#প্রণয়িনীর_হৃদয়কোণে
#আফসানা_মিমি
| একুশ তম পর্ব | + |বাইশ তম পর্ব |
❌ কোনভাবেই কপি করা যাবে না।❌
হাবলু কিছুটা অসুস্থ। প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও এখন বেশ বুঝতে পারছি। তার রোগের ধরণ ঠিক এমন; রাত হলেই জেগে থাকে, ভাত কম খায়, সবসময় ভয়ে থাকে। বাবা, ভাইয়ার সামনে হাবলুকে দাঁড় করাতেই ভেবেছিল আমি এই হাবলুকে ভালবাসি। এটা কোন কথা! আমার থেকে বয়সে ছোট এই ছেলেকে আমি কেন ভালবাসতে যাবো? সাদা কইতরের নাম বলতো তবুও মানা যেত। হাবলুকে যখন বাবা জিজ্ঞেস করেছিল হাবলু তখন লজ্জায় মরে যায় অবস্থা। আমার চোখ রাঙানি দেখে বলেছিল,
” আফা খুব ভালা। আমারে তিনবেলা খাওন আর কাম দিব কইছে।”
বাবা ভাইয়া বিশ্বাস করেছিল এবং আমাকে বাহবা দিচ্ছিল।
এর মধ্যে অনেক দিবস রজনী কে’টে গিয়েছে। সাদা কইতরের বাড়িতে আর যাওয়া হয়নি। কেননা আগামীকাল আমার ফাইনাল পরীক্ষা। সারা বছর পড়াশোনা না করার ফলে এখন পড়তে হচ্ছে। পাশ তো করতে হবে! ভাইয়ার বিয়ে আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পর। আমি পড়াশোনায় যেন অমনোযোগী না হই তাই বাবা, ভাইয়া কড়া নজরে রেখেছে।
এই যে এখনো পড়ছি। সাত সকালে ব্রাশ করেই পড়তে বসেছি। বাংলা আনন্দপাঠ থেকে লালসালু। আমার কাছে মজিদ ইতর উপাধি পাবে। চঞ্চলতার দিক দিয়ে জমিলার সাথে আমার খুব মিলে। আমি যদি সেই কালে থাকতাম না! লালসালু উপন্যাসের লেখক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ স্যারকে বলতাম জমিলার মাঝে আরো চঞ্চলতা দিতে তবে বুদ্ধি কমাতে বলতাম না।
বর্তমানে বই কিতাবের কথা বাদ দেই। হাবলু আমার পুরাতন খাতা ভাঁজ করছে। বাহিরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সূর্যিমামা সেই কখন উদিত হয়েছে। এতক্ষণে পৃথিবীর মানুষদের ব্যস্ততাও শুরু হয়ে গেছে। একমাত্র আমিই ঘরে বসে খাতা কলমে আঁকিবুকি করছি। অনেকদিন হয়েছে আমার নয়া জামাইয়ের খবরাখবর নেওয়া হয় না। বাবা, ভাইয়ার নজর সিসি টিভি ক্যামেরার চেয়েও স্পষ্ট, পরিষ্কার। আমি টেবিল থেকে উঠলেই খবর সেখানে চলে যাবে। খোঁজ খবর নিলে অন্যের মাধ্যমেও তো নেওয়া যায় তাই না? হাবলুকে পাঠালেই তো কাজ হয়ে যাবে। হাবলু খাতা ভাজ করে, শেষ হয়ে যাওয়া কলম একপাশ করছে। হাবলুর হাতে মিনি দূরবীন ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
” আবুলের বাই হাবলু। এখনই ছাদে যাবি। আশেপাশে ছাদে আমার সাদা কইতরকে খুঁজবি।”
হাবলু কিছুক্ষণ ওর মাথা চুলকে আমার কথার মর্মার্থ বুঝতে চেষ্টা করল। না বুঝেই উত্তর দিল,
“সাদা কইতর যদি না পাই? কালা কইতর হইলে চলবো?”
” এত প্রশ্ন করিস কেন? আগে তো তুই যাবি! গিয়ে দেখ দূর দূরান্তে ছাদে কোন সাদা কইতর দেখতে পাস কিনা।”
হাবলু কিছু বুঝেছে কিনা জানিনা। মাথা হ্যাঁ বোধক ইশারা করে হাবলু ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে চলে গেছে। এদিকে আমি ভাবছি সাদা কইতরের কী আমার কথা আদৌও মনে আছে? এতদিন তো বউ বউ করে মাথায় চড়িয়ে রাখতো আর এখন তো কোন খোঁজ খবরই নেয় না।
হঠাৎ আমার মনে হল হাবলুকে যে ছাদে পাঠালাম, হাবলু কি চিনতে পারবে? আমি তো ছেলেটাকে ভালো করে সাদা কইতরের পরিচয় বলিনি। দেখা যাবে বোকা ছেলেটা সত্যিকারের সাদা কইতর খুঁজে বের করবে। বেশি কিছু না ভেবে দৌড় দিলাম ছাদের দিকে।
বোকা হাবলু চোখে মিনি দূরবীন লাগিয়ে আমার কথামতো এই ছাদ থেকে সেই ছাদে নিকটবর্তী থেকে দূরবর্তী সব ছাদে নজর ঘুরাচ্ছে কিন্তু আসল ছাদের দিকে তাকাচ্ছে না। আমি হালকা ঝাপসা দেখতে পাচ্ছি সাদা কইতরদের ছাদে দুইজন মানুষ আছে এবং তারা এদিকে তাকিয়ে আছে। হাবলুর কাছে গিয়ে মাথায় একটা ঘাট্টা মেরে দূরবীনটা হাতে নিয়ে দৌড় দিলাম চিলেকোঠা ঘরের ভিতরে।
এখান থেকে সাদা কইতরকে দেখতে পাব কিন্তু সাদা কইতর আমাকে দেখতে পাবে না। কি মজা। এবার বুঝুক আমাকে সবসময় বকা দেওয়া, শাস্তি দেওয়া! এখনতো রাতে দরজা জানালা কিছুই খোলা রেখে ঘুমাই না। আমি জানি সাদা কইতর সুযোগ পেলেই টুক করে আমার ঘরের ভেতর ঢুকে যাবে এবং আমাকে জ্বালাতন করা শুরু করবে। হাবলুর দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ছেলেটা বোকা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে যা ইচ্ছা করুক আমি আগে সাদা কইতরকে দেখে নেই। ছাদের চিলেকোঠায় একটি গোপন গর্ত আছে। যে গর্তটা আমি করেছি দুষ্টুমি করার জন্য। আজ সেটা কাজে লাগবো। চোখে দূরবীন লাগাতে দেখতে পেলাম সাদা কইতর এদিকেই ফিরে তাকিয়ে আছে। নজর একটু চারপাশে ঘুরাতেই দেখতে পেলাম নেংটি কইতর উপুর হয়ে কি যেন আঁকছে। নেংটি কইতরকে দেখে হাসি পেয়ে গেল। কেননা নেংটি কইতর তার থেকেও আয়তনে এবং আকারে বড়ো একটি টুলের উপর বসে নিচু হয়ে আঁকছিল। দেখে মনে হচ্ছে যেন সে হাত দিয়ে নয় মাথা দিয়ে আঁকছে।
সাদা কইতর দাঁড়ানোর স্টাইল এবার পরিবর্তন হয়েছে। কোমরে হাত রেখে রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমাদের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে যেন আমাকে পেলে কাচ্চা চিবিয়ে খাবে। কিন্তু আমি তো তা হতে দেবো না। এত সহজে সাদা কইতরের হাতে আর ধরা দিচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলাম সাদা কইতর হাত দিয়ে আমাদের ছাদের দিকেই ইশারা করছে। হাই, হ্যালো যেভাবে যা পারছে তাই করছে কিন্তু আমি চিলকোঠার ঘর থেকে বের হচ্ছি না। আরো কিছু সময় পার হয়ে যায়। সাদা কইতর ঝুঁকে পেইন্টিংয়ের খাতাটা হাতে নেয় এবং সেটা আমার দিকে তাক করে দাঁড়ায়,
” উই আর মিস ইউ দুষ্টুরানী।”
আমি অবাক, স্তব্ধ। মাথায় কোন কিছুই কাজ করছে না। এই দুইজন মানুষ আমাকে এত ভালোবাসা এবং এত মনে রাখে জামার ভাবনার বাহিরে ছিল। কিন্তু আমি তো মনে মনে পন করেছি যে তাদের সামনে যাবো না। এবার কি করি।
ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা বুদ্ধি চলে আসলো হাবলুকে ডেকে ডাক দিযলাম তৎক্ষণাৎ। ম্যাসেজ পাঠাতে হলে হাবলুর মাধ্যমে পাঠাতে হবে। তাই হাবলুর হাতে একটি লাল উড়না ধরিয়ে দিলাম এবং বললাম, ” এ ওড়না ধরে ছাদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াবি এবং মাথার উপর ওড়না ধরে কতক্ষণ গোল গোল করে ঘুরবি।”
” আফা আমি তো পুলা। এমন ভাবে ঘুরলে তো আমারে সবাই হিজলা কইবো।”
হাবলু কাজ না করে দিলে কীভাবে? ছেলেটাকে ধমকের উপর রাখতে হবে। নয়তো কাজ করবে না। তাই বললাম,
” আমার মুখের উপর কথা বলিস বেয়াদব ছেলে? এখনই আমি তোর সব আরাম বন্ধ করে দেব। এই আবুলের ভাই হাবলু! তুই না খুব ভালো ছেলে। আমি না তোকে অ আ ই ঈ এর সাথে A B C Dও শেখাব। আর প্রতিদিন তোরে আমি পাঁচ টাকা করে দিব।”
” পাঁচ টাকা দিয়ে কিছু পাওয়া যায় না আপা। আমার টেহা লাগবো না আপনার বাড়ি নুন খাই তাই আমি কামটা কইরা দিতাছি।”
যাক আমার বেশি কষ্ট করতে হয়নি। হাবলু এমনিই মেনে গেছে। ছাদে বের হয়ে হাবলু আসে পাশে কিছুক্ষণ তাকালো এরপর মাথায় ওড়না দিয়ে গুজরাটের মহিলাদের মত ঘুরঘুর করে ঘুরতে লাগলো
শুধু ঘুরলে একটা কথা ছিল। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় নাচা শুরু করল। এদিকে আমি হাবলুর কান্ড থেকে হাসতে হাসতে শেষ। দূরবীন চোখে লাগিয়ে দেখতে পেলাম সাদা কইতর আর নেংটি কইতর হা করে এদিকে তাকিয়ে আছে। ভীষণ হাসি পেল। নেংটি কইতর তো আমার মত চোখে দূরবীন লাগিয়ে নিয়েছে এবং সে সাদা কইতরকে একটু পর পর কি যেন বলছে। যাক দুজনকে কিছুক্ষণ জ্বালাতে পারলাম এবার নিচে চলে যাই।
———————–
আজ আমার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। ভোর সকাল থেকেই দৌঁড়ের উপর আছি। ট্রেনের গতিতে পড়ছি। আমার পিছু পিছু ভাই এবং বাবাও দৌঁড়াচ্ছে সাথে হাবলু বেচারাও। হাবলু আমার সাথে সাথে থেকে রাত জেগে পড়েছে আপনারা ভাবছেন কি পড়েছে? আরে বলছি বলছি ও অ আ ই ঈ ছাড়া কিছুই পারে না আমি সব ওকে শিখিয়েছি। একা রাতে পড়াশোনা করতে ভয় লাগে এজন্য হাবলুকে পড়ার নামে বডিগার্ড হিসেবে রেখে দিয়েছি। সে হাবলু আজ আমার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে খাবারের জন্য।
পরীক্ষার আর দেড় ঘন্টা বাকি আছে। এখনই আমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব। আজ বাবা এবং ভাইয়া কেউ কাজে যায়নি। আমাকে সাথে করে পরীক্ষার হল পর্যন্ত নিয়ে যাবে এবং নিয়ে আসবে।
নিপা ভাবী কিছুক্ষণ আগে ফোন করেছিল। পরীক্ষার জন্য অনেক কিছু বুঝালো। যেন টেনশন না করি, ভালোভাবে পড়াশোনা পরীক্ষা, আশে পাশে না তাকাই ইত্যাদি ইত্যাদি ।আমি এক কান দিয়ে ঢুকিয়েছি আরেক কান দিয়ে বের করেছি। আমার রিভিশন দেওয়া শেষ। এবার বের হব নিচে নামতে দেখতে পেলাম ভাইয়া বাটিতে করে কি যেন নিয়ে আসছে। আমার কাছে নিয়ে আসতে দেখতে পেলাম ডিম সেদ্ধ। ডিম তা দেখে হাবলু জোরে চিৎকার করে উঠে বলে,
আরে ভাইজান আরে ভাইজান কি করছেন ডিম খাওয়া না পারে আপা তাহলে পরীক্ষায় ডিমই পাইবো
হাবলু এখনো সেই আদিকালে বাস করে। আদিকালের দাদী নানীরা যে যা কথা বলতো ঠিক সেরকমই কথা বলে। ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর। আমি কখনো উপভোগ করি কখনো বিরক্ত হই। এই যে এখন খুবই বিরক্ত। যাওয়ার সময় উল্টাপাল্টা কাজ না করলে হয় না!
হাবলুর কথা শুনে ভাইয়া বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল,
” এসব কথা তোকে কে বলেছে শুনি? দাদি নানীদের মত কথা বলিস না। এখন আধুনিক যুগ আমি নিজে প্রমাণ করেছি ডিম খেয়ে ডিম পায় না ডিম খেলে বুদ্ধি বাড়ে।”
“আপনিও কি ডিম খাইয়া পরীক্ষা দিতে গেছিলেন?”
“অবশ্যই দিয়েছি এবং ভালো রেজাল্ট করেছি।”
” তো আজকে আমি অফারে খাইতে দিমু না আপনি যদি আমারে মা’ই’রা ফেলেন তবুও আমি রাজি হবো না। দেন ডিম আমি খাইয়া ফালাই।”
কথা বলে হাবলু এক সেকেন্ডও থামেনি। গপ গপ করলে দুইটা ডিম খেয়ে নিয়েছে।এদিকে ভাইয়া হাবলুকে মারার জন্য হাত তুলতে নিতে আমি থামিয়ে দেই আর বলি,
” হাবলুর কথার মানে, পরীক্ষায় ডিম খেয়ে পরীক্ষা দিতে যাই তাহলে ডিম পাবো তাই না! আজ ডিম খেয়ে যাব। আগামীকাল তোর কথা মানবো এরপর ডিম খেয়ে পরীক্ষা দিতে যাব। দেখব কোন পরীক্ষাটা ভালো হয় এবং কোন পরীক্ষাটা খারাপ হয়।”
আমার কথা যেন দুজনেরই পছন্দ হলো অবশেষে তিন গার্ডিয়ানের সাথে আমি একজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষার দিতে যাচ্ছি।
আজ আমার পরীক্ষা ভালো হবে কি খারাপ হবে তা জানি না। তবে পরীক্ষার আগে আমার অবস্থাটা খারাপ হবে তা সম্মুখে দাঁড়ানো ব্যক্তিকে দেখেই বুঝতে পারছি। মইনুল আঙ্কেলকে অনেকদিন পর দেখছি।
দুই হাতে দুইটা মাটির হাড়ি। মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমাকে দেখা মাত্রই হাসি আরও বেশি প্রশস্ত করে বলল,
” আমার পুরান বউ ফিরে আসছে। আমার যে কি খুশি লাগছে! এখন আগের মত আমি খেতে পারব ঘুরতে পারব কেউ বাঁধা দিবে না।”
পুরান বউ মানে যে বউ মইনুল আঙ্কেলকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেই বউ! তাহলে নতুন টার কি হলো? প্রশ্ন করার আগে সে উত্তর দিল,
“নতুনটা একটা পোলার লগে পিরিত ছিল। চইলা গেছে ভালোই হইছে। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা শুধু হাতির মতো খাইতো আর বায়ু দূষণ করতো। আমি না খেয়ে খেয়ে একদম কাঁচা মরিচ হয়ে গিয়েছিলাম।”
” এখন কি মিষ্টি আমাকে দিবেন মইনুল আঙ্কেল?”
” আরে মামনি তোমাকে দিব কেন? তুমি না পরীক্ষা দিতে যাচ্ছো! পরীক্ষার আগে গোল গোল জিনিস খেতে হয় না। তাহলে পরীক্ষায় গোল্লা পাবে। আমি তো এই মিষ্টি আমার পুরান বইয়ের জন্য নিয়ে যাচ্ছি। আজকে বউ এবং জামাইয়ের মাঝে প্রতিযোগিতা হবে যাই যাই।”
এটা কোন কথা! কোথায় ভেবেছিলাম পরীক্ষা দেওয়ার আগে মিষ্টিমুখ করে যাব কিন্তু তার হলো না। এদিকে বাবা এবং ভাইয়া হাসছে আশপাশের প্রতিবেশীদের আলোচনাও কানে আসছে কেউ কেউ তো বলছে,
“মইনুল আবার আগের মত খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। এবার জায়গায় জায়গায় বায়ু দূষণ হবে আর বোম ফাটাবে।”
” ওই শালাকে এলাকা ছাড়া করা উচিত।”
” আরে এলাকা ছাড়া না করে বাংলাদেশ থেকেই বের করে দেওয়া উচিত।”
বেচারা মইনুল আঙ্কেল। জীবনটাই বেদনাময়। বিয়ে করেও শান্তি পেল না। বিয়ে! আমি তো বিবাহিতা। স্বামী আছে। পরীক্ষায় যাওয়ার আগে দোয়া নিতে হয়। আমরা কিছু কিছু পরীক্ষার্থীরা দোয়ার অজুহাতে টাকা আদায় করি। তুবা তার স্বামীর কাছ থেকে দোয়া নিবে না তা কে মানা যায়! দশটা না পাঁচ টা না আমার একটা মাত্র জামাই। দোয়া না নিলে তো পরীক্ষা ভাল হবে না।
পরীক্ষার হলে যেতেই সাদা কইতরকে দেখতে পাই। আবরারের ডাব্বার সাথে দাঁড়িয়ে কারো অপেক্ষা করছে। আমি জানি সাদা কইতর কার জন্য অপেক্ষা করছে। অবশ্যই আমার জন্য। বাবা ভাইয়াকে ফেলে সাদা কইতরের সামনে এসে দাঁড়াই। আমাকে দেখে দুজনই চমকে যায়। আবরারের ডাব্বা বুকে থুথু দেওয়ার ভাব করে বলে,
” ভয় পাইছি।”
আবরারের ডাব্বার দিকে নজর দিলাম না। সাদা কইতরের দিকে এক হাত এগিয়ে বলি,
” দোয়া দাও সোয়ামি।”
আমার কথায় আবরারের ডাব্বার কাশি চলে আসে। খুক খুক করে কেশে পাশে চলে যায়। এদিকে সাদা কইতর শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কথা বলছে না। আমার আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে পরীক্ষার হলে ঢুকতে হবে। দেরী করা যাবে না। সাদা কইতরকে তাগাদা দিয়ে বললাম,
” কি হলো! এভাবে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকলে মানুষ ভিক্ষুক বলবে। বউকে এভাবে দাড় করিয়ে রাখবে নাকি?”
” স্বামী বলে মানছো তবে! কয়টা দায়িত্ব পালন করেছো শুনি?”
” সাদা কইতর একটা ত্যাড়া কইতর
লাগবে না অর্থ প্রাচুর্য
কিপটে তুই থাকবি তবে
বদ দোয়া দিলো ভদ্র মেয়ে।”
ত্যাড়াবাঁকা কথা না বললেই নয়! কোথায় আমাকে একটু উপদেশ বাণী শুনাবে তা না করে রোমান্টিক কথা বলা শুরু করেছে। আজকে পরীক্ষা খারাপ হলে সাদা কইতরের দোষ।
—————-
দীর্ঘদিনে বই খাতার সাথে সংগ্রাম করে পরীক্ষা শেষ করেছি। আগামী সপ্তাহে ভাইয়ার বিয়ে। কার্ডবিলির কাজ চলছে। আমার হাতে দুইটা কার্ড। একটা লিজার জন্য আরেকটা সাদা কইতরদের জন্য। প্রায় দেড় মাস পর সাদা কইতরদের বাসায় যাব। পরীক্ষার মধ্যে নেংটি কইতর দুইবার আমাদের বাসায় এসেছিল। ওর হাতি ছিল নিজের হাতে আঁকা আমার ছবি। আমি বরাবরই চঞ্চল প্রকৃতির। কখনো স্থির থাকি না। নেংটি কইতর আমার যেই কয়টা ছবি এঁকেছে সবগুলোতেই আমি স্থির হয়ে বসে আছি। আমার কাছে এই ছবিগুলো কোন নিখুঁত হাতের শিল্পীর আঁকা মনে হচ্ছিল। নেংটি কইতরকে হাজারবার জিজ্ঞেস করে, ধমকে, বকে কোন কথাই উদ্ধার করতে পারিনি।
সাদা কইতরদের গেইট আস্তে করে খুললাম যেন কেউ টের না পায়। মূলত নেংটি কইতর আর পেট মোটা আনারস আঙ্কেলকে ভয় দেখবো। প্রধান দরজা পাড় করে ভিতরে প্রবেশ করতেই আমার হাত থেকে বিয়ের কার্ড দুটো পড়ে যায়। আপনাআপনি চোখে অশ্রু ছলছলে জমে থাকে। অন্তরে অজানা পীড়ার সৃষ্টি হয়।
মুখ দিয়ে শুধু এই কথা নিস্তৃত হয়,
” তুমি আমাকে ধোঁকা দিলে সাদা কইতর। তুমি অন্যেকে ঐ বুকে জায়গা দিলে!”
চলবে………..
#প্রণয়িনীর_হৃদয়কোণে
#আফসানা_মিমি
| তেইশ তম পর্ব |
❌ কোনভাবেই কপি করা যাবে না।❌
আমার সামনে যেন নাটকের শুটিং চলছে। নায়িকা নায়ককে জড়িয়ে ধরেছে আর নায়ক অভিমান করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতেই আমি শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট মেয়ে। কিন্তু আপনজনদের ক্ষেত্রে হিংস্র বাঘিনী। সিনেমার মেয়েদের মতো স্বামীর বুকে পর নারী দেখে মুখ আঁচলে গুঁজে কান্না করে দৌঁড়ে পালাব তা হবে না। এই সাদা কইতরকে তো আমি পরে দেখে নিব। তার আগে কে এই কালনাগিনী দেখতে হবে। চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে এগিয়ে গেলাম সাদা কইতরের সামনে। অন্যপাশে ফিরে থাকা মেয়েটাকে এক ঝাটকায় টেনে ধরলাম। আরেহ! এ আমি কাকে দেখছি! এ তো ঘরের শত্রু বিভীষণ। লিজা পিজ্জা আমার বরটাকে জাপটে ধরেছিল মানে কি?
লিজা পিজ্জার ভাবখানা দেখো? মনে হচ্ছে কেঁদে সমুদ্রের পানি ভাসিয়ে ফেলেছে। আমি নিশ্চিত এই মেয়ে ঢং করছে। আসার আগে কমলার রস চোখে মেখে এসেছে। লিজার ভাব এমন যেন সাদা কইতর আমাকে নয় এই পিজ্জাকে লুকিয়ে বিয়ে করেছে। সাদা কইতর এই সময়ে মনে হয় আমাকে আশা করেনি। তাই তো আশাপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। আমার চোখে চোখই রাখছে না। সাদা কইতরকে তো পরে দেখে নিব। আগে এই লিজি পিজ্জার কাহিনী খতম করি! লিজাকে সাদা কইতরের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড় করিয়ে বললাম,
” সুন্দরী আন্টির দুই কইতরের দূর সম্পর্কেরও বোন নেই। এই তুই আবার এই কথা বলিস না যে তুই সাদা কইতরের দূর সম্পর্কের বোন লাগিস।”
লিজার মুখের রং পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি যে ওর চালাকি ধরে ফেলেছি। এবার মনে হচ্ছে অন্য এক ফন্দি আটছে।
” বোন হতে যাব কেন রে! আমি তো আমার মনের মানুষকে পেয়েছি। কি আর বলবো তুবা! আজকাল চিঠির মাধ্যমে কেউ মনের কথা বলে! রাদ বলেছে। তাইতো অপেক্ষা করিনি। সোজা চলে এসেছি মনের উষ্ণতায় মানুষটাকে আটকে দিতে।”
” কি যা তা বলছো লিজা? আমি তোমার মনের মানুষ মানে? তোমাকে তো আব,,,,,,
কটমট চোখে সাদা কইতরের দিকে তাকিয়ে আছি। চুমু খাবে আমাকে আর উষ্ণতা পাবে লিজার থেকে? পাওয়াচ্ছি তোমাকে।
লিজার হাতে কার্ড দিয়ে বললাম,
” কান্না করতে করতে চেহারার একি হাল করেছিস লিজা পিজ্জা! তোকে দেখতে পেত্নীর খালাম্মা লাগছে। সাদা কইতরের মতো হ্যান্ডসাম ছেলের পাশে এই চেহারায়!”
” তুই কি এখন আমাকে মেকআপ মেখে আসতে বলছিস?”
” আরে আমি তা বলবো নাকি? তুই তো পেত্নীর রাণী। আমার ভাইয়ের বিয়ে। আজ চলে যা। মা বাপকে নিয়ে আরেকদিন আসিস। একা অবলা ছেলের বাসায় তোকে কেউ দেখলে কি হবে?”
লিসা পিজ্জাকে বোকা বানানো আমার দুই হাতের কাজ। আমি এই পেত্নীর জায়গায় থাকলে বলতাম, ‘ছেলেদের আবার কীসের সমস্যা? সমস্যা হলে তো মেয়েদের হবে। আর সমস্যা মানেই তো আমার লাভ লোকে দেখলে বিয়ে করিয়ে দিবে।’ কিন্তু গাধা লিজাটার মাথায় এসব কথা আসবেই না।
লিজাকে বিদায় দিয়ে সাদা কইতরদের বাসায় আবারও ফিরে আসলাম। সাদা কইতর তখন ভাইয়ার বিয়ের কার্ড দেখছে আমাকে দেখে মুচকি হেসে বলে,
” একমাত্র ভাইরার বিয়ে। উপস্থিত না থাকলে হয়! আমি তো পনের দিন আগে থেকেই গিয়ে বসে থাকবো।”
সাদা কইতরের হাত থেকে কার্ড নিয়ে মুখ বাঁকিয়ে পেট মোটা আনারস আঙ্কেলদের ঘরে যাচ্ছি। কোন কথাই নেই। কেন কথা বলব! যখন ওই লিজা পিজ্জা যখন তাকে জড়িয়ে ধরল তখন ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিতে পারল না? না সে তো পর নারীর উষ্ণতা অনুভব করেছে। এমন চরিত্রহীন কইতরের সাথে আমার কোন কথা নেই।
” আরে কোথায় যাচ্ছ? বাড়িতে কেউ নেই। তোমার শ্বশুর শাশুড়ি দেবরকে নিয়ে মার্কেট করতে গিয়েছে। আর আমাদের সুযোগ দিয়ে গেছে রোম্যান্স করার।”
রোমান্স না ছাই! কার্ড রেখে আমি চলে যাব সাদা কইতরের সাথে কোন কথা নেই। আমার মুখ দিয়ে তো আজ থেকে একটা কোথাও শুনতে পাবে না।
ঘর থেকে বের হয়ে চলে আসতে নিলেই সাদা কইতর আমার হাত চেপে ধরে। শুধু হাত চেপে ক্ষ্যান্ত হয় না আমাকে টেনে নিয়ে যায় নিজের ঘরে। একদম বিছানার উপর বসিয়ে দরজা আটকে দেয় সে।
” আমাকে বলতে দাও আয়মান। রাগ করে আছো কেন? আমার উপর শুধুমাত্র তোমারই অধিকার রয়েছে। আর কারো না। লিজা আমাকে পছন্দ করে। বলতে এসেছে হঠাৎ কি হলো! আমাকে জড়িয়ে ধরে আর তখনই তুমি এসেছো।”
আমি কথা বলছি না। এদিক সেদিক তাকে পালাবার পথ খুঁজছি। ইচ্ছা তো করছে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যাই। আমি তাই করব। জানালার কাছে চলে এসে এখনই লাভ দিব। আমার অবস্থা সাদা কইতর বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি এসে পিছনে আমাকে জাপটে ধরে,
” এভাবে রাগ করে না আমার চঞ্চল পাখি। আমি যে আমার চঞ্চল পাখিটাকে খুব মিস করছি। ওই বউ! চুপ করে থাকে না। তোভার কথা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি।”
অ্যাহ এখন ভালোবাসা উপচে পড়ছে। মনে কারেন্ট লেগেছে। তোর ভালোবাসা তোর পকেটে রাখ সাদা কইতর। আমায় দেখাতে হবে না।
সাদা কইতরের হাত থেকে রেহাই পাওয়া মুশকিল।
আমার সামনে কোন পথে অবশিষ্ট নেই কি করবো? অবশেষে বাজে একটা কাজ করেছি। সাদা কইতরের দিকে ফিরে ঠিক বুকের বাম পাশে হৃদপিন্ডের উপরে জোরে কামড় বসিয়ে দেই। সাদা কইতর ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে। আমার চুলের মুঠি ধরে সরাতে চেষ্টা করে কিন্তু বেচারা ব্যথায় ব্যর্থ হয়ে যায়। শেষে আমিই ছেড়ে দিই সাদা কইতরকে ধাক্কা দিয়ে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে আসি।
” আরে রাক্ষসী জংলি! আঘাত করেছ ভালো কথা। মলম পট্টি তো দিয়ে যাও!”
জ্বালিয়ে দিব। সব ধ্বংস করে দিব। সাদা কইতর শুধু আমার সাদা কইতর। কোন তেলাপোকা, ছাড়পোকার নজরও আমার সাদা কইতরের দিকে ছুড়তে দিব না।
মনে মনে কথাগুলো ভেবে সাদা কইতরের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহন করে চলে আসলাম বাড়ি থেকে। আজ নিজেকে অনেক পালোয়ান মনে হচ্ছে। দারুন একটা কাজ করে এসেছি। খারাপ কাজের জন্য শাস্তি দিয়ে এসেছি এবং বুঝিয়েও এসেছি এই আয়মান তুবা কেমন।
—————————
হাসি মজার মাঝে তিনদিন অতিবাহিত হয়ে যায়। ভাইয়ের বিয়ে দুদিন পর। সমস্ত মার্কেট করা শেষ। আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে মামার বাড়ির বৃদ্ধ মামা-মামী রয়েছে তাদের কোন সন্তান নেই। এর জন্য আমাদের আদর আরো অনেক বেশি। মা মারা যাওয়ার পর একবারের জন্য মামা বাড়ি যাওয়া হয়নি। মূলত মা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমাদের জীবনটাই ছন্নছাড়া হয়ে যায়। বাবা মার স্মৃতি নিয়ে নিজের কর্ম জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় ভাইয়া ছোট বোনকে দেখার শোনার জন্য রয়ে যায়। আমি মাসিক ছয়ে পূর্বে ভাইয়াকে জোর করে চাকরি করতে পাঠিয়েছি।
” আফা মনি আপনার জন্য একখান চিঠি আইছে?”
আবুলের ভাই হাবলু জীবনেও চালাক চতুর হতে পারবে না। মাথায় বুদ্ধির ব নেই আছে একবস্তা পায়খানা। শত চেষ্টা করেও অ আ ই এর বেশি শেখাতে পারিনি। আমার এত পরিশ্রমের ফল যদি মিষ্টি না হয়! তাই ভাইয়া অধৈর্য হয়ে বলেছিল,
” ওকে আর পড়াতে হবে না। যে পড়ার সে ছোটকাল থেকেই শিখে ফেলে। আর যে পড়তে পারবে না, তাকে সারাজীবন পড়ালেও করতে পারবে না।”
আবুলের ভাই হাবলুও সেটা মেনে নেয় এবং বলে,
” অফামনি আমারে আপনার আশেপাশে রাখলেই চলব। এত পড়াশোনা করে কি করব? চাকরি বাকরি করতে পারমু ন। যেই চেহারা কোন মাইয়াও পটবে না।”
ওসব ভাবনা বাদ দেই। আগে দেখ চিঠি ওয়ালা কে? আমার জানামতে আমার কোন প্রেমিক পুরুষ নেই যে আমাকে চিঠি পাঠাবে। আছে একটা বেনামী স্বামী। যে নাকি বছরেও একটা খবর নেয় না। আর খবর নিবেই বা কীভাবে? আমি যে তাকে কামড়ে দিয়ে এসেছি। নিশ্চয়ই এখনো ব্যথায় বিছানায় পড়ে আছে!
শুধু চিঠি এলেও একটা কথা ছিল সাথে একটু ফুলের তোড়া এসেছে। ফুল হাতে নিয়ে নাকের কাছে ধরলাম আহা কিছু সুগন্ধ। চিঠি খুলে দেখতে পেলাম সেখানে লেখা আছে,
” সাদা কবুতরের ঘর আজকাল অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। আলোর বড্ড অভাব। এ অভাব কি কখনো দূর হবে না! ভাবছি ছাদে নয়া কইতর আনবো। এরপর তুমি এসে উদ্ভট নাম দিবে।”
চিঠিটা পড়ে মুচকি হাসলাম। বিড়বিড় করে বললাম,
“ও আমার সাদা কইতর রে,
আয় আয় তুই উড়াল দিয়া আয়”
চলবে।