পরিণতি পর্ব -৯ ( শেষ পর্ব )
লেখক:জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
রিয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোহনার দিকে। মোহনার গাল বেয়ে এক ফোটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়লো টেবিলের ওপর।রিয়ানের বুকের মাঝে কেমন একটা চিনচিন ব্যাথা করছে। এমন পরিস্থিতিতে কি বলতে হয় তা রিয়ানের জানা নেই। তাই সে চুপ করেই রইলো। মোহনা আবার বলতে থাকে,
‘আমি আমার মেয়েটাকে ছোট্ট অবস্থায় নিয়ে এই শহরে চলে আসি। মা আর আমি মিলে ওকে আগলে রেখেছি। মাহিনের স্মৃতি নিয়ে আমি এতকাল বেঁচে আছি আর বাকিটা জীবন সেটাই করবো। আমি এতটুকু রাস্তা পার হয়ে আজ এখানে এসেছি, অনেক বাধা অতিক্রম করে। সমাজের অনেক ঝড় ঝামেলা মোকাবেলা করে আজ আমি এখানে। আমি চাই না সামনে আর কোন ঝামেলা হোক।’
মোহনা কথাটা বলে থামলো।
কেউ কোন কথা বলছে না।রিয়ান বললো,
‘আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এখন চাইলেও আর ভুলতে পারবো না আমি। মেহনাজকে নিয়ে আপনাকে নিয়ে একসাথে থাকতে চাই। তবে আমি আর আপনাকে জোড় করবো না। জোড় করে কখনো কোন কিছু হয় না, ভালোবাসা তো একদমই না। আপনাকে বিরক্তও করবো না। তবে মেহনাজ কে আমার থেকে দূরে থাকতে বলবেন না প্লিজ। আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্য। যদি কখনো মনে হয় আপনাকে ভালোবাসার, আগলে রাখার, একটা সুযোগ আমাকে দিবেন সেদিনটার অপেক্ষা।’
মোহনা আর কিছু বললো না। উঠে সোজা রেস্টুরেন্ট এর বাহিরে চলে গেলো।
বাসায় গিয়ে মোহনা দরজা আটকে রুমে শুয়ে পড়লো। বিছানার পাশের ডেস্কের উপর মাহিনের সাথে মোহনার একটা ছবি রাখা আছে । মোহনার কোলে মেহনাজ আর মাহিন মেহনাজের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।ছবিটা নিয়ে মোহনা নিজের বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো। আজ মাহিনকে খুব মনে পড়ছে।কেনো এতো ভালোবাসা দিয়েছিলো, যে ভালোবাসার মায়া কাটানো মোহনার পক্ষে সম্ভব নয়! যখন এতোটা ভালোবাসা দিয়েই ছিলো তাহলে কেনই বা ওদেরকে একা রেখে চলে গেলো।
বিকেলে রিয়ান বাসায় শুয়ে ছিলো। ভাবনার সবটা জুড়ে মোহনা। একটা মেয়ে কতটা সংগ্রাম করে আজ এতদূর এসেছে। কতজনের কুপ্রস্তাব পেয়েছে তবুও নিজের সম্মান নষ্ট করে নি।মোহনার প্রতি তার ভালোবাসার সাথে সাথে শ্রদ্ধাটাও বেড়ে গেলো। পৃথিবীতে কিছু মানুষকে শুধু ভালোবাসতেই ইচ্ছে করে মোহনা ঠিক তেমনি একজন মানুষ।
রিয়ান আপন মনে বলতে থাকে,আমি হয়তো কোনদিন মাহিনের মতো হতে পারবো না। মাহিনের মতো করে তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না মোহনা। তবে আমি আমার মতো করে তোমাকে ভালোবাসবো। মেহনাজ কে তার একটা বাবা ফিরিয়ে দিবো। শুধু এই সুযোগটা আমাকে তুমি দিও।
পরদিন সকালে স্কুলে গিয়ে রিয়ান মেহনাজকে দেখতে পায়নি। তাহলে কি তার জন্যই মোহনা আজ মেহনাজকে নিয়ে আসে নি? তার থেকে দূরে থাকবে বলে? তারপর আবার ভাবলো অন্য কিছুও হতে পারে। হয়তো কোন প্রবলেম তাই আজ আসে নি।
রিয়ান মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে মোহনাকে তার নিজের মতো থাকতে দিবে। সামনে গিয়ে বার বার ভালোবাসার কথা বললে যদি রেগে যায়। তাই, আর সরাসরি কিছু বলবে না শুধু তার ভালোবাসা বুঝিয়ে যাবে। যেদিন মোহনা তার ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারবে সেদিন ঠিকই তার কাছে আসবে। সেই দিন রিয়ান সব থেকে খুশি হবে। মোহনা আর মেহনাজ কে প্রচন্ড ভালোবাসবে আর সেই দিনটার অপেক্ষায় থাকবে রিয়ান।
বিকেলে বাসায় ঢোকা মাত্র রিয়ানের ছোট বোন এসে বললো, তোর একটা চিঠি এসেছে ভাইয়া। রিয়ান একটু অবাক হয়ে বললো আমাকে আবার কে চিঠি দিবে। তারপর চিঠিটা বোনের হাত থেকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। চিঠি টা খোলে মোহনার নাম দেখে রিয়ানকে এক অজানা ভয় আকড়ে ধরলো, রিয়ান পড়া শুরু করলো,
রিয়ান,
পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে যারা চাইলেও সব কিছু পায় না।কিছু চাওয়া পবিত্র হলেও পূর্ণতা পায় না অপূর্ণই থেকে যায়। আপনার চাওয়াটা ও পবিত্র ছিলো। আপনি মন থেকে চেয়েছিলেন আমাকে সেটা আমি বুঝতে পেরেছি।সত্যি বলতে আপনাকেও আমার ভালোলাগে।তবে সেটা শুধুই ভালোলাগা তার বেশি কিছু না।
মাহিন আমার জীবনের সব কিছু। আজ মাহিন নেই। তবে, তার স্মৃতি গুলো আছে। সেগুলোকে নিয়ে আমি খুব ভালো আছি।মাহিন আমাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসতো। একটা ছেলের পাগলের মতো ভালোবাসা ছিলাম আমি। আজ সে নেই বলে, আমি আবার বিয়ে করে ফেলবো? শুধু নিজের জীবন গুছিয়ে নেয়ার জন্য? এতে তো মাহিনের ভালোবাসাকে অপমান করা হবে। আমি সেটা করতে পারলাম না। মাহিন না থাকলেও মাহিনের ভালোবাসাটা আমার সাথে থাকে প্রতিটা মুহুর্ত। নিজের ভালোবাসা আকড়ে ধরে বাঁচতে হয়। আমিও সেটা করবো।মাহিনের ভালোবাসা আকড়ে ধরে বাকিটা জীবন বেঁচে থাকবো।
মেহজান আপনাকে নিয়ে অনেক কথা বলে, মেয়ের কাছে আপনি খুব পছন্দের হয়ে উঠেছেন। মা ও চায় মেহজানের মাথার উপর বাবার ছায়া থাকুক। তিনি চায় আমি আবার বিয়ে করি, সুখি হই,আমার একটা পরিবার হোক। আর আপনার কাছাকাছি থাকলে হয়তো একদিন আমি নিজেও দুর্বল হয়ে যেতাম, আপনার ভালোবাসার কাছে। আমি সেটা চাই না।তাই চলে গেলাম আমার মাহিনের শহরে।যেখানে অনেক বাধার মাঝেও আছে আমার মাহিনের স্মৃতি।
সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। কিছু ভালোবাসা না হয় অপূর্ণই থাকুক। ভালো থাকবেন।
ইতি,
মোহনা।
চিঠির ওপর রিয়ানের চোখের দু’ফোটা অশ্রু ঝড়ে পড়লো।তারপর আবার নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে আপন মনে বলতে লাগলো হুম মোহনা, তুমি ঠিকই বলেছো নিজের ভালোবাসা আকড়ে ধরে বাঁচতে হয় আমিও সেটাই করবো। এই অপূর্ণ ভালোবাসাকে আমি পূর্ণ করে তুলবো। কথাটা বলে রিয়ান চিঠিটা পকেটে রখলো তারপর বেড়িয়ে গেলো মাহিনের শহরের উদ্দেশ্যে।
(সমাপ্ত)