#পুকুরের সেই আতঙ্ক
৫ম পর্ব
লেখা: #Masud_Rana
মধ্যরাতে গ্রামের মানুষ আর তান্ত্রিক বুড়োর নিষেধ না মেনে চারটা মেয়ের লাশ পুলিশ ভ্যানে তুলে থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার আগে পুলিশের দলটা কল্পনাও করতে পারেনি মাঝপথে মাথাবিহীন এই চার কিশোরীর লাশ জীবিত হয়ে উঠবে। কিন্তু যখন তা ঘটলো তখন ভয়ঙ্কর আতঙ্কে শিহরিত হয়ে পালানো ছাড়া আর কোনো চিন্তা তার মাথায় এলো না। এমন একটা দৃশ্য যে তারা দেখেছে তা শুনে অন্য মানুষ কী বিশ্বাস করবে পুলিশের দলের লোকেরাই বিশ্বাস করতে পারছে না। যে দুজন কনস্টেবল লাশগুলোকে জেগে উঠতে দেখে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়েছিল তারা বেশ আহত হয়েছে। ড্রাইভার আর অফিসার দম থাকা পর্যন্ত দৌড়েছে।
একসাথেই তারা চারজন সকাল হওয়ার অপেক্ষায় এক জায়গায় আশ্রয় নিল। ভোরের আলো ফুটলেই গাড়ির কাছে পৌঁছে স্থির হলো তারা। দিনের আলোয় ভয় কেটে গেছে অনেকটাই। মৃত মানুষের ভয়ে পালানোর জন্য উল্টো লজ্জাই লাগছে তাদের এখন। গাড়ি, আশেপাশের পথ তন্নতন্ন করে খুঁজেও লাশগুলোর চিহ্ন মাত্রও তাদের নজর কারলো না। মানে কী এর! পুকুরে মেয়েগুলোর মৃত্যু যে অস্বাভাবিক, অলৌকিক কিছুর প্রভাবে ঘটেছে এটা এর মধ্যে তারা বিশ্বাস করছে। কিন্তু চারটা মেয়ের লাশ গাড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে নেমে চলে গেছে এটা তাদের মাথাতেই ঢুকছে না। লাশগুলোকে পেলে অন্তত রাতের ঘটনাটা ভুলে যাওয়া যেত। একেবারেই স্তম্ভিত হয়ে গেল তারা। হতাশ হয়ে গাড়ি নিয়ে আবার ফিরতে লাগলো আফসারপুরের দিকে।
রশিদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রাচীন পুকুরটারর পানির দিকে। ভোরের হালকা আলো ফুটতে শুরু করেছে। মৃদু বাতাস বইছে চারদিকে। এত সুন্দর লাগছে জায়গাটা! এই পুকুরে যে অশুভ কিছু থাকতে পারে তা কল্পনাও যেন করা যায় না। কিন্তু পুকুরে যেই অশুভ শক্তিই থাকুক না কেন ওটা যে ভয়ঙ্কর কোনো ক্ষমতাবান শক্তিমান আতঙ্ক এতে তার কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে গত রাতে জালালুদ্দিন মাতবর তাকে যা বললেন তারপর সেও কিছুটা আতঙ্ক অনুভব করছে। গতরাতে চারটি মেয়ের লাশ যখন তারা উদ্ধার করতে নেমেছিল পুকুরে তখন জালালুদ্দিন তার পায়ে একটা শক্ত হাতের স্পর্শ পান। আতঙ্কিত না হয়ে উল্টো পুকুরের পানিতে ডুব দেন তিনি। এরপর তিনি দেখেন অদ্ভুত একটা জন্তুকে। জন্তুটার শারিরীক বর্ণনা তার বিন্দুমাত্র মনে নেই। এর কারণ ওটার অদ্ভুত চোখ।
ঘোলা পানিতেও জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল ওগুলো। কেমন এক বীভৎস তুচ্ছ হিংস্রতা বিরাজ করছিল দৃষ্টিতে। কিলবিল করে ভাসছে ওটার মাথার চুল। ভয়ে দম আটকে মারা যাবেন যেন তিনি। পরমুহূর্তেই চোখদুটো অদৃশ্য হয়ে গেল। ওখানে উদয় হলো ৬টি ছোট মেয়ের মুখ। মেয়েগুলোকে এই প্রথম দেখলেও বুড়ো তান্ত্রিক বুঝতে পারলেন ওরাই সেই সব কিশোরী যারা এই পুকুরে মারা গিয়েছে। করুণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সবাই। কী একটা সাহায্য চাইতে এসেছে যেন। পানির ভেতরেও কী সাবলীল কণ্ঠে একটা মেয়ে মায়া ভরা কণ্ঠে অনুনয় করলো, ‘আমাদের বাঁচাও দাদু, ওই রাক্ষসটা আমাদের অনেক কষ্ট দিচ্ছে। আমাদের সঙ্গে চলো নীচে, ওটাকে মারার উপায় আমরা বলে দিচ্ছি! তার আগে তোমার শরীরের ওসব নোংরা জিনিস খুলে ফেল।’
এক মুহূর্তে সম্মহিত হয়ে গেল তান্ত্রিক। সম্মোহিত হওয়ার পর হাজার বছরের সাধনা, হাজার বছর ধরে নিজের মস্তিষ্কে জমা করা জ্ঞানও কোনো কাজে আসে না। তখন সে হয়ে যায় দাস। জালালুদ্দিন মাতবর ধীরে ধীরে খুলে ফেলল তার সব রক্ষা কবজ। মেয়েগুলোর করুণ মুখগুলো হঠাৎ করে বদলে বিদ্রুপ হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলতে লাগলো। এক মুহূর্তের জন্য সম্মোহন ছুটে গেল তার। সবগুলো মেয়ের আলোকোজ্জ্বল মুখের উপর দিয়ে চোখ ঘোরালেন তিনি। বিস্মিত হয়ে দেখলেন সবার চোখ দেখতে একই রকম, শুধু মুখায়ব গুলো ভিন্ন। চোখটা সেই প্রথম দেখা অদ্ভুত জন্তুর! এক মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল আবার ৬টি মেয়ের মুখ সেখানে উদয় হলো সেই হিংস্র দৃষ্টির জন্তুটি।
এক মুহূর্ত কিছু না ভেবেই তিনি শরীর বাকিয়ে মন্ত্র বিড়বিড় করতে করতে মাথা উঠিয়ে দিলেন পানির উপর। শক্ত করে চেপে ধরলেন রশিদের শরীর। থরথর কাঁপছেন তিনি। আতঙ্ক নিয়ে রশিদের সাহায্যে লাশগুলোকে বেঁধে পাড়ে তুললেন।
হতভম্ব হয়ে জালালুদ্দিন মাতবর থেকে ঘটনাটা শুনলো রশিদ। মেম্বার বাড়ির ঘরটির মধ্যে মৃদু আলো জ্বলছিল। সেই আলোতে ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে প্রথম খেয়াল করলো আসলেই তার শরীরে কোনো কবজ নেই। ‘পিশাচ’ ‘দেও’ ‘প্রেত’ এদের অসংখ্য শক্তি থাকলেও মানুষকে সম্মোহন করে কিছু করানোর শক্তি এদের থাকে না। হয়তো সর্বোচ্চ মোহে আটকে ফেলতে পারে। কিন্তু প্রাচীন পুকুরের এই শক্তির এই ক্ষমতা আছে। সে নিশ্চই সম্মোহিত করেই পুকুরের কাছে টেনে নিয়ে গেছে পরের ৫জন। কিশোরী মেয়েকে। এবং তান্ত্রিক মাতবরের মতো সম্মোহন করে হত্যা করে ফেলতে পারবে যে কাউকে। কিন্তু ওটার উদ্দেশ্য কী! তান্ত্রিক জালালুদ্দিন মাতবরেরইবা উদ্দেশ্য কী!
এতটুকুই শুধু ওস্তাদ তাকে বলেছে। এইটুকুতেই যে বড় তান্ত্রিক ভয় পেয়ে এই আফসারপুর ছেড়ে চলে যেতে চায় এটা বিশ্বাস হয় না রশিদের। হয়তো আরও কিছু আছে যা তাকে বলেনি ওস্তাদ। এরপর আধো ঘুম আর জাগরণের মধ্যেই কেটে গেছে সময়। তাই ভোরে সেই রহস্যময় পুকুরপাড়ে এসে হাজির হয়েছে রশিদ। দিনের আলোয় হয়তো ওটার শক্তি থাকে না। আবার হয়তো থাকে। ওটার আকর্ষণ হয়তো কেবল কিশোরী মেয়েদের মাথা। আবার ওটার শিকারের পথে কেউ বাধা দিলে তারাও যে ওটার শিকার হতে পারে এও অসম্ভব কিছু নয়।
হঠাৎ পেছনে পদধ্বনি শুনে ঘুরে তাকালো রশিদ। মেম্বার বাড়ি থেকে পুকুরটা বেশ তফাতে। ওস্তাদ ঘুমিয়ে ছিল বলে ডেকে বলে আসেনি সে। জালালুদ্দিন মাতবর তাকে দেখতে না পেয়ে অনুমান করেই হয়তো এখানে চলে এসেছেন। রশিদের কাঁধে হাত রাখলেন তিনি। অনেকটা ফুরফুরে মেজাজের লাগছে তাকে। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘সাহস দেখছি তোমার খুব বেশি! একা একাই চলে এসেছ!’
মুচকি হাসলো রশিদও। মাতবর বললেন, ‘আমার গতরাতের ধারণা অতিরঞ্জিত ছিল রশিদ। পানির ভেতরে আমি যা দেখেছি পুরোটাই আমার কল্পনা ছিল। কল্পনার মোহে পরেই কবজ গুলো খুলে ফেলেছিলাম। রাতে মাথা গিট মেরে ছিল, তাই নিজেও ভয় পেয়ে ছিলাম আর তোমাকেও ভয় দেখাচ্ছিলাম। এখন সব পরিস্কার লাগছে। ওটা একটা পিশাচই।’
কিছুটা অবাক হলো রশিদ। তারপর বলল, ‘এখন কী করবেন?’
‘মেম্বারের কাছ থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি যে ৬জন মেয়ে মারা গেছে ওরা নাকি খেলার সাথী ছিল। এবং প্রতিটা মেয়েই নিখোঁজের আগের রাতে নাকি তাদের মৃত সাথীদের ঘরের আশেপাশে দেখেছে। আর ভয় পেয়ে চিৎকার করেছে। তারা নাকি তাকে পুকুরের দিকে আহ্বান করেছিল।’
‘মানে কী! তাহলে ওদের পরিবারের লোকেরা কেন কাউকে সতর্ক করে দেয়নি! তাহলে হয়তো বাকি মেয়েগুলোকে পাহারায় রাখা যেত!’
‘ সেটাই! তারা কেউই প্রতিটা মেয়ের নিখোঁজের পেছনে যে তাদের অন্য মৃত মেয়েরা দায়ী তার মিল করতে পারেনি এবং বিষয়টাকে হালকা করে নিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে পিশাচটার লক্ষ্যই ছিল ওই ৬জন মেয়ে। তার লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। এবং ওটা এখন অনেকদিন আর নতুন কাউকে শিকার করবে না। অর্থাৎ পুকুরে আর ওই পিশাচটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। ওটা আবার কখন তার শিকার বানায়। তখনই বোঝা যাবে ওটা কেন এতগুলো মেয়েকে খুন করেছে। আমরা আজই চলে যাব। ‘
‘কিন্তু আপনি অনুমান করে এত নিশ্চিত ভাবে কথাগুলো কিভাবে বলছেন? আমার মনে হয় না গত রাতে আপনি যা কিছু বলেছেন তা সব আপনার কল্পনা। বরং এখন যা কিছু বলছেন তাই উদ্ভট লাগছে আমার কাছে!’
রশিদের কথাটা শুনে কেমন একটা ক্রোধ ভর করলো জালালুদ্দিন মাতবরের দৃষ্টিতে। এক মুহূর্তের জন্য রশিদের মনে হলো তার সামনে মাতবর নয়। অন্য কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলো জালালুদ্দিন মাতবর পুকুরের দিকে। বিস্ময়ের সীমা রইলো না রশিদের। ওস্তাদের মুখে কেমন একটা ক্রুর পৈশাচিক হাসি। এখন ভোর, মিনিটে মিনিটে প্রকৃতি আলোকিত হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু সেকেণ্ডে সেকেণ্ডে পুরো চারপাশটা আঁধারে ডুবে গেল। আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত সামান্য আলো ছাড়া আর কিছুই নেই। মানে এখনো আধার রাত্রি। তার মানে এই সমস্ত কিছুই তার মায়া ছিল! অন্ধকার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো জালালুদ্দিন মাতবর। একি! মুহুর্তে পানির নিচে তলিয়ে গেলেন তিনি।
চোখ-কপালে উঠে এলো রশিদের দৃশ্যটা দেখে। পানি ফুঁড়ে উঠে এসেছে ৬জন কিশোরী মেয়ে। রশিদের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। পা জমে গেছে তার। এরমধ্যেই দেখল মেয়েগুলোর পেছনে আরেকটা মাথা উঠে এসেছে। এই জগতের কোনো প্রাণ ওটা নয় যেন! ওটার চোখই বলে দিচ্ছে এটাকেই ওস্তাদ পানির নিচে ডুব দিয়ে দেখেছিলেন। একটা হাতকে শুধু পানি থেকে উপরে উঠতে দেখল সে। কী বীভৎস দেখতে তা!
জালালুদ্দিন মাতবর আৎকে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠলেন। তার মনে হলো এতক্ষণ যেন তার বুকের উপর ভারী কিছু চেপে বসেছিল। বাইরে তাকিয়ে দেখল এখনো অনেক রাত। মেঝেতে বিছানা করে ঘুমিয়েছিল রশিদ। সেখানে ওকে দেখতে না পেয়ে খোলা দরজার দিকে চোখ গেল তার। অশুভ এক আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল । ভালো করে রশিদের শোয়ার জায়গায় চোখ বোলাতেই আশঙ্কার কারণটা অনুভব করতে পারলেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সেখানে রশিদের রক্ষা কবজগুলো। সজ্ঞানে ও ওগুলো খুলবে না কখনোই। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। ঐতো রশিদ অনেকটা দূরে চলে গেছে, এত রাতে দ্রুত হেটে কোথায় যাচ্ছে সে! দ্রুত হেঁটে তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন বুড়ো তান্ত্রিক। যতই দ্রুত হাঁটছেন নাগাল পাচ্ছেন না ওর।……………….
………………………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana