটোপালটা কথা কে ঢুকিয়েছে মাথায়?”
–“কেউ ঢুকাতে যাবে কেন? আমার বন্ধুই তো ইটিসপিটিস করে বি শাখার রোল একের সাথে। আমি দেখি তো!”

শতাব্দের চোখে বিস্ময়। আজকালকার বাচ্চারা এত আপডেট? শতাব্দ কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না। চঞ্চল আবারও বলল,
–“আজ নাকি ইটিসপিটিস দিবস। এই দিনে ফুল দেয় মেয়েদের। তুমি আপুকে দিবা নাকি? আমি কিন্তু ফুল দিতে দিব না।”
–“ফুল পাব কই যে দিব?”
–“আমাদের স্কুলের সামনে সাত-ই ফেব্রুয়ারি থেকে রোজ গোলাপ ফুল নিয়ে একটা ভাইয়া বসে। তার থেকেও নিতে পারো!”
–“ফুল দিতে দিবা না আবার ফুল কোথা থেকে নিব সেটাও বলে দাও। বাহ!”

চঞ্চল এই কঠিন কথাটার অর্থ বুঝল না। মাথা চুলকাল সে। কথাটা যে বুঝেনি সেটাও শতাব্দকে বলল না। সে সরে আসল শতাব্দের সামনে থেকে। তারপর খুঁজে খুঁজে নিঝুমকে বের করল। নিঝুমকে বলল,
–“জানো, সোফার কোণায় বসে থাকা ভাইয়াটা নম্র আপুকে গোলাপ ফুল দিবে। ওটা কী আমি জেঠুকে বলে দিব?”

নিঝুম আঁতকে উঠে চঞ্চলের দিকে তাকায়। কথাগুলো প্রথমে মাথার উপর দিয়ে গেলেও পরমুহূর্তে চঞ্চলকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
–“কী যে বলিস না চঞ্চল! ফুল দেওয়ার কথা বড়োদের বললে তোর পিঠের ছাল-ই তুলে নিবে। তাই তাদের এসব কিছু বলিস না। কিন্তু ঘটনা কী সত্যি?”
–“সত্যি! আমি নম্র আপুর কাছে যাই!”

নম্র রান্নাঘরে কাজ করছিল। সাবরিনা চা দিতে গেছিল সবাইকে। চঞ্চল বড়ো মানুষের মতো রান্নাঘরে ঢুকল। ডাকল নম্রকে। নম্র আড়চোখে চঞ্চলের দিকে চেয়ে বলল,
–“যা বলার তাড়াতাড়ি বল! তারপর চলে যা। খামাখা কাজের মধ্যে জ্বালাবি না!”
–“আজকে না ইটিসপিটিস দিবস আপু। ভাইয়া তোমাকে ফুল দেয়নি?”

নম্রের হাত না চাইতেও থেমে গেল। অবাক হয়ে বলল,
–“কোন ভাইয়া?”
–“ওই যে, বার্গারের দোকান যেই ভাইয়ার। ভাইয়া নাকি তোমাকে ফুল দিবে। আমি মানা করলাম, তাও নাকি তোমাকে দিবেই!”

নম্রের বুঝতে বাকি রইলো না চঞ্চল তার স্বভাবতই আজেবাজে বকছে। তবে নম্রের রাগ অন্য ব্যাপারে গিয়ে লাগল। সে চট করে এক চড় বসিয়ে দিল চঞ্চলের গালে। চঞ্চল অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চেঁচিয়ে বলল,
–“মারলে কেন?”
নম্র রান্নাতে মনোযোগ দিয়ে বলল,
–“অল্প বয়সে পাকনা কথা বলার শাস্তি ছিল। আবার যদি এই ধরণের কথা-বার্তা তোর মুখে শুনি তখন আমি নই, বড়ো’রা তোর পিঠের ছাল তুলে দিবে!”

চঞ্চল এবার কিছুটা ভয় পেল। শুকনো ঢোঁক গিলে দ্রুত কেটে পড়ল। ভাব করল এমন, সে অবুঝ একজন বাচ্চা। চঞ্চল চলে যেতেই নম্রের মাথাতে এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো, শতাব্দ কী তাকে আসলেই ফুল দিবে? পরমুহূর্তেই নিজের বোকা ভাবনায় নিজেরই বিরক্ত লাগল। এই চঞ্চলটাও না! কাজের সময়ে বাজে বকে তার মাথাটা আউলে দিয়ে গেছে।

চঞ্চল সারাদিনে কারো কাছে এই ব্যাপার নিয়ে কথা না বললেও শতাব্দের মাথা পুরোই খেয়ে ফেলল। একটু পরপরই সে জিজ্ঞেস করেছে,
“আপুর ফুল কিনেছ?”
“আচ্ছা যাও, ফুল দেওয়ার পারমিশন দিচ্ছি।” “কখন দিবে ফুল? আমি ভিডিও করে দিব।”
“এই ইটিসপিটিস দিনে ফুল দেওয়া কী বাধ্যতামূলক?”
“ফুল দিয়ে আপুকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছ না কেন?”
“খবরদার ঘুরতে যাওয়া চলবে না। আপুকে তোমার সাথে দিব না!”
“গোলাপ ফুলে যদি কাঁটা থাকে? সেদিন শুনেছি বি শাখার মেয়েটার হাতে গোলাপের কাঁটা ঢুকে গেছে। সে যে কী কান্না! আপুও তো কান্না করবে।”
“আপুকে কী ফুলের সাথে বার্গারও দিবা?”

মানে বাচ্চা মানুষের যত আগ্রহ। শতাব্দ ভুলভাল উত্তর দিলেও চঞ্চলকে নিজের কাছ থেকে সরাতে পারেনি। লাঞ্চের পরপর নম্র তার বারান্দাতে যেতেই চমকে গেল। শতাব্দ দাঁড়িয়ে আছে। শতাব্দ নম্রের উপস্থিতি বুঝতে পেরে নম্রের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। নম্র শতাব্দকে একা রেখে চলে যেতে নিতেই শতাব্দ বলে উঠল,
–“তোমার ছোটো ভাইটা তো কথা দিয়েই তোমার আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে!”

নম্রের পা থমকে গেল এ কথা শুনে। পিছে ফিরে হতবাক হয়ে তাকাল। শতাব্দের নজর তখনো নম্রের দিকেই। নম্র বলল,
–“মানে?”
–“চঞ্চলের কথায় তো তা-ই বোঝা যাচ্ছে। বিয়ে দিয়ে দিবে নাকি? তুমি করবে?”

নম্রের গলায় কথা আটকে গেল। সঙ্গে চঞ্চলের উপর চরম রাগ হলো। নম্র এই মুহূর্তে হাতের কাছে চঞ্চলকে পেলে কী করত সে নিজেও জানে না। রেগে চঞ্চলকে ডাকতে নিতেই শতাব্দ থামিয়ে দিয়ে বলল,
–“বারান্দায় এসে দাঁড়াও। বকে কাজ নেই!”

নম্র কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলল,
–“স্যরি। চঞ্চলটা তার নামের মতোই। মাথায় কখন কী যে চাপে, বোঝা দায়!”
শতাব্দ চুপ থাকল। কিছু একটা ভেবে বলল,
–“ভ্যালেন্টানে কখনো ফুল পেয়েছ?”
–“না!”
–“আমি পেয়েছি।”
নম্র ঘাড় বাঁকিয়ে চাইল শতাব্দের দিকে। ভেতরটা হঠাৎ কেমন অস্থির হয়ে গেল। কে দিল শতাব্দকে ফুল? কোন মেয়ের এত স্পর্ধা শতাব্দকে ফুল দেয়? নম্র তো শতাব্দের সাথে ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না। নম্র অল্প করে বলল,
–“আজকাল মেয়েদের এত সাহসও বেড়েছে?”
–“হুঁ। তবে বাইরের মানুষদের এত সাহস আমার সেরকম পছন্দ না। তাই ফুলটা আমার বন্ধুর কপালেই জুটেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখন সেই মেয়েটাই আমার বন্ধুর বউ!”

নম্রের হাসি পেল। মুহূর্তে-ই ফুরফুরে হয়ে গেল মন। নম্র বলল,
–“দারুণ!”
–“কী দারুণ? আমার তোমার বিয়ের ব্যাপারটা নাকি সেই মেয়েটা বন্ধুর বউ হওয়াটা?”

~[ক্রমশ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে