প্রণয়ের রংধনু পর্ব-০৪

0
374

#প্রণয়ের_রংধনু ✨
#পর্ব-৪
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
‘ এই মাইয়া এক রাইতের জন্যে তোমার রেট কত?’

পাশের কয়েকজন বখাটের মধ্যে একজনের প্রশ্নে অবাক হয়ে তাঁকালো অনন্যা। রাস্তার অপাশে কয়েকজন বখাটের মধ্যে হ্যাংলা পাতলা,মাথায় টাক বিশিষ্ট লোকের হঠাৎ অনন্যার দিকে কুনজর পরে, তখনি সে এমন প্রশ্ন করে। লোকটার কথায় সায় দিয়ে, তার পাশের বখাটেরাও শিটি বাজাতে থাকে। অনন্যা সবেমাত্র ব্যাংক থেকে বেড়িয়েছে, হাতে কালো ব্যাগ, তাতে রয়েছে টাকা। ব্যাংক বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু ম্যানেজার, লতিফ সাহেবের ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়ায়, রাতের দিকে টাকা তুলতে তেমন কোন কষ্ট হয়নি অনন্যার। ভদ্রলোক যথেষ্ট স্নেহ করেন তাকে কিন্তু ব্যাংকের বাইরে এসে এমন বাজে পরিস্হিতির মুখোমুখি হতে হবে, তা বোধহয় কল্পনা করেনি অনন্যা। এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যা গা গুলিয়ে আসছে অনন্যার। অনন্যা কোনরুপ জবাব না দিয়ে, দ্রুত গাড়িতে উঠে। সেই হ্যাংলা পাতলা রোগা লোকটি অনন্যার সেই গাড়িটির দিকে তাঁকিয়ে কুৎসিত হাসি দিয়ে, নিজের দলবলদের নিয়ে, বাইক নিয়ে গাড়ির পিছনে যেতে থাকে। ব্যাংক থেকে কিছুদূর আসতেই, হঠাৎ অনন্যার গাড়িটা থেমে যায়। অনন্যা ‘ ওহ শিট ‘ বলে উঠে। অনন্যা বুঝতে পারে, হয়তো গাড়ির চাকা পাঞ্চার হয়ে গিয়েছে। সে গাড়িটা থেকে নেমে, পিছনের ডেকিতে চাকা খুঁজতে শুরু করে, কিন্তু এক্সট্রা চাকা নেই। অনন্যা গাড়ি লক করে।অত:পর পার্স থেকে ফোন বের করে, মেনেজারকে ফোন করে জানায়, সে যেন ম্যাকানিক নিয়ে এসে, গাড়িটি সারিয়ে বাড়িয়ে পৌঁছে দেয়। অনন্যা গাড়ি সাড়ানো অব্দি অপেক্ষা করতে পারবে না, তাকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে। অনন্যার মনে হলো তার পদে পদে বিপদ! কোন কাজ সুষ্ঠুভাবে হবেনা, হয়তো ঘেটে যাবে। গাড়িটাই বা এসময়ে খারাপ হবে কেন? সে রিকশার জন্যে অপেক্ষা করলেও, তার মনের সংশয় হচ্ছে, আদোও কি সে রিকশা পাবে? হয়তো আজ ভাগ্য কোনভাবেই তার সহায় নয়। কথাগুলো ভেবে অনন্যা না দাঁড়িয়ে, হেটে সামনের দিকে যেতে লাগলো কিন্তু বিপত্তি ঘটলো গলির সামনে এসে। সেই বখাটেগুলো বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। অনন্যাকে ফের আরেক পলক দেখে বিকৃতভাবে তাঁকালো হ্যাংলা পাতলা লোকটি। মুখে কুৎসিত হাঁসির রেশ! লোকটা আবারোও বলে উঠলো, ‘ কি মাইয়া? আসো, আমাগো লগে। এক রাইতের সুখ দিলে, মেলা টাকা পাইবা। তোমার শরীর আমার মেলা পছন্দ হইছে। ‘
লোকটির কথা শুনে তার সাথে বখাটেরাও বিচ্ছিরি ভাবে হাঁসতে থাকে। তাদের কথাবার্তা এবং বিচ্ছিরি অঙ্গবঙ্গিতে ঘৃণায় গা রি রি করতে থাকে অনন্যার। অনন্যা রাগে সামনে এগিয়ে লোকটার গালে থাপ্পড় মে/রে চেঁচিয়ে বলে, ‘ লজ্জা হওয়া উচিৎ আপনাদের। একজন মেয়েকে সম্মান করতে না পারলে, অন্তত অসম্মান করবেন না। মেয়েরা কি আপনাদের কাছে পন্য? এতোটা কুৎসিত মানুষিকতা কিকরে হতে পারে আপনাদের?’

বখাটে লোকটির মুখস্রীর ধরণ পরক্ষনেই পাল্টে যায়। ছোট ছোট আখিজোড়ায় ক্রোধে টকটকে লাল হয়ে যায়। তার পাশে থাকা কম বয়স্ক বখাটে ছেলেটি, অনন্যার দিকে তাঁকিয়ে বলে, ‘ এত্তো বড় সাহস! ভালো কথার দাম নেই ওস্তাদ। ওরে তুলে নিয়ে যাই, চলেন। এমন অবস্হা আজকে করবো, এই দেমাগী কখনো নিজের চেহারা সমাজের সামনে দেহাইতে পারবো না। ‘

অনন্যা বুঝতে পারে, অনন্যা যতই সাহস দেখাক, এতোগুলো বাজে বখাটাদের সাথে সে কিছুতেই পেরে উঠবে না। সে পিছাতে থাকে, কিন্তু বখাটেগুলো যখন তার দিকে এগিয়ে আসছে, সে তখন দৌড়ে সামনের দিকে যেতে থাকে। পিছনে পিছনে বখাটে গুলোও দৌড়াতে থাকে। তার কিছুটা দূরেই, ফারিশ গাড়িতে বসে ছিলো। সে ইচ্ছে করেই, অনন্যাকে সাহায্য করছে না, কারণ সে অবগত হতে চায় অনন্যার সাহস সম্পর্কে। অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে পরলে সে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করে, সেই সম্পর্কে ধারণা নিতে চায়। ফারিশ গাড়ির জানালা নামাতে নামাতে বলে, ‘ যেকোনে গেমে নিজের শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে গেলে, তার সাহস, তার দুর্বলতা সম্পর্কে প্রতক্ষভাবে অবগত থাকতে হয়।তবেই সেই শত্রুকে হারানো সহজ, নাহলে গেম জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। গেম শেষ হয় না, চলতেই থাকে। তখন মজাও ফিকে হয়ে যায়। ‘

ফারিশ কথাটি বলেই সিগারেট ধরায়,কিন্তু তার মনে হয়, অনন্যা নামক রমনী অন্যদের মতো নয়, সে ব্যাতিক্রম!
অনন্যা দৌড়াতে দৌড়াতে পরে যায়, তার হাতে থাকা টাকার ব্যাগটাও রাস্তার পাশে গিয়ে ছিটকে পরে যায়। বখাটে লোকগুলো এসে থেমে যায়। সেই হ্যাংলা পাতলা লোকটা এগোতে নিলেই, অনন্যা তার পাশে থাকা ভারি ইটের টুকরো নিয়ে, লোকটার কপাল বরাবর ছুড়ে মারে। লোকটা সজোড়ে আঘা/ত পেয়ে মাটিতে বসে পরে। বাকিরা তা দেখে, লোকটাকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে। অনন্যা সেই সুযোগে দৌড়াতে থাকে, দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ আরেকজনের গাঁয়ের সাথে ধাক্কা খায়।

____________________

পাঁচ বছরের ছোট্ট মিষ্টি তার রুমে খাটের উপর বসে,আকাঁআকি করছিলো। একজন সার্ভেন্ট রুমে এসে, দরজায় কড়া নাড়তেই, সে খাট থেকে নেমে যায়। মহিলা সার্ভেন্টটি খাবার হাতে, বিছানার পাশে খাবার রেখে বললো, ‘ মিষ্টি সোনা, খেয়ে নাও। রাত হয়ে গিয়েছে, অনেক। ‘

মিষ্টি মুখ বেঁকিয়ে বললো, ‘ বাপি কোথায়? বাপি, নিজ হাতে খায়িয়ে না দিলে, খাবো না। যাও, তুমি।’

‘ এমনভাবে বলে না, মা! ছোট স্যার তো কাজে আছে। ফিরতে অনেক রাত হবে। সেই পর্যন্ত না খেয়ে থাকবে? ‘

‘ হ্যা, হ্যা। না খেয়েই থাকবো। বাপি না আসা অব্দি মিষ্টি কিচ্ছু খাবেনা। ‘

বলেই মিষ্টি বারান্দায় চলে গেলো। সেখানে তার পোষা একটি ময়না আছে। তার বাপি তার জন্মদিনে দিয়েছিলো। মিষ্টির বেশিরভাগই সময়ই তার ময়নার সাথে কাটে। মিষ্টি বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে,

‘ ময়না! এই ময়না! বল মিষ্টি। ডাক তো আমায়। ‘

ময়না ডাকে না, মিষ্টি প্রায় প্রতিদিন তার ময়নাকে মিষ্টি বলা ডাক শেখায়, কিন্তু ময়না কিছুতেই তাকে মিষ্টি বলে ডাকে না, কিন্তু তার বাপি তাকে বলেছিলো ময়না পাখি নাম ধরে ডাকতে পারে, তবে তার নাম ধরে ডাকছে না কেন? ময়নার কাছে বোধহয় মিষ্টি নাম উচ্চারণ বেশ কঠিন মনে হচ্ছে, তবুও মিষ্টি চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তার বিশ্বাস কোন এক ভোরে তার ময়না চেঁচিয়ে ডাকবে, ‘ মিষ্টি, মিষ্টি……..’

_________________

অনন্যা তার সামনে থাকা ব্যাক্তিটিকে দেখে তৎক্ষনাৎ সরে যায়। অভি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাঁকিয়ে আছে। অভি বুঝতে পারছে না, অনন্যা কেন দৌড়ে আসছে। অভি তার চেম্বার থেকে গাড়ি করে, বাড়ি ফিরছিলো, হঠাৎ অনন্যাকে দৌড়ে আসতে দেখে, গাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে।তখনি অনন্যা দৌড়াতে দৌড়াতে সরাসরি অভির বুকে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পরে। অভি অনন্যাকে বিধস্ত অবস্হায় দেখে বলে, ‘ কি হয়েছে তোমার অনন্যা? ‘

তখনি অভি দেখতে পায়, পিছনে পিছনে সেই বখাটে গুলোও আসছে, যার মধ্যে একজনের মাথায় বেশ বাজেভাবে জখম হয়ে আছে। সেই বখাটের দেখে, অভির বুঝতে বাকি নেই, অনন্যা কেন দৌড়ে আসছিলো।

‘ রাস্কেলগুলোর সাহস দেখে,সত্যিই অবাক হচ্ছি। ওয়েট! ওদের দেখাচ্ছি মজা। ‘

বলে অভি বখাটাদের সামনে যেতে নিলেই, অনন্যা হাত বাড়িয়ে অভিকে থামিয়ে, কঠোর গলায় বলতে থাকে, ‘ থ্যাংকস ফর ইউর কনসার্ন, কিন্তু অভি শিকদারের একজন নষ্টা মেয়ের জন্যে, নিজের মূল্যবান সময় নষ্টা করা অনুচিত। ‘

অনন্যার কথা শুনে অভি থেমে যায়। অনন্যা হাতের ইশারা করে, অভিকে সামনে তাঁকাতে বলে। অভি সামনে তাঁকাতেই দেখে, ইতিমধ্যে পুলিশ এসে, সেই বখাটেদের ধরে ফেলেছে। অনন্যা দৌড়াতেই দৌড়াতেই, ত্রিপল নাইনে ডায়েল করে, ফোন করে ফেলেছিলো। পাশেই থানা ছিলো বিধায়, অনন্যার ফোন পেয়ে, তৎক্ষনাৎ পুলিশ চলে আসে। অনন্যা অভির দিকে তাঁকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

‘ অনন্যা নিজের বিপদ, একাই কাটিয়ে উঠতে পারে।
তার জন্যে আপনার মতো মানুষের অন্তত সাহায্যের প্রয়োজন হবে না। আপনি বরং, আপনার হবু বউকে নিয়ে চিন্তা করুন। আমাকে নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে। আমার জন্যে আমি একাই যথেষ্ট। ‘

কথাটি বলেই অনন্যা চলে যায়। অভি সেখানে দাঁড়িয়ে পরে। এতোক্ষন যাবৎ সমস্ত কিছুই পর্যবেক্ষন করে যাচ্ছিলো, ফারিশ। সর্বশেষে সে বাঁকা হেসে, গাড়ি ঘুড়িয়ে, অফিসের দিকে রওনা হয়।

_______________________
অন্যদিকে অনন্যা সেই গলিতে এসে হন্ন হয়ে সেই টাকার কালো ব্যাগটি খুঁজতে থাকে, কিন্তু কিছুতেই পায় না। এই ঢাকা শহরে এতোগুলো টাকার ব্যাগ পেয়ে, কেউ নিশ্চই বুঝি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করবে না,ফেরত দেওয়ার জন্যে। এমন মানুষ দূর্লভ বটে। সৎ মানুষের থেকে অসৎ মানুষের
সংখ্যাই বেশি। অনন্যা ধপ করে বসে পরে। এতো চেষ্টা করেও, কোন লাভ হলো না। প্রচুর কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে, আজ কেউ তার পাশে নাই। না আছে বাবা-মা, না আছে ভালোবাসার মানুষ আর না আছে কোন বন্ধু, যার বুকে মাথা রেখে বেশ কিছুক্ষন কেঁদে হাল্কা হওয়া যাবে, কিন্তু অনন্যা ভাবে তাকে কাঁদলে চলবে না। তার বাবার জন্যে হলেও, তাকে শক্ত থাকতে হবে।
___________________
ফারিশ কিছু ফাইল ঘাটছিলো, নজর তার সামনে থাকা সিসিটিভি ফুটেজের স্ক্রিনের উপর। হঠাৎই তার অধরে রহস্যময় হাঁসি ফুঠে উঠে……

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে