পরিণতি পর্ব-৭
লেখক:জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
বাসর ঘরে বসে আছি আমি, মাহিন রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিলো।
আমার কাছে এসে বসে বললো, ২ মিনিট দিচ্ছি ঝটপট শাড়ি চেঞ্জ করে নরমাল কিছু পরে আসো। আর সাজও সব মুছে ফেলবা, একদম নরমাল ভাবে আসবা। আমি একটু অবাক হয়ে তাকালাম তার মুখের দিকে তারপরই আবার ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে, ফ্রেস হয়ে রুমে এলাম। এসে দেখি মাহিন একটা জিন্স এর সাথে ব্লেক একটা টি-শার্ট পড়ে দাড়িয়ে আছে। আমি নরমাল একটা থ্রিপিস পড়ে তার সামনে এসে দাড়ালাম।
মাহিন আমাকে বললো,
-নিজের স্বামীকে চিনেছো তো?
কথাটা শুনে আমার অনেক হাসি পাচ্ছিলো। তবে, অনেক কষ্টে সেটা চেপে রেখে বললাম, ‘হুম চিনেছি।’
-এখন থেকে তো আমি তোমার হাজবেন্ড ফ্রি হয়ে যেতে হবে আমার সাথে এভাবে সংকোচ বোধ করলে তো হবে না।
আমার ইচ্ছে করছিলো একবার জানতে চাইতে উনি আমাকে বিয়ে করলেন কেনো,আর আমার খোঁজই বা কিভাবে পেলো,নাকি পুরো ব্যাপারটাই কাকতালীয়? সব কিছু জানতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু কোন প্রশ্নই তাকে করতে পারলাম না।আমি চুপ করে বিছানায় গিয়ে বসে রইলাম। মাহিন আমার পাশে এসে বসলো।বলতে থাকলো,
‘তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম দু মাস আগে। তুমি আর তোমার কোন এক ফ্রেন্ড একসাথে কোথাও থেকে তোমাদের বাসার দিকে যাচ্ছিলে। তোমাকে তোমার এলাকার গলির মাথায় দেখি, আমি সেখানে গিয়েছিলাম এক ফ্রেন্ডের সাথে একটা দরকারি কাজে। তুমি কি জানো তুমি অসম্ভব সুন্দরী একটা মেয়ে?’
আমি একটু লজ্জা পেলাম।মাহিন আবার বলতে শুরু করে,
‘তবে তোমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আমি তোমাকে বিয়ে করি নি।সেদিন তোমাকে আমার অনেক ভালো লেগেছিলো। আমি তোমাকে ফলো করে তোমার পিছু পিছু গিয়েছিলাম। সেদিনি তোমার বাসা টা চিনে আসি। তোমাদের এলাকায় আমার এক ছোট ভাই আছে পরিচিত। তাকে তোমার কথা বলি, তার থেকেই তোমার সম্পর্কে জানতে পারি। তোমার মা, তোমাদের বর্তমান অবস্থা সব কিছুই জেনে যাই আমি। তারপর ছোট ভাইটাকে বলে দেই তোমার একটু খোঁজ খবর দিতে আমাকে। এরপর থেকেই ওর সাহায্যে মাঝে মাঝে তোমাকে দূর থেকে দেখেছি।তুমি অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর যখন বাসের জন্য গলির মুখে দাড়িয়ে থাকতে, তখন প্রতিদিন তোমাকে দেখার জন্য ছুটে যেতাম আমি। তারপর একদিন বাসে উঠে তোমার পাশে বসা, সেই কাহিনী তো তুমি জানোই। সেদিন আমি ইচ্ছে করেই তোমার পাশে বসেছিলাম।’
এটুকু বলে মাহিন থামলো, আমার হাতটায় নিজের হাত রেখে হাতটা শক্ত করে ধরলো। আমার কেমন অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছিলো। তারপর আবার মাহিন বললো,
-এর পর কিছুদিন তোমাকে নিয়ে খুব ভাবি। আমি বুঝতে পারি, তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি। তোমার পেছনে ঘুরলে তুমি ব্যাপারটা কিভাবে নিতে জানি না আর আমিও এসব পেছনে ঘুরাঘুরি চাইনি। আমি একদম তোমাকে নিজের করে নিয়েই ভালোবাসতে চেয়েছি। তাই, বাসায় তোমার কথা বলি। তারাও মেনে নেয় আমার কথা। এরপর তোমার পরিবারে প্রোপোজাল দেয়া হয়। আর আজ তুমি আমার বউ,আমার ভালোবাসা,আমার চোখের সামনে।
মাহিন আমার সামনে সোজা হয়ে বসে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
-কথা দিচ্ছি, খুব ভালোবাসবো। ভালোবাসবে তো আমায়?
আমি লজ্জামাখা একটা হাসি দিয়ে বললাম, ‘বাসবো।’
এর পর মাহিন বললো, চলো ঘুড়ে আসি বাহির থেকে।
আমি বললাম, এতো রাতে?
-হ্যা,আর বাহিরে গেলে তোমার এটা মনে হবে না বরং ভালো লাগবে। আজ তোমাকে নতুন একটা পৃথিবী দেখাবো আমি। রাতের পৃথিবী।
-কিন্তু এখন তো অনেক রাত। তাছাড়া আজই আমাদের বিয়ে হলো এখন বের হলে বাসার লোকজন কি বলবে?
-কিছু বলবে না পাগল, আর কেউ জানবেও না, সকলে ঘুমাচ্ছে।
আমি আর কিছু বললাম না মাহিনের পিছু পিছু বের হলাম।আমাদের রুমটা দোতালার এক কর্নারে। মাহিন আমাকে বললো কোন সাউন্ড করবে না। আস্তে ধীরে বের হও যাতে কেউ টের না পায়। আমি বুঝতে পারলাম না নিজের বাসা থেকে এভাবে চোরের মতো বের হওয়ার মানেটা কি। কিছু না বলে শুধু মাহিন কে অনুসরণ করলাম। মাহিন আস্তে করে সদর দরজাটা খুললো। আমরা বের হয়ে যাওয়ার পর মাহিন দরজায় বাহির থেকে একটা তালা দিয়ে চাবিটা নিজের কাছে রেখে দিলো।
গলির একটা বড় রাস্তা দিয়ে আমরা পাশাপাশি হাটছি। তেমন কোন যানবাহন নেই, নেই কোন কোলাহল। মাহিন আমার হাতধরে হাটছিলো।
রাস্তার পাশে দুইটা চায়ের দোকান খোলা। একটা দোকানের সামনে মাহিন গেলো, আমি ওর পেছনে দাড়িয়ে রইলাম।দোকানে দুইটা লোকও ছিলো তারা কেমন ভাবে যেন আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। হয়তো অন্য কিছু ভাবছিলো আমাকে নিয়ে, মাহিন সেটা লক্ষ করে একটু জোড়ে লোকগুলোকে শুনিয়ে দোকানদারের উদ্দেশ্যে বললো,
-মামা বিয়ে করেছি, তোমাদের বৌমা। নিয়ে ঘুড়তে বের হলাম।
দোকানদার আমার দিকে তাকিয়ে একটা তৃপ্তির হাসি দিলো।তারপর দুকাপ চা বানিয়ে দিলো। আমি আর মাহিন দোকানের সাইডে দাড়িয়ে চা খেলাম। তারপর মাহিন চায়ের বিল মিটিয়ে আবার আমাকে নিয়ে রাস্তায় হাটা শুরু করলো।
চারদিকটা কেমন নিস্তব্ধ। জনমানবহীন শহরটাকে রাতের বেলায় না দেখলে বোঝায় যায় না পৃথিবীর কোলাহলটা একটা সময়ে কেমন থেমে গিয়ে সব কিছু নিরব হয়ে থাকে। দূরে কোথাও রাস্তায় কিছু কুকুরের ডাক শুনা যাচ্ছিলো। রাতের নিস্তব্ধতায় শব্দগুলো অনেক বেশি শুনা যাচ্ছিলো। আর তার সাথে কানে আসছিলো মাহিনের অনর্গল বলা কথা গুলো। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম তার বলা প্রতিটি কথা। মাহিনের বলা প্রতিটি কথায় আমি আমার জন্য ভালোবাসা অনুভব করছিলাম। পৃথিবীর কোথাও কেউ আমাকে এতোটা ভালোবাসবে তা নিয়ে কখনো আমি ভাবি নি। আমারো খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছিলো এই মানুষটাকে। মা এই কথাগুলো শুনলে সব থেকে বেশি খুশি হবে। মা চাইতো এমন একজন আসুক আমার জীবনে। আমার মনে হচ্ছিলো মায়ের পরে কেউ একজন এসেছে আমার জীবনে, যে আমাকে এতোটা ভালোবাসে। নিজেকে অনেক সুখি মনে হচ্ছিলো।
তারপর আবার আমরা বাসায় চলে এলাম। রুমে ঢুকে আমি ফ্রেস হয়ে এলাম। বের হয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছিলাম। মাহিন ততক্ষণে ফ্রেস হয়ে চলে এলো।আমার পেছনে এসে, চিরুনি নিয়ে নিজেই আমার চুল বেধে দিলো। মাহিনের দিকে ঘুরে আমি মাহিন কে জড়িয়ে ধরলাম।মাহিন আমাকে কোলে তুলে নিলো….
চলবে….