প্রণয়ে প্রলয়ের সুর পর্ব-১৩+১৪

0
730

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_১৩
.
তরুর ঘুম ভাঙলো ঘণ্টা দেড়েক পর। চোখ মেলে বুঝতে পারছে না কোথায় শুয়ে আছে সে৷ সবকিছু কেমন অন্ধকার লাগছে। কোনো গাড়ি যেন খানিকটা দুলছে আর তাকে নিয়ে পেছনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তরু মাথা নাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। বস্তা জাতীয় কিছু একটা যেন তার মুখটা চেপে ধরে রেখেছে। ধীরে ধীরে সবকিছু মনে পড়ে গেল তরুর। বাসে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছিল, এক্সিডেন্ট হয়, বমি করে সে, নির্জন তাকে নিয়ে কারে উঠেছে। মুচকি হাসলো এবার, অনেক বছর পর এই সমস্যাটা হলো। কোথাও বেড়াতে গেলে ঘুম থেকে হঠাৎ উঠে সে রুম দেখে প্রথমে অবাক হয়ে যেত, এখানে কীভাবে এসেছে বুঝতে পারতো না। একটু সময় পর ঠিক হতো। আজও এমন হলো। কিন্তু তার মুখ এভাবে কি দিয়ে ঢাকা? কোমরের দিকে ভারী কিছু আছে মনে হচ্ছে। আস্তে-আস্তে পাশ ফিরলো তরু। সঙ্গে সঙ্গে কোলে কিছু একটা পড়লো। কি সেটা বুঝতে দেরি হলো না, উষ্ণ একটা শ্বাস পড়ছে কোলে। তারমানে কি? সে নির্জনের কোলে ঘুমিয়েছে আর সেও অজান্তেই ঘুমিয়ে তার কোমরকে বালিশ বানিয়েছে? পুনরায় মুচকি হাসলো তরু। ডান হাতটা ধীরে ধীরে মুখে আনলো। মুখ ঢেকে রেখেছে কিছু একটা। সে মাথা ফাঁক করে আস্তে-আস্তে টেনে সরিয়ে নিল। নির্জনের ব্লেজার। আন্দাজে সেটা রাখলো ওর পিঠে। গাড়ির মৃদু দুলুনিতে এবার নির্জনের পেট বারবার তরুর চোখে, মুখে ঠেসে ধরছে। অদ্ভুত এক অচেনা অনুভূতি। তরুর জীবনে এরকম কখনও হয়নি। নিজে নিজেই লজ্জায় ক্ষীণ সময় শক্ত করে চোখবুজে রইল। কি করবে এখন? মানুষটা ঘুমিয়ে আছে যে। আবার এখনই না তুলে দিলে তরু মরে যাবে একদম। এই অসহ্য অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেয়া পাপ। গাড়ির দুলুনির সঙ্গে কোলে নির্জনের মাথাও নড়ছে, ভুস ভুস করে ছাড়ছে উষ্ণ শ্বাস। তরু পা ভাজ করে এনে শুকনো ঢোক গিলে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। তারপর আস্তে-আস্তে নির্জনের পেটে ধাক্কা দিয়ে ডাকলো, ‘একটু উঠুন প্লিজ, ঠিক হয়ে ঘুমান।’

নির্জনের শরীর খানিকটা নড়লেও আবার চুপ করে ঘুমিয়ে রইল সে। তরু এবার একটু জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকলো, ‘নির্জন ভাই উঠুন, উঠুন তো।’

নির্জনের ঘুম ভাঙলো তখনই। নিজেকে তরুর কোলে দেখে সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো, ‘স্যরি, আমি বুঝতে পারিনি কীভাবে ঘুমিয়েছি।’

তরু কিছু না বলে সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে বুকে হাত বেঁধে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। কেমন একটা অস্থিরতা নিজের পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। নির্জন মোবাইল বের করে দেখে সন্ধ্যা সাতটা হয়ে গেছে। তরুকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বললো, ‘ঘুম কেমন হয়েছে ম্যাডাম।’

তরু না তাকিয়েই বললো, ‘ভালো।’

– ‘শুধু ভালো?’

– ‘হুম, আপনার হয়েছে?’

– ‘আমি বোধহয় বেশিক্ষণ আগে ঘুমাইনি।’

– ‘ও, তাহলে আবার ঘুমান।’

– ‘আর ঘুম আসবে না। এখন চা বা কফি কিছু খেতে পারলে দারুণ হতো। আচ্ছা এখন শরীর ঠিক লাগছে তো তোমার?’

– ‘হ্যাঁ।’

নির্জন খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তরুকে চুপ থাকতে দেখে ভালো লাগছে না। তাও অন্যদিকে তাকিয়ে বসে আছে। মেয়েটির মধ্যে কিছু একটা আছে। যখন কথা বলে দেখতে ভালো লাগে, হাসলে ভালো লাগে। চুপ করে থাকলে মনে হয় আকাশে মেঘ করেছে। মনে হয় বিরক্তিকর অবসর সময় কাটতেই চাইছে না।

সামনে একটা টং দোকান ফেলে যাচ্ছে দেখে নির্জন ড্রাইভারকে বললো, ‘একটু সাইটে রাখুন ভাই, ওইখানে চা আছে মনে হচ্ছে।’

ড্রাইভার গাড়ি থামায়। নির্জন তরুকে ইতস্তত করে বললো, ‘চলো চা খেয়ে আসি, ভালো লাগবে।’

তরু তবুও ওর দিকে তাকালো না। কিন্তু গলাটা ভীষণ কোমল, আন্তরিক লাগলো তরুর কাছে। সে কেবল সম্মতি জানিয়ে বললো, ‘হুম চলুন।’

নির্জন গাড়ি থেকে নামতে নামতে ড্রাইভারকে বললো, ‘আপনিও আসুন ভাই চা-টা খেয়ে আসি।’

– ‘আপনারা যান ভাই, আমার একটা জরুরি কল আছে৷’

‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে নির্জন সরে এসে দাঁড়ায়। নেমে আসে তরু। নির্জনের গায়ে এখন ব্লেজার নেই, শুধু গেঞ্জি, খুব লম্বা লাগছে দেখতে। তরু কাছে যাওয়ার পর নির্জন ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘এত নীরব কেন?’

– ‘এমনিই।’

– ‘ভয় লাগছে এখনও?’

– ‘না।’

– ‘মাথা ব্যথা আছে এখনও?’

– ‘না।’

– ‘কপালে হাত দিয়ে দেখি জ্বর-টর এলো কি-না। তোমাকে এত নীরব দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে।’

তরু কিছু বললো না। নির্জন সত্যি সত্যিই কপালে হাত দিল। রাস্তায় আবছা আলো। তরু চোখবুজে নিল স্পর্শে। তারপর নির্জনের হাত ধরে আস্তে করে সরিয়ে বললো, ‘চলুন চা দেখুন আছে কি-না।’

– ‘হ্যাঁ চলো।’

দু’জন রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছে। গাড়ি চলতি থাকায় দোকানটা ফেলে কিছুটা দূরেই চলে গিয়েছিল। সন্ধ্যার ফুরফুরে মিহি বাতাস এসে গায়ে লাগছে৷ নির্জন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে তরুকে দেখছে। অস্বাভাবিক ঘুমের কারণে মুখ ওর খানিকটা ফোলা ফোলা লাগছে। দুই গালের পাশ দিয়ে কয়েক গোছা চুল বেয়ে পড়েছে৷ বারবার কেন যেন ইচ্ছা করছে হাত দিয়ে ওর চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। বুকের ভেতর কিছু একটা ঘটতে চলেছে তার। এরকম লাগছে কেন তা যে বুঝতে পারছে না তা নয়। তবে এরকম হওয়াটা তার স্বভাববিরুদ্ধ৷ প্রেম-ভালোবাসায় কখনওই সে ছিল না। বান্ধবীদের কেমন ছেলে বন্ধুদের মতোই মনে হতো। তরু তার পাশাপাশি হাঁটছে৷ লম্বায় তার কাঁধ অবধি হবে। সেদিন সিঁড়িতে এটাই দেখতে চেয়েছিল মেয়েটি। এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। মুচকি হাসলো সে। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বাহ, তুমি লম্বায় আমার কাঁধ অবধি চলে আসো।’

তরু ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘কেন, আমাকে দেখতে আরও বেশি খাটো মনে হয় না-কি?’

কি জবাব দেবে সে বুঝতে পারলো না। ইতস্তত করে বললো, ‘সেরকম কিছু আসলে বুঝাতে চাইনি। হঠাৎ এখন খেয়াল হলো তাই বললাম।’

খানিকক্ষণ চুপ থেকে তরু বললো, ‘আপনার নিশ্চয় অনেক লম্বা মেয়ে পছন্দ তাই না?’

– ‘এটা কেন মনে হলো?’

– ‘এমনিই।’

– ‘খুব লম্বা মেয়ে দিয়ে কি আমি বাসার ফ্যান পরিষ্কার করাবো?’

তরু ফিক করে হেসে বললো, ‘সেটা না, তবুও তো মানুষ চায়।’

– ‘লম্বা মেয়ে চাই বলে ছেলেরা গোঁ ধরে বসে থাকে বলে আমার মনে হয় না। হ্যাঁ, সুন্দর চাইতে পারে। সেটা সবকিছু মিলিয়েই হয়। খাটো মানেই অসুন্দর কিংবা লম্বা মানেই সুন্দর তা কিন্তু না।’

– ‘আপনি বড্ড প্যাঁচিয়ে কথা বলেন।’

টং দোকানের কাছে চলে এসেছে। নির্জন উত্তর দিল না এখন। পরে কথাগুলো সে নিজেই চুইংগামের মতো টেনে লম্বা করবে। কেন যেন প্রচণ্ড ভালো লাগছে ওর সঙ্গে অকারণ কথা বলতে। দোকানের সামনে এসে দেখলো ফ্ল্যাক্স আছে। এটাই দেখেছিল গাড়ি থেকে।

– ‘মামা চা আছে?’

– ‘হ ভাইজান, লিকার চা।’

– ‘দিন দুই কাপ।’

দোকানি চা দিল দু’জনকে। নির্জন চা দু’টা হাতে নিয়ে বললো, ‘ওদিকে আছি আমরা।’

তরু ভ্রু- কুঁচকে বললো, ‘বেঞ্চেই বসি।’

– ‘আরে না, গাড়িতেই তো সারাক্ষণ বসা ছিলাম।’

তরু উঠে এলো। টং দোকান থেকে একটু দূরে আসার পর নির্জন ওর হাতে কাপ দিয়ে বললো, ‘নিন ম্যাডাম।’

– ‘এটা কি হলো, দেখুন দোকানদার মিটমিট করে হাসছে।’

– ‘হাসুক তাতে কি আসে যায়। আমার নাম নির্জন। আমি নির্জনতাই পছন্দ করি।’

– ‘তাহলে আমিও চলে যাই। একা থাকুন।’

– ‘আরে না দাঁড়াও, একটু কাব্য করতে চেয়েছি শুধু।’

– ‘ও আচ্ছা তাই।’

নির্জন চায়ে চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আগে তুমি কিছু একটা বলেছিলে। আমি সোজা উত্তর দেই না।’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘কি সোজা জানতে চাও শুনি।’

– ‘বলেছিলাম লম্বা মেয়ে পছন্দ করেন কি-না।’

– ‘যদি হ্যাঁ বলি তার মানে কি খাটো মেয়ে অপছন্দ করি ধরবে তুমি?’

– ‘আবার প্যাঁচানো উত্তর।’

– ‘প্যাঁচানো না, সোজা কথাই বলেছি। লম্বা মেয়ে আমার পছন্দ ঠিক আছে। এদিকে দেখো, তুমি খুব একটা লম্বা না, অথচ দেখতে কি ভীষণ মিষ্টি, মায়াবী চেহারা। তোমার মতো চোখ, হাসি, চুল। তা তো অনেক লম্বা মেয়েরও নেই।’

তরু ভেতরে ভেতরে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। নাক উঁচু লোকটা তার প্রশংসা করছে? বাবা বিশ্বাস করা যায় না৷ তবুও সেটা প্রকাশ না করে বললো, ‘আমার চোখ, হাসি, চুল বুঝি সুন্দর?’

– ‘শুধু তা নয়, তোমার চঞ্চলতাও সুন্দর। তোমার নীরবতা শুধু খুবই বিশ্রী রকম বাজে।’

তরু চায়ের কাপে ঠোঁট নিয়েছিল চুমুক দিতে। থেমে গেল সে। তাকিয়ে রইল নির্জনের চোখের দিকে। এই নির্জন একেবারেই অন্যকেউ। যার সম্পর্ক তার বাইরের কাঠিন্যের সঙ্গে নেই। তরুর বুকটা কেমন করে যেন উঠলো।
____চলবে…..
লেখা: জবরুল ইসলাম

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_১৪
.
চা খেয়ে দু’জন আবার গাড়ির দিকে যাচ্ছিল। পাশাপাশি হাঁটছে তারা। ফুরফুরে মিহি হাওয়া এসে লাগছে, আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে। তরুর হঠাৎ করে মনে হলো এত সুন্দর সন্ধ্যা তার জীবনে আর কখনওই আসেনি৷ নির্জন খানিক পর পর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকেই দেখছে। তরু বুঝে, সবই বুঝে, নির্জনের চোখের ভাষাটাও। হাঁটার সময় বারবার তরুর হাত নির্জনের হাতে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তাতেই বুকে শিরশির করে উঠে তরুর। কেমন এক মধুর যন্ত্রণা যেন হয়। মাথা তুলে তাকালো সে। চোখে চোখ পড়ে গেল দু’জনের। নির্জন সরালো না। অসহ্য এক অস্থিরতা কাজ করছে তরুর। চোখ ফিরিয়ে নিল সে। কিছু একটা যেন হয়ে যাচ্ছে, ঘটে যাচ্ছে। কেমন ভালোও লাগছে, আবার যন্ত্রণাও হচ্ছে। আর তাকাবে না সে। চুপচাপ হেঁটে হেঁটে গাড়ির কাছে এলো। নির্জন দরজা খুলে বললো, ‘যাও ম্যাডাম।’

তরু মুচকি হেসে ভেতরে গেল। নির্জন এসে ব্লেজার কোলে নিয়ে পাশে বসে।
তরুর বাড়ি থেকে কল এলো তখনই। রিসিভ করে কথা বললো সে। বিয়ে বাড়িতে মেহেদি দেবার পর্ব চলছে। খুব হইচই শোনা যাচ্ছে। কথা শেষে ফোন রেখে দেয়। নির্জনও ইয়ারফোন কানে গুঁজে গান শুনছে। তার এখনও মাথায় আকাশের তারার মতো দপদপ করে ব্যথা করছে। ধীরে ধীরে সে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে গেল। ঘুমোচ্ছে দেখে তরু ভেবে পাচ্ছে না তার করণীয় কি? মাথা নড়ছে৷ সামনের দিকে চলে যাচ্ছে। সে তো টেনে কোলেও আনতে পারে না। খানিকক্ষণ পর নির্জনের মাথায়ই ধীরে ধীরে তরুর কাঁধে এসে গেল। ফিক করে হেসে দিচ্ছিল তরু। অকারণ হাসি পাওয়া যাকে বলে। সে ড্রাইভারের দিকে চোরা চোখে তাকালো। ভেতরে ভেতরে চাচ্ছে নির্জনের একটা ভালো ঘুম হোক। কাঁধটা ভালো করে এগিয়ে দিয়ে রাখলো সে। কিন্তু কাজ হলো না। গাড়ির দুলুনিতে নড়ছে। তরু কিছু একটা ভেবে নির্জনের ব্লেজারটা কোলে এনে রাখলো। তারপর ধীরে ধীরে নির্জনের মাথা ধরে কোলে আনতে যাবে। তখনই তাকিয়ে ফেললো ও। তরু ইতস্তত করে বললো, ‘ঘুমান, পড়ে যাচ্ছিলেন।’

নির্জন সত্যি সত্যিই কোলে মাথা রাখলো। তরুর কি যে লজ্জা লাগছে। আবার হাসিও পাচ্ছে। বারবার ড্রাইভারের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীর মানুষ তাকিয়ে দেখছে এসব। কিন্তু আবারও সমস্যা দেখা দিল। লম্বা কেডস পারনে নির্জন সিটে পা তুলেনি, তুলতে পারবে না। এদিকে দুলুনিতে মাথা তরুর কোল থেকে সরে যাচ্ছে। এভাবে হলে হঠাৎ পরে যাবে নির্জন৷ তরু আস্তে-আস্তে কাঁপা এক হাত নির্জনের থুতনির দিকে নিয়ে গালে ধরে, আরেক হাত মাথায়। তারপর টেনে রাখে নিজের পেটের দিকে৷ ওর খোঁচা-খোঁচা দাড়ি হাতে লাগছে আর তরুর বুকেও অদ্ভুত এক শিরশিরানি শুয়ে হয়েছে। সে তাকিয়ে রইল নির্জনের মুখের দিকে। ঘোর লেগে যাচ্ছে বারবার। অদ্ভুত এক মমতা বুকের ভেতর বুদবুদ করে যেন ফুটছে। তরু নিজের অজান্তেই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো, শুরু করলো পরম মমতায় গালে হাত বুলিয়ে দিতেও। একটা সময় আর ড্রাইভারের দিকে তাকানোর কথাও মনে রইল না তরুর।

তারা শ্রীমঙ্গল শহরে পৌঁছে গেল রাত এগারোটার দিকে। গাড়ি থামিয়ে কিছু কেনা-কাটা করে নিল দুজন। সেখান থেকে পথ দেখিয়ে তরুরই নিতে হচ্ছে। পাহাড় আর চা বাগানের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। ঢালু পথ। মিনিট বিশেক পরেই বিয়ে বাড়ির সামনে চলে এলো। বিয়ের গেইট দেখা যাচ্ছে, রঙিন বাতি জ্বলছে। তরু কিছু একটা ভেবে বললো, ‘এখানেই রেখে দেন।’

ড্রাইভার সাইট করে তাদের নামতে দেয়। তরু এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘ভাইয়া ভাড়া কত?’

ড্রাইভার বললো, ‘আপনি ঘুমে ছিলেন। গ্যাস ভরার সময় উনিই ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন।’

নির্জন ব্লেজার আর ব্যাগ-প্যাক নিয়ে নেমেছে। তরু তাকিয়ে বললো, ‘দিয়ে দিছেন।’

‘হ্যাঁ’ বলে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে বিদায় দিয়ে তরুকে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটলো। উঠোনে যেতেই একঝাঁক মেয়ে খিলখিল করে ছুটে এসে তরুকে নিয়ে চলে গেল। তাকে বসতে দেওয়া হলো সিটিংরুমে। খানিক পর তরুর মা নাহেরা বেগম এসে ভালো-মন্দ কথা বলে চা-নাশতা দিয়ে গেলেন। এরপর সে একা একা পুরো সময় বসে বসে মোবাইল টিপলো। বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততা, ছোটাছুটি চারদিকে। এর ভেতরে তরুর দেখা মিললো না। রাতের খাবার দেয়া হলো আরও কয়েকজন অচেনা মেহমানের সঙ্গে। খাবার শেষে নাহেরা বেগম বললেন, ‘নির্জন, তুমি তো ক্লান্ত, অনেক জার্নি করে এসেছো। ঘুম পাচ্ছে নিশ্চয়?’

– ‘হ্যাঁ মামী।’

– ‘তাহলে আসো, তোমাকে একটা রুমে দিয়ে আসি।’

নির্জন উনার সঙ্গে গেল। তাকে উঠান পেরিয়ে নিয়ে গেলেন সামনের ঘরে। নাহেরা বেগম চলে যাওয়ার পর সে মুখ-হাত ধুয়ে নিল। মাথা এখনও ব্যথায় ‘টনটন’ করছে। একটা ঘুম ভীষণ দরকার। বালিশে এসে মাথা রাখতেই মেসেঞ্জারে নোটিফিকেশন এলো। হাতে নিয়ে দেখে তরুকে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছে একজন। সেটার ভিডিয়ো। সে কোনো রিপ্লাই দিল না৷ কেমন যেন অভিমান হচ্ছে তার। এসেই নাই হয়ে গেল। একবারও কথা বলতে এলো না। একা একা বসে ছিল সে। মোবাইল পাশে রেখে চোখবুজে রইল। ঘুম এলো সঙ্গে সঙ্গেই। এক ঘুমেই রাত কেটে গেল। দরজায় ডাক শুনে ঘুম ভাঙলো তার। উঠে দেখে নয়টা। ‘হাই’ তুলে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজা খুলে দেখে একটি ৬-৭ বছর বয়সের ছেলে। তাকে দেখে বললো, ‘ফুপু বলছে উঠে নাশতা করতে।’

– ‘তোমার ফুপু কে?’

– ‘তরু আপুর আম্মা।’

– ‘ও আচ্ছা, আমাকে এখানে এনে নাশতা দিতে পারবে? আমি দাঁত ব্রাশ করে ফ্রেশ হব।’

‘পারবো’ বলে ছেলেটি চলে গেল। নির্জন ব্যাগ থেকে ব্রাশ বের করে পেস্ট লাগিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। উঠোন, বারান্দায় অনেক মানুষ এদিক-ওদিক যাচ্ছে। কিন্তু তরুকে দেখা যাচ্ছে না। ভেতরে ভেতরে সে ক্রমশই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। ওই পিচ্চি ছেলের জায়গায় তরুও তো আসতে পারতো। কেন এলো না?

মোবাইল হাতে নিয়ে তরুর ফেইসবুকে দেখলো মেহেদি দেওয়া হাতের ছবি পোস্ট করেছে। ক্যাপশন, ‘মামাতো বোনের বিয়েতে এসেছি, কু*ত্তি নুসরাত জোর করে মেহেদি লাগিয়ে দিল। মেহেদি মানে কোনো ছেলের নাম না কিন্তু।’

‘ঢং’ দেখে তার শরীরটা কেমন জ্বলে উঠলো। পোস্ট দেওয়ার টাইম আছে, অথচ রাত্রে একবারও আসেনি। এখনও সকাল নয়টা বাজে। আর কারও কি মামাবাড়ি নেই? আর কারও মামাতো বোনের বিয়ে হয় না? তাই বলে ঘরের কোণায় ঢুকে থাকতে হবে? রাগে সে পোস্টে এংরি রিয়েক্ট দিয়ে দিল। হাজার খানেক ‘হা-হা’ রিয়েক্টের মধ্যে তার একটি এংরি রিয়েক্ট যে অস্বাভাবিক ব্যাপার। তা আর খেয়ালই হলো না তার। ছোট্ট ছেলেটি ট্রে-তে করে তারজন্য নাশতা নিয়ে এলো। টি-টেবিলে রেখে চলে যাচ্ছিল। সে ডেকে দাঁড় করিয়ে বললো, ‘বিয়ে কি তোমার তরু আপুর?’

ছেলেটি হেসে বললো, ‘না না, ফারিহা আপুর।’

‘তা তো মনে হচ্ছে না, আচ্ছা যাও তুমি।’

ছেলেটি চলে গেল। নির্জন নাশতা করে রুমে শুধু পায়চারি করলো। জানালা দিয়ে বারবার উঁকি দিল। নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে বেকার, অবসর মানুষ মনে হচ্ছে। সময় যেন যাচ্ছে না। বের হলো ঘর থেকে। রাতের সেই বাতি-টাতি বন্ধ। গেইট দেখা যাচ্ছে। মানুষ যাচ্ছে-আসছে। সে হেঁটে-হেঁটে রাস্তায় এলো। পাশে একটা মুদি দোকান৷ উদ্দ্যশ্যহীন সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। দোকানদার আমতা-আমতা করে বললো, ‘কিছু লাগবে?’

– ‘দেন টাইগার একটা।’

দোকানদার বাড়িয়ে দিল তাকে। হাতে নিয়ে বললো, ‘ঠান্ডা নেই?’

– ‘ফ্রিজ নেই ভাই।’

তার ইচ্ছা করলো ‘ফকিন্নি গ্রাম, ফকিন্নি দোকান’ বলে খানিকক্ষণ গালাগাল করতে৷ নিজেকে সামলে নিয়ে টাকা দিয়ে টাইগার খেতে খেতে আবার হাঁটতে লাগলো। গেইটের কাছে এসে কেন যেন মনে হলো, এখন হয়তো তরু নাশতা-টাশতা করে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। পুনরায় হেঁটে হেঁটে সে বাড়িতে এলো। না, উঠোনে কেবল দুইটা কুকুর লাজ নাড়াচ্ছে বসে বসে। দুইজন অচেনা লোক গল্প করতে করতে সিগারেট খাচ্ছে। সে রুমে চলে এলো। খানিক্ষণ ইয়ারফোন কানে গুঁজে গান শুনে, পায়চারি করে, জানালার দিকে গিয়ে বারবার উঁকি দেয়।
সাড়ে দশটায় মেসেঞ্জারে তরুর মেসেজ পেল, ‘নির্জন ভাই, গোসল করে রেডি হয়ে যান, বারোটার সময় বের হবে সবাই। গাড়ি এসে যাবে।’

নির্জন একটা লাইক দিল শুধু। কিছুই বললো না। খানিক পর তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে গোসলে চলে গেল। বাথরুম থেকে বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি তরু এসে বলবে, ‘কই আপনি, গোসল কি শেষ?’
কিন্তু কেউ এলো না। সে গোসল করে শরীর মুছে তোয়ালেটা মেলে দিল বারান্দায়। তখনও তাকিয়ে এলো চারদিকে; উঠান, বারান্দা আর যতদূর দেখা যায় কামরাগুলোর ভেতর। ফিরে এসে ব্যাগ থেকে নীল পাঞ্জাবিটা বের করে পরে। পারফিউম দেয় একটু। চুলগুলো ঠিক করে, কেডস পরে বসে রয় মোবাইল হাতে নিয়ে। ধীরে ধীরে মানুষ আসতে শুরু করেছে। গাড়িও এসে গেছে বলে বাচ্চাদের কথাবার্তা ভেসে আসছে তার কানে। তবুও সে জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। দেখতে দেখতে উঠানে গাড়িগুলো চলে এসেছে। ছেলে-বুড়ো সবাই নতুন জামা-কাপড় পরে হাঁটাহাঁটি করছে। তখনই দেখা গেল মহিলারা বের হচ্ছে কনে নিয়ে। ক্যামেরাম্যান ছবি তুলছে। কনের পাশে অনেকগুলো মেয়ের পরনে একইরকম খয়েরি রঙের শাড়ি। দলটি উঠানে নেমে গেল। তখনই তরুকে দেখা যায়। ফেলে আসা কিছু একটা ফিরে গিয়ে আনতেই যেন দলছুট হয়েছে। ওদের মতোই খয়েরি রঙের শাড়ি পরেছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে দেখতে। লাল শাড়িতে কি-না কে জানে, গায়ের রঙ দুধে আলতা মনে হচ্ছে। দেখেও মনে হচ্ছে একদিনে বয়স বেড়ে গেছে অনেক বছর। একপাশের চুল কানে গুঁজা, অন্যপাশের চুল কপাল বেয়ে সামনের দিকে এসে পড়েছে। হাতে ঘড়ি আর ছোট্ট ব্যাগ। সবই ঠিক আছে। তার রাগটা উঠলো অন্য কারণে। চোখও আঁটকে আছে অন্য জায়গায়। তরুর শাড়ির ফাঁকে খানিকটা পেট দেখা যাচ্ছে। সেখানে ছোট্ট একটি তিল। কয়েকটা ছেলে ওর দিকে বারবার তাকাচ্ছে। তরু দ্রুত আবার মিশে গেল মেয়েদের সঙ্গে। এভাবে পেট বের করে কে শাড়ি পরিয়ে দিল ওকে? জানালার গ্রিলে তার হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যেন রীতিমতো কাঁপছে। কেউ একজন দরজার কাছে এসে বললো, ‘গাড়ি চলে এসেছে আসুন।’

নির্জন নিজেকে সামলে নিয়ে বাইরে এলো। তরু কনের গাড়িতে উঠে পড়েছে। সে বসলো ছেলেদের সঙ্গে। সেন্টারে এসে তরু যখন নেমেছে, যেদিকেই হেঁটেছে, অনেকগুলো ছেলে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে থেকেছে। সবকিছুই নির্জন দেখলো।
তারপর ভেতরে এসে চুপচাপ একটি চেয়ারে বসে রইল সে। সবাই ছোটাছুটি করে ছবি তুলছে। সে কেবল মোবাইল টিপলো। মেয়েদের হল আলাদা থাকায় তরুকেও দেখা গেল না। খাবার পর্ব শেষে হইচই শুনে তার মাথা ধরে যাচ্ছিল। চুপচাপ উঠে সে ছাদে যায়। তখন দেখা গেল তরু এবং আরও একটি মেয়ে সিঁড়িতে নানান এঙ্গেল থেকে ছবি তুলছে৷ নির্জন কোনো কথা না বলে পাশ দিয়ে ছাদে চলে গেল। তরু কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ওর চেহারা দেখে বললো না। নির্জন ছাদে এসে ছায়া দেখে হাঁটাহাঁটি করছে। তখনই দেখা গেল শাড়ির কুঁচি ধরে চারপাশ আলোকিত করে তরু এসে উঠেছে। একেবারে একা। সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রেলিঙ ধরে সামনের একটি গাছের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন এই গাছ দেখাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য উদ্দেশ্য। আশেপাশের আর কিছুই দেখবে না সে। তরু পাশে এসে বললো, ‘আপনি এটা কি করলেন বলুন তো?’

নির্জন ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘কি করেছি?’

– ‘আপনি সাজিদকে বলেছেন তরুর বিয়ে আজ। ও আমাকে সকল কাজিনের সামনে গিয়ে বলেছে তরু আপু তোমার সঙ্গে যে ভাইয়া এসেছে সে বলছে আজ না-কি তোমার বিয়ে। ওরা সবাই হেসেছে।’

নির্জন চেহারা কালো রেখেই বললো, ‘তো তোমারই তো বিয়ে মনে হচ্ছে।’

– ‘মানে কি?’

সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো, ‘কিছু না।’

– ‘কিছু না মানে? ফেইসবুকেও এংরি রিয়েক্ট দিয়েছেন। এসব কেমন অসভ্যতামি বলুন তো।’

সে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললো, ‘আমি অসভ্য না, অসভ্য হচ্ছ তুমি। সাদা পেটে একটা তিল আছে। ওটা তো সবাইকে দেখানো লাগবে তোমার। তাই পেট বের করে শাড়ি পরেছো।’

তরু বিস্মিত হয়ে বললো, ‘মানে, আপনাকে এগুলো বলার রাইট কে দিয়েছে?’

– ‘হ্যাঁ, রাইট নাই, যাও। রাস্তায় ছেলেদের দেখাও গিয়ে৷ সবাই ‘হা’ করে দেখছিল। মজাও পাচ্ছিলে নিশ্চয়। এজন্যই তো এভাবে শাড়ি পরেছো।’

তরুর লজ্জা এবং বিস্ময় মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেল। সে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বললো, ‘আপনি একটা উন্মাদ, নিজের লিমিটের ভেতরে থাকবেন। আমার দিকে কে তাকালো, আমি কি পরলাম, আপনার কাছে সেগুলোর জবাব দেবো না। আপনি আমার বাপ-ভাই না৷ একটু মিশেছি বলে আপনি কি মনে করেছেন। যা ইচ্ছা তাই বলার অধিকার পেয়ে গেছেন?’ বলে হনহন করে তরু চলে এলো সিঁড়ির কাছে।

নুসরাত দরজার আড়ালেই দাঁড়িয়ে ছিল৷ তরু আসতেই বললো, ‘কিরে রাগারাগি করছিলে মনে হলো।’

– ‘কিছু না আয়।’

– ‘আরে দাঁড়া একটু দেখি, ছেলেটা অনেক জোস।’

– ‘তাহলে গিয়ে বিয়ে বসে যা, কোলে উঠে বসে থাক।’

– ‘তুলবে কোলে?’

তরু দাঁত কটমট করে তাকিয়ে ‘সর’ বলে সিঁড়ি দিয়ে হনহন করে নেমে গেল।
___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে