প্রণয়ের রংধনু পর্ব-০৩

0
680

#প্রণয়ের_রংধনু ✨
#পর্ব-৩
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
নিজের ভালোবাসার মানুষের বুকে অন্য এক মেয়েকে দেখলে,তা কতটা যন্ত্রনাময় হয়, একটি মেয়ের জন্যে তা হয়তো বর্ণনা করে মুশকিল।অনন্যা আসার পূর্বে জুঁই এসেই হুট করে অভিকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। কেন বুঝোনা তুমি? অনন্যা তোমায় কখনো ভালোবাসে নি। আমি বলেছিলাম তোমায় অভি! অনন্যা ভালো মেয়ে না। ওর চরিত্রে সমস্যা আছে, কিন্তু আমার কোন কথাই তো বিশ্বাস করো নি, তুমি। আজ বুঝতে পারলে তো? সেদিন আমার কথা অবিশ্বাস করে কতটা ভুল করেছিলে।’
জুঁইয়ের কথা শুনে অভির মনে পরে যায়, হ্যা জুঁই তাকে বহুবার অনন্যার চরিত্র সমন্ধে বারংবার সর্তক করলেও, সে শুনেনি বরং সে বারংবার এড়িয়ে গিয়েছে। অনন্যার প্রেমে সে একপ্রকার অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তাই ফলস্বরুপ এতো বাজেভাবে ঠকতে হলো তাকে। অভির ভাবনার মাঝেই, সেখানে অনন্যা এসে, তাদের একসাথে ঘনিষ্ঠ অবস্হায় দেখে ফেলে। অভি এতোক্ষন যাবৎ জুঁইকে নিজের থেকে সরাতে চাইলেও, অনন্যাকে দেখে সে জুঁইকে সরানোর বিন্দুমাত্র প্রয়াস করলো না। অনন্যাকে দেখে বেশ ক্ষোভ নিয়ে, নিজ থেকেই অভির থেকে সরে দাঁড়ালো জুঁই। অনন্যা কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে থাকে, ‘ জুঁই তুই এখানে? কি করছিস এইসব?’

জুঁই কিছু বলার পূর্বে, অভি এগিয়ে এসে বলে,

‘ তার আগে তুমি বলো! কেন এসেছো এখানে? ওহো! বিয়ের বেনারসি এখনো গাঁয়ে! তা কোন আশায় এসেছো এখানে? হাত- পা ধরে বিয়ে করতে বলবে নিশ্চই, ‘আমাকে বিয়ে করো অভি! ‘কেন যার সাথে রাত কাটিয়েছো দিনের পর দিন সে বুঝি এখন ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে ?’
জুঁই অভির কথা শুনে মুচকি হাঁসে। এতোদিন ধরে সে যা চাচ্ছিলো তাই হয়েছে। অনন্যা অভির কথা শুনে বিন্দুমাত্র অবাক হয়না। কারণ যেই মানুষটি ভরা বিয়ের আসরে, এতো বাজে বাজে কথা বলে অপমান করতে পেরেছে, সে নিশ্চই এখন সম্মানজনক কোন কথা বলবে না। অনন্যার ভাবনার মাঝেই, অভি পুনরায় কটাক্ষ করে বলে,

‘ এতো ঘটনা ঘটার পরেও কীকরে পারলে আমার সামনে বেহায়ার মতো আসতে, লজ্জা করলো না? ছিহ! একজন প্রস্টেটিউটেরও বোধহয় তোমার থেকে বেশি মান- সম্মান বোধটুকু আছে। ‘

অভির শেষ কথা টুকু শুনে গাঁ শিউরে উঠছে অনন্যার। একজন মানুষ কীকরে তার নিজের ভালোবাসার মানুষকে এতোটা অসম্মান করতে পারে? বারংবার তাকে একজন পতিতার সাথে তুলনা করে যাচ্ছে অভি।নিজের ভেতরের ক্ষোভটুকুকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলো না অনন্যা। ঠাটিয়ে পরপর অভির দুটো গালে, দুটো করে
থাপ্প/ড় বসিয়ে দিলো সে। জুঁই হতভম্ব! অভি নিজের গালে হাত রেখে মাথা নিচু করে ফেললো। রাগে- দু:খে, কান্নামিশ্রিত গলায় অনন্যা বলতে থাকে,
‘ আমার আজ নিজের প্রতি সত্যিই লজ্জা করছে অভি। আমি তোমার মতো মানুষকে ভালোবেসেছি। যেই মানুষ সম্মানই করতে পারে না, তার ভালোবাসার উপরই আমার সংদেহ হচ্ছে। আদোও কখনো তুমি আমায় ভালোবেসে ছিলে তো! আমারই দোষ, আমি বোকার মতো ভেবে বসেছিলাম এই বিপদের সময় হয়তো তুমি আমায় ফিরিয়ে দিবেনা, কিন্তু তুমি আমায় কি নিখুঁতভাবে ভুলটা শুধরে দিলে। ‘

কথাটি বলে অনন্যা চলে যেতে নিলে, অভি জুঁইয়ের হাত ধরে অনন্যাকে শুনিয়ে বলে, ‘ তুমি আমাকে ভালোবাসো তাইনা জুঁই? ‘

অভির কথা শুনে জুঁই সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘ হ্যা অভি! আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। অনেক অনেক! ‘

অভি অনন্যার দিকে তাঁকিয়ে বলে, ‘ তবে আজ অভি শিকদার তোমায় কথা দিচ্ছে বিয়ে করলে, তোমাকেই করবে। নিজের জীবন আমি গুঁছিয়ে নিবো। কোন চরিত্রহীন মেয়ের জন্যে আমার জীবন থেমে থাকবে না।’
অভির কথা শুনে জুঁই খুশি হয়ে অভিকে জড়িয়ে ধরে। নিজের বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতাও অবাক করলো না অনন্যাকে। তার ভাগ্যের প্রতি আজকাল তার প্রচুর হাঁসি পায়। অনন্যা অভির দিকে ফিরে তাঁকিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে বলে,

‘ চলে যাচ্ছি আমি অভি! আজ আমিও কথা দিচ্ছি, কখনো এই চরিত্রহীন মেয়েটাকে তোমার দেখতে হবেনা, তুমি চাইলেও তাকে কখনো দেখতে পারবে না।তবে কে বলতে পারে? একদিন এই চরিত্রহীন মেয়েটার জন্যেই হয়তো তোমাকে আফসোস করতে হবে। ‘

‘ হ্যা আফসোস হচ্ছে। বড্ড আফসোস হচ্ছে, তোমার মতো মেয়েকে এই অভি শিকদার ভালোবেসে ছিলো। নাও জাস্ট লিভ প্লিয। ‘

অনন্যা কোনপ্রকার উত্তর দিলো না। অভি লক্ষ্য করছে অনন্যার অশ্রুসিক্ত নয়নে কাজল ঘেটে একশা অবস্হা, তবুও কি সুন্দর স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে! কি পবিত্র লাগছে কিন্তু বাস্তবতা চরম ভিন্ন! অভি মুখ ঘুড়িয়ে ফেলে। অনন্যা সামান্য তাচ্ছিল্যের হাঁসি হেসে বের হয়ে যায়। অনন্যা বেরিয়ে যেতেই, জুঁইকে নিজের থেকে সরিয়ে, অভি বলে উঠে,

‘ জুঁই এখন তুমি যাও। আমাকে দয়া করে একা থাকতে দাও। ‘

‘ কিন্তু অভি……’

‘ প্লিয লিভ মি এলন। ‘

জুঁই মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, রকিং চেয়ারে, কপালে হাত রেখে বসে থাকে।
_____________

অভির অফিস থেকেই অনন্যা হসপিটালে ছুটে যায় তার বাবাকে একঝলক দেখতে। সেখানে শেফা বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন। মাকে দেখে বুক কেঁপে উঠে অনন্যার। মধয়বস্কক হলেও যথেষ্ট সুন্দরী শেফা বেগম। কিছুমুহুর্তের মধ্যে নানা দুশ্চিন্তায় চোখের নীচে কালো দাগ পরে গিয়েছে। বেশ অসহায় লাগছে নিজের কাছে অনন্যাকে। সে চাইলেও কিছু করতে পারছে না। আজ ফারিশ নামক নিকৃষ্ট লোকের জন্যে জীবনের এমন করুন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে অনন্যার। অনন্যা নিজের অশ্রুটুকু মুছে, শেফা বেগমের কাঁধে হাত রাখতেই, তিনি তড়িৎ গতিতে মাথা উঁচু করে তাঁকালেন। মনের এমন জটিল অবস্হায় সমস্ত ক্ষোভ তিনি অনন্যার দিকে উগড়ে দিয়ে বললেন, ‘ টাকা জোগাড় হয়েছে?’

অনন্যা মাথা নাড়িয়ে ‘না ‘ বলে। অর্থাৎ সে পারেনি। শেফা বেগম শক্ত করে অনন্যার বাহু চেপে ধরে, প্রশ্ন করে,
‘ তাহলে কেন এসেছিস তুই? আমাদের এতো বড় ক্ষতি করেও কি তোর শান্তি হয়নি? নষ্টা মেয়ে-মানুষ! এতো বড় কান্ড করেও, কী করে পারছে সামনে আসতে! তোর শোকেই মানুষটা আজ মৃত্যুযাত্রী। ‘

অনন্যা কাঁদতে কাঁদতে মায়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে, ‘ মা! আমার উপর দয়া করে বিশ্বাস করো। তোমরা আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে, আমার কীকরে বাঁচবো বলো? ‘

শেফা বেগম তৎক্ষনাৎ চিৎকারের সহিত উত্তর বললেন, ‘ তাহলে ম/রে যা। অন্তত ম/রে গিয়ে আমাদের উদ্ধার কর। ‘

মায়ের কথা শুনে অনন্যা ভাবতে থাকে, সে কি তবে সত্যিই নিজেকে শেষ করে দিবে? সে ম/রে গেলেই
কি তবে তার বাবা- মায়ের ঝামেলা শেষ হবে? পরক্ষনেই সে ভাবলো, সে কেন ম/রবে? সে তো কোন অন্যায় করেনি। তাকে উঠে দাঁড়াতে হবে। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। অনন্যার মনে পরে যায়,ছোটবেলায় যখন সে একবার পরে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছিলো, তখন সে কি তার কান্না। তখন তার বাবা তার হাত ধরে তাকে উঠিয়ে, মাথায় হাত রেখে বলেছিলে, ‘ ডোন্ট ক্রাই মাই প্রিন্সেস! আমার প্রিন্সেস তো এতো দূর্বল নয়, সামান্য আঘাতে দূর্বল হলে চলবে না, আমার সোনা। দুনিয়াটা বেশ কঠিন, মা। অনেক বড় বড় লড়াই তোমাকে সাহসের সহিত লড়তে হবে। মনে রেখো মা! তোমার বাপি সবসময় তোমার সাথে থাকবে না। একটা সময় কেউ থাকবে না তোমার পাশে, সবাই তোমাকে একা করে দিবে,কিন্তু তুমি লড়াই চালিয়ে যেও। কারণ তুমি আমার স্ট্রং প্রিন্সেস। ‘

ছোটবেলায় বাবার বলা সেই কথাগুলো মনে পরতেই, নিজেকে সামলিয়ে নেয় অনন্যা। সে তো দূর্বল নয়, তাকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে, তবে তার আগে, তার বাবার চিকিৎসার জন্যে তাকে টাকা জোগাড় হবে।

_________________________
সন্ধ্যা সারে ৭টা বাজতে চললো। রাত ১১টার মধ্যে হসপিটালে টাকা জমা দিতে হবে অনন্যাকে। অনন্যা হাল ছেড়ে দেয়নি। সে নিজের বাসায় এসে, ফ্রেশ হয়ে বিয়ের বেনারসি খুলে, সুতির সেলোয়ার কামিজ পরে ফেলে। তার এখন নিজেকে শক্ত রাখতে হবে, নিজের বাবা- মায়ের জন্যে হলেও। সে তার বাবার রুমের আলমারি ঘেটে কয়েকটা ফাইল বের করে, ঘাটতে থাকে। অনন্যার নামে বেশ কয়েকটি ডিপোজিট করেছেন লতিফ হাওলাদার। সেইগুলো ভেঙ্গেই আজকের মতো হসপিটালের বিল পরিশোধ করতে পারবে অনন্যা, বাকিটা কালকে জোগাড় করে ফেলবে। অনন্যা ফাইলগুলো হাতে নিয়ে বাইরে এসে,নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে বেড়িয়ে পরলো ব্যাংকের উদ্দেশ্যে। অনন্যা হয়তো জানেনা, তার পিছনে পিছনে বেশ কিছু গাড়ি রয়েছে, যারা প্রতিনিয়ত অনন্যাকে ফলো করছে। অনন্যা ব্যাংকের সামনের গাড়ি থামিয়ে, ব্যাংকের ভেতরে চলে যায়। অনন্যার পিছনে পিছনে, কালো পরিহিত কিছু লোকগুলোও ভিতরে প্রবেশ করে। অনন্যা কাউন্টারে গিয়ে, মেনেজারের সাথে দেখা করে,কথা বলতে থাকে।
অপরদিকে,ফারিশ নিজের অফিসে বসে, হাতের উপর হাত রেখে ল্যাপটপে অনন্যার কার্যক্রম দেখতে থাকে। কালো পোষাক পরিহিত লোকগুলো ফারিশের, যারা সর্বোক্ষন অনন্যাকে নজরে নজরে রেখেছে। ফারিশ অনন্যার দিকে তাঁকিয়ে মুচকি হেসে বলে, ‘ দম আছে মেয়েটার। ভেইরি ইন্টারেস্টিং গার্ল! আই রেইলি লাইক দিজ টাইপ অফ ইনার্জি। আহ,দ্যা গেম ইউল বি ভেইরি ইন্টারেস্টিং ইউথ হার।’
___________

ফিক্সড ডিপোজিটে একসাথে সব ক্যাশ না পেলেও, ২লাখের মতো ক্যাশ জোগাড় করতে পেরেছে অনন্যা। সেই টাকা দিয়ে অন্তত তার বাবার আজকের হসপিটালের বিলটুকু পরিশোধ করতে পারবে অনন্যা। টাকাগুলো নিয়ে ব্যাংক থেকে খুশিমনে বেড়িয়ে যায় অনন্যা কিন্তু ব্যাংক থেকে বেড়িয়ে আসতেই, অবাক হয়ে যায় সে।

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে