পূর্ণিমা_সন্ধ্যায়
পর্ব_৩৭
#লেখিকাTasneem Tushar
হলুদ সন্ধ্যা।
একমাস পর আজ নাদিম মুজদাহীরের মেয়ে আলিয়া মুজদাহীর ও তার হবু জামাতা আহনাফ ফারাবি’র একযোগে গায়ে হলুদ আজ। জমজমাট আয়োজন। চারিদিকে উৎসব। সুবিশাল মাঠে খোলা আকাশের নিচে সাদা ও হালকা গোলাপি রঙের ফুল ও নিয়ন লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে হলুদের মঞ্চ। অনুষ্ঠানে নাদিম মুজদাহীরের পরিচিত অনেক নামিদামি মানুষের আনাগোনা। এছাড়া অন্যান্য আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবরা তো আছেই। হলুদে মেয়েরা সবাই পড়েছে ময়ূরকন্ঠী নীল রঙা শাড়ি আর ছেলেরা নীলচে সবুজ রঙা পাঞ্জাবী।
অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। একে একে সবাই গায়ে হলুদ দিচ্ছে ছেলে ও মেয়েকে। আর আরেকটি মঞ্চে লাইভ গান হচ্ছে। নওরীন মুজদাহীর আদনানকে ডেকে জিজ্ঞেস করে বলে,
“তোর ঐ বন্ধুটা কই?”
“কার কথা বলছো?”
“উফ…নামটা মনে পড়ছেনা। ভীষণ মিষ্টি মেয়েটা। খুব সুন্দর গান করে যে।”
আদনান হেসে বলে,
“তিয়াশার কথা বলছো?”
তারপর হাতের ঘড়িতে তাকিয়ে বলে,
“হুম বলেছে তো আসবে। কিন্তু এখনো কেন আসছেনা।”
“আসলে আমার সাথে দেখা করাতে ভুলিস না কিন্তু। ওর কণ্ঠে আবারও গান শুনতে চাই।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে আম্মু।”
*“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
তিয়াশা অনুষ্ঠানস্থলের প্রধান ফটকের সামনে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে প্যাট্রিসিয়া ও ম্যাথিউ তাকে ঠেলেও ঢুকাতে পারছেনা গেটের ভেতরে। জিজ্ঞেস করলেও বলছেনা, শুধু ছটফট করছে। তিয়াশার কেন যেন খুব নার্ভাস লাগছে, হাত পা কাঁপছে। অনেক বলে কয়ে প্যাট্রিসিয়া ও ম্যাথিউ তিয়াশাকে ভেতরে ঢুকালেও এখন তিয়াশা প্যাট্রিসিয়া ও ম্যাথিউ এর পেছন পেছন আসছে। চেষ্টা করছে নিজেকে লুকোতে। প্যাট্রিসিয়া একটু ক্ষেপে ধমক দিয়ে উঠে তিয়াশাকে,
“কিরে তুই কি চুরি বা ডাকাতি করেছিস? তাহলে কেন এমন করছিস? এরকম করলে একটা চড় খাবি। ঠিক হয়ে হাট।”
তিয়াশা প্রথমে মন খারাপ করলেও, হঠাৎ বোধোদয় হয়। আসলেই তো সে তো কিছু করেনি বা বলেনি নিজ থেকে। তাহলে কেন এমন চোরের মতো লুকিয়ে হাটবে। প্যাট্রিসিয়াকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলে,
“ধন্যবাদ, দোস্ত।”
“কেন?”
“তোর ধমকের জন্য।”
প্যাট্রিসিয়া ও ম্যাথিউ দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তিয়াশার দিকে। ধমক খেয়ে কেউ ধন্যবাদ বলে? তারপরেও খুশি এখন তিয়াশাকে স্বাভাবিক দেখে। মাঠের শেষ প্রান্তে হলুদের স্টেজ, সেদিকেই তারা হেটে চলেছে যে দিকে আদনান থাকবে বলেছে।
*
আদিলের পরণে শেরওয়ানি। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে, দেখে মনে হচ্ছে কোনো এক রাজকুমার দাঁড়িয়ে। সে কথা বলছে তার দুই বন্ধু মাহিদ ও সুজয়ের সাথে। দেখে মনে হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তাদের মাঝে আলোচনা হচ্ছে। আলোচনার প্রায় শেষের দিকে মাহিদের সাথে হাত মিলিয়ে বলে উঠে,
“বন্ধু, ধন্যবাদ তোকে। সবকিছু কিন্তু এখন তোর উপরেই নির্ভর করছে।”
মাহিদ হেসে বলে,
“ধন্যবাদ তো আমি তোকে দিব, বরং তোর জন্যই আমার চাওয়া পূর্ণ হতে যাচ্ছে।”
“তা যাই হোক, এখন সবকিছু ভালো ভাবে সম্পন্ন হলেই হলো।”
তারপর সুজয়ের কাঁধে হাত রেখে চাপর দিয়ে বলে,
“তোকেও অনেক ধন্যবাদ। তুই না থাকলে আমি এত সহজে এই কন্ট্রাক্টটা পেতাম না।”
“হয়েছে, এটাতে কি শুধু তোর লাভ হয়েছে? আমারও তো লাভ হয়েছে নাকি?”
আদিল হেসে দুই বন্ধুকেই সামনের দিকে হাত দেখিয়ে বলে,
“চল, যাওয়া যাক ওদিকটায়?”
যেতে যেতে আদিলের পথিমধ্যে চোখ আটকে যায় তিয়াশার দিকে। কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে সবুজ পাড়ের ময়ূরকন্ঠী নীল রঙা কাতান শাড়িতে। কানে টানা দুল, মাথায় টিকলি, নাকে নাকফুল, চুলে বেনুনি করে তাতে সাদা ফুল দিয়ে সজ্জিত করা। চোখে গাঢ় কাজল, আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। হাত ভর্তি কারুকাজ পূর্ণ চুড়ি। ইশ যদি তিয়াশার হাত দুটি সে আরেকবার ধরতে পারতো। সুজয় আদিলের চোখের সামনে তুড়ি বাজাতেই আদিল সংবিত ফিরে পেয়ে হেসে দেয়। সুজয় হেসে বলে,
“কিরে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি?”
“আরে, কোথাও না।”
“আমি তো গিয়েছিলাম।”
“মানে?”
“ঐ যে ওই মেয়েটিকে দেখছিস, সাদা এক লম্বুর সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। চিনিস তাকে?”
আদিল কিছু বলার আগেই দেখতে পায় আদনান তিয়াশার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আর আদনানকে দেখেই সুজয় আদিলকে বলে উঠে,
“মনে হচ্ছে মেয়েটি আদনানের বন্ধু। শোন, আমি একটু পরিচিত হয়ে আসি।”
আদিলকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চলে যায় সুজয় তিয়াশাদের দিকে। আদিলের ইচ্ছে করছে সুজয়কে ধরে ঘুষি লাগাতে। কিন্তু শুধু নীরব তাকিয়ে দেখা ছাড়া তার কিছু করার নেই এখন। আদিল পেছন ফিরে মাহিদকে নিয়ে ডাঃ সামির ও তার মেয়ে সুহানির সামনে যেয়ে দাঁড়ায় এবং খোশ গল্পে মেতে উঠে। কিছুদূর থেকে নাদিম মুজদাহীর আদিলকে সুহানি ও তার বাবার সাথে গল্প করতে দেখে ভীষণ খুশি হয় এই ভেবে যে ছেলের মন সুহানিতে বসেছে শেষ পর্যন্ত।
অন্যদিকে আদনানের সাথে কথা বলতে থাকলেও তিয়াশার চোখ থাকে আদিলের দিকে। ভাবতে থাকে, আদিল কি আমাকে দেখতে পায়নি? নাকি এড়িয়ে গেল? হয়তো সে ভালোই আছে সুহানির সাথে।
আদনান, তিয়াশা, ম্যাথিউ ও প্যাট্রিসিয়া কথাবার্তা চালিয়ে যাবার মাঝে সুজয় পৌঁছলে আদনান তিয়াশা ও তার বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দেয় তার সাথে। গল্প করার এক ফাঁকে আদনান তিয়াশাকে বলে বসে,
“তুই বলেছিলি আমার অনুরোধ রাখবি।”
“হুম, বল কি অনুরোধ। ভুলে যাস না তোর অনুরোধেই আজ এসেছি।”
“বিয়েতে আসা অনুরোধ ছিলো না, ঐটা আদেশ ছিল। না আসলে কানে ধরে নিয়ে আসতাম তোরে।”
“ইশ।”
তিয়াশার হাত ধরে টানতে টানতে মঞ্চের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
“আমার সাথে একটা ড্যান্স পারফরম্যান্স করতে হবে তোর।”
“তোর মাথা কি খারাপ হয়ে গেল? কোনো তো রিহার্সেল করিনি। কিভাবে কি করবো?”
“কোনো কথা না, চল আমার সাথে। একটু পরেই আমাদের ডাকবে মঞ্চে।”
“আচ্ছা যাচ্ছি, আগে আপু আর দুলাভাইয়ের সাথে একটু দেখা করি, হলুদ ছোঁয়াই তারপর নাহয়…।”
“পরে দেখা করিস, আগে আপুকে সারপ্রাইজ দিয়ে নেই।”
মঞ্চে এসে দাঁড়াতেই স্পিকারে গান বেজে উঠে,
“মেহেন্দি লাগাকে রাখনা
ডোলি সাজাকে রাখনা
লেনে তুঝে ও গরি
আয়েঙ্গে তেরে সাজনা।”
দুজনে হাসি ঠাট্টা করে বেশ মজা করে পারফর্ম করে এবং করতালিতে মুখরিত হয় অনুষ্ঠান। সবাই আরেকটা পারফরম্যান্স এর জন্য অনুরোধ করলে আদনান নেমে যায় স্টেজ থেকে পরবর্তী গান ঠিক করার জন্য। এর মাঝেই হঠাৎ স্টেজ অন্ধকার হয়ে যায় এবং গান শুরু হয়,
“তেরি মেরি, মেরি তেরি
প্রেম কাহানি হ্যায় মুশকিল
দো লাফজো মে ইয়ে বায়ানা হো পায়ে।
এক দুজে সে হুয়ে জুদা
যাব এক দুজে সে লিয়ে বানে।”
স্টেজের বাতি জ্বলে উঠে এবং তিয়াশা তাকিয়ে দেখে সামনে আদিল দাঁড়িয়ে। আদিল তিয়াশাকে কাছে টেনে কোমর পেঁচিয়ে ধরে এবং খুব ধীরে ধীরে গানের তালে তালে নাচতে থাকে তিয়াশাকে নিয়ে। তিয়াশার সারা গায়ে শিহরণ বয়ে যায়, আর আদিলের দৃষ্টি নিবদ্ধ তিয়াশার দিকে।
আদনান ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনের ভেতর কেমন খচ খচ করতে থাকে তার। তাদের নাচ শেষ হলে তাদেরকে যেয়ে সাধুবাদ জানায়। সেই সময় নওরীন মুজদাহীর তিয়াশার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে,
“সোনা মেয়েটা, ভেবেছিলাম শুধু গান জানো, এখন তো দেখছি নাচেও পারদর্শী।”
তিয়াশা ধন্যবাদ জানিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করার ফাঁকে নওরীন মুজদাহীর তিয়াশাকে বলে তার আম্মুকেও যেন নিয়ে আসে বিয়ের অনুষ্ঠানে। এবং তিয়াশাও কথা দেয় সে তার মা নীলিমা হাবিবকে বিয়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে আসবে।
নওরীন মুজদাহীর তিয়াশাকে এবার হলুদের স্টেজে নিয়ে যায় আলিয়া ও তার হবু বর আহনাফের গায়ে হলুদ দেয়ার জন্য। সাথে আছে আদনান, প্যাট্রিসিয়া ও ম্যাথিউ। গায়ে হলুদ দিতে গেলে আলিয়া যখন পরিচয় করিয়ে দিতে থাকে তার হবু বরের সাথে তখন তিয়াশার চোখ ছানাবড়া। এ কাকে দেখছে সে? এটা কি দুঃস্বপ্ন নাকি বাস্তব! কিভাবে সম্ভব এটা? একি আলিয়ার হবু বর আহনাফ ফারাবি নাকি তিয়াশার প্রাক্তন স্বামী আফরান?
মুহূর্তের আকস্মিকতায় তিয়াশা স্তব্ধ হয়ে যায়। কি করবে ঠিক বুঝতে পারে না। কোনরকমে কাঁপা কাঁপা হাতে হলুদ দিয়ে দেয় দুজনকেই। রক্তিম দৃষ্টিতে তিয়াশার দিকে তাকিয়ে আছে আফরান ওরফে ছদ্মনাম ধারী আহনাফ ফারাবি। তিয়াশা দ্রুত স্টেজ থেকে সরে আসে, ওর যে আফরানের কথা আদিলকে জানাতেই হবে। এই বিয়ে যে বন্ধ করতে হবে, নাহলে যে আলিয়ার সর্বনাশ হয়ে যাবে এই লোভীর সাথে বিয়ে হলে।
মোবাইলটা বের করে তিয়াশা আদিলকে কল দেয়। রিং বেজেই যায়, কিন্তু কেউ ধরে না। তার ঠিক কিছুক্ষন পরেই ফোনে একটা মেসেজ আসে প্রাইভেট নাম্বার থেকে, তাতে লিখা,
“সর্ব ডানের প্রাচীরের দিকটায় একবার আসবে? কথা বলতে চাই একটু তোমার সাথে। অপেক্ষায় আছি।”
তিয়াশা ভাবে এটাই ভালো, সামনা সামনি আদিলকে জানাতে পারলেই বেশী ভালো হবে। তাই দ্রুত পায়ে সে প্রাচীরের দিকে হাটতে থাকে। চোখজোড়া খুঁজতে থাকে আদিলকে। সেখানে পৌঁছতেই তিয়াশার হাতে হঠাৎ হেচকা টান পরে এবং কেউ একজন গায়ের জোড়ে তিয়াশাকে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে। তিয়াশা আধো আলো আধো ছায়াতেও যেন স্পষ্ট দেখতে পায়, তার মুখ চেপে ধরে যে আছে সে আর কেউ নয়, তার জীবনের বিভীষিকা, আফরান।
চলবে…
আগের পর্ব: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/947465892350797/