পরিণতি পর্ব-৬

0
1319

পরিণতি পর্ব-৬
লেখক :জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

রেস্টুরেন্টে সামনা সামনি দুটো চেয়ারে বসে আছে রিয়ান আর মোহনা। দুপাশেই নিরবতা।
মোহনা হাতের কফির মগে একটা ছোট চুমুক দিয়ে কথা শুরু করলো।

যেদিন বাবার সব কিছু জেনে মামার বাসায় আমরা চলে যাই, তখন থেকেই আমার জীবনের খারাপ দিনগুলো শুরু হয়। মামার বাড়িতে ভালোই যাচ্ছিলো সব। তবে, মানুষের নানাধরনের কথা সব সময় লেগেই থাকতো। কিছু মানুষ আছে যারা কখনো কাওকে কিছু বলার সুযোগ পেলে ছাড়ে না। বাবাকে নিয়ে মায়ের সব সময় বাঁজে কথা শুনতে হতোই। প্রথম প্রথম মাঝে মাঝেই বাবা আমার সাথে দেখা করার জন্য আসতো। তবে একসময় সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। আশেপাশের মানুষ মা কে বিভিন্নভাবে খোটা দিতো। সে সব শুনে মা কে নিরবে কাঁদতে দেখতাম। মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম, মা কাঁদছে। ওইটুকু বয়সে বাবা ছাড়া থাকাও সমাজে খুব কষ্টকর ছিলো। মাথার ওপর যাদের বাবার ছায়া নেই তারাই শুধু সেই কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারবে। তবুও দিনগুলো চলে যাচ্ছিলো কোনভাবে। মামা পড়াশুনা করা নিয়ে কখনো পিছিয়ে থাকতে বলেনি। মামাতো বোন আর আমি মিলে পাড়ার এক নাচের টিচারের কাছে নাচও শিখেছিলাম। সে সব নিয়েও মানুষ বিভিন্ন ধরনের কথা বলতো। তবে মামা আমাকে বোঝাতেন, লোকের কথায় কান না দিয়ে ভালো কিছু করে দেখাতে। মা ও আমাকে খুব করে বোঝাতো, তোর বাবা থেকেও নেই, সমাজে অনেক বাধা তোর সামনে আসবে। তবে, সেগুলোকে তোর অতিক্রম করতে হবে। মা সব সময় চাইতো যাতে আমি পড়াশুনা করে অনেক বড় হই। কেউ সেদিন আমাকে কু-কথা বলতে পারবে না। মা চাইতো তার কপালের মতো যাতে আমার কপালটা না হয়। কেউ যেনো আমাকে খুব ভালোবাসে,নিজের থেকে বেশি ভালোবাসে। হ্যাঁ মায়ের দোয়াতে আমি তেমন একজন মানুষ পেয়েছিলামও।

আমি তখন সবে মাত্র অনার্স ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি বাসা থেকে ত্রিশ মিনিট সময় লাগে কলেজে যেতে। প্রতিদিন বাসে করে যাতায়াত করতাম। লোকাল বাস হওয়ায়, যেখানে সেখানে যাত্রী তুলে বাসগুলো। একদিন বাসে করে কলেজ যাওয়ার পথে আমি ফোনে মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলাম এমন সময় একটা ছেলে এসে বললো, -একটু পাশের সিটে গিয়ে বসবেন প্লিজ?
আমি সেদিকে নজর না দিয়েই ফোনে কথা বলতে থাকি।ছেলেটা আবার বলে,
-হ্যালো মিস। পাশের সিটে যেতে না চাইলে কাইন্ডলি যদি একটু সরে বসতেন। আমি পাশের সিট টায় গিয়ে বসতাম।
আমি তখন ফোনটা রেখে ছেলেটার দিকে তাকাই। তাকিয়ে রিতিমত জীবনের প্রথম ক্রাসটা তখনি খেয়ে ফেলি। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, একটু ভদ্র টাইপ করে চুলটা কাটা, সুন্দর, লম্বা চওড়া ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আমি হা হয়ে যাই। ছেলেটা আবার বললো,
-জ্বি আপনাকে বলছিলাম। যদি একটু সরে বসতেন।
আমি সাথে সাথে পাশের সিট টায় গিয়ে ছেলেটাকে আমার সিটে বসতে দিলাম।ছেলেটা বসে বললো,’ধন্যবাদ’।
আমি বিনিময়ে একটা ভদ্রতা সূচক হাসি দিলাম। তারপর ছেলেটা তার মতো আর আমি আমার মতো বসে আছি।একবারো আমার দিকে ছেলেটা তাকালো না।আমি মাঝে মাঝে আড়চোখে ছেলেটাকে দেখছিলাম তখন ছেলেটার ফোনের মধ্যে মনোযোগ। কলেজের সামনে চলে আসলে আমি নামতে যাবো তখন দেখি আমার ওড়নায় টান লেগেছে। ঘুড়ে দেখি, আমার ওড়নার উপর ছেলেটা বসা।আমি হালকা করে ওড়নাই আরেকটা টান দিতেই ছেলেটা বুঝতে পেরে বলে উঠলো,
-ওহ, সরি সরি। আসলে একদম খেয়াল করিনি। ছেলেটা উঠে দাড়াতেই আমি ভদ্রতা সূচক আরেকটা হাসি দিয়ে বাস থেকে নেমে গেলাম।

নিয়মিত ক্লাস করতে থাকি। মায়ের সাথে টুকটাক হাতের কাজ করি। মামাতো ভাইটাকে অবসর সময়ে নিয়ে পড়তে বসি।বোনের সাথে নাচের ক্লাসে যাই। এভাবেই কাটছিলো সময়।

তার প্রায় এক মাস পর আমার বাসায় বিয়ের প্রোপোজাল আসে। ছেলে ব্যাংকে জব করে। বাসার সবাই ছেলের খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে সব দিক দিয়েই ছেলে ভালো। সবাই সেদিন খুব খুশি হয়। আমি সেদিন না করতে পারিনি। কারোর সাথে সম্পর্কে জড়াইনি সব সময় মায়ের কথা ভেবেছি। মায়ের মুখের দিকে তাকালেই আমার ভেতর কেমন একটা কষ্ট হতো। মানুষটা যে জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। সেদিন সবাইকে খুশি হতে দেখে, আমি বিয়েতে রাজি হয়ে যাই। মায়ের কাছেই শুনি ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা হবে। ছেলেপক্ষ দেড়ি করতে চাইছে না। দুদিনের মাঝে ছোট করে সব আয়োজন করা হয়।
বিয়ের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, সবাই সকালের নাস্তা করেই কাজে লেগে যায়। মামির কড়া হুকুম আমি রুম থেকে বের হতে পারবো না। ছেলের বাড়ি থেকে যে কোন সময় লোকজন চলে আসবে। আমিও কোন কাজ না পেয়ে ঘরে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকি। মামার দুই ছেলে মেয়ে। রাজু আর রিয়া। রাজু ক্লাস ফাইভে পড়ে তাকে নিয়েই ঘড়ে টিভি দেখছিলাম। রিয়া ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়তো। তাকে দিয়ে ঘর গোছানোর কাজ করানো হচ্ছিলো। রিয়া একটু পর পর রুমে ঢুকে বলে আপু দেখ, কত কাজ করতেছি আমি! বিয়ে কি আমার? আমি কেন কাজ করবো! আমাকে বিয়ের পর তোর ট্রিট দিতে হবে বলে দিলাম।
সকাল থেকে চারবার তার একথা শুনে ফেলেছি আমি।

দুপুর দুইটার দিকে কলিংবেল বাজলো। মামি আমার রুমে এসে আবারো বললো,
– কোন আওয়াজ করবি না সবাই চলে এসেছে, একদম বের হবি না। রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো, এই রিয়া মোহনাকে সাজিয়ে দিবি তুই, এখানেই বসে থাক।
তারপর রিয়া আমার কাছে বসে রইলো। একটু পর মামি এলো, মামির সাথে একজন মহিলা আর একটি মেয়েও ঢুকলো রুমের ভিতরে।
মহিলাটিকে দেখিয়ে মামি বললো এই যে মোহনা, ইনি তোর শ্বাশুড়ি মা আর তোর ছোট ননদ। মেয়েটার বয়স বারো-তেরো হবে হয়তো। তবে খুব সুন্দরী। আমি গিয়ে সালাম করলাম আমার শ্বাশুড়িকে। তারপর উনি আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে হাতে আংটি পড়িয়ে দিলেন।

আমাকে সাজিয়ে সকলের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো,
মা তখন আসে নি কারোর সামনে। আমি চাইছিলাম মা সকলের সাথে গিয়ে কথা বলুক। কিন্তু মা সামনে গেলো না। আমার খুব খারাপ লাগছিলো সকলের থেকে মায়ের নিজেকে এমন আড়াল করে রাখাটাকে। তবে কিছু বলতে পারলাম না।
একটা ছেলের পাশে নিয়ে আমাকে বসানো হলো, আমি সেদিকে তাকাই নি। নিচের দিকে চোখ রেখে বসে ছিলাম।রুমে জন-বিশেকের মতো মানুষ ছিলো।তার মধ্যে হঠাৎ ছেলেটা বললো, কেউ একজন ভিতর থেকে মা কে ডেকে আনুন প্লিজ। আমার কিছুটা সময় লাগলো বুঝতে যে, তিনি আমার মায়ের কথা বলেছেন। কথাটা শুনার সাথে সাথে আমার মন টা খুশিতে ভরে গেলো। আমি ছেলেটার মুখের দিকে তাকালাম। তারপর সাত আসমান থেকে সোজা মাটিতে!
বাসে আমার পাশে বসা সেই ছেলেটি, যাকে দেখে আমি ক্রাস খেয়েছিলাম! এর সাথেই আমার বিয়ে হচ্ছে, যার নাম পর্যন্ত আমি এখনো জানি না। মাত্র একদিন বাসে দেখা। এখন তার বউ হবো আমি কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব! কিছু বলার পরিস্থিতিও নেই। তাই, চুপ করে বসে রইলাম। ভেতর থেকে মা বের হয়ে আসতেই মাকে সালাম করলো ছেলেটা।

আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো। বিয়ে পড়ানোর সময় আমি আমার স্বামীর নামটা শুনেছিলাম, শাহরিয়ার মাহিন । আমি একবার মনে মনে বললাম, আমি এখন মাহিনের বউ। বলে নিজেই মুচকি হেসে দিলাম। চলে যাওয়ার সময় মা কে সামনে দেখতে পেলাম না। ওই মুহুর্তটুকু আমার কাছে সব থেকে কষ্ট লেগেছিলো।আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো শ্বশুর বাড়িতে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে