পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতার ছোয়া পর্ব-১৪(শেষ পর্ব)

0
1200

#পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতার ছোয়া
#লেখিকাঃশুভ্রতা শুভ্রা
#পর্বঃ১৪(শেষ পর্ব)

অনিক মনে মনে বিরবির করে বলতে লাগতো, -“তোদের আমি ভালো থাকতে দিবোনা।” বলেই রাগেমেগে ভার্সিটির বাহিরে যেতে লাগলো। রাগে অনিকের গা থরথর করে কাপছে। সে জোরে ড্রাইভিং করছিলো। হঠাৎ, করেই একটা ট্রাক এসে অনিকের গাড়িকে ধাক্কা দেয়।

———————–

অনিকের জ্ঞান ফিরতেই সে বুঝতে পারলো সে কতটা আঘাত পেয়েছে। সারা শরীর নাড়াতেও পারছে না ও। ও পিটপিট করে চোখ খুলে চারিপাশে চোখ রাখতেই দেখলো আদিল, শুভ্রা, অভ্র, নুসরাত আর অনুভব। সে আদিলকে দেখে রেগে উঠতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না ব‍্যথার জন‍্য। আদিল বিষয়টি বুঝতে পেরে সে একাই শুভ্রাকে নিয়ে বাহিরে চলে গেলো। অনুভব বলল, -“কেমন লাগছে এখন?”

অনিক গম্ভীর কন্ঠে বলল, -“হুম ভালো। তা কে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে?”

অভ্র বলল, “আদিল”

অনিক তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, -“আদিল কেমনে কি?”

অনুভব বলল, -“দেখ তুই অনেক কিছুই জানিস না তাই এইরকম করে বলতে পারিস না।”

অনিক বলল-“কি জানিনা আমি!সবই জানি।”

অনুভব রাগী কন্ঠে বলল, -“কিছুই জানিস না তুই। আর আজকে তুই শুধু মাত্র আদিলের জন‍্য জীবিত আছিস। আর যাকে তুই অন্ধের মতো বিশ্বাস করিস আজ সে তোকে মারার জন‍্য লোক পাঠিয়েছিলো।”

অনিক বলল, “মানে”

অনুভব বলল, -“তোর ফুফু তোকে লোক দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। ওই রাজিব নিয়ে আয় তো।” রাজিব একটা লোককে ভিতরে নিয়ে এলো যে ট্রাকটি চালাচ্ছিলো। সে নিজের মুখে শিকার করলো যে, “সে লামিয়া বেগম মানে অনিকের ফুফুর কথা ইচ্ছা করে এক্সিডেন্ট করিয়েছেন। তারপরে অতীতে ঘটে যাওয়া সব কিছু ও অনুভব অনিকের কাছে ক্লিয়ার করে। এমন কি আজকে যদি আদিল অনিককে রেগে ভার্সিটি থেকে বের হতে না দেখতো। তাহলে অনিকে বাঁচানো যেতো না লামিয়া বেগম ওকে মেরেই ফেলতো। এমনকি আদিল রক্তও দিয়েছে অনিককে।”

অনিক সব শুনে নিস্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলো। তারপর ভাঙা গলায় বলল, “আদিলকে একটু ডেকে দিবি।”

অনুভব অভ্র আর নুসরাতকে নিয়ে বের হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর আদিল কেবিনে আসলো। আদিলকে দেখে অনিক উঠতে যাবে তখন আদিল দৌড়ে এসে অনিককে আটকিয়ে বলে, -“পাগল হয়েছিস নাকি। লাগবে তো।” অনিক ছলছল নয়নে আদিলের দিকে তাকিয়ে বলল, -“আমাকে ক্ষমা কর দয়া করে। আমি তাছাড়া যে মরেও শান্তি পাবো না রেএ।”

আদিল বলল, -“ধুরু এগুলো কি বলিস! আর তুই জানিস না বন্ধুত্বের মধ‍্যে নো সরি নো থ‍্যাংকিউ।”

আদিলের কথা শুনে অনিক আদিলকে জরিয়ে ধরলো। অনেকক্ষণ পর আদিল বলল, -“ছাড় বেটা মানুষ কি মনে করবে? আমি কি তোর বউ লাগি নাকি যে এমন করে জরিয়ে ধরে আছিস।”

আদিলের কথা শুনে অনিক হেসে দিলো।
অনিক বলল, -“দোস্ত আমি এখনি এখান থেকে যাবো।”

আদিল বলল, -“কি বলিস কি এই অবস্থায় কিভাবে? না এইরকম অবস্থায় কোনো মতেই যাওয়া যাবে না। অনিকের জেদে কাছে হার মেনে ওরা সবাই মিলে অনিককে ওর বাসায় নিয়ে আসলো। লামিয়া বেগম অনিককে জীবিত দেখে অবাক হয়ে গেলেন। ওনাকে অবাক হতে দেখে অনিক একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, -“কি হয়েছে ফুফু,এতো অবাক হলে কেন?আমি জীবিত আছি তাই দেখে তাই না।”

লামিয়া বেগম নেকামির সুরে বলল, -“কি বলছিস এগুলো? আর তোর এমন অবস্থা কিভাবে হলো রে বাবা? বলেই লামিয়া বেগম অনিকের দিকে এগিয়ে আসতে নিলে অনিক হাত উঠিয়ে না করে আর পুলিশকে ডাক দেয়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আর আদিল,অভ্র, অনুভব, নুসরাত আর শুভ্রা এসে হাজির হয়। লামিয়া বেগম এদের দেখে কিছুটা ভয় পায় তারপরেও উচু গলায় বললেন, – আদিল আর শুভ্রা এখানে কেন? ওরা কোন সাহসে এই বাসায় এসেছে।

অনিক বলল, -“লামিয়া বেগম দয়া করে আর কিছু বলবেন না। আপনার কথাগুলো শুনলে গা আমার জ্বলে যাচ্ছে। অফিসার এই মহিলাকে নিয়ে যান চোখের সামনে থেকে।” পুলিশ লামিয়া বেগমকে নিয়ে গেলো। অনিক শুভ্রাকে ডাকলো। শুভ্রা আদিলের দিকে তাকাতেই ও যেতে বলল। অনিক মাথা নিচু করে বলল, -“শুভ্রা আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছি।”

শুভ্রা বলল, -“এতে আপনার কোনো দোষ ছিলো না সব ওই মহিলার দোষ ছিলো। তাই আপনাকে ক্ষমা করার কথা কোথায় থেকে আসছে।”

শুভ্রা কথায় অনিক সামান্য হাসলো তারপর বলল, -“আদিল তুই শুভ্রাকে ভালো রাখিস আর শুভ্রা আদিলকে দেখে রেখো ও অনেক ভালো ছেলে।”

আদিল বলল, -“বাদ দে তো এখন চল সবাই মিলে আবার সব নতুন করে শুরু করি।”

অনিক মুচকি হাসি দিয়ে বলল, -“কাল আমি বিদেশ চলে যাচ্ছি। সব ব‍্যবস্থা শেষ।”

আদিল বলল, -“এই শরীর নিয়ে তুই কিভাবে কি!”

অনিক বলল, -“পারবো আমি আর আদিল মামা হবার খবরটা কিন্তু আমাকে দিবি।”

অনিকে কথা আদিল হাসলো আর শুভ্রা শরমে লাল নীল হতে লাগলো।

———————–

আজ রাজিব আর লুভা, আদিল আর শুভ্রা, অভ্র আর নুসরাত, অনুভব আর সারার বিয়ে হলো।

ওদের সবার একসঙ্গে বিয়ে করার কথা শুনে অনুভব ও সারাকে বিয়ে করে নেই। আর তাদের পরিবার ও এতে অমত করেন নি।

অনিক সেই দুইমাস আগেই একবারের জন‍্য বিদেশ চলে গিয়েছে। ও সবাইকে এক এক বিয়ের জন‍্য অভিনন্দন জানিয়েছে। ও এখন নিজের গানকে নিজের একাকিত্বের সঙ্গী করে তুলেছে।

ওরা সবাই জোরায় জোরায় ঘুরতে বের হয়েছে।

নুসরাত অভ্রকে বলছে, -“ওই আমি ফুচকা খাবো।”

অভ্র বলল, -“এখন রাত দুটো বাজে এখন কিভাবে? আর এমনি আজকেই বিয়ে কাজকাম করে আমি খুব ক্লান্ত। ঘুম ধরছে আমার চল এখন।”

নুসরাত বলল, -“না আমি যখন বলছি তখন খাবো তো খাবোই।”

অভ্র আর উপায় না পেয়ে ফুচকা আলার বাসায় পৌঁছে গেলো। ফুচকাআলা কেবলি ঘুমিয়ে ছিলেন। দরজায় কড়ানাড়ার শব্দকে সে মনে করেছে চোর মনে হয় খুটখুট করে শব্দ করছে। সে হঠাৎ করেই চোর চোর বলে চিল্লাতে থাকলো। অভ্র বিষয়টি বুঝতে পেরে নুসরাতের হাত ধরে দিলো এক দৌড়। এক দৌড়ে বাসা। দুইজনই হাটুতে হাত রেখে হাপাচ্ছে আর হাসছে। অভ্র নুসরাতকে বলল, -“ভালো লাগছে এখন চোর হয়ে।” নুসরাত বলল, -“হুম অনেক ভালো লাগছে। এখন চলো বাসার ভিতরে যাই। আজকের দিনের কথা আমি কখনো ভুলবো না। শেষমেশ চোর।”

——————

রাজিব আর লুভা ফুটপাত ধরে হেটে চলছে। রাজিব খেয়াল করলো লুভা আর হাটতে পারছে না। হাপিয়ে উঠেছে। আর কিছু বলছেও না। রাজিব কিছু না বলে লুভাকে কোলে নিয়ে হাটতে শুরু করলো। লুভা বলল, -“একি কি করছেন কি নামান বলছি।”
রাজিব বলল, -” চুপচাপ না থাকলে এখন কোল থেকে ফেলে দিবো বলে দিলাম।” রাজিবের কথা শুনে লুভা আর কিছু বলল না।

—————-

সারা অনুভবকে বলছে “আম গাছ থেকে আম পেরে আনতে। অনুভব এখনি না এনে দিলে সে রাস্তায় বসে পরবে আর উঠবেনা বলে হুমকি দিয়েছে।” অনুভব দেখলো সেইদিনের পাগলটা আম গাছের নিচে ঘুমিয়ে আছে। সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো। যেই গাছে উঠতে যাবে তখনি পাগলটার ঘুম ভেঙে গেলো। আর অনুভবের দিকে তাকাতে অনুভব দৌড়ে সারার হাত ধরে দৌড়াতে লাগলো আর পাগলটা ওরে পিছে পিছে “আমার বউকে চুরি করে নিয়ে গেলো” বলে আসতে লাগলো।

———————–

আদিল আর শুভ্রা সেই নদীর পাড়ে বসে আছে। আদিলের কাধে মাথা দিয়ে বসে আসে শুভ্রা। আদিল বলল, -“শুভ্রতা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। যা প্রকাশের মতো না। আর তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লীজ। আমি যে তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।”

শুভ্রা বলল, -“এই কথা বলবে না আর আমি আছি তো তোমার পাশে।”

কেটে গেছে বছরের পর বছর। দুইজনই হয় তো চেয়েছিলো তাদের কথা রাখতে কিন্তু হয় তো ওরা যেমন ভাবে চেয়েছিলো তেমন ভাবে তাদের ভাগ‍্যে লেখা ছিলো না। তাই তো আজ দুইজনই মৃত্যুর দরজায় পা রেখেছে। শুধু কষ্টে রেখে গিয়েছে দিশাকে। দিশা হলো শুভ্রা আর আদিলের মেয়ে। দিশা হওয়ার সময় শুভ্রা মারা যায়।আর তখন থেকেই আদিল অন‍্য রকম হয়ে যায় কিছু খায় না কারো সঙ্গে কথা বলে না। সারাদিন শুভ্রার ছবি নিয়ে বসে থাকতো। আর বলতো “শুভ্রতা তুমি না বলেছিলে আমার পাশে থাকবে তাহলে এখন কি হলো।”

আদিলের এমন অবস্থা দেখে সবাই চিন্তিত হয়ে পরে। হঠাৎ একদিন নুসরাত আদিলের রুমে গিয়ে দেখে ও অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর শোনা যায় আদিলের ব্রেন ক‍্যান্সার হয়েছে। এই কথা শুনে ওরা সবাই চিন্তায় পরে যায় দিশাকে নিয়ে। দুইমাস পর আদিলও সবাইকে ছেড়ে শুভ্রার কাছে চলে যায়। তখন নুসরাত দিশাকে কোলে নিয়ে বলে ওকে ও মানুষ করবে। ওর কথা শুনে অভ্রও খুশি হয়ে যায় নুসরাতের এমন কথায়।

অভ্র দিশাকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে, -“ওরা হয় তো একসঙ্গে থাকবে বলে দুইজন চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। ওদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েও যে অপূর্ণতার ছোয়ায় আটকা পরে গেলো। ওদের কথা যেন আমাদের সবসময় মনে থাকে তাই হয় দিশাকে আমাদের কাছে ওদের স্মৃতি সরূপ রেখে গিয়েছে।”

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে