#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_৮
.
তরুও পিছু পিছু কেয়ার রুমে এলো। নির্জন এসে বসলো তন্ময়ের পাশে। কেয়া বিছানার একপাশে চুপচাপ। ইশহাক সাহেব জিমের বিষয়ে সবকিছু বিস্তারিত বুঝিয়ে বললেন নির্জনকে। সে খুব একটা আগ্রহ না দেখালেও অসম্মতি জানালো না। দীর্ঘ আড্ডা আর কথাবার্তার শেষে সিদ্ধান্ত হলো আগামী শুক্রবারে সবকিছু কেনা হবে। তন্ময়কে রাতের খাবারের আগে ছাড়লেন না ইশহাক সাহেব। একটু আগেই আজ রাতের খাবারের আয়োজন করা হলো। খাবার পর্ব শেষে সাড়ে দশটার দিকে তন্ময় বিদায় নিয়ে চলে গেল। নির্জন তখন সিটিংরুমে বসা। ইশহাক সাহেব তন্ময়কে গেইট অবধি এগিয়ে দিয়ে এসেছেন। নির্জন তখনই বিরক্তি প্রকাশ করলো।
– ‘আব্বা এসব কি হচ্ছে? বাইরের একটা ছেলেকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন করছো বুঝলাম না?’
ইশহাক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘বলছো কি বাবা? তোমার আম্মু শুনলে খুব রাগ করবে। ও খানপুরের, কেয়ার ক্লাসমেট। আর ছেলেটাও ভদ্র..।’
নির্জন কথাটি শেষ করতে না দিয়ে বললো, ‘তাই বলে বেডরুমে নিয়ে যাবে? তুমি দিনকে দিন বাচ্চাদের মতো হয়ে যাচ্ছো।’
ইশহাক সাহেব হাসতে হাসতে এসে নির্জনের পাশে বসলেন। তারপর বললেন, ‘এগুলো কি আমি বুঝি না? আসলে হয়েছে কি, প্রথমে ছেলেটি বললো কেয়াকে একটা সারপ্রাইজ দেই, আপনি ভেবে দরজা খুলে দেখবে আমি। তো তোমরা কমবয়সি ছেলে-মেয়েরা তো এগুলোতেই আনন্দ পাও তাই না? আমিও সঙ্গ দিলাম। ছেলেটা গিয়ে দরজায় নক দিল, কেয়া খুলে দিল। এরপর তন্ময় নিজেই বিনয়ের সাথে বললো আমি সিটিংরুমে গিয়ে বসছি এখানে ডায়রেক্ট আসাটা ঠিক হয়নি। এই অবস্থায় কি বলবো বাবা বল? ভদ্রতা থেকেও তো বলতে হয় সমস্যা নেই, আসো।’
নির্জন খানিক নরম হলো। তবুও সে কোনোভাবেই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলো না৷ সোফা থেকে উঠে যেতে যেতে বললো, ‘যাইই বলো বাবা, এগুলো বাড়াবাড়ি।’ আরও অনেক কথা বলতে চেয়েছিল। কেয়ার ব্যাপারে অনেক অভিযোগ ছিল। তবুও বলতে পারলো না। তার বাবার মন খারাপ হবে। আবার ভাবতে পারেন সৎ মাকে সে হয়তো সহ্য করতে পারছে না। তাই রোজ রোজ এত অভিযোগ। এটা একবার মাথায় ঢুকে গেলে তাদের বাবা ছেলের সম্পর্কে অনেক বড়ো ছিঁড় ধরবে। একটা দূরত্বের দেয়াল তৈরি হবে। নতুন স্ত্রী নিয়ে মানসিকভাবে দূরে সরে যাবেন। দুই ভাইয়ের আলাদা সংসারের মতো হয়ে যাবে। ছেলে হয়েও তার কোনো অধিকার তখন থাকবে না তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলার। মোবাইল টিপতে টিপতে উপরে এলো নির্জন। তরুর রুমের সামনে এসে মনে হলো কেয়াকে নিয়ে টুকটাক কিছু বিষয় জিজ্ঞেস করবে। তাছাড়া এই যে তন্ময়। ও তাদের কতটুকু পরিচিত ইত্যাদি। কিন্তু আবারও তার মনে হলো হয়তো সে নিজেই বাড়াবাড়ি করছে। অন্যদের বিষয় নিয়ে বেশি ভাবছে। কয়েকদিন আগেও তার বাবার সঙ্গে প্রচণ্ড রাগারাগি হয়েছে। একপর্যায়ে ইশহাক সাহেব তাকে বলেই ফেললেন, ‘তুমি নিজেই তো বাবা প্রথমে রাজি ছিলে। এখন যদি কেয়াকে তোমার অসহ্য লাগতে শুরু করে তাহলে তো যন্ত্রণা।’
সে তখন বললো, ‘ব্যাপারটা অসহ্য না, উনার স্বৈরাচারিতাই অসহ্য লাগছে৷ তুমি বুঝতে পারছো না যে ফুপু আমাদের জন্য এখানে থাকতেন, অথচ তাকেই চলে যেতে হয়েছে।’
– ‘গিয়ে ভালো করেছে৷ কিছুদিন ওখানে থাক, পরে নিয়ে আসবো। তাছাড়া কেয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি সে। মেয়েরা তো একটু এরকম হয়ই। সংসারে মন বসে গেলে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। এর আগেই যদি সবার চোখের বিষ হয়ে যায় তাহলে তো সমস্যা বাবা।’
– ‘আর উনি যখন-তখন বাইরে যে যায় এগুলো নিয়েও কেন কিছু বলো না? তোমাকে কি বলে যায়?’
– ‘নির্জন তুমি তো দেখছি খুবই খারাপ হয়ে যাচ্ছ। তোমার মা সে, তার সবকিছু নিয়ে কথা বলবে না-কি? বাসায় ভালো লাগে না তাই একবার হয়তো বাইরে যায়। ঢাকায় ওর কিছু বান্ধবী আছে। ওদের বাসায় যায়, ওদের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যায়। তাছাড়া তুমি তো জানো না সে আমাকে বলে যায় কি-না৷ কোথায় একটু মানিয়ে চলবে। বাবাকে একটু শান্তিতে থাকতে দেবে। তা না করে মহিলারা যেমন নতুন বউয়ের পেছনে লাগে তুমি সেরকম লেগে গেছো দেখছি।’
নির্জন সেদিন ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। বুঝতে পারছিল তাদের সম্পর্ক ভিন্ন দিকে মোড় নিবে। ভাবতেই তার কেমন অদ্ভুত লাগছিল। তারই বাবা, এখন অন্য কারও। তাদের আলাদা সংসার হয়ে গেছে। এবার সে মানিয়ে নিতে না পারলে খুবই স্বাভাবিকভাবে আলাদা হয়ে যাবে। হয়তো একটা রুমে থাকবে। খাওয়ার সময় এসে খাবে। তাদের কথাবার্তা হবে না, হলে ঝগড়া হবে বেশি.. ভাবতে পারছিল না নির্জন। কিন্তু সে তার বাবার কিছু বিষয় ভেবে পায় না। উনি তো বোকা না। বেশ বুদ্ধিমান একজন মানুষ। সফল ব্যবসায়ী। কিন্তু এখন এরকম হয়ে যাচ্ছেন কেন? তবে সে কিছু কিছু মানুষ দেখেছে। চড়াই-উতরাইয়ের সময় যে মানুষ খুবই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ছিল, সে সফল হওয়ার পর, সুখী হওয়ার পর কেমন সরল হয়ে যায়। সবকিছু আগের মতো খেয়াল থাকে না। অনেক বোকামি করে। তার ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু আগের ধাক্কায় চলে, অভিজ্ঞতায় চলে। তার বাবার হয়তো সেটাই হয়েছে? না-কি প্রেমে? ভেতরের তুমুল আনন্দে? না-কি তরুণদের মতো হতে গিয়ে নিজেস্বতা হারিয়ে বিকৃত হয়ে গেছেন? নির্জন ঠিক জানে না, তবে তার বাবার তুমুল পালটে যাওয়া, সরলতা অনেক বেশি চোখে পড়ছে। বোকা বোকা লাগছে। সে তরুর সঙ্গে কোনো কথা না বলে নিজের রুমে চলে গেল।
পরের পুরোটা দিন তরুর ভেতরে কিছু একটা খচখচ করছিল। কিন্তু কাকে সে কি বলবে? কেয়া ফুপুকে কিছু জিজ্ঞেস করলে যদি ক্ষেপে যায়? নির্জনকে কিছু বললে যদি তার ফুপুকে নিয়ে অন্যকিছু ভেবে বসে? তরু কোনোকিছুই ভেবে পাচ্ছিল না। তবুও কোচিং থেকে এসে কেয়ার রুমে গেল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলো তন্ময় ভাইয়ের সাথে ফুপার পরিচয় কীভাবে? এখানে সবার সাথে এত খাতির জমলো কীভাবে ইত্যাদি। কেয়াও তাকে হাসিমুখে বললো শপিংমলের কথা। এরপর ইশহাক সাহেবই ওকে বাসায় ইনভাইট করেছেন, এনেছেন। এসব নিয়ে সে তেমন কিছু জানে না। তরু সবকিছু শুনে বললো, ‘ফুপা হয়তো ভেবেছেন তোমার ফ্রেন্ড, তাই নিয়ে আসেন। তুমি একদিন উনাকে বুঝিয়ে বলো যে ওকে নিয়ে এত টানাটানির কিছু নেই। তাহলে তো আর আনবেন না। কখনও কি বলেছো?’
কেয়া শুয়ে-শুয়ে মোবাইল টিপছিল। ওর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললো, ‘তুই তো দেখি বেশি কথা বলিস তরু, পড়তে এসেছিস তুই নিজের পড়া নিয়ে থাক, সবকিছু নিয়ে মাতব্বরিতে আসবি না।’
– ‘তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? একটু চিন্তা করো। বুঝাই যাচ্ছে তন্ময় ভাই রোজ এই বাসায় আসবে। হয়তো সেইই ফুপাকে জিমের কথা বলেছে।’
– ‘তাতে তোর কি?’
তরু ইতস্তত করে বললো,
– ‘আমার সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে ফুপু। তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। নিজের ইচ্ছায় বিয়েতে রাজি হয়েছো।’
কেয়া ফোন হাত থেকে রেখে বিছানায় উঠে বসে বললো, ‘আশ্চর্য! তুই এত কথা বলছিস কেন বুঝলাম না তো।’
– ‘তুমি ভুল কিছু করছো না তো..।’
– ‘কি! কি বললি তুই? বের হ রুম থেকে.. বের হ বলছি…না হলে..।’
‘আস্তে কথা বলো কেউ শুনবে, আমি যাচ্ছি’ বলে তরু বিছানা থেকে উঠে বের হয়ে এলো।
এরপর দু’দিন তরু কোচিং আর বাসায় পড়াশোনায় কাটিয়ে দিল। তবুও ভেতরে ভেতরে তন্ময় নামক কাঁটা বিঁধছিল। বারবার মনে হচ্ছিল ফুপু বড়ো কোনো ভুলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না তো? এই জায়গায় সে কি করবে? তার আসলে ভূমিকা কি? কিছুই বুঝতে পারছিল না কেয়া।
আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। তরু কেয়ার কাছে আজকাল একটু কম যাচ্ছে। ছুটির দিন হিসাবে যাওয়া দরকার। পড়ার টেবিল থেকে উঠে বারান্দায় এসে দেখে সিটিংরুমে তন্ময় বসা। ইশহাক সাহেবেরও গায়ে পাঞ্জাবি। তারা জুম্মার নামাজ পড়ে ফিরেছেন। তখনই এসে ঢুকলো নির্জন। তরু দোতলার রেলিঙের কাছ থেকে দেখছে। ওর পরনে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, হাত গুটানো। অদ্ভুত সুন্দর স্নিগ্ধ লাগছে। ইশহাক সাহেব তাকে দেখে বললেন, ‘নির্জন আমরা একটু পরেই জিমের যন্ত্রপাতি কিনতে বের হবো।’
সে ম্লানমুখে হেসে বললো, ‘আমার ভালো লাগছে না বাবা। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা তোমরা যাও।’
তন্ময় উঠে হ্যান্ডশেক করে বললো, ‘কি অবস্থা?’
‘ভালো মামা, বসুন’ বলে উপরে চলে এলো। তরু এই কয়দিন ফুপুর বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিল। নিজের পড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিল। নির্জন ভাইও বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকেন। খুব কম কথা হয় তাদের।
তার পাশ দিয়ে নির্জন হেঁটে চলে গেল নিজের রুমে। তরুর কেমন যেন লাগছে নির্জনকে দেখে। কেমন যেন। সেটা কি? চেহারা এত ম্লান কেন উনার? তরু হঠাৎ আবিষ্কার করলো নির্জন ভাই তার নামের মতোই একজন জনশূন্য, একা, নিঃসঙ্গ মানুষ। তার আসলে বাবা ছাড়া কেউ নেই। সেই বাবাও এখন অনেকদূরের কেউ হয়ে গেছেন। ওইদিন তন্ময় চলে যাওয়ার পর নির্জন আর ইশহাক সাহেবের আলাপও শুনেছে তরু। ঠিক এখানে দাঁড়িয়ে থেকে শুনেছে। তরু পুনরায় রুমে চলে এলো। এরকমই হয় তার। মাঝে মাঝেই একটু বেশিই বুঝে ফেলে। গ্রামে তাদের পাশের বাড়ির রাবেয়া বেগম। উনার একটাই সন্তান হয়েছিল। সে পাঁচ বছর বয়সে পানিতে পড়ে মরে গেল। রাবেয়া বেগমের সামনে একমাত্র ছেলের পেটফোলা লা*শ। বেচারি মাটিতে পড়ে কাঁদছে। তখন তরুর বয়স আট বছর। সেই কান্না এখনও তরু ভুলতে পারে না৷ মাঝেই মাঝেই মনে পড়ে। মাঝরাতে, কখনও দুপুরে। তরুর তখন বড়ো কষ্ট হয়। একা একা কেঁদে ফেলে। যেন সে এখনও ঠিক অনুভব করতে পারে রাবেয়া বেগমের কষ্টটা, একমাত্র সন্তান হারানোর বেদনাটা। অথচ এত বছরে রাবেয়া বেগম সন্তানের শোক কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন।
তরুর এখন কষ্ট হচ্ছে। নির্জন ভাইয়ের জন্য কষ্ট। উনি আসলেই নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন কি-না সে জানে না। কেবল তার মনে হচ্ছে মানুষটা বড়ো একা। সে মুখ দেখে বুঝে গেছে। এমনিই বুঝে গেছে৷ কীভাবে বুঝে এগুলো তরু জানে না। এখন আর কেয়ার রুমে গেল না সে। দরজা ভেজিয়ে বসে রইল। বারবার মনে হচ্ছে নির্জন তার ফুপুকে পছন্দ করে না৷ কেবলমাত্র বাবার সুখের জন্য সে হাসিমুখে মানিয়ে চলে। একটা টগবগে যুবক এরকমও হতে পারে? এত বুঝ? এত ভাবে? নির্জনের জন্য তরুর অদ্ভুত এক শ্রদ্ধাবোধ ক্রমশই তৈরি হতে থাকলো।
পাঁচটার দিকে ওর দরজায় নক পেল। খুলে দেখে নির্জন দাঁড়িয়ে আছে।
– ‘কিছু বলবেন?’
নির্জন ইতস্তত করে বললো, ‘আপনি হয়তো বাসায় বোর হচ্ছেন। বাইরে কোথাও যাবেন? যেতে হলে আপনার ফুপুকে বলে চলুন।’
মুচকি হাসলো তরু। বুঝতে পারছে ওইদিনের ফোনালাপের প্রভাব এটা।
___চলবে___
লেখা: জবরুল ইসলাম