পুতুল বিয়ে পর্ব-০৩

1
1219

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#৩য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা টা ঘটলো পরদিন।আমি অফিসে গিয়েছি। দুপুর পর্যন্ত অফিস করে লাঞ্চ করার জন্য বাসায় ফিরে এসে দেখি মিতুল বাসায় নেই! ওকে বাসায় না পেয়ে আমার ভেতরটা কেমন হো হো করে কেঁপে উঠলো। ওকে যে একটা ফোন দিবো সেই অবস্থাও নাই। ফোন তো আগেই বিক্রি করে দিয়েছি!
ওর জন্য আধ ঘন্টার মতো অপেক্ষা করেছি।মিতুল ফিরেনি। আমার হঠাৎ কেন জানি একটা সন্দেহ হলো! সন্দেহ বশত ব্যাগের চেইনটা খুলে দেখি যা ভেবেছি তাই সত্য।একটা টাকাও নাই আর! ওকে যে দু হাজার দিয়েছিলাম তা তো নিয়েছেই,বাকী যা আমার ছিল তাও নিয়ে গেছে। তবে কী ও বাড়িতেই চলে গেছে!
আমার মন মানছে না।মনে হচ্ছে ওর কোন বিপদ টিপদ হলো কি না! হয়তো ওখানেই টাকার প্রয়োজন হয়েছে।আর ওর বিপদ হলে তো আমায় জানাতেও পারবে না।জানাবে কী করে? আমার তো আর মোবাইল ফোন নাই!

বাসার সামনে যে দোকান আছে ওখানে গেলাম দৌড়ে। গিয়ে দোকানীকে অনুরোধ করলাম ওর ফোনটা একটু দেয়ার জন্য। ফোন দিলে আমি মিতুলকে ফোন করলাম।ওর ফোনের সুইচ অফ!
কী সর্বনাশের কথা! আমার শরীর কাঁপছে থরথর করে। বুঝতে পারছি না ও কোথায়? একবার মনে হচ্ছে আমায় পেলে রেখে বাড়ি চলে গিয়েছে। আবার অন্যবার মনে হচ্ছে কিছুতেই এমন করতে পারে না আমার মিতুল!আমায় তো সে ভালোবাসে।ভালোবাসে বলেই তো আমায় নিয়ে পালিয়ে এসেছিল!

আমার কেমন ভয় ভয় করছে।ভয় করছে বলেই যতদূর আমি হাঁটতে পেরেছি ততদূর হেঁটে হেঁটে খুঁজেছি।মিতুলকে পাইনি! কোথাও সে নেই!
যেদিকেই তাকিয়েছি মানুষ আর মানুষ।ঢাকা শহরে কী আর মানুষের অভাব আছে?নাই। কিন্তু অত অত মানুষের ভেতর তো আর আমার মানুষ নাই!
তারপর ভেবেছি ও বোধহয় রাতে ফিরবে। কিন্তু ফিরেনি।সারা রাত ওর জন্য আমি জেগে জেগে অপেক্ষা করেছি।প্রহর গুণেছি ওর জন্য। কিন্তু মিতুল আসেনি।আমি রাতের খাবার খাইনি। পরদিন সকালেও খাইনি।অফিসেও যাইনি।কী করবো আমি বুঝতে পারছিলাম না। এখানে তো আমি একা। আমার তো আর কেউ নাই!

কেঁদেছি। ইচ্ছে মতো কেঁদেছি।গলা ছেড়ে।নিঃশ্বব্দে।বালিশে মুখ ডুবিয়ে।মুখে ওড়না গুঁজে ধরে!কেউ আমার কান্না শুনেনি!
পরদিন আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় থাকতে পারি না। শরীর কাঁপে থরথর করে। এই ক্ষুধার্ত শরীর আর ব্যথিত মন নিয়ে অফিসে যাওয়া যায় না। কিংবা আমি অফিসে যাবো কার জন্য?যার জন্য অফিসে যেতাত সে তো এখন আমার পাশে নাই!

পেটে ক্ষুধা লাগলে জল দিয়ে আর আপনি কতোক্ষণ চালাবেন?জল পিপাসা মেটায়,পেটের ক্ষুধা না!
সামনের দোকানীটা খুব ভালো। এই মাঝ বয়সী দোকানী আমায় খুব মুহব্বত করে।আপা আপা ডাকে।বলে, আপনে আমার ছোড বোনের মতন ‌। আমার দেশের বাড়ি ময়মনসিঙ্গের ফুলপুরে। আপনার মতন আমার একখান বইন আছিলো। ফুটফুইট্টা চান্দের মতন চেহারা। সেই বইন যহন কেলাস টেনে পড়ে তহন এক বড় লোকের ছেড়ার লগে বাগা মারলো (পালিয়ে গেলো)। বুঝতে পারে নাই ছোড মানুষ। কিন্তুক যে ছেড়ার সাথে বাগা দিলো সেই ছেড়ার চরিত্র খারাপ।সে তার বন্ধু বান্ধব লইয়া আমার বইনের সব্বোনাশ করলো।বইন আমার কোনদিন বাড়িত ফিইরা আহেনাই।আয়ছে তার লাশ।ছেড়ার কাছ থিইকা প্রতারিত ওইয়া বইন আমার গাড়ির নীচে ঝাঁপ দিয়া মারা গেছে!’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,’আপনার বোনের নাম কী ছিল?’
দোকানী বললো,’নাম আছিলো খোশনাহার। কিন্তুক এই নাম তার পছন্দ না।নাম বদলাইয়া হে নিজেই তার নাম রাখছিলো রাফি।তারে রাফি বইলা না ডাকলে সে গোস্যা করতো!’
দোকানী কাঁদছে।তার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে।
আমি তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।আর বললাম আমার বিপদের কথা।দোকানী আমায় আস্বস্ত করলো।বললো,’আমি আপনের ধর্মের ভাই। আমার নাম মঞ্জু। এই মঞ্জু যতদিন বাইচ্যা আছে ততোদিন আপনের কোনো টেনশন নাই আপা।আপনেরে আমি ফালাইতাম না। বাজার যতো লাগে নিবাইন।মাস শ্যাষে টাকা অইলে দিবাইন।টাকা না অইলে দিবাইন না।ভাই বইনের সম্পরক্ষ টেকার না।মনের।বুঝছইন আপা?’
আমি মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললাম,’আপনি আমায় চেয়ে অনেক বড়। তাছাড়া আমি আপনার ছোট বোনের মতো। আমার নামও রাফি। আপনি আমায় রাফি বলেই ডাকবেন।’
মঞ্জু মিয়া ভীষণ খুশি হলো।সে গদগদ করে হাসতে হাসতে বললো,’আইজ থিইকা তোমারে আমি রাফিই ডাকবাম।আর আইজকা সময় নাই।বাসায় একটা কাম আছে। আগামীকাল রাইতে বইনের হাতের রান্ধন খাইবাম!’
আমি মৃদু হেসে বললাম,’অবশ্যই ভাই। অবশ্যই।’

তিনদিন পর অফিসে গেলাম। কিন্তু অফিসে গিয়েও মন ঠিকছে না। ভালো লাগছে না কিছুই।রাফিদের বাসার কোন নম্বর নেই আমার কাছে।ওর নম্বর তো খুলছেই না।বাড়িতেও ফোন করতে পারছি না। কোন মুখে আমি বাড়িতে ফোন করবো!আমি তো ওদের ঠকিয়ে রেখে এসেছি।আমি তো ওদের মান সম্মান সবকিছু ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়ে এসেছি!

সন্ধ্যা বেলায় বাসায় ফিরে বোকার মতো বসে থাকি। কাঁদি। কিছুই ভালো লাগে না।একটু পর হঠাৎ করে বারান্দার কলিং বেল বাজে। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরটা আমার কেঁপে উঠে। আনন্দে আমি আত্মহারা হয়ে উঠি। আমার বাসায় তো আর কেউ আসে না। শুধুমাত্র মিতুল ছাড়া। তবে কী আমার মিতুল ফিরে এসেছে!
কাঁপা কাঁপা হাতে দরজায় ছিটকিনি খুলতেই হতাশ হই।মন ভেঙ্গে যায়।মিতুল না। বাসার সামনের দোকানী মঞ্জু এসেছে।তার হাতে একটা ব্যাগ।ব্যাগ ভর্তি বাজার।
মঞ্জু হাসি হাসি মুখে বললো,’বাজারে গেছিলাম।চিতল মাছ দেইখা পছন্দ হইয়া গেলো খুব।বইনের লাইগা অধ্ধেকটা কিইন্যা নিয়া আইলাম।আর সাথে নয়া আলু।ফইল্যা ফইল্যা দিবা আলু।বিরাট টেস্ অইবো!’
মঞ্জু মিয়ার অত আহ্লাদ আমার ভালো লাগছে না। এইসব পাতানো সম্পর্ক টম্পর্ক আমার বিরক্তি লাগে। তবুও যেহেতু বিপদে একটা ছায়া পাওয়া গেল তাকে তো আঁকড়ে ধরতেই হবে।
আমি তাকে বললাম,’ভাইয়া,ফ্যানের নিচে বসেন।ঠান্ডা হন।আমি রান্না চড়াচ্ছি।’
মঞ্জু হেসে বললো,’এক গেলাইস পানি দেও বইন। আমার তিয়াস পাইছে।পানি খাইয়া এক টিপ ঘুমাই।এই সুযোগে তুমি রাইন্ধালাও!’
আমি কিচেনে গিয়ে তার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এলাম।সে পানি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো!

মঞ্জু মিয়া আমার বাসায় প্রায় সময় আসা যাওয়া করে। নিজের বোনের মতোই দেখে আমায়।আচার আচরণ মন্দ না। তবে তাকে যেন কেন আমার সহ্য হয় না।তার মুখে অতি ভক্তি।এই অতি ভক্তি জিনিসটাই আমার পছন্দ না। কিন্তু পছন্দ না করেও উপায় নাই। আমার হাতে পয়সা কড়ি নাই।এই দুঃসময়ে তার অবদান ভুলবো কী করে আমি? কিংবা তার সাহায্য ছাড়া চলবোই বা কী করে?

এক সপ্তাহ পরের কথা-
আমি বাথরুমে গোসল করছি।
মঞ্জু মিয়া এসে কলিং বেল বাজাচ্ছে।আমি ভেজা কাপড়েই দরজা খুলে দিলাম।ওর হাতে এক বয়াম দুধ। সেই দুধ আমার হাতে তুলে দেয়ার সময় সে আমার ভেজা শরীরের দিকে কেমন করে যেন তাকালো! এই তাকানোটা আমার কাছে মোটেও ভালো লাগলো না। এবং এটা সত্য যে মেয়েরা পুরুষের চোখকে খুব ভালো করেই চিনে। কোন চাহুনি তার প্রতি ভালোবাসার আর কোন চাহুনি লোভাতুর,কামার্ত তা চেনা খুব একটা কঠিন বিষয় না মেয়েদের জন্য। সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের এই গুণ দিয়েই সৃষ্টি করেছেন!

#চলবে


(গল্পটা পড়ুন। এগিয়ে যান। বাস্তবতা কী বুঝতে পারবেন!)

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে