পুতুল বিয়ে পর্ব-০৮

0
1160

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#৮ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



আমি যে কনসিভ করেছি এই বিষয়টা আমি আমার শাশুড়িকে জানিয়েছিলাম। জানানোর প্রয়োজন ছিল বলেই জানিয়েছিলাম।না জানালে পরে সমস্যা করতেন তিনি। অস্বীকার করতেন হয়তোবা।আমি তাকে এটাও বলেছিলাম যে,মা, আপনার ছেলেকে আপাতত এই সবের কিছু বইলেন না।ও শুনলে ঝামেলা করবে। এমনিতেই ও সন্তান নিতে রাজি ছিল না!’
শাশুড়ি বললেন,’ঠিক আছে বলবো না। তুমি টেনশন কইরো না!’
আমার কাছে বলবো না বললেও তিনি কিন্তু মিতুলকে বলেই দিলেন। মিতুল শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো।সে আমার কাছে এসেই আমায় প্রচন্ড রকম মারতে শুরু করলো। অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ করে নোংরা নোংরা গাল বকতে শুরু করলো।
আমি ওর কাছে মিনতি করে বললাম,’দোহাই আল্লার এমন করো না তুমি! আমার সমবয়সী যাদের বিয়ে হয়েছে সবার সন্তান আছে।তারা সন্তানদের নিয়ে খেলা করে।সময় কাটায়। আমারও খুব ইচ্ছে হয়েছিল।তাই এটা করেছি আমি।’
মিতুল তখন বললো,’সন্তান নিয়েছো ভালো কথা। এবার এবরোশন করে ফেলো। দিন তো আর বেশি হয়নি। কেবল দু’মাস।’
আমি ওর কথা শুনে ভয়ে আঁতকে উঠলাম।সারা শরীর আমার কেমন কেঁপে উঠলো।ও অত সহজে এমন ভয়ংকর একটা কথা বলতে পারলো?
আমি তখন ওকে বললাম,’এমন কথা বলো না তুমি আমায়! নিজের সন্তানের খুনি আমি হতে পারবো না! এরচেয়ে তুমি আমায় মেরে ফেলো।এটাই ভালো হবে!’
মিতুল তখন রেগে গিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসলো।আর আমার গলায় শক্ত করে চেপে ধরলো।আরেকটুর জন্য দম আটকে গিয়েছিল প্রায়! মিতুল তখন ছেড়ে দিল।আর একটা ধাক্কা দিয়ে আমায় বিছানার উপর ফেলে দিয়ে বললো,’জাহান্নামে যা তুই !’
আমি আর কোন কথা বললাম না তখন। শুধু বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে থেকে চুপিচুপি কাঁদলাম।আর ভাবতে লাগলাম,কষ্ট আমি করবোই। আমার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগ পর্যন্ত আমি কষ্ট করে যাবো।সে পৃথিবীতে এলেই সবকিছু বদলে যাবে।বদলে যাবে তার পিতার চরিত্রও।

আমার প্রেগন্যান্সির ছ’মাস চলছে। ইদানিং মিতুল আরো উচ্ছেন্নে গিয়েছে। আগে তো একটু আধটু বাড়িতে আসতো। কিন্তু এখন আর আসে না। রাতের বেলা বাইরে থাকে।দিনে এসে কোনদিন বিছানায় পড়ে মাতালের মতো ঘুমায়। আমার এসব দেখে আর সহ্য হয় না। জীবনে প্রথমবারের মতো প্রেগন্যান্সির সময়টাতে প্রত্যেকটি মেয়েই ভীত হয়। ভীষণ রকম আতংকে থাকে তারা। এই সময়টাতে তার একটা আপন মানুষের প্রয়োজন হয়।যে মানুষটার হাত ধরা যায় অনায়াসে।যে মানুষটা কি না তাকে সাহস জোগাবে।হাত ধরে বলবে, তোমার কিচ্ছু হবে না।এই যে আমি তোমার হাত ধরে আছি।এই হাত আর কক্ষনো ছাড়বো না!’
আমার কান্না আসে খুব!
একদিন সন্ধ্যা বেলায় মা দেখেন আমি বিছানায় পড়ে থেকে কাঁদছি। খুব খুব করে কাঁদছি।
মা তখন জিজ্ঞেস করেন,’কী হয়েছে?কাঁদতেছো কেন?’
আমি তখন কান্নাভেজা গলায় বলি,’মা, মিতুল এখন একদম আসে না ঘরে। আসলে আমার সাথে কোন কথাবার্তা বলে না।আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর দেয় না!’
মা চুপ হয়ে থাকেন।আর কোন কথা বলেন না।
আমি তখন অনুরোধের গলায় মাকে বলি।বলি,’মা, আমার পেটে তো আপনার নাতী। আপনার ছেলের সন্তান।ওর দিকে তাকিয়ে হলেও আপনি মিতুলকে একটু বুঝিয়ে বলুন।ও না এখনও খারাপ পাড়ায় যায়!’
কথাটা বলতে বলতে আবার কেঁদে উঠি আমি।
মা তখন আমার শিউরের পাশে বসেন। তারপর বলেন,’শোন বউ, এইসব নিয়ে টেনশন কইরো না! তুমি এখন গর্ভবতী। তোমার পেটে সন্তান। এখন তুমি মিতুলরে নিয়ে ভাইবো না। তুমি ভাবো তোমার সন্তান নিয়া। সন্তানের সুস্থতা নিয়া।’
আমি মার একটা হাত ধরে ফেলি খপ করে। তারপর বলি,’মা,ও খারাপ মেয়েদের সাথে গিয়ে থাকে! আমার সহ্য হয় না এসব!’
কথাটা বলতে গিয়ে আমার কী যে কান্না আসে।
মা তখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,’ভয় পাইওনা। এইরকম হয়। পুরুষ মানুষ তো বুঝোই! তুমি তো গর্ভবতী।সে তোমার কাছে আসতে পারে না।এই জন্য ওইখানে যায়। বাচ্চা হোক। এরপর দেইখো ঘর থাইকাই রাতের বেলা বের হইবো না!’
মার কথা শুনে আমার প্রচন্ড রাগ পায়! একজন মা কী করে এমন বিশ্রী কথা বলতে পারে!তাও এই নোংরা কথাগুলো কতো সুন্দর করে গুছিয়ে বলছে,যেন এই কথাগুলো তেমন কিছুই না।যেন এইগুলো সভ্য সমাজেরই উদাহরণ!

দিন যায় রাত যায়। আমার চিন্তা বেড়েই চলে।কষ্ট হয় খুব। বুকের কাছে যন্ত্রণা হয়। ইচ্ছে করে কোথাও গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে। কিন্তু পারি না। ওকে ছেড়ে যেতে পারি না!
আগে তো মিতুল আমার ধারে কাছেও ঘেঁষতো না। এখন আসে। এসে খারাপ ব্যবহার করে।এটা ওটা কাজ দেয়।ভারী ভারী কাজ!
অথচ আমার শরীরে পানি এসে গেছে। শরীর কেমন দূর্বল হয়ে আসছে। হাঁটতে পারি না।কষ্ট হয় খুব!এসব দেখার পরেও সে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে! জোর করে কাজ করায়।মা দেখেও কিছু বলে না। নিজেও এগিয়ে এসে কাজটা করে দেয় না!

তখন আমার প্রেগন্যান্সির আট মাস চলছে। মিতুল তখন একটা ব্যবসা শুরু করেছে। বিভিন্ন প্রোগ্রামে ডেকোরেশনের কাজ করতো। এমনিতে সে কখনো সামিয়ানা ধোয়ার জন্য বাড়িতে আনেনি।কারণ কাজের লোকেরাই সেসব ধুতো! কিন্তু একদিন হঠাৎ করে সে অনেক গুলো ময়লা হয়ে থাকা সামিয়ানা বাড়িতে নিয়ে এলো।আর আমার কাছে এসে আমায় বললো,’এইগুলো আজ দুপুরের ভেতর ধুয়ে রোদে দেও।আজ দিনে দিনে যেন শুকায়।রাতে প্রোগ্রাম আছে।এই সামিয়ানা গুলো নিয়ে ওখানে ডেকোরেইট করবো!’
আমি দেখে অবাক হয়ে যাই।এতো এতো ভারী কাপড় নিয়ে এসেছে সে আমার কাছে।এই ভার শরীর নিয়ে কী করে আমি এসব করবো?
মিতুলকে আমি একবার অনুনয়ের গলায় বলি,’মিতুল,আমি তো হাঁটতেই পারি না!কী করে এতো গুলো কাপড় ধুবো?’
মিতুল তখন শান্ত গলায় বলে,’তোমায় হাঁটতে বলিনি তো আমি!বলেছি কাপড়গুলো ধুতে।’
আমি অবাক হই ওর নির্মমতা দেখে!কী ভয়ংকর মানুষ ও!
মিতুল ঘর থেকে চলে যায়।আর যাওয়ার সময় বলে,’আমি যেন ফিরে এসে দেখি কাপড় রোদে শুকাতে দিয়েছো।আর না দিলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ!’
ও চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে কাঁদি। তারপর ভাবি কাঁদলে আর কী হবে?দোষ তো সব আমার।নিজেই তো নিজের পায়ে আমি কুড়াল মেরেছি!
তারপর অতগুলো সামিয়ানা নিয়ে বাথরুমে ঢুকি। তারপর এই ভারী এবং দূর্বল শরীর নিয়েই কাপড় কাচতে শুরু করি।
একটা সামিয়ানা কাচার পরই মিতুলের বড় চাচী আমাদের ঘরে আসেন। এসে আমায় দেখে অবাক হয়ে বলেন,’এই বউ,তুমি কী করতাছো এইসব?’
আমি ধরা গলায় তখন বলি,’কী করবো বলুন!ও তো বললো করতে!’
বড় চাচী তখন আমায় জোর করে ওখান থেকে উঠিয়ে দেন।বলেন,’মরার শখ লাগছে না খুব !এই ভার শরীর নিয়া এইসব কাজ করলে তুমি আর তোমার সন্তান কেউ বাঁইচা থাকবা না দুনিয়ায়!’
তারপর বড় চাচী নিজেই কাচতে শুরু করেন এগুলো।
মিতুল বাইরে কোথায় যেন গিয়েছিল।আজ এসেও পরে বাইরে থেকে দ্রুত। এসে দেখে আমি শুয়ে আছি। তারপর আমার কাছে এসে অবাক হয়ে বলে,’শুয়ে আছো কেন? কাপড় ধুইবা না তাইলে নাকি?’
আমি তখন কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,’ধুতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু বড় চাচী ধুতে দেননি। বললেন,এই শরীর নিয়ে কাপড় ধোয়া যাবে না।তাই তিনি নিজেই ধুয়ে দিচ্ছেন।’
মিতুল আমার মুখ থেকে কথাটা শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো।আর সঙ্গে সঙ্গে আমায় বিছানা থেকে উপরে টেনে তুলে আবার জোরেই বিছানার উপর ছেড়ে দিলো। ওর এমন করায় মনে হলো আমার পেট বুঝি এই ফেটে যাচ্ছে। এবং সেদিন থেকেই আমার আরেকটা সমস্যা শুরু হলো। চিনচিন করে পেট ব্যথা। এই ব্যথা আমার জন্য খুব কষ্টদায়ক হয়! কিন্তু ওরা আমায় ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যায় না।বলে,’এটা স্বাভাবিক।ডাক্তার লাগবে না। এলাকার ধাই আছে।ধাইয়েই বুঝবে সবকিছু!’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে