পুতুল বিয়ে পর্ব-০৬

0
1214

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#৬ষ্ঠ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



মিতুলদের বাড়িতে যাওয়ার পর কেউ আমায় মেনে নিতে চায় না।সবাই আমায় দেখে নাক সিঁটকাতে শুরু করে।যেন আমি বড় পাপিষ্ঠা মেয়ে।যেন আমার মতো নোংরা মেয়ে আর একটাও এ ধরায় নেই আর!
ওর মা আমার মুখের উপর বলে,’ঠিক ঠিকানা নাই,চাল চুলো নাই যে মেয়ের তাকে আমরা পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করতে পারবো না! তাছাড়া পালিয়ে যাওয়া একটা মেয়ে আর যায় হোক ভালো কেউ হতে পারে না!’
আমি তখন কান্নাভেজা গলায় বললাম,’মা, আপনি তাড়িয়ে দিলে কোথায় যাবো আমি? আমার তো আর যাওয়ার কোন জায়গা নাই!’
মিতুলের মা তখন বললো,’আমি তোমারে মাইনা নিতে পারবো না। কই যাবা তুমি তা আমি বলে দিতে পারবো না।যেইদিকে দুই চোউখ যায় ওইদিকে চলে যাও। এখন ভালোয় ভালোয় আমার বাড়ি ছাড়ো। আমার ছেলের পেছন ছাড়ো!’
মিতুল তখন আমায় ইশারায় বলে ওর মায়ের হাত পা ধরতে।সেও তার মার হাত পা ধরে। অনুরোধ করে। আমিও উপায় না দেখে তার মায়ের হাতে ধরি। অনুরোধ করি।বলি,’আমরা যেহেতু একটা ভুল করেই ফেলেছি আপনি আমাদের দূরে সরিয়ে দিবেন না। আপনি শুধু আমায় একবার মেনে নিন।আমি সারা জীবন আপনার অনুগত থাকবো। জীবন ভর আমি আপনার সব কথা শুনবো!’
আমার কান্না দেখে আর কথাগুলো শুনে
মিতুলের মা- বাবার মনে খানিক দয়া হয়।তারা সেবারের মতো তাদের পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেন আমায়।
এবার ভেবেছিলাম সংসারটা এখন থেকে সুন্দর হবে। এবার থেকে মিতুলকে নিয়ে সুখে বসবাস করবো আমি। আবার আমরা আগের মতো হবো। মিতুল আমার জন্য সব সময় উদগ্রীব থাকবে।আমায় পাগলের মতো ভালোবাসবে।
কিন্তু না। আমার ভাগ্য মনে হয় মন্দ।অথবা আমি সৌভাগ্য মেনে নিতে জানি না।
মিতুল আবার প্রতারণা করতে শুরু করলো আমার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে। আবার কথা বলা শুরু করে ওই মেয়েটির সাথে।আমি মাঝে মধ্যে ওকে হাতেনাতে ধরে ফেলি। কিন্তু তখন ও নানান বাহানা করে। মিথ্যে বলে আমায় সাত পাঁচ বোঝায়!
আমার এসব মেনে নিতে কষ্ট হয়।আমি কাঁদি। কাঁদতে থাকি।আর শাশুড়ি মাকে বলি।অভিযোগ করি তার কাছে।
শাশুড়ি মা বলেন,’সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য্য ধরো। ধৈর্যের ফল হয় মিষ্টি। সুস্বাদু।’
আমি ধৈর্য্য ধরি। দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকি। কিন্তু দিন দিন তার কাছে আমি একটা অবহেলার বস্তুতেই পরিণত হতে থাকি।যেন আমি মূল্যহীন কোন বস্তু।যেন আমি পঁচে যাওয়া কোন দ্রব্য।

মিতুলের পরিবার আমায় মেনে নেয়ার ছ’মাস পরের কথা-
তখন আমি একেবারেই ভেঙে পড়েছি।কারণ মিতুল তখন আমার সাথে একটা কথাও বলতো না।আমায় সহ্য করতে পারতো না। কেমন যেন হয়ে উঠছিল ও। একদিন আমার শশুর আমায় আদর মাখা গলায় বলে,’মা, তোমার উপর দিয়ে তো অনেক ঝড় ঝাপটা বয়ে যাচ্ছে। তুমিও এখন ক্লান্ত। এখানে এভাবে পড়ে থাকলে তো তুমি শেষ হয়ে যাবে। এরচেয়ে চলো তোমায় তোমার মার কাছে দিয়ে আসি আমি। ওখানে গিয়ে কদিন থাকো।আর ততোদিনে মিতুলকে আমি বুঝাবো।ওই মেয়ের বাবার সাথে কথা বলে মিতুলের জীবন থেকে ওকে দূরে সরিয়ে দিবো!’
আমি বাবার কথায় আশ্বস্ত হই।তার সাথে মার কাছে আসি।
কিন্তু মার কাছে আসার পর থেকেই নতুন এক সমস্যার সম্মুখীন হই আমি।মিতুলের ফোন বন্ধ। দিনের পর দিন কল দেই।ওপাশ থেকে রিং হয় না।সুইচ অফ।একটা অল্প বয়সী মেয়ে বারবার করে একই কথা বলে যায়। দুঃখিত, আপনার কাঙ্খিত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।কি বিরক্তিকর কথা! ইচ্ছে করে ঢিল মেরে মোবাইল ফোন ভেঙে ফেলি। আবার নিজের উপরই নিজের রাগ হয়।মনে মনে বলি,কেন বাড়িতে এলাম। ওখানেই থাকতাম। চোখে চোখে রাখতাম ওকে!
তারপর হঠাৎ করে ভাবি ওদের তো ঘরের নম্বর আছে।ওর মাকে ফোন দেই। বাবাকে দেই। ফোন দিলাম ও। কিন্তু ওরা বললো তাদের ছেলে কোথায় আছে তারা জানে না।আমি আসার পর থেকেই নাকি মিতুল বাড়ি ফিরে না। নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে!
এটা কেমন ধরনের উদ্ভট কথা! চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে উঠি।ভাবি কোন বিপদ হলো কি না! তারপর বড়দের কাছে কথাটা বলি। তাদের অনেকেই ধৈর্য্য ধরার কথা বলে। আমার এক দূর সম্পর্কের মামী আছে। আল্লাহ ভক্ত মহিলা। তিনি একটা দোয়া লিখে দেন আমায়।আমি সেই দোয়া জপতে থাকি। আল্লাহর কী অসীম খুদরত।এই দোয়া যে রাতে জপেছি ঠিক এর পরদিন সকাল বেলা মিতুল ফোন করে আমায়। মোবাইলের স্ক্রিনে ওর নম্বর দেখে আমার শরীর কাঁপতে থাকে। খুশিতে ঠিক কেঁদে ফেলি আমি। তাড়াহুড়ো করে ফোন রিসিভ করে ভেজা গলায় বলি,’কীভাবে আমার সাথে যোগাযোগ না করে থাকছো তুমি? কোথায় ছিলে এতো দিন তুমি?কার কাছে ছিলে?’
মিতুল তখন যে কথাটা বলে তা শুনে মাথা চক্কর দিয়ে উঠে আমার।চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কাঁপা হাত থেকে টুপ করে মোবাইল ফোন পড়ে যায় জমিনের উপর।
আমি আবার সেই ফোন হাতে তুলে নেয়। তারপর আবার কানে চেপে ধরে বলি,’মিতুল কী বললে তুমি এটা?’
মিতুল বলে,’কানে কী শুনতে পাও না নাকি?বলেছি আমি ওই মেয়েটা মানে পিয়াকে বিয়ে করেছি।বাবা নিজে আমাদের দুজনের বিয়ে দিয়েছেন।আমি এখন ওদের বাড়িতেই আছি। আচ্ছা এখন রাখি।পরে কথা বলবো।’
আমি এ পাশ থেকে বলি,’মিতুল তুমি বলো যা বলেছো তা মিথ্যা।একটা কথাও সত্য না।বলো তুমি আমার সাথে এতোক্ষণ ফান করেছিলে।বলো মিতুল। আমার প্রিয় মিতুল!’
মিতুল এবার রাগ পেয়ে যায় খুব।রাগত স্বরে সে বলে,’ঢং আমার ভাল্লাগে না। এখন রাখতে বলছি রাখো।আমি ঘরে যাবো। পিয়ার কাছে যাবো।ও যদি জানে তোমার সাথে কথা বলেছি তবে সে খুব রাগ করবে।আমি তাকে রাগাতে চাই না রাফি!’
আমি আর কিছু বলতে পারি না।হেলে পড়ি জমিনের উপর।মা দেখে দৌড়ে আসেন।বড় বোন আসে।মামা মামীরা এগিয়ে আসে।নাকে মুখে জল ছিটিয়ে দেয়। মাথায় জল ঢালতে থাকে।
এক সময় হুঁশ ফিরে আসে আমার। হুঁশ ফেরার পর আমি কাঁদতে থাকি।
ওরা জানতে চায় কী হয়েছে। কেন এমন করছি আমি।
আমি তখন কান্নাভেজা গলায় বলি,’আমার সব শেষ হয়ে গেছে।মিতুল আরেকটা বিয়ে করেছে।’
সবাই তখন আফশোস করতে থাকে।বলে,’এটা অন্যায়।ঘোর অন্যায়।মিতুল এমন করলেও ওর পরিবার কীভাবে এমন করতে পারে?মেনে নেয়ার পর এমন করাটা অন্যায়!’
মা এবার শক্ত হন।আমায় বলেন তিনি,’অনেক হয়েছে। এবার আমি যা বলবো তাই হবে।ওই হারামজাদাকে ডিভোর্স দিবি।এটাই ফাইনাল কথা!’
কিন্তু আমি এমন বোকা কেন?
মিতুলকে ছাড়া থাকতেই পারি না।মিতুলকে ছাড়া এই পৃথিবীতে একা বাঁচবো এটা ভাবতে গেলেই মনে হয় এরচেয়ে আমার জাহান্নাম ভোগ শত গুণে ভালো। মিতুল আমার প্রশান্তি।ও আমার ভালোবাসা। কিন্তু মিতুল তো আমায় ঠকাচ্ছে। খুব করে ঠকাচ্ছে। তবুও ওকে চাই কেন আমি?

মিতুলের সাথে আবার কথা বলি আমি।বলি,’তোমায় ছাড়া আমি কিছুতেই থাকতে পারবো না।মরে যাবো।’
মিতুল বলে,’আমি এখন তোমায় নিয়ে একা থাকতে পারবো না। বিয়ে যেহেতু পিয়াকে করেছি এখন থেকে তাই দুজনকে নিয়েই থাকতে হবে। তুমি যদি সতীন নিয়ে আমার ঘর করতে পারো তবেই আমি তোমায় আমার বাড়ি আনতে পারি।’
আমার এটা মানতে কষ্ট হয়। আমার ভালোবাসার মানুষটা তবে দু ভাগ হয়ে যাচ্ছে!
তবুও ওর বাড়িতে ফিরতেই হয় আমার। বাঁচার জন্য ফিরতে হয়।আমি জানি ওর বাড়িটা আমার জন্য যন্ত্রণাময়। আমি জানি ও আমায় ভালোবাসে না। কিন্তু সত্যি হলো এটাই যে ভালোবাসার মানুষের কাছে কাছে থাকতে পারাও যে প্রশান্তির।তার কাছ থেকে প্রাপ্ত আঘাতও যে মিষ্টি! ওকে ছাড়া যদি আমি থাকতে পারতাম তবে কোনদিন আমি ওর বাড়ি ফিরতাম না। ওকে ঠিক ডিভোর্স দিতাম। কোনদিন ওর ছায়াও মাড়াতাম না। কিন্তু ওকে ছাড়া বাঁচবো না বলেই ওর কাছে আবার ফিরতে হয় আমার।মেনে নিতে হয় ওর দ্বিতীয় বিয়ে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে