#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
৩.
‘মহারাজা গ্রামে কবে আসলরে?’
আমার কথায় পারুল টিপটিপ করে চাইল। পরক্ষণেই চিনতে পেরে বলল,
‘তিহান ভাইয়ের কথা বলছিস?’
আমি মুখ বাঁকালাম।
‘তিনি ছাড়া গ্রামে আর কোন মহারাজা আছে?’
পারুল মুখ টিপে হাসলো। এক মুঠো চানাবুট তুলে নিতে নিতে বলল,
‘শুনলাম আজকে সক্কাল সক্কাল আসছে।’
আমি নাক কুঁচকালাম। এই লোক কদিন পর পরই আসে কেন? শহরে থেকে গেলেই তো পারে। আমার একটা জ্বালা কমতো তাহলে।
স্কুল থেকে ফেরার পথে তিহান ভাইকে কোথাও দেখলাম না। একটু অবাক হলেও খুশি হলাম। তিনি গ্রামে আসলে স্কুলে যাওয়া আসার পথে তার সাথে দেখা হওয়া যেন প্রকৃতির কোনো নিয়ম। যে নিয়মের কখনো বরখেলাপ হয় না। অনেকটা সূর্য প্রতিদিন পূর্ব দিকে ওঠার মত। আজ হয়তো সূর্য পথ হারিয়ে পশ্চিমে উঠেছে তাই তিহান ভাইয়ের মুখদর্শন থেকে মুক্তি মিললো।
আপা এসেছে। সাথে দুলাভাই ও। এতদিন বাদে আপাকে দেখে চোখ ছলছল করে উঠলো। ছুটে যেয়ে আপাকে জড়িয়ে ধরলাম। আদুরে গলায় বললাম,
‘তোমাকে আর যেতে দেব না আপা।’
আপা গাল ভরে হাসলো। ইশশশ আসাটা কত্ত সুন্দর হয়ে গেছে। দেখলাম মা দুলাভাইকে খেতে দিয়েছে। আমাকে দেখেই সে দাঁত বের করে হাসলো।
‘শালি তো অনেক বড় হইয়া গেছো। বিয়া দিবার বয়স হইয়া গেছে।’
আমি কিছু বলার আগেই মা বললো,
‘না জামাই পুতুলরে এত তাড়তাড়ি বিয়া দিতাম না। লেখাপড়া করুক। ভালো শিক্ষা দেখি একটা জামাই আনবার চাই।’
আমি মুচকি হাসলাম। মায়ের আমাকে নিয়ে অনেক শখ। কত্ত স্বপ্ন তার আমাকে ঘিরে। আপাকে নিয়েও ছিল কিন্তু সময় আর পরিস্থিতির ভাঁজে তা বিলিন হয়ে গেছে।
—————–
‘জলদি করে এই পিঠাগুলি নিয়ে একটু জমিদার বাড়িতে মা দেখি। ঐ আঁচারের কৌট দুইটাও নে সাথে। তোর বড়মা-র হাতে দিয়ে আসিস মনে করি।’
আপাকে জড়িয়ে শুয়ে ছিলাম। এতদিন বাদে আপাকে পেয়ে গল্প যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না। এমন সময় মায়ের এই কথা একদম পছন্দ হলো না।
‘তুমি নিয়ে যেও যখন যাবা। এখন জ্বালাবে না একদম।’
‘জামাই বাড়িতে আছে। এখন আমি এসব রাখি বেরোতি পারি? যা মা। আমার হাতে কত্ত কাজ।’
না চাইতেও মাথায় ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে রহিম কাকার সাথে দেখা হলো। তিনি আশপাশের গ্রাম ঘুরে ঘুরে ফেরি করেন।
‘কেমন আছেন চাচা?’
চাচা একগাল হাসলেন। পান খাওয়ার দরুন দাঁত গুলো কালচে হয়ে গেছে। মুখে বয়সের ছাপ পড়ে গেছে। বয়স আনুমানিক কত হবে? পঞ্চাশ বা তার কাছাকাছি।
‘চমেৎকার আছি। আজ পাশের গ্রামে তোর বাপরে দেখলাম পুতুল। ভালো টাকা-পয়সা করিছে। গায়ে গতরে ভালো পোশাক। একদম সাহেব সাহেব ভাব।’
আমি মলিন হাসলাম। মুচকি হেসে বললাম,
‘কার কথা বলছেন চাচা? আমার তো বাপ নাই! দেরী হয়ে যাচ্ছে চাচা। আসি কেমন?’
আর দাঁড়ালাম না। বাপ নামক ব্যক্তিটার প্রতি ঘৃণা ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি কাজ করে না এখন আর। কখনো যদি সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলে আমি শুধু জানতে চাইব কি দোষ ছিল আমাদের। কিন্তু মজার কথা এটা যে সে সামনে আসলেও কি চিনতে পারব? কিংবা তিনি পারবেন? ঠোঁট কোণে খেলে গেল দুঃখ কষ্টে ঘেরা এক টুকরো হাসি। এ হাসির গভীরতা মাপার সম্ভব নয়।
জমিদার বাড়িটা বেশ বড়। পুরো গ্রামের মাঝে অহংকারের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। এমন সুউচ্চ বিশাল বাড়ি গ্রামে আর নেই। ছোটখাটো একতলা দুইতলা ভবন আছে তবে এমন রাজপ্রাসাদের মত কোনো বাড়ি নেই। বাড়ির নাম প্রহেলিকা। এর অর্থ আমার জানা নেই। সদর দরজা থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই বড় দরজা। পাশেই গ্যারেজ। বাড়ির সামনের জায়গাটুকু পুরোটা ফাঁকা। কোনো গাছপালার চিন্হ নেই। তারিম খন্দকার পছন্দ করেন না। তিনি যেহেতু এ বাড়ির বড় মাথা তাই সকলে তার পছন্দ অপছন্দের খুব কদর করেন।
আমাকে দেখে বড় মা এগিয়ে এলেন। আমি সুন্দর করে সালাম দিলাম। এ বাড়িতে আমার আসা যাওয়া খুব একটা বেশি না হলেও বাড়ির সকলে ভীষণ পছন্দ করে আমাকে। দিদুনতো চোখে হারাণ।
‘মা পিঠা পাঠালো। সাথে আমের আঁচার।’
বড় মা আমার হাত থেকে ওগুলো নিয়ে হেসে বলল,
‘ভালো করেছে তোকে পাঠিয়ে। কতদিন খবর পাঠালাম তোকে আসার জন্য তা তো এরই না। এসেছিস তখন বোস।’
আমি দ্রুত বললাম,
‘না বড়-মা আজকে না। অন্য একদিন আসবনি।’
আমার কি মাথা খারাপ? তিহান ভাই এ বাড়িতে থাকতে আমি এ বাড়িতে এক সেকেন্ড ও থাকতে চাই না। কিন্তু ভাগ্য আমার সাথে নেই। বড়-মা ধমক দিয়ে বললেন,
‘চুপচাপ বোস। তুতুল ঘুমাচ্ছে। ও উঠুক। ওর সাথে কিছুক্ষণ খেলা করে তারপর যাওয়ার কথা বলবি তার আগে না।’
তুতুল হচ্ছে এ বাড়ির ছোট সদস্য। গুলুমুলু একটা বাচ্চা। তিহান ভাইয়ের চাচাতো বোন। কোনো কারণ ছাড়াই বাচ্চাটা আমাকে ভিষণ পছন্দ করে। চুপ করে সোফায় বসলাম। এ বাড়ির উপরের তলায় কখনো যাওয়া হয়নি। একবার কি যাব? এর মাঝে বড়-মা একটা করলে হাতে এসে দাঁড়ালেন।
‘এগুলো একটু উপরে নিয়ে যা তো। এ…..’
বড়-মার কথা শেষ করার আগেই আমি ছোট করে ট্রেটা নিয়ে নিলাম। আমিতো উপরেই যেতে চাচ্ছি। এতবড় সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া কেন করব? হেসে বললাম,
‘কোনো ব্যাপার না। শুধু কোন ঘরে যেতে হবে সেইটা বললেই চলবে।’
বড়-মা হেসে বললেন,
‘উত্তর দিকের শেষ রুমটাকে। সাবধানে যা। পরে যাসনা আবার।’
আমি সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বললাম,
‘একদম চিন্তা করো না।’
এত বড় বাড়িতে মানুষ থাকে কিভাবে? হারিয়ে যায় না? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম। চার পাঁচটা রুমের পর শেষ রুমটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আরো একবার হিসাব করে নিলাম। হিসাব হিসেবে এটাই উত্তর দিকের শেষ রুম। দরজা চাপানো। ভেতরে ঢুকব কি?
‘কেউ আছেন?’
কোন উত্তর এলো না। চাপানো দরজা ঠেলে ভেতরে পা রাখলাম। সুসজ্জিত পরিপাটি একটা রুম। বিছানাটা দেখার মতো। কোথায় আমার ঘরের চকি আর কোথায় এমন আলিশান বিছানা। আস্তে ধীরে পুরো রুমটাতে চোখ বুলালাম। কিন্তু রুমটায় কোনো বারান্দা নেই। আছে খোলা বিশাল এক জানালা। জানালার সামনে দাঁড়াতেই মনে হল পুরো গ্রামটাকে আমি এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি। জানালা গলিয়ে হিম শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে নাক চোখ মুখ। চোখ বন্ধ হয়ে এলো। প্রকৃতির মাঝে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে আমার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে সেটা বিন্দুমাত্র বুঝতে পারিনি।
‘দেখা শেষ?’
‘উহু। এ যে শেষ হতে চাচ্ছে না!’
‘একটা ছেলের রুমে একা একটা মেয়ে এতক্ষণ আছিস ভয় হচ্ছে না? যদি কিছু করে ফেলি?’
কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজ এমন কথা শুনে আমার হুস এলো। দ্রুত সরে দাঁড়াতেই দেখলাম তিহান ভাই বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছেন। কাঁধে মোটা টাওয়েল। টুকটুকে লাল রঙের গেঞ্জিটার গলার কাছটা অল্প ভেজা। চুল থেকে টুপটাপ পানি পড়ছে। ভোট গিললাম। লোকটা দেখতে তার স্বভাবের মতোই ভয়ংকর।
‘না আসলে বড়-মা..’
আমার কথাকে শেষ হতে দিল না তিহান ভাই। তার মুখভঙ্গি হঠাৎ করেই বদলে গেছে।
‘নো মোর টক। সোজা নিচে চলে যা। আর কখনো যেন আমার রুমে তোকে না দেখি। দেখলে যা হবে সেটা সহ্য করার মতো বয়স তোর এখনো হয়নি। নাউ গেট লস্ট।’
আমার চোখ ছলছল করে উঠলো। আমি কি সখ করে রুমে আসছি? এমন খারাপ লোকের রুমে ঢোকার কোনো সখ নেই আমার। নেহাত বড়-মা বললো তাই মানবতা দেখালাম। আমি কারো কথা ফেলতে পারিনা দেখেই তো আসতে হলো। জীবনেও আসব না আপনার রুমে।
__________
ঐ দিনের পর কেটে গেছে দুদিন। এ দুদিনে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে তিহান ভাইয়ের সাথে। কিন্তু প্রতিবারই আমি তাকে উপেক্ষা করেছি। ওমন লোকের সাথে কথা বলতে যেন আমার বয়ে গেছে!
আপা গতকাল চলে গেছে। যাওয়ার সময় বারবার করে আমাকে যেতে বলে গেছে। দুলাভাই অনেকবার গল্প করার জন্য ঠেকেছে কিন্তু বিভিন্ন ছুতো দিয়ে আমি প্রত্যেকবার এড়িয়ে গেছি। ঐ লোকের থেকে মত দূরে থাকব তত মঙ্গল।
‘পুতুল তাড়তাড়ি কর পারুল দাঁড়ায় আছে সেই কোন সময় থেইকে। মাইয়াটারে বসতে বললাম তাও বসলোনে।’
স্কুল শুরু হতে খুব বেশি দেরি নেই। আজকে কান ধরে দাঁড়ায়ে থাকতে না হয়। পুতুলের জন্য পারুলকেও প্রায় রোজই কান ধরে দাঁড়াতে হয়। পারুলের দুচোখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। আজ বোধহয় রক্ষা নেই!
চলবে……..