#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৬.
বারোটার দিকে সাগর ফিরলো হাতে দু ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে। শীতকালীন প্রায় সকল ধরণের সবজি সে নিয়ে এসেছে। সাথে এনেছে বড় পাঙ্গাশ। শিউলি ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বড় করে হেসে বলতে থাকলো,
‘এগুলি কেন আনছ বাপ! এতকিছুর তো দরকার ছিল না। ঘরে উইঠে বসো। পুতুল সাগর বাবারে পানি চা-বিস্কুট দে। সেই সক্কাল বেলায় বের হইছে।’
সাগর চওড়া হাসলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘এত ব্যস্ত হবেন না। আমি বাজার থেকে চা খেয়ে এসেছি।’
‘তাইলে রুটি ঝোল দেই? চা তে কি আর ওত বড় মানুষের প্যাট ভরে? পুতুল? এদিক আয় তো মা!’
শিউলি নিজেই এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। সাগর পুতুলের রুমের দিকে তাকিয়ে রইল। উঠান থেকে পুতুলের রুমটা সরাসরি দেখা যায়। জানালা খোলা। পুতুল জানালার পাশের চেয়ারটিতে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। কি করছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে খোলা চুলে তাকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। শিউলির ডাক তার কান অবদি পৌঁছেছে বলে মনে হলোনা সাগরের। সে কপালদ্বয়ে ভাঁজ ফেলে বোঝার চেষ্টা করলো। মেয়েটার কি বিয়েতে মত নেই? ততক্ষনে শিউলি সামনের রুমে খাওয়ার আয়োজন করে ফেলেছে। সাগরকে ডাকতেই সে পুতুলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে মুচকি হেসে বললো,
‘বেয়াইন খাবে না? স যে ঘরে আটকে গোমট হয়ে বসে আছে!’
কথাটা সে একটু জোরেই বলেছে যেন পুতুল শুনতে পায়। হোলোও সেটা। পুতুলের সাথে তার চোখাচোখি হয়ে গেল। সাগর পুতুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। জবাবে পুতুল উঠে চলে গেলো জানালার পাশ থেকে। এতে সাগরের অপমান বোধ হওয়ার কথা কিন্তু সে হলো না। বরং তার হাসি পেলো এই ভেবে পুঁচকে একটা মেয়ে আজ তাকে উপেক্ষা করছে! সিরিয়াসলি?
সাগরের খাওয়র ব্যবস্থাটা করা হয়েছে সামনের রুমের খাটের উপর। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে শিউলি আবারো পুতুলকে ডাকল। এবার পুততুল দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। সুন্দর করে তার মাথায় ওড়না টানা। শিউলি দম ছেড়ে বাঁচলো। কেমন একটা অস্বস্তিতে ছিলেন তিনি এতক্ষণ।
‘তুই তাইলে এইদিকটা দেখ। আমি রান্নার দিকে যাই। বেলা কত হইছে দেখছিস!’
শিউলি বড় বড় পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। পুতুল আগের জায়গাতেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সাগর আড় চোখে তাকে পরখ করলো। কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজছে সে। পাশে তাকিয়ে দেখলো পানির গ্লাসটাতেও পানি পূর্ণ করা। এই মুহূর্তে তার শিউলির প্রতি রাগ হলো। এত আনরোম্যান্টিক শ্বাশুড়ি কেন তার?সাগর কেশে উঠলো। পুতুলকে ইশারা করলো পানির জন্য। পুতুল বুদ্ধিমতী মেয়ে। সাগরের চাল সে খুব সহজেই ধরে ফেললো। রিনরিনে গলায় বললো,
‘আপনার কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। এভাবে কাহিনী সাজাতে হবে না। আমি শুনছি, আপনি বলতে থাকেন।’
সাগর লজ্জা পেলো। পুতুলের ঝাঁঝালো কথা তীব্রভাবে তার ব্যক্তিত্বে আঘাত করলো। সাগর সরাসরি পুতুলের চোখে তাকালো। মেয়েটা কঠিন দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে। মেয়েটা কি তাকে খুব বেশি অপছন্দ করে? কোনো ভনিতা ছাড়া সাগর সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘আমাকে পছন্দ করনা এটা আমি জানি কিন্তু কারণ কি?’
পুতুল উত্তর না দিয়ে উল্ট প্রশ্ন করলো তাকে।
‘আমিকে কেন আপনার পছন্দ?’
‘কখন বললাম তোমাকে আমার পছন্দ?’
‘আপনি যেভাবে বুঝলেন আপনাকে আমার পছন্দ না ঠিক সেভাবেই আমিও বুঝলাম।’
সাগর না চাইতেও মুচকি হাসলো। মেয়েটাকে দেখতে খুব সাদামাটা হলেও খুব বুদ্ধিমতী। তেজস্বী ও বটে!
‘আমার কোনো কারণ ছাড়াই তোমাকে পছন্দ। ঠিক কখন থেকে পছন্দ সেটাও আমি জানি না। আমি জাস্ট গোটা তুমিতে মুগ্ধ।’
লোকটা কত সুন্দর করে তার মুদ্ধতা প্রকাশ করলো! তার আর তিহানের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য। তিহান কখনো এমন সুন্দর করে কথা বলে না। মুগ্ধতা প্রকাশ করে না। তবুও তিহান তার চোখে সেরা! কারণ সে তিহানকে পড়তে পারে। তিহানের চোখের ভালোবাসাকে কে সে উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু সাগরের চোখে মুগ্ধতা ছাড়া ভালোবাসা নেই।
‘আপনাকেও আমি কোনো কারণ ছাড়াই অপছন্দ করি সাগর সাহেব। আমি বিয়েটা করতে চাই না। আপনিকি বিয়েটা আটকাতে পারবেন প্লিজ!’
পুতুল একরাশ আশা নিয়ে অপলক তাকিয়ে। সাগর যেন এমন কিছুরই আগাম আভাস পেয়েছিল। এই বয়সটা সে পার করে এসেছে। এই বয়সী ছেলে মেয়েদের চিন্তাধারা তার অজানা নয়। সাগর পুতুলের কথাকে পুরোপুরি অবগ্গা করে বললো,
‘চা হবে? কড়া চাপাতি দিয়ে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা দুধ চা। খুব ভালো হয় যদি তুমি নিজ হাতে বানাও।’
‘আমার উত্তর দিলেন না যে আপনি?’
সাগর ঠোঁট টেনে হাসলো। রুটি ছিঁড়ে ঝোলে মাখাতে মাখাতে বললো,
‘এত ব্যস্ত কেন বেয়াইন? আগে তো চা খাওয়ান! উত্তরটা না হয় তারপরেই দিব!’
সাগরের এমন রহস্য করে কথা বলার ভঙ্গি পছন্দ হলো না পুতুলের। তবে আশা ছাড়লো না সে। ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো। তাকে এভাবে ব্যস্ত হতে দেখে সাগরের মনক্ষুণ্ণ হলো। মেয়টা তার থেকে পালাতে কতটা ব্যস্ত! সে কি খুব বেশি খারাপ? পুতুলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে সাগর বিরবির করে বলল,
‘এই খারাপ লোকটা যদি আরো একটু খারাপ হয় তুমি কি ঘৃণা করবে আমাকে? তোমার সেই ঘৃণা দেখার জন্যও আমার মন অতি আগ্রহে অপেক্ষা করছে পুতুল!’
_____________
ঢাকায় শীতটা গ্রামের তুলনায় বেশ কম। এত জানজটে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তিহান কিছু মাল্টন্যাশনাল কম্পানিতে ছোটখাটো পোস্টে চাকরির জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সাথে সাথে চলছে স্কলারশিপের চেষ্টা ও। বেশ কিছু অ্যক্টিভিটিসের সাথেও জড়াতে হচ্ছে তাকে সার্টিফিকেটর জন্য। সব মিলিয়ে ভিষণ ব্যস্ত সে। এত ব্যস্ততার মাঝেও পুতুল নামের কিশোরী মেয়েটা এক সেকেন্ডের জন্য ও তার মাথা থেকে সরে যায় না। তার ভেইনে ভেইনে ছড়িয়ে গেছে যেন মেয়েটা। দিনের বেলাতে সে শত চেষ্টা করেও কল করতে পারে না। নিজের ব্যস্ততা তো আছেই সাথে পুতুলকে নিয়েও চিন্তা হয়। যদি ওর মা জেনে ফেলে! এই মুহূর্তে তাদের সম্পর্ক গোপন রাখাই শ্রেয়। কিছু সম্পর্ক শেষ অবদি নিতে হলে গোপন রাখাটা জরুরি।
সে আপাতত এ.আর অর্গানাইজেশন এর থার্ড ফ্লোরে ওয়েটিং রুমে বসে আছে। জীবনের প্রথম জব ইন্টারভিউ! না চাইতেও সে কিছুটা নার্ভাস। ফর্মাল পোশাকে তাকে পাক্কা একজন গভমেন্ট অফিসার লাগছে। জবটা কনফার্ম হলে সে আরো একবার পুতুলের সাথে দেখা করে আসবে। পরে সময় সুযোগ নাও হতে পারে। মেয়েটা নিশ্চই কেঁদে কেটে নাক লাল করে ফেলবে শুনলে। মেয়েটাকে কাঁদতে দেখলেও কেন যেন তার প্রশান্তি লাগে। তার প্রেয়সী তার কথা ভেবে কাঁদছে! এটা প্রশান্তি ছাড়া আর কি হতে পারে?
___________
নদীর পাড়ে শো শো শব্দ করে বাতাস বইছে। ঠান্ডা বাতাসে দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে বরংবার। পুতুল গায়ের চাদরটা শক্ত করে চেপে ধরলো। এই শীতে কেউ নদীর পাড়ে আসার মত পাগলামী কিভাবে করে? পুতুল বিরক্ত চোখে সাগরের দিকে চাইলো। সাগর তখন চোখ বুঝে ঘাসের উপর বসে আছে। পুতুল বিরবির করলো,’পাগল লোক।’
ঘাস বৃষ্টির কারণে ভিজে আছে। সাগর চোখ বন্ধ অবস্থায় পুতুলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘অপেক্ষা কিসের বেয়াইন? বসে পড়ুন।’
পুতুল বসলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
‘তোমার মন খারাপ?’
পুতুল জবাব দিলো না। তার মতে পাগল লোকেদের জবাব দেওয়ার থেকে চুপ থাকা শ্রেয়। এই যে লোকটা কনটিনিয়াসলি তাকে আপনি-তুমি করে সম্মোধন করছে এটাও পাগলের লক্ষণ। লোকটা পুরোটাই পাগল। শিক্ষিত পাগল। তার তিহান এমন নয়। সে ভিন্ন। তার কল্পপুরুষ সে। এই লোককে তিহানের সাথে তুলনা করলে তিহান দশে দশ পাবে কিন্তু ইনি পাবে জিরো!
চলবে……
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন। ধন্যবাদ।)