#পাত্র_বদল
#৪র্থ_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
ইয়াসমিন বেগম এবার নিজেই খাতায় খসখস করে লিখলেন,’আমি বুঝতে পারিনি রে বাবা!আমি তো তোর মঙ্গলের জন্যই এটা করেছিলাম। কিন্তু এমন কঠিন হয়ে যাবে বিষয়টা তা আমি ভাবিনি!’
জুয়েল পড়লো।লিখাটা পড়ে আবার খাতা টেনে নিয়ে লিখলো,’আমি কিছুই বলতে পারবো না আর এই বিষয়ে। তুমি আজকের ভেতর মিতুর বাবা মাকে ফোন করে বলবে এখানে আসার জন্য। তারপর তারা এলে তাদের কাছে সবকিছু খুলে বলবে।উনারা তখন যা বলেন তাই হবে।আর এই সংবাদটা তুমি গিয়ে মিতুকে এক্ষুনি দিয়ে আসো।বলে আসো,সে সম্পূর্ণ সেইফ। তাকে কেউ বিরক্ত করবে না।সে এই বাড়ির মেহমানদের মতোই এখানে থাকবে। তারপর তার বাবা মা এলে তার ইচ্ছে হলে চলে যাবে।অথবা তার যদি ইচ্ছে হয় তার সাথে প্রতারণার জন্য আমাকে শাস্তি দিবে তাও আমি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত।মা শুনো,সুখি হওয়ার জন্য প্রতারণা করে ঘরে কোন বউ আনার প্রয়োজন হয় না। এরচেয়ে একা ভালো থাকা যায়।আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার মতো সুখ এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই!’
ইয়াসমিন বেগমের এই লিখাটি পড়েও কান্না এলো। তিনি এবার সোয়েলকে বললেন,’আয়।তুইও আয় আমার সাথে। আমরা দুজনই অপরাধ করেছি। যদিও অপরাধটা তখন আমরা বুঝতে পারিনি।আমরা তো তখন ভেবেছিলাম ভালো কিছুই করছি। আমার বাকশক্তি হারা ছেলেটাকে একটু শান্তি দেয়ার জন্য ঘরে একটা বউ আনছি। কিন্তু এতে যে মেয়েটা আঘাত পাবে তখন তা ভেবে দেখিনি।আয়, আমার সাথে আয়।আমরা গিয়ে এখন মিতুর হাত পা ধরে ক্ষমা চাইবো।আর ওর বাবা মাকে আসার জন্য বলবো।’
সোয়েল ইয়াসমিন বেগমের পিছু পিছু গেল মিতুর ঘরে।
‘
ইয়াসমিন বেগম মিতুর ঘরে গিয়ে বেশ অবাক হলেন।মিতু বিছানায় বসে হাঁটুর ভেতর মাথা গুঁজে দিয়ে কাঁদছে। কিন্তু শব্দ করছে না অন্য কেউ শুনে ফেলবে বলেই হয়তো!
মিতুকে এভাবে কাঁদতে দেখে ইয়াসমিন বেগমের ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠলো হু হু করে। নিজের করা ভুলটার জন্য নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে তার! এমন লক্ষ্মী একটা মেয়ের জীবন তিনি কীভাবে এলোমেলো করে দিতে পারলেন!অথচ এই মেয়েটার আজ হাসবার কথা ছিল।আনন্দে তার বরের সাথে খোশগল্প করার কথা ছিল।কী ভুলটাই না করলেন তিনি! ইয়াসমিন বেগমের চোখ ছলছল করে উঠেছে জলে।তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সোয়েল।সোয়েলের চোখেও জলকণা।তারও নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে!
‘
ইয়াসমিন বেগম আরেকটু কাছে গিয়ে মিতুর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’মা মাগো!’
মিতু ভীষণ চমকে উঠে উপরে মুখ উঠালো।
ইয়াসমিন বেগমকে দেখে সে চমকে উঠেছে।আর সোয়েলের দিকে তাকিয়ে পরখ করে দেখছে এটা আসলে কে? জুয়েল না সোয়েল? একজন কথা বলতে পারে আরেকজন পারে না এই একটা প্রার্থক্য ছাড়া আর কোন প্রার্থক্যই নাই দুই ভাইয়ের মধ্যে।মিতুও তাই ভাবছে।সে চেষ্টা করছে চেনার!
ইয়াসমিন বেগম চমকালেন মিতুর চোখ মুখ দেখে। কাঁদতে কাঁদতে নাক মুখ কেমন ফোলা ফোলা হয়ে আছে।চোখ টকটকে লাল।নাকে স্বর্দি জমা।
ইয়াসমিন বেগম কী বলে ক্ষমা চাইবেন তাই বুঝতে পারছেন না। বুঝতে পারছেন না বলেই মিতুর একটা হাত তার হাতের মুঠোয় নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি।
মিতুর এতে অস্বস্তি লাগছে।সে বুঝতে পারছে না এই মহিলা এসে তার হাত ধরে কাঁদছে কেন! এখন সে কী করবে?তার আসলে এই মুহূর্তে কী করা উচিৎ!
‘
ইয়াসমিন বেগম কিছু বলার আগেই সোয়েল কথা বললো।সে মিতুর কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,’মিতু,আমরা আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।আমরা জানি যে ভুল আমরা করেছি এর কোন ক্ষমা হয় না। তবুও ক্ষমা চাইছি!’
মিতু মুখ তুলে ওর দিকে তাকানোর আগেই ইয়াসমিন বেগম বলে উঠলেন,’ওমা,মাগো,সোয়েলের দোষ নাই গো মা।ওরে তো আমিই পাঠাইছি।জামাই সাজাইয়া পাঠাইছি। তখন অতকিছু বুঝি নাই।ভাবিও নাই অতকিছু।নিজের সন্তানের ভালোর জন্য অন্যের সন্তানের যে খারাপ করছি তা আমার মাথায় ছিল না।আমি শুধু নিজের স্বার্থটাই খুঁজছিলাম তখন!’
মিতু ইয়াসমিন বেগমের মুখের উপর তাকালো। ইয়াসমিন বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে তার কেমন মায়া হচ্ছে। কিন্তু এই মায়ার চেয়ে তার ভবিষ্যৎ চিন্তায় সে বেশি উদগ্রীব হয়ে আছে।সে কেবল ভাবছে আদতে এখান থেকে কী সে কোনদিন যেতে পারবে?তার মন বলছে কিছুতেই আর যাওয়া সম্ভব নয়।এখান থেকে যাওয়ার পর সমাজে তার নাম হবে ডিভোর্সি মেয়ে। কেউই তাকে বিশ্বাস করবে না।কেউ তার কথা শুনতে চাইবে না।ঘর থেকে ঘরে,মুখ থেকে মুখে,এক চায়ের স্টল থেকে অন্য চায়ের স্টলে ছড়িয়ে পড়বে তার নামে শত শত বানোয়াট অপবাদ। কেউ বলবে,ছেলেটা ভালোই ছিল কিন্তু মেয়েটার সমস্যা।মনে হয় অন্য ছেলের সাথে রিলেশন ছিল।বর জেনে গেছে আর সাথে সাথেই ডিভোর্স দিয়েছে।কেউ আবার আরেকটু গভীরে গিয়ে বলবে,মেয়ে অসতী।বর প্রথম রাতেই বুঝে ফেলছে।আরো যে কত দোষ তার বেরোবে।এসব মিতু খুব ভালো করেই জানে। ছোট বেলা থেকেই সে দেখে এসেছে এ দেশের সমাজে নারীরা সব সময় বঞ্চিত। নারীদেরকে সমাজের মানুষেরা মানুষই মনে করে না। আবার এর জন্য কোন পুরুষকেও জোরালো ভাবে দোষারোপ করা যায় না। নারীদের এই দুর্দিনের জন্য নারীরাই দায়ী।তারাই সদা ব্যাস্ত থাকে অন্য একটা নারীর খুঁত ধরা নিয়ে।তারাই সবচেয়ে পটু পাশের ঘরের মেয়েটির নামে কীভাবে একটি কুৎসা রটানো যায় সেই কাজে!
মিতুর এসব ভেবেই চোখ ঝাঁপসা হয়।গলা কাঁপতে থাকে।নাকে স্বর্দি জমে।আর মুখ ভেঙে আসে কান্না। নিজেকে সে শান্ত রাখতে চেয়েও পারে না। এবার দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরে সে। তারপর নীচ দিকে মাথা দিয়ে চুপটি করে বসে থাকে।
‘
ইয়াসমিন বেগম ভয় পেয়ে যান।তার কেন যেন মনে হতে থাকে মিতু তাদের ক্ষমা করবে না।সে বরং ভয়ংকর কোন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে। ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে তখন তার কী হবে?ছেলে দুটো আর মেয়েটির?
ইয়াসমিন বেগমের শরীর কাঁপে থরথর করে। তিনি ভয়মাখা গলায় বলেন,’মিতু মা, তোমার বাবার নম্বরটা বলো তো মা!’
মিতু মাথা উপরের দিকে উঠায়।
ইয়াসমিন বেগম বলেন,’আর কিছু না গো মা। তোমার বাবা মারে আসতে বলবো এখানে।তারা এখানে এসে একটা সমাধান দিবেন। ইচ্ছে করলে আমাদের প্রাপ্য শাস্তি দিবেন। ইচ্ছে যা হয় তাই করবেন।আমরা যেহেতু ভুল করেছি তাই সবকিছু মাথা পেতে নিবো।মুখ দিয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করবো না।’
সোয়েল তার ট্রাউজারের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে নম্বর তোলার জন্য।
মিতু এই সময় একটু ভাবে।ভাবে যে তার বাবা মা এই সংবাদটা শুনে সহ্য করতে পারবে কি না!
তার বাবার তো হার্টের সমস্যা! একটুও চিন্তা করতে পারেন না!তার আগেই অসুস্থ হয়ে যান। মায়ের শরীরও আজকাল খুব একটা ভালো যায় না।না কিছুতেই না।এই মুহূর্তে এমন একটা দুঃসংবাদ তার বাবা মার কানে দিয়ে আরেকটা সমস্যার ভেতর কিছুতেই পড়তে চায় না মিতু। তারচেয়ে বরং কদিন এখানে এভাবেই থাকবে সে। তারপর আস্তে আস্তে সবকিছু বলা যাবে ভেঙে।যেন তার বাবা মা বিষয়টা সহজেই মেনে নিতে পারেন!
‘
মিতুকে চুপ করে থাকতে দেখে ইয়াসমিন বেগম বললেন,’কী গো মা, নম্বর বলো!’
মিতু বললো,’না মা, আপনি বাবাকে কিছুতেই ফোন করবেন না। কিছুতেই না!’
ইয়াসমিন বেগম—-
‘
#চলবে