পাত্র বদল পর্ব-০৫

0
2406

#পাত্র_বদল
#৫ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



মিতুকে চুপ করে থাকতে দেখে ইয়াসমিন বেগম বললেন,’কী গো মা, নম্বর বলো!’
মিতু বললো,’না মা, আপনি বাবাকে কিছুতেই ফোন করবেন না। কিছুতেই না!’
ইয়াসমিন বেগম আঁতকে উঠা গলায় বললেন,’কেন?কেন ফোন করবো না মা?’
মিতু বললো,’বাবা এই সংবাদটা শুনলে কিছুতেই সহ্য করতে পারবেন না।ভেঙে পড়বেন।তার হার্টের সমস্যা।আমি চাই না বাবার কোন ক্ষতি হোক!’
ইয়াসমিন বেগম খানিক সময় কী যেন ভাবলেন। কিন্তু কী নিয়ে ভাবছেন তা তিনি কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারছেন না।একটু পর তার খেয়াল হলো। আসলে তিনি ভাবছেন মিতুর মা ডাকা নিয়ে।মিতু তাকে মা বলে ডেকেছে।
ইয়াসমিন বেগমের চোখ ভিজে উঠেছে জলে। তিনি মিতুর কাছে গিয়ে তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললেন,’মাগো,আমায় তুমি মাফ করে দিও মা! তোমার মতন লক্ষ্মী একটা মেয়েরে যে দুঃখ আমি দিছি এর কোন মাফ নাই গো মা!’
মিতু ইয়াসমিন বেগমের চোখের দিকে তাকালো। ইয়াসমিন বেগমের চোখ ভেজা।মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।মিতু তার ভেজা গলায় বললো,’মা আমার সাথে যা হয়েছে তা আমার নিয়তি। আপনাদের কারোর প্রতি আমার আর কোন অভিযোগ নাই।’
ইয়াসমিন বেগমের মন যেন একটু শান্তি পেলো। অনেক কষ্টে তিনি তার শুকনো মুখে হাসলেন। তারপর মিতুকে বললেন,’আজ থেকে তুমি আমার সাথে থাকবা। আমার সাথে ঘুমাবা। তুমি আমার মেয়ে।মেয়ের মতো থাকবা!’
ইয়াসমিন বেগম বিথিকে ডাকলেন।
‘বিথি,এই বিথি?’
বিথি এতোক্ষণ জুয়েলের কাছে বসে ছিল।মার ডাক শুনে সে সায় দিলো।ও ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বললো,’আসছি মা।’

বিথি এসে দেখে ইয়াসমিন বেগম মিতুর হাত ধরে বসে আছেন। সে অবাক হলো।মিতু কী সবকিছু মেনে নিয়েছে তবে?

সোয়েল ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেছে। ইয়াসমিন বেগম বিথিকে কাছে ডাকলেন। বললেন,’বুবুর কাছে বসো।’
বিথি খানিক লজ্জা নিয়ে বসলো মিতুর কাছে।সে বুঝতে পারছে না মা তাকে ভাবীর কাছে বসো না বলে বুবুর কাছে বসো বললেন কেন!
মিতু বললো,’বিথি, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো বোন?’
বিথি মৃদু হেসে বললো,’ক্লাস সেভেনে।’
‘বাহ্।রোল কতো তোমার?’
‘তিন।’
বলতে গিয়ে খানিক লজ্জায় পেলো বিথি।
মিতু বললো,’খুব ভালো।আরো ভালো করতে হবে। আগামী বছর আরো ভালো হবে ইনশাআল্লাহ!’
বিথি মিতুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
ইয়াসমিন বেগম বললেন,’তোমরা দুই বোন মিলে কথা বলো।আমি জুয়েলের কাছে যাই।দেখি ও কী করে!’

ইয়াসমিন বেগম বের হয়ে যাওয়ার পর মিতু বললো,’বিথি, ও ঘরে চেঁচামেচি,হৈ হুল্লোড় শোনা গিয়েছিল কেন?কী হয়েছিল ওখানে?’
বিথি বললো,’তুমি জানো না?’
তারপর মিতু কিছু বলার আগেই বিথি তার জিভে কামড় দিয়ে বললো,’সরি বুবু! আপনাকে আমি তুমি করে ডেকে ফেলেছি!’
মিতু ওর মাথায় একটা চাপড় দিয়ে হেসে উঠে বললো,’বিরাট বড়ো অপরাধ করে ফেলেছো তুমি।এর শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে!’
বিথি ভয় ভয় চোখে তাকালো মিতুর দিকে।
মিতু হেসে বললো,’তোমার শাস্তি হলো আজ থেকে তুমি আমায় তুমি করেই ডাকবে।ডাকতে হবে।বুঝেছো?’
বিথি যেনো জানে বাঁচলো।সে তার কপালে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা চুল টেনে কানের উপর দিয়ে পেছনের দিকে নিয়ে বললো,’আচ্ছা।’
মিতু বললো,’এখন ও ঘরে কী হয়েছিল তা বলো।আমি কিছুই জানি না!’
বিথি বললো,’বড় ভাইয়া ছোট ভাইয়াকে খুব মেরেছে!’
‘বড় ভাইয়া ছোট ভাইয়াকে মেরেছে!বড়– ছোট– মানে?’
মিতু কিছুই বুঝতে পারছে না।সে কেমন আঁতকে উঠেছে শোনে কথাটা।
বিথি বললো,’আরে জুয়েল ভাইয়া সোয়েল ভাইয়াকে মেরেছে।বুঝেছো?’
‘কেন?কেন মেরেছে?’
মিতু বড্ড অবাক হলো। জুয়েলকে তো সে দেখেছে সৌম্য এবং শান্ত একটা ছেলে।সে কী করে এমন করতে পারে?
বিথি বললো,’তুমি দেখি কিছুই জানো না!শুনো,বড় ভাইয়া তো আগে জানতো না এটা তার বিয়ে। তুমি তার বউ। ছোট ভাইয়াই তো বর সেজে গিয়েছিল তোমাদের বাড়ি। কিন্তু কাগজ পত্রে নাকি বড় ভাইয়ার নাম দিয়েছে।আর ছোট ভাইয়া কবুলও বলেনি।কারণ বাড়ি থেকে তো পরামর্শ করেই গিয়েছিল যে সে নকল বর সেজে যাবে।আসল বর তো বাড়িতে!’
মিতু বললো,’তারপর?’
বিথি আবার বলতে শুরু করলো।সে বললো,’বড় ভাইয়াকে জানানো হলো আজ সন্ধ্যা বেলায় যে, এই বিয়েটা আসলে তার হয়েছে আর তুমি তার বউ। ভাইয়া কিছুতেই মানতে চায়নি। কিন্তু মার জোরাজুরি, ছোট ভাইয়ার জোরাজুরিতে রাজি হলো!’
‘তো তোমার বড় ভাইয়া হঠাৎ ছোট ভাইয়াকে মারলেন কেন?’
‘তুমি তো বিয়েটা মেনে নাওনি। তাছাড়া বড় ভাইয়া বললো,এটা তো বিয়ে হয়নি।এটা প্রতারণা। তোমার সাথে, তোমার বাবা মার সাথে প্রতারণা হয়েছে এই বিয়েতে।তাই ভাইয়া রেগে গিয়ে ছোট ভাইয়াকে মেরেছে।আর মাকে বলেছে, তিনি যেন এসে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে যান।আর তোমার বাবা মাকে এখানে ফোন করে এনে তাদের কাছেও ক্ষমা চেয়ে নেন।তারা যদি কোন শাস্তি নির্ধারণ করেন তাও মাথা পেতে নিতে ভাইয়া প্রস্তুত!’
মিতু অবাক হলো। ভীষণ ভীষণ অবাক হলো!একটা বোবা ছেলে যে কি না কোন কথা বলতে পারে না তার চিন্তা ধারা কত সুন্দর!কত পবিত্র!
মিতু ভাবলো। আসলে আমরাই এমনটা করি, মানুষদের বোবা বলে,অন্ধ বলে,পঙ্গু বলে দূরে সরিয়ে দেই।অথচ এদের ভেতর সুপ্ত থাকে কত জ্ঞান,কত সুন্দর চিন্তা ধারা।মিতুর হঠাৎ স্টিফেন হকিং এর কথা মনে পড়ে।মটর নিউরন রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি।চলতে ফিরতে পারতেন না। তবুও কত কী করে গেছেন এই পৃথিবীর জন্য তিনি।কত অজানা আর বিষ্ময়কর তথ্য জানিয়ে গিয়েছেন আমাদের!

বিথি তাকিয়ে থাকে মিতুর মুখের উপর।দেখে মিতু কী যেন ভাবছে!
এই সময় ঘরে আসেন ইয়াসমিন বেগম। তিনি এসে বলেন,’মিতু,চলো মা আমরা ওই ঘরে থাকবো।রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো।ঘুমাতে হবে।’
মিতু বিছানা থেকে উঠে ইয়াসমিন বেগমের পিছু পিছু হাঁটে। তার সাথে হেঁটে যায় বিথি। ঘরে গিয়ে ইয়াসমিন বেগম বলেন, বাথরুমে গিয়ে কাপড় চোপড় ছেড়ে আসো। এইসব শাড়ি পাড়ি পরে রাখার প্রয়োজন নাই। ব্রিফকেস থেকে নামিয়ে জামা পরে নাও।’
মিতুর কষ্ট লাগে। এই তার ভাগ্য! বিয়ের রাতেও তার আর শাড়ি পরে থাকা হলো না!
বিথি ব্রিফকেস খুলে জামা নিয়ে আসে।মিতু বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে আসে। ইয়াসমিন বেগম মিতুর দিকে তাকিয়ে বলেন,’বেশ হয়েছে। এবার ঘরের মেয়ের মতোই লাগছে।’
মিতু হাসে। কিন্তু তার ভেতরে চাপা পড়ে থাকে সীমাহীন কষ্ট!
ইয়াসমিন বেগম বিছানা ঝেড়ে বলেন,’তোমরা শুয়ে পড়ো।’
মিতু আর বিথি শুয়ে পড়ে বিছানায়।বিথি একটু পরেই মৃদু নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়ে।মিতু ঘুমোতে পারে না কিছুতেই।তার চোখ জ্বালাপোড়া করে। চোখের পাতা বারবার ঝাঁপসা হয় গরম জলে।সে এবার উপোড় হয়ে শুয়ে পড়ে। এবার বালিশ ভিজে চোখের জলে। মিতুর ফুঁপিয়ে কান্না আসে।মার কথা মনে পড়ে। বাবার কথা মনে পড়ে। ছোট ভাইটার কথা মনে পড়ে।সে যখন কনে সেজে এখানে এসে যাবে তখন কাঁদছিলো খুব,প্রত্যেক বাঙালি মেয়েরা তাদের বিয়ের দিন বাবার বাড়ি ছেড়ে বরের সাথে চলে যাওয়ার সময় যেভাবে কাঁদে।তার ভাইটা তখন তাকে খোঁচা মেরে বলেছিল, এমন লক্ষ্মী বর পেলে কেউ কাঁদে!
মিতু আর কিছুই ভাবতে পারছে না।অত ভাবলে সে পাগল হয়ে যাবে। সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাবে!

ইয়াসমিন বেগম বাথরুমে গিয়ে অজু করে আসেন। তারপর তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষ করে অজিফা জপেন। তারপর দু হাত তুলে খোদার কাছে তার করা পাপের কথা প্রকাশ করেন।বড় মিনতি করে চোখের জল ফেলে বলেন,’মাবুদ গো,আমি তোমার বড় পাপী বাঁদি। অনেক বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছি আমি। তুমি আমায় মাফ করে দাও মাবুদ। তুমি ছাড়া তো আমার আর কেউ নাই!কার কাছে যাবো।কার কাছে গিয়ে বলবো, তুমি আমায় মাফ করো!
মিতু মেয়েটা অনেক ভালো গো মাবুদ। তুমি তার জন্য উত্তম কিছুর ব্যবস্থা করে দাও। তাকে ভালো রেখো ‌।তার বাবা মাকে সবকিছু সহজ ভাবে মেনে নেয়ার তাওফীক দাও!’
দোয়া শেষ করে আঁচল দিয়ে চোখ মুছেন তিনি। তারপর এসে বিছানায় শুয়ে পড়েন। শুয়ে থেকে তিনিও ঘুমাতে পারেন না। নিজেকে তার বড়ো অপরাধী মনে হয়। তিনি নিজেকেই নিজে ক্ষমা করতে পারছেন না!

মিতু আবার ভাবে জুয়েলের কথা।ওর তো কোন অপরাধ নেই। কেন সে শুধু শুধু এমন সহজ সরল একটা মানুষের মনে কষ্ট দিলো?কলার চেপে ধরলো! এরচেয়ে সুন্দর করে বললেই তো হতো!সে ভাবে সকাল বেলা যে করেই হোক জুয়েলের সাথে সে কথা বলবে।ওর কাছে সরি বলবে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে