প্রণয় কাব্য পর্ব-২০

0
779

#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি

২০.
শুক্রবার বিকেল। সূর্য ডুবু ডুবু। রক্তিম রঙ ধারণ করেছে আকাশ। পুতুল ওর জানালার পাশে বসে থেকেই এই সুন্দর দৃশ্য দেখছে। শিউলি উঠানে মাদুর পেতে কাঁথা সেলাই করছে। এভাবে বশে থাকতে পুতুলের ভালো লাগছে না। আজকাল তার কিছুই ভালো লাগে না। সব কিছুতেই কেমন বিতৃষ্ণা লাগে। টেবিলে থাকা মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে তিহানের নম্বর ডায়াল করে। ওপাশ থেকে খুব সুন্দর করে এক রমণী জানালেন আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন তা এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। অনু…
পুতুল কল কেটে দিলো। এই পাঁচ দিনে সে শতখানেক বার তিহানকে কল করেছে। প্রত্যেকবারের ফলালফল একই। পুতুল তপ্ত শ্বাস ফেলে আকাশ পানে তাকায়। অনুযোগ করে বলে,
‘সব খারাপ কেন শুধু আমার সাথেই ঘটে? সবাই কেন আমায় ছেড়ে যায়? তারা আমায় ভালোবাসে না তাই নাকি আমিই তাদের যোগ্য নই?’
গলা ধরে আসে ওর। এটুকু জীবনে সে কম ঝড়ের মুখমুখি হয়নি। সে এবার সত্যিই ক্লান্ত। বিশ্রাম চাই তার!
.
.
সন্ধ্যার আজান পড়েছে। শিউলি কেবল নামাজ শেষ করে চুলায় চায়ের হাড়ি চাপিয়েছে। সন্ধ্যার নাস্তায় চা না হলে চলে না তার। বাহিরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। পুতুলকে ডেকে বাহিরের বাতি জ্বালিয়ে দিতে বললো শিউলি। শিউলি কিছুদিন ধরে পুতুলের আচরণ লক্ষ্য করছে। কেমন শান্ত হয়ে গেছে মেয়েটা। এই পরিবর্তন শিউলিকে ভাবায়। চিন্তায় কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পরে।

কথায় আছে সাময়িক কষ্ট অগাধ সুখ বয়ে আনে। ঠিক তেমনটাই ঘটলো পুতুলের জীবনে। হুট করেই সব কিছু বদলে গেলো যেন। এই তো খানিক খনের আগের কথা। সন্ধ্যার নাস্তা শেষে পুতুল বই খুলে বসেছে। ওপাশে শিউলি কাপড় গুছিয়ে রাখছে। এমন সময় বাহির থেকে জমিদার বাড়ির বড় বউ রেণুর কন্ঠ শোনা গেল। অবাক হলেও পুতুল বই রেখে দৌড়ে বের হয়। তার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। একমাত্র তিহানের বাবা অর্থাৎ তারিম বাদে সকলে তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। পুতুলের বুক কেমন করে উঠলো। সবাই এ সময়ে এখানে কেন? তিহানের দিকে চোখ পড়তেই সে মুচকি হাসলো। পুতুলের মন শান্ত হলো। বুকে তেড়ে ওঠা ঝড় শান্ত হলো। রেণু হেসে বললো,

‘কিরে ভিতরে ডাকবি না? নাকি এখানেই দাড় করিয়ে রাখবি?’

পুতুল লজ্জা পেল। আড়ষ্ঠ হয়ে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। ঠোঁটে হাসি টেনে বললো,

‘তা কেন? ভেতরে আসেন। আপনি না আসতে চাইলে আমি ধরে বেঁধে নিয়ে আসবো।’

পুতুলের কথায় উজ্জ্বল হাসলো রেণু। একে একে সবাই ভেতরে গেলে বাদ থাকল কেবল তিহান। পুতুল একবার সেদিকে তাকিয়ে ভেতরে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে তিহান বলে উঠলো,

‘তুই কি আমাকে চলে যেতে বলছিস?’

‘আপনাকে আলাদা করে আমন্ত্রণ করতে হবে?’

পুতুলের কন্ঠে রাগ। তিহান বুঝলো। মনে মনে হাসলো।

‘স্পেশাল মানুষদের জন্য সব কিছু স্পেশাল হতে হয় বুঝলি! আমার জন্য এটুকু করতে পারবি না?’

পুতুল সরাসরি জবাব দিলো,

‘না। এলে আসেন নয়তো যেখানে খুশি যেতে পারেন। যেমনটা এতদিন ছিলেন।’

পুতুল ভেতরে চলে গেল। তিহান সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে তো পুতুলকে প্রাপ্তির আনন্দটা তার মতো করে উপভোগ করাতে চেয়েছে। চেয়ে সাথে সাথেই পেয়ে যাওয়া জিনিসগুলোর কদর করতে জানেনা মানুষ। পুতুলকে সে উপলব্ধি করাতে চেয়েছিল তিহান তার জীবনে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
আজ আকাশে চাঁদ উঠেছে। বেশ বড় চাঁদ। তিহান সেদিকে দেখে সিগারেট ধরালো। তারিম আজ ঢাকা গেছেন। কোনো কাজ ছাড়াই গেছেন। হয়তো ছেলের উপর অভিমান করেই এই পদক্ষেপ! তিহান ফোন বের করে তারিমের নম্বরটা খুঁজে বের করলো। তার ফোন থেকে ঠিক দুবছর আগে এই নম্বর থেকে লাস্ট কল এসেছিল। তিহান কল করলো। কোনো কারণ ছাড়াই তার বুক কেমন করে উঠলো। এই প্রথম সে তার বাবাকে নিজ থেকে কল দিয়েছে। কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি। একবার বাজতেই কল রিসিভ হলো। রিসাভ হওয়ার দু প্রান্তেই নিরবতা চললো। হয়তো দুজনের কেউই তাদের জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারছে না! নীরবতা কাটিয়ে তিহান প্রথম কথা বলে উঠলো,

‘বাবা!’

তারিম হয়তো একটু চমকে উঠলো। তার চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। এই প্রথম হয়তো তিহান তাকে এত সুন্দর করে ডাকল। যে ডাকে ছিলনা অভিমান, অভিযোগ কিংবা ঘৃণা। তারিম জবাব দিতে পারলো না। জবাব দিলেই যে তার এই কান্ন জরিত কথা ছেলে বুঝে ফেলবে! তিহান হয়তো তার পরিস্থিতি বুঝলো। নিজ থেকেই বললো,

‘বাবা কাল ফিরে আসুন। এতদিন তো আপনি সব সামলেছেন এখন থেকে নাহয় আপনার ছেলে সবটা সামলালো! আপনার আপন প্রত্যেকটা মানুষ আপনাকে মিস করছে বাবা! আমিও করছি! আমরা পুতুলকে দেখতে এসেছি। ওকে আমি এর আগেও দেখেছি বহুবার। তবুও আমি এক্সাইটেড বাবা! ভিষণ রকম ভালো লাগছে। আপনি থাকলে আরো ভালো লাগত।’

তিহান থামলো। তার চোখের কর্ণিশ ঘেঁষে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। এতদিন বাদে বাবার সাথে এভাবে কথা বলতে পেরে তার নিজেকে হালকা লাগছে। তিহান আবারো বলতে শুরু করলো,

‘আমাদের পারিবারিক একটা ট্যুর প্লান করলে কেমন হয়? মো তো সবসময় একা থাকে। ব্যস্ততার কারণে আপনার ও কখনো ঘোরার হময় হয়নি। আপনারা দুজন নাহয় কিছুটা সময় কাটালেন! সকাল, দুপুর আর রাত তিন বেলায় পুরো পরিবার মিলে একত্রে খাওয়া দাওয়া হবে। সেখানে কিন্তু কোনো রুলস চলবে না!’

ওপাশ থেকে তারিম ছেলের কথায় হাসছেন। হাসি চাপিয়ে গম্ভীর গলায় শুধালেন,

‘তুমি কথা বলতে বলতে হয়তো ভুলেই বসেছো আমি তোমার বাবা! বাবা মায়ের প্রেমগুরু কে হতে বলেছে তোমাকে? নির্লজ্জ ছেলে! বিয়ে করছো বলে কি লজ্জার মাথা খেয়ে ফেলেছ?’

তিহান হেসে ফেললো। আকাশ দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস ফেলল। বাবা ছেলের এতদিনের অমিলতা তবে দূর হলো!
_______________

পুতুল নিজের রুমে বসে হাঁসফাঁস করছে। ঘনঘন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। তার বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে আছে পাঁচ ছয়টা শাড়ি।কোনটা পড়লে ভালো হবে ভেবে পাচ্ছে না সে। ওদিকে শিউলি দু মিনিট পরপর এসে তাড়া দিচ্ছে। পুতুল অনেক ভেবে চিন্তে হালকা সবুজ রঙের শাড়িটা পড়ার সিদ্ধান্ত নিল। মায়ের শাড়ি গুলোর মধ্যে এই শাড়িটা সে কখনোই পড়েনি‌। কিন্তু বিপত্তি বাদল ব্লাউজ নিয়ে। তার যে ব্লাউজ নেই! ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি কিভাবে পড়বে? মুহূর্তেই মুখ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ঠিক তখনি তার জানালায় টোকা পড়লো। ফিসফিস করে তিহান পুতুলকে ডাকছে। পুতুল সেদিন তাকিয়ে ভ্রুকুচু করলো। এই লোক এখানে কি করছে? জানালা খুলতেই তিহান বিরক্ত হয়ে বললো,

‘সামান্য জানালা খুলতে এত সময় লাগে?’

‘এত রাতে একটা মেয়ের ঘরের জানালায় নক করতে লজ্জা করে না? হ্যারাস করার জন্য আপনাকে কারাদন্ড প্রদান করা দরকার’

তিহান বোকার মতো তাকায়ে থাকলো। অবাক হয়ে বললো,

‘আমি তোকে হ্যারাস করছি?’

পুতুল মাতা উপর নিচ করে হ্যা জানালো। তিহান জানালা থেকে সরে দাঁড়িয়ে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিল। মুখে বাঁকা হেসে বললো,

‘আজকের মতো যা বলার বলে নে! বউ হলে তো আর হ্যারাস করার জন্য মামলা করতে পারবি না!’

পুতুল মুখ বাঁকিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো। প্যাকেট খুলতেই সেখানে হালকা মেরুণ রঙের সুন্দর জামদানি শাড়ি নজরে পড়লো। পুতুল মুচকি হাসলো। লোকটার পছন্দের তারিফ করা দরকার। শাড়ির প্যাকেট ছাড়া সেখানে আরো একটা প্যাকেট আছে। সেটা খুলতেই ব্লাউজ আর পেটিকোট দেখা গেলো। পুতুলের ঠোঁট ছুঁয়ে গেলো মিষ্টি হাসির রেখা। লোকটা বেশ বুঝমান ও!

চলবে………

(ভুল ত্রুটি মার্জনা করিবেন। ধন্যবাদ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে