পরিণতি পর্ব-৫
লেখক: জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
তিনদিন পর মেহজান সুস্থ হয়ে উঠলো। এই তিনদিনের, প্রতিদিনই রিয়ান একবার করে ফোন দিয়েছে মোহনাকে।ফোন দিয়ে শুধু মেহজান এর খোঁজ নিয়েছে।মোহনার কাছে রিয়ান এর এমন কান্ড একদম ভালো লাগছে না। আবার কিছু বলতেও পারছে না।উনি তো খারাপ কিছু করে নি। স্কুলের টিচার, ভালো করে খোঁজ খবর নিচ্ছে। তাই, মোহনা আর কিছু বলে নি রিয়ান কে।
রিয়ান যখন শুনলো মেহজান সুস্থ হয়ে গেছে কাল স্কুলে আসবে তখন বাহিরে গিয়ে অনেকগুলো চকলেট কিনলো মেহজানের জন্য।এ কয়দিনে রিয়ান বুঝে গেছে সে মোহনাকে ভালোবেসে ফেলেছে।মেহজানের প্রতি তার অদ্ভুত এক টান সৃষ্টি হয়েছে।চাইলেই যা উপেক্ষা করা যায় না।রিয়ান বুঝতে পারছিলো না তার কি সময় নেয়া উচিত, নাকি মোহনাকে সব বলে দেয়া উচিত।বলে দেয়ার পর কি মোহনা তাকে ভুল বুঝবে?
রিয়ান আবার ভাবতে থাকে মোহনা বিবাহিতা মেয়ে। তার একটা মেয়ে আছে, প্রোপোজালটা কি আমার ফ্যামিলি থেকে তাকে দিবে? তাদের এক মাত্র ছেলের বিয়ে কি তারা এমন একটা মেয়ের সাথে দিবে? পরমুহুর্তে আবার রিয়ান নিজেকে বললো,ছি! এসব কি ভাবছি আমি! মোহনা যেমন তেমন মেয়ে না। দুর্ঘটনা ঘটে গেছে তার জীবনে একটা। বরং মোহনা খুবই ভালো একটা মেয়ে, ভালো একজন মা। আমার ফ্যামিলিতে আমার ছোট বোন আর আমি।বাবা মা ঠিকই বুঝবে। আর যদি না বোঝে তাহলেও করার কিছু নেই। মোহনাকে ভালোবাসি তাকে যেভাবেই হোক নিজের করে নিবো, ভালোবাসবো।
পরদিন সকালে মোহনা মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেইট এর ভিতর ঢুকেই দেখে রিয়ান দাড়িয়ে আছে।মেহজান কাছে আসলে রিয়ান বললো,
-আমার মামোনি টা এখন কেমন আছে?
-আমি একদম সুস্থ টিচার।
-তোমাকে খুব মিস করেছি মামোনি।
-আমিও তো মিস করেছি।
তারপর রিয়ান মেহজানকে চকলেট গুলো দিলো।মেহনাজ খুশি মনে ক্লাসে চলে গেলো।
মেহজান ক্লাসে চলে যাওয়ার পর যখন মোহনা চলে যাবে তখনই রিয়ান মোহনা কে ডাক দিলো,
-আপনার সাথে একটু কথা ছিলো।
মোহনা পেছন ঘুরে রিয়ানের দিকে তাকালো।আর মনে মনে ভাবতে লাগলো যে ভয়টা সে পাচ্ছে সেটা যেনো না হয়।অস্বস্তি নিয়ে মোহনা রিয়ানকে বললো,
-জ্বি বলুন ??
-এখানে আশেপাশে অনেকে আছে।যদি আমরা অন্য কোথাও বসে কথা বলি?
মোহনা বললো,
-না,যা বলার এখানেই বলুন।তাছাড়া একটু পরেই আমার অফিসে যেতে হবে।
রিয়ান আর কিছু না ভেবে বলা শুরু করলো, আমি যখন কলেজে পরি তখন একটি মেয়েকে আমার ভালোলাগে। তবে, কখনো বলে উঠতে পারিনি। তবে সেই ভালোলাগা টা শুধু ভালোলাগাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এর বেশি কিছু না।এর পর আর রিলেশন,প্রেম,ভালোবাসা এসব নিয়ে তেমন ভাবি নি। এত বছর পর আমি যখন এই স্কুলে জয়েন করি তখন প্রতিদিন একটা মেয়েকে লক্ষ্য করি একটি বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে আসে।
এই টুকু বলে রিয়ান একটু থামলো, মোহনার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো তার অভিব্যক্তি কি?
মোহনা তাকিয়ে আছে রিয়ানের মুখের দিকে।রিয়ান নিচের দিকে তাকিয়ে , আবারো বলতে শুরু করলো,
আমি প্রায় এক বছর হলো মেয়েটিকে দেখছি। প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলি।সেটাকে ভালোবাসা বলবেন নাকি ভালোলাগা তা জানি না।তবে যেদিন জানতে পারলাম মেয়েটা বিবাহিত আমার অনেক খারাপ লেগেছিলো।আমি হতাশ হয়ে সরে যেতে চেয়েছিলাম।তবে পারি নি।আমার সকল কাজের মাঝেও মেয়েটির কথা মনে পরতো। তার পর আমি আরো খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, মেয়েটির হাজবেন্ড মারা গেছে অনেক আগে।কথাটা শুনে আমার কেন যেন আরো খারাপ লাগে। এর পর থেকে আমি একটু সময়ের জন্যও স্বস্তিতে কাটাতে পারিনি।বার বার বাচ্চা মেয়েটির মুখ ভেসে উঠছিলো চোখের সামনে। আমি এ কয়দিনে বুঝে যাই আমি তাদের কতটা ভালোবেসে ফেলেছি।আমি পাশে থাকতে চাই তাদের।এটুকু বলে রিয়ান মোহনার দিকে তাকালো।মোহনার চোখের কোণে পানি, এখনি হয়তো ঝরে পরবে।রিয়ান মোহনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
আমাকে ভুল বুঝোনা মোহনা। আমি সবটা না জেনেই তোমাকে ভালোবেসেছি।সবটা জানার পর আরো বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।
কিছুক্ষন দুজনেই চুপ করে রইলো।
মোহনা শুধু বললো,
আমি আপনাকে ভালোবাসি না আর কোনদিন ভালোবাসতেও পারবো না।কথাটি বলেই মোহনা বেরিয়ে গেলো।
রিয়ান জানতো এমন কিছুই তাকে শুনতে হবে।মোহনা মানবে না সহজে। তবে, সেও হাল ছাড়বে না।
আজ মোহনার কোন কিছুতেই মন বসছে না।রিয়ানের বলা কথা গুলো শুনার পর থেকেই তার সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো।ছেলেটা সব কিছু জেনেও এমনটা কেন করলো।রিয়ান কি তাকে সত্যি ভালোবাসে?মোহনা অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় গেলো।কোথাও কিছু ভালো লাগছে না তার।মোহনা ব্যাপারটা তার মায়ের সাথে শেয়ার করলো। বীনা আহমেদ বললো, ছেলেটাকে দেখে ভালোই মনে হয়েছে। তাছাড়া মেহজানকে অনেক আদর ও করে। মেহজান এর এই বয়সে বাবার স্নেহ দরকার। আশেপাশের সবাইকে যখন দেখে, বাবার সাথে ঘুরাফেরা করতে, খেলাধুলা করতে তখন হয়তো ওরো ইচ্ছা করে। এখন হয়তো তুই আর আমি আগলে রেখেছি।তবে, ভবিষ্যতের জন্য হলেও কাউকে দরকার। মোহনা মায়ের কথা গুলো শুনলো। সবগুলো কথাই তার মা ঠিক বলেছে তবে তার মেয়েকে যে আরেকজন সারাজীবন আগলে রাখবে তার কি নিশ্চয়তা আছে? আর যদি রাখেও সে অন্য কাউকে মানতে পারবে না। তাই আর কিছু না ভেবে রিয়ান কে না করার ডিসিশন টাই ঠিক মনে করলো মোহনা।
মোহনা এখন আর রিয়ানকে নিয়ে কিছু ভাবতে চায় না। রোজ সকালে মেহজানকে স্কুলে দিয়ে আসে। রিয়ান প্রতিদিনই দাড়িয়ে থাকে। তবে, মোহনাকে আর কিছু বলে না। শুধু দাড়িয়ে মোহনার চলে যাওয়া দেখে। মেহজানের নতুন একটা অভ্যাস হয়েছে। কিছুদিন ধরে গেইটের ভিতর রিয়ানকে দাড়িয়ে থাকতে দেখেই, মোহনার হাত ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে রিয়ানকে জড়িয়ে ধরে।এইটুকু বাচ্চা মেয়েকে কি বা বলবে ? বাবার আদর পায় নি।তাছাড়া বাচ্চারা যেখানে আদর পায় সেখানেই বেশি যায়। তাই মেহজানকে আর কিছু বলে না মোহনা। রিয়ান ও মোহনা কে জ্বালায় না। সে ভাবে, হয়তো মোহনাই কোনদিন নিজ থেকে বুঝতে পারবে তার ভালোবাসা।
একদিন রাতে মোহনা মেহজান কে ঘুম পাড়াচ্ছিল তখন মেহজান বলে, জানো মা রিয়ান টিচার আমাকে অনেক আদর করে।প্রতিদিন চকলেট দেয়।আমাকে মাঝে মাঝে গল্প শুনায়। আব্বু থাকলে কি আমাকে এভাবেই আদর করতো?
মোহনা বলে,
-না মা, তোমার আব্বু থাকলে এর থেকে অনেক বেশি আদর করতো।
-কিন্তু আব্বু তো আদর করতে আসেই না। রিয়ান টিচারই তো আমাকে প্রতিদিন আদর করে। একদম তোমার মতো করে আদর করে।
মোহনা আর কোন কথা বললো না। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুমোতে বললো।
রিয়ান ছেলেটা ভালো সেটা মোহনা বুঝতে পেরেছে। তবে তার জীবনে সে আর কাওকে আনবে না। মেহজান আজ যা বললো এসব দিন দিন বারতে থাকলে ব্যাপারটা ভালো হবে না বোঝা যাচ্ছে। তাই রিয়ানের সাথে সামনা সামনি কথা বলতে হবে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত ১০.২৭ বাজে। মোহনা নিজেকে খুব স্বাভাবিক রেখেই রিয়ান কে ফোন দিলো।
মোহনা নিজ থেকে ফোন দিয়েছে তবুও এতো রাতে ! রিয়ানের কাছে একটু অবাক লাগলো ব্যাপারটা । তবুও, ফোন রিসিভ করলো সাথে সাথেই।
-হ্যালো(রিয়ান)
-আমি আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাই।
রিয়ান বিশ্বাস করতে পারছে না মোহনা এ কথা বলছে ! যে মেয়ে তাকে দেখলেই এড়িয়ে চলে, সে কিনা নিজে ফোন দিয়ে বলছে, দেখা করতে। পরমুহুর্তে আবার রিয়ান বললো,
-হ্যা কোথায় দেখা করবো বলুন?
মোহনা লোকেশন বলেই ফোন রেখে দিলো।
রিয়ানের আজও ঠিক করে ঘুম হলো না। মোহনা কি বলবে, কেনো দেখা করতে চাইলো এসব ভাবনা ভাবতে থাকে সে।অপেক্ষা করছে কখন সকাল হবে, কখন মোহনার সাথে দেখা করবে।
চলবে…
পর্ব -৪ এর লিংক..https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/888034121627308/?app=fbl