নূপুর বাঁধা যেখানে পর্ব-৩৫ এবং শেষ পর্ব

0
2718

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-৩৫
#মিফতা_তিমু

[অন্তিম পাতা]

‘ কে বলছেন ? ‘

‘ অঙ্গনা ঝুমুরের বাবা বলছি ‘

ক্ষণ মুহূর্ত থমকে গেলো ফাহমানের। এই মধ্য রাত্তিরে নিস্তব্ধতা ভেঙে ওপাশ থেকে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারোর গম্ভীর, থমথমে কণ্ঠে তার সমস্ত জগৎ ভেঙেচুরে গেলো। মনে হলো এই এক মানুষের মুখোমুখি সে কখনো হতে চায় না। জান্তে হোক কিংবা অজান্তে এই মানুষটার মুখোমুখি হওয়া চলে না। কারণ!! কারণ সে যে ঝুমুরের সমানে সমানে নয়।

ঝুমুরের সঙ্গে প্রণয়ের শুরু থেকেই ফাহমানের মনে এক বিচিত্র ধরনের ভয় ছিলো। তার ভয় ছিলো যদি কোনওদিন প্রেমিকার বাবা নামক মানুষটার সঙ্গে অকস্মাৎ দেখাদেখি হয়ে যায় তবে সে কি করবে ? সেই কারণেই সে কখনো চায়নি ঝুমুরের বাবার মুখোমুখি হতে। কিন্তু সবকিছু যদি তার ইচ্ছে মতোই হতো তাহলে আজ ধন ঐশ্বর্যে মধ্যবিত্ত নামে আখ্যায়িত হতে হতো না তার। জীবন চলে জীবনের নিয়মে। এই সময় মানে না কারো বাধা। তাইতো শত চেয়েও ঝুমুরের বাবার সঙ্গে নিজের মুখোমুখি হওয়ার মতো অপ্রীতিকর ঘটনায় বাধা দিতে পারলো না সে।

‘ আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। আমি ফাহমান। ‘

ফাহমান গলা ঝেড়ে কথাগুলো বলতেই ওপাশ থেকে মোতালেব সাহেব বললেন ‘ বিন্দু বিন্দু জল থেকেই সমুদ্রের উৎপত্তি। তাই বলে কি সেই এক বিন্দু জলের সঙ্গে সমুদ্রের তুলনা চলে ?বিয়ে হলো সমানে সমানে। ভালোবাসা অপরাধ নয় কিন্তু জেনে বুঝে ভুল করা অপরাধ। ‘

মোতালেব সাহেবের কথার অর্থ না বোঝার মতো অর্বাচীন ফাহমান নয়। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে মোতালেব সাহেব তাকে কি বুঝাতে চেয়েছেন। সে নিঃশব্দে হেসে বুকে সাহস সঞ্চয় করলো। তারপর কোমল কণ্ঠে বলল ‘ বিন্দু বিন্দু জল থেকে সাগরের উৎপত্তি বলেই সেই এক বিন্দু জলকে অবহেলা করা যায়না। বিন্দু বিন্দু জল না থাকলে বিশাল সমুদ্রের উপস্থিতি কখনোই সম্ভব নয়। এ ঠিক যে বিয়ে সমানে সমানে হওয়া উচিত কিন্তু সম্পর্কে ভালোবাসা আর বিশ্বাস থাকলে সেই ভালোবাসা দিয়েও একে অপরের ব্যর্থতা মুছে দেওয়া যায়।

ভালোবাসা অপরাধ নয় কিন্তু জেনে বুঝে ভুল করা এবং মানুষ হয়ে নিজ ইচ্ছায় সাপের বিষ অন্তরে ধারণ করা দুটোই সমান। এক্ষেত্রে বিষ যে নিজে গলাধঃকরণ করেছে তাকে শাস্তি দেওয়ার সাধ্যি কার ? ‘

ফাহমানের কথায় না হেসে পারলেন না মোতালেব সাহেব। রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে তিনি শশব্দে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতেই বললেন ‘ আমার মেয়ে তাহলে বাবাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য যোগ্য কাউকে বেছে নিয়েছে। ওয়েল ডান, ইয়াং ম্যান। আমাকে আমারই কথায় বাজিমাত করলে। কিন্তু একটা কথা আছে জানো তো ? ওয়ান লাভ, ওয়ান হার্ট, ওয়ান ডেসটিনি। এখন দেখা যাক তুমি কে। ইউমির ভালোবাসা না ওর নিয়তি ? ভালোবাসা ঠেকানো গেলেও নিয়তি ঠেকানো যায় না মাই বয়। ‘

ফাহমানের মনে হলো মোতালেব সাহেবের প্রতিটা কথায় রাতের নিস্তব্ধতায় প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। মোতালেব সাহেব যে তারই অলক্ষ্যে তার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে এটা স্পষ্ট। তিনি কথায় কথায় বুঝিয়ে দিয়েছেন আলটিমেটলি তার মেয়ের বিয়েটা তার ইচ্ছে মতোই হবে।

‘ কথাটা ঠিক। তবে আমার বিশ্বাস আমিই ঝুমুরের নিয়তি। না হলে ঝুমুরের সঙ্গে আমার দেখা বৃষ্টি ভেজা দুপুরে হতো না। বৃষ্টি ভেজা দুপুরে যাদের দেখা হয় তাদের বিচ্ছেদ কখনও ঘটেনা। ‘

ফাহমানের কথায় মোতালেব সাহেবের ভ্রু কুচকে গেলো। বললেন ‘ কোন লেখক বলেছেন ? হুমায়ূন আহমেদ ? আমি তার অলমোস্ট সব বই পড়েছি কিন্তু এই উক্তি কোথাও পড়েছি বলে মনে হচ্ছে না। ‘
ফাহমান উত্তরে বললো ‘ কোনো লেখক বলেনি। বৃষ্টি ভেজা দুপুরে অষ্টাদশীর প্রেমে পড়া তার প্রেমিক বলেছে। ‘

মোতালেব সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। ফাহমান ফোনটা পকেটে রেখে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেলো ১৩ নং ওয়ার্ডের দিকে। বেড নাম্বার দুইয়ের পেশেন্ট কলাপস করেছেন। অদ্ভুত ভাবে গোঙাচ্ছেন তিনি। নার্স রুহি ডেকে নিয়েছে ফাহমানকে। ফাহমান পেশেন্টের পালস রেট চেক করে নার্সকে ইশারায় ওষুধের এম্পিওলটা পাস করতে বললো।

সময় কাটছে ঝরা পাতার মতো। ঝুমুরের আজকাল রোজ টেস্ট হচ্ছে। এই সাতদিনে টেস্ট দিয়ে দিয়ে যেন ঝুমুরের অবস্থা কাহিল। কোনমতে নাকে মুখে খাবার গুঁজে পড়ে যেতে হচ্ছে। এতকাল পড়াশোনা তার বেশ আনন্দের মনে হলেও আজকাল কেমন যেন কঠিন লাগছে সবকিছু। পরীক্ষায় আগের মত আশানুরূপ ফলাফল হচ্ছে না। কোনমতে যেন পাশ করছে। যদিও এমনটা নয় যে সে শুধুই পাশ মার্ক তুলছে। বরং তার মার্ক উঠছে পাশ মার্ক থেকেও অনেক বেশি। কিন্তু অতীতের সফলতার সঙ্গে এই পরীক্ষার মার্ক মেলাতে গেলে দিনশেষে ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাস তাকে ঘিরে ধরে।

রোজ রাতে খেয়েও এখন ঝুমুরকে বই নিয়ে বসতে হয়। আগের মতো এখন আর নিয়ম মেনে রাত সাড়ে দশটায় ঘুমানো হয়না। রাত দুটো অব্দি পড়তে হয় তার। তারপর আবার মাঝে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে ভোর সাতটায় উঠে পড়তে বসতে হয়। কোনমতে পড়ে তারপর নাকে মুখে গুজে কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে ছুটতে হয়। কোচিংয়ের সময় বদলেছে তার। আগের থেকে দুই ঘণ্টা পিছিয়ে দিয়েছে।

মূলত পরীক্ষা আর পড়াশোনার চাপ মিলিয়েই ঝুমুরের এখন আর বাগান বিলাস সম্ভব হয়না। আবার সেই সূত্রে ফাহমানকেও দেখা হয়না। বিগত দিনগুলোতে ফাহমানও ব্যস্ত ছিল। হয়তো তারও ঝুমুরের মতো এখনও ব্যস্ততা কাটেনি। এই সাতদিনে ঝুমুরের তার সঙ্গে কথা হয়েছে মাত্র দুই বার। দুজনেই যেন দুজনের দিক থেকে ব্যস্ত। কত রাত পেরিয়েছে ব্যস্ততায় অথচ এত কাছাকাছি থেকেও যেন ফুরসৎ মিলে না কথা বলার।

সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে অবশেষে এক্সামটা দিয়ে বের হলো ঝুমুর। দুইদিন পর আবার একটা পরীক্ষা আছে। কাল তথাকথিত প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য ভালোবাসা দিবস হলেও ঝুমুরের জন্য দিনটা পহেলা বসন্ত হিসেবে অভিহিত। ঝুমুর প্রকৃতি প্রেমী নাহলেও তার বসন্ত খুবই পছন্দ। বসন্তে যখন গাছে গাছে কোকিলের ডাক শুনতে পাওয়া যায় তখন তীব্র বিষাদের সুরও কেটে যায়। মনে হয় এই বুঝি সে হারিয়ে যাবে কুহু ডাকা ভোরে।

এক্সাম শেষে ক্লান্তিতে ভারী হয়ে উঠা শরীরটা জোর করে টেনে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। এখনও অনেকটা পথ ফেরা বাকি। বাসে করে হোসেন মার্কেট গিয়ে রিকশা নিতে হবে আজ। এক টানা সাতদিন পরীক্ষা দিয়ে এক ফোঁটা শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই শরীরে। ঝুমুর ক্লান্তিতে এক প্রকার হেলেদুলে হাঁটতে লাগলো। এক সময় হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো কারোর সঙ্গে ধাক্কা খেল। ঝুমুর কপালে আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে বিরক্তিতে মুখ তুলে সামনে দাড়ানো মানুষটার দিকে তাকালো।

এতদিন পর প্রিয় মানুষটাকে দেখে ঝুমুর কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। মুহূর্তেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো তার। মানুষটা কি সুন্দর হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে। অথচ সে সুযোগ করে একবারও ফোন দিল না। সে তো বলেছিল নিজেই ফোন দিবে। মানুষটাকে ঠিক কত সময় অপেক্ষা সে করালো তা হিসাব করে বের করা যাবে না। ঝুমুর ঝাঁপিয়ে পড়লো ফাহমানের গায়ে। এতদিন পর প্রেয়সীর দেখা পেয়ে ফাহমান আদরে জড়িয়ে নিলো প্রিয়তমাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল ‘ পরীক্ষা কেমন হলো ? সব এনসার করা হয়েছে ? ‘

ঝুমুর একসময় নিজেকে ফাহমানের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। চোখের কোণে থাকা অশ্রু মুছে হাসি হাসি মুখে বললো ‘ মোটামুটি বলা যায়। আপনাকে দেখে আমি অনেক খুশি ডাক্তার সাহেব। কতদিন দেখিনা আমি আপনাকে। আপনি রাগ করেছেন আমার উপর ? বলেছিলাম ফোন দিবো কিন্তু কথা দিয়েও কথা রাখতে পারলাম না। ‘

ফাহমান এগিয়ে ঝুমুরের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। ঝুমুরকে আগলে ধরে এগোতে এগোতে বললো ‘ রাগ করিনি। আমি জানি তুমি ব্যস্ত ছিলে। তোমার ব্যস্ততা বোঝার মত বুঝ না থাকলে আমি তো ডাক্তার হিসেবে ব্যর্থ হবো। তুমি এখন যেই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ বছর কয়েক পূর্বে আমিও সেখানেই ছিলাম। ‘

ঝুমুর হাসলো। ফাহমানের বাহুতে মাথা রেখে রাস্তার পাশে দাঁড়ালো। ফাহমান বাসের অপেক্ষায় আছে। বাস আসতেই দুজনে উঠে বসলো। ঝুমুর বললো ‘ আপনার ডিউটি শেষ হতে তো এখনও অনেকটা সময় বাকি। এত আগে বের হলেন কি করে ? দেখে মনে হচ্ছে একবারে বাড়ি ফিরছেন। ‘
‘ আজ হাফ ডে ছিল। তাছাড়া হসপিটালেও পেশেন্ট কম হওয়াতে সুবিধা হয়েছে। ভাবলাম অনেকদিন দেখা হয়না। তাই বাড়ি যখন ফিরছিই তখন একসঙ্গেই ফিরি। এতে কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটানো হবে। ‘

‘ আপনি অনেক দিক দিয়ে লাকি পারসন ডাক্তার সাহেব। ‘

ঝুমুরের কথায় ফাহমান অবাক হয়ে সুধালো ‘ আমি ?? কি করে ? ‘
ঝুমুর বললো ‘ আপনি নিজে একজন ডাক্তার। আপনার প্রেমিকাও ভবিষ্যৎ ডাক্তার হওয়ার পথে হাঁটছে। জানিনা কতটা কি করতে পারবে তবে চেষ্টা আছে। আপনার বন্ধু মানে প্রেমিকার মামাও ডাক্তার। আবার আপনার শাশুড়িও ডাক্তার ছিলেন। আপনার শশুড় বাড়ির গুষ্টি ডাক্তার গুষ্টি। ‘

ঝুমুরের কথা শুনে ফাহমানের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। সে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল ‘ আন্টি ডাক্তার ছিলেন ? কোন ডিপার্টমেন্টের ?আগে তো কখনও বলনি। ‘
‘ গাইনোলোজি ডিপার্টমেন্ট। আপনি জিজ্ঞেস করেননি তাই বলিনি। ‘

ফাহমান চোখ পাকিয়ে তাকালো ঝুমুরের দিকে। ঝুমুর সেই দৃষ্টি দেখে হাসলো। ফাহমান সরু চোখে বললো ‘ আমাকে দুই মেয়ে মানুষ নিয়ে কনফিউজড দেখে খুব মজা নিচ্ছিলে না ? খুব ভালো লাগে আমাকে ঝামেলায় দেখে ? ‘
ঝুমুর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। সহাস্যে বললো ‘ লাগে তো। অনেক ভালো লাগে আপনাকে ঝামেলায় দেখে। বিশেষ করে কনফিউজড হয়ে যখন পাগল পাগল হয়ে যান তখন আরও ভালো লাগে। মনে হয় টুকুস করে গালটা টেনে দেই। ‘

কথা বলতে দেরি হলেও ঝুমুরের ফাহমানের গাল টানতে দেরী হলো না। ফাহমান হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। এই মেয়ে দিনদিন বড় হচ্ছে আর এর দুষ্টুমি বাড়ছে। ফাহমান কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুললো কিন্তু তার আগেই পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন ‘ ভাই আপনি কিছু মনে না করলে একটু দাড়িয়ে ওকে বসতে দিন। ও আমার মেয়ে। ‘

ফাহমান ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখলো ভদ্রলোকের দাড়িতে হালকা পাক ধরেছে। পাশে এক চৌদ্দ বছরের কিশোরী দাড়ানো। ফাহমান বাক্যব্যয় করলো না। উঠে দাড়িয়ে কিশোরীকে বসার জায়গা করে দিলো। ফাহমানের উদারতায় ভদ্রলোক তো খুশি হলেনই সঙ্গে দেখা মিলল ঝুমুরের চিরাচরিত সেই ভুবন ভুলানো হাসি। দিনশেষে এই হাসিটা দেখার জন্যই তো এতকিছু করা।

স্ট্যান্ডে হাত রেখে কোনমতে গা বাঁচিয়ে দাড়িয়েছিল ফাহমান। উপস্থিত জনতা যারা সিটের অভাবে দাড়িয়ে আছেন তারা যে যতটা পারছেন একে অপরকে ঠেলে ধাক্কিয়ে রাখছেন না। এমন সময় ফাহমানের ফোন বেজে উঠলো। ফোন বের করে দেখলো চেনা জানা নাম্বার। মুখের ভাব বদলে গেলো। সময় নিয়ে ফোন রিসিভ করলো।

ফোনের ওপাশ থেকে পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ‘ তোমার কাছে দুটো রাস্তা আছে। ইউমিকে বিয়ে করে কোরিয়ার মতো উন্নত দেশে ওকে এমবিবিএস পড়ার সুযোগ দিবে। অথবা ক্ষণিকের জন্য হারানোর ভয়ে কোনওদিন ইউমিকে নিজের করার সুযোগই পাবে না। তুমি কোনটা চাও ? সাময়িক দূরত্বের মধ্যে দিয়ে ইউমিকে সবসময়ের জন্য নিজের করবে নাকি ইউমির কাছ থেকে দূর হওয়ার ভয়কে আপন করে চিরতরে ইউমিকে হারিয়ে ফেলবে ? তোমার সিদ্ধান্তের উপর তোমার আর ইউমির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে। ‘

ফাহমান আড়চোখে দেখলো যেই কিশোরীর জন্য সে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল ঝুমুর তার সঙ্গেই হেসে হেসে কথা বলছে। ফাহমানের বড় লোভ হলো মেয়েটার এই হাসি রোজ নিয়ম করে দেখার। ফাহমান হেসে বললো ‘ ঝুমুরের হাসি দেখার জন্য হলেও ওকে আমার রোজ সামনে চাই। কথা রইলো, বিয়ের পর ঝুমুর এমবিবিএসের পড়াশোনা কোরিয়াতে করবে। কিন্তু আপনাকেও কথা দিতে হবে। ঝুমুর এমবিবিএসের পড়াশোনা শেষ করতেই ওকে আর নিজের কাছে রাখতে পারবেন না। যত দ্রুত সম্ভব ওর দেশে ফেরার ব্যবস্থা করবেন। আর বিয়ের পর ওর কোরিয়া যাওয়ার আগে যতদিন সময় আছে ততদিন আমি চাই আমরা যেন একসঙ্গে থাকি। ‘

মোতালেব সাহেব দুর্বোধ্য হাসলেন। তার সামনে দাড়িয়ে থাকা ফারুক সেই হাসির মানে ধরতে পারলো না। মোতালেব সাহেব বললেন ‘ তবে তাই হবে। ইউমির এমবিবিএসের পড়াশোনা শেষ হতেই আমি আর ওকে আটকাবো না। ওর কোরিয়া যাওয়ার আগে ওকে তোমার কাছ থেকে দূরেও রাখবো না। ‘

কথাগুলো বলে ফোন রাখলেন মোতালেব সাহেব। তিনি সকলকে চমকে দিয়ে আজ সকালেই এসেছেন। কোরিয়া থেকে বাংলাদেশের এয়ার ফ্লাইট ডিউরেশন বেশিক্ষন নয়। আনুমানিক ষোলো ঘন্টা, তাই তিনি কালই রওয়ানা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। এসেই চমকে দিয়েছিলেন সকলকে। এত বছর পর পরিবার সমেত মোতালেব সাহেবকে বাংলাদেশে দেখে সকলে রীতিমত চমকে গিয়েছিলেন।

মোতালেব সাহেব তাদের বিস্ময়ের মাত্রা আরও একধাপ বাড়িয়ে জানিয়েছিলেন বড় মেয়েকে বিয়ে দিতেই তার বাংলাদেশে আসা। এবার একবারে ছয়-সাত মাস থাকবেন। সেথেকে সকলের খুশির অন্ত নেই। আশেপাশে পাড়া মহল্লায় আজমাঈন সাহেবের ভিনদেশী মেয়ে জামাইয়ের দেশে আসার ঘটনা চাউর হয়েছে। বাগান বাড়িতে যেন বহু বছর পুরোনো সেই উৎসব আমেজ ফিরে এসেছে।

মোতালেব সাহেব ফারুককে বললেন ‘ ফাহমান আমার কল্পনার চাইতেও বেশি বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান মানুষ কখনোই সাময়িক দূরত্বের ভয়ে চিরদিনের জন্য ভালোবাসার মানুষকে হারাবে না। ভেবেছিলাম ফাহমান হয়তো সেরকম নয়, সাময়িক দূরত্বের কাছে তার প্রিয় মানুষটাকে সারাজীবন কাছে পাওয়ার সুযোগ হয়তো মলিন হয়ে যাবে, সে রাজি হবে না। কিন্তু ও রাজি হয়েছে। ইউমি এমবিবিএস কোরিয়াতেই পড়বে। এখন ইউমি নিজে রাজি হলে হয়। নয় ফাহমান করাবে ওকে রাজি। ‘

‘ ঝুমুরকে রাজি করাতে ফাহমানের বেশি হেপা পোহাতে হবে না ভাইয়া। ঝুমুর ফাহমানের কথা শুনে। কোনওদিন ফাহমানের কথার বিরুদ্ধে যায়নি। ওদের দুজনের ভালোবাসার গভীরতা আমি জানি। ফাহমানকে কথায় কথায় ঝুমুর থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। কিন্তু ও আমাকে পুরোই ইগনোর করে গেছে। ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে নিজের আত্মসম্মানের কাছে ভালোবাসাকে বিকিয়ে দিত। কাজেই ঝুমুর কিংবা ফাহমান কেউই এই ব্যাপারে কোনো আপত্তি করত না। কিন্তু সত্যিই কি এসবের কোনো দরকার ছিল ? ঝুমুরকে বললে হয়তো ও নিজেই আপনার কাছে গিয়ে থাকতো। ‘ ফারুক বললো।

‘ না থাকতো না… ওকে আমি চিনি। ওর ভিতরে আমার প্রতি যেই অভিমান জমে আছে সেগুলো ওকে কখনোই আমার কাছে যেতে দিত না। সময়মতো বুঝিনি, ভেবেছিলাম টাকা পয়সা সব মেয়েকে দিলেই হলো। কিন্তু আমার এই ভুলগুলো যে ওকে অভিমানী করে তুলবে কে জানত। ও তাসনুবার মেয়ে… ওর অভিমান বড্ড ভয়ংকর জিনিস। ‘ মোতালেব সাহেব বাহিরের শিমুল গাছের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন। মেয়েটা ঠিক যেন মায়ের মত। অভিমান তার বড্ড ভয়ংকর।

ফারুকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বসার ঘরে ঢুকলেন মোতালেব সাহেব। ঢুকে দেখলেন শাওমি দ্বিধা নিয়ে সোফায় বসে। তার সামনে দাড়িয়ে সামি তাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে আর সেও বুঝদারের মতো মাথা নাড়ছে। অথচ আদতে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। বাবাকে দেখতে পেয়ে উঠে গেলো শাওমি। বাবার কাছে গিয়ে বলল ‘ বাবা ও কি বলছে আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। ‘

সামি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। শাওমির কোনো কোথ তার বোধগম্য হয়নি। কিসব উলটা পালটা ভাষায় কথা বলছে। তার মাথায় প্রশ্ন এলো মেয়েটা এসব কি বলছে ? এমন ভাং ছাংয়ের মানে কি ?
মোতালেব সাহেব হাসলেন মেয়ের কথায়। শাওমি যেন বহুদিন পর বাবাকে হাসতে দেখলো। মোতালেব সাহেব বললেন ‘ সমস্যা নেই, আস্তে আস্তে বুঝে যাবে। তোমার অন্নি ফিরুক। তাকে বললে সেই বুঝিয়ে দিবে। ‘

শাওমি এবার চিন্তায় পরে গেলো। সে জানে তারা এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে তার অন্নির বিয়েতেই এসেছে। এখন অন্নির বিয়ে হয়ে গেলে তাকে এই আছো, যাছো বুঝাবে কে ?মাথায় এত বড় চিন্তা নিয়ে সে বেদিশার মতো হন্যে হয়ে চারিপাশে তাকালো। চেনা, পরিচিত কাউকেই চোখে পড়ছেনা হালমনি ছাড়া। ওমা হালমনি তো জানে এদের আছো,যাছো অর্থ কি। সে নিজেও তো বাঙালি এবং সেই আছো যাছো ভাষায় কথাও বলছে দিব্যি। তারমানে নিশ্চই সে শিখাতে পারবে শাওমিকে। এ বড়ই আনন্দের ব্যাপার।

‘ মোতালেব আমার মনে হয় আমাদের বেরিয়ে পড়া উচিৎ। কালই তো ওদের আংটি বদলের অনুষ্ঠান। তুমি তৈরি হয়ে নাও। আমি, তোমার বাবা, ফাহমানের মা আর তুমি যাবে। হবে না ? ‘ মনোয়ারা বেগম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন।

‘ হবে আম্মা। আমি তৈরি, এখন আপনারা তৈরি হয়ে নিন। ‘

—-

‘ ভাই, বাস থামান। আমরা নামবো। ‘

পরিচিত কণ্ঠে ঝুমুর মুখ ফিরিয়ে তাকালো। দেখলো ফাহমান কন্ডাকটরকে বাস থামাতে বলেছে। অথচ তারা এখনও হোসেন মার্কেট এসে পৌঁছায়নি। ঝুমুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ফাহমানের দিকে। ফাহমান হেসে ঝুমুরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। বললো ‘ বৃষ্টি নামবে নূপুর কন্যা। দেখা যাক আমাদের প্রেম হয়েছে কিনা ? ‘

ঝুমুর মুহূর্ত কয়েক থমকেছিল পরে নিজেকে সামলে হেসে হাতটা এগিয়ে দিল ফাহমানের দিকে। হাতে হাত রেখে বাস থেকে নেমে এলো দুজনে। ততক্ষণে মেঘ গর্জন করে কাদতে বসেছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। আজ এই বৃষ্টি ভেজা দুপুরে ঝুমুরের মনটা হুট করে ভালো হয়ে গেলো। তার বৃষ্টি বড্ড অপছন্দ। অথচ ভালোবাসার মানুষটার সান্নিধ্যে এসে চরম অপছন্দের এই বৃষ্টিও তার পছন্দ হতে শুরু করেছে। পছন্দের এই পথ শুরু হয়েছিল সেদিনের সেই বৃষ্টি ভেজা রাতে বৃষ্টির প্রতি তৈরি হওয়া বিরক্তি দূর করে। আজ সেই পথ এসে ঠেকেছে ভালো লাগায়।

‘ নূপুরটা দাও তো ? ‘

ফাহমানের কথায় চমকে গেলো ঝুমুর। সে ছিল নিজের খেয়ালে। তাছাড়া ফাহমান কি করে বুঝলো নূপুর তার কাছে ? তাই থতমত খেয়ে সে জিন্সের পকেট থেকে নূপুর নামিয়ে ফাহমানের দিকে এগিয়ে দিল। ফাহমান নূপুর হাতে নিয়ে বলল ‘ যেই নারী তারই অন্য সত্তার প্রশংসা করাতে রেগে যেতে পারে তার পক্ষে নিজেরই নূপুর গুম করা কঠিন কিছু নয়। যেদিন জেনেছিলাম তুমি সেই নূপুর কন্যা ব্যাপারটা সেদিনই ধরতে পেরেছিলাম। ‘

কথাগুলো বলে ফাহমান ঝুঁকে বসলো নূপুরের সামনে। ঝুমুরের ডান পায়ে নূপুর পড়াতে পড়াতে বললো ‘ এইযে এত পুরনো এই নূপুর, এর ঝুমঝুম শব্দ আজও আমার বুকে লাগে। তোমার ঐ টানা টানা কাজল চোখগুলো আমার মনে লাগে। তোমার মিষ্টি রিনরিনে কণ্ঠ আমার কানে লাগে। ‘

ঝুমুর হেসে উঠলো। সঙ্গে হাসলো তার চোখও। ফাহমান উঠে দাঁড়াতেই নিঃশব্দে তার বুকে মাথা রেখে বললো ‘ ভালোবাসি… খুব ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব। আমার এই ভালোবাসা আমার নূপুরের ঝুমঝুম শব্দের মতোই। নূপুর যেমন কখনও বাজতে ভুলে না তেমনি আমিও কখনও আপনাকে ভালোবাসতে ভুলবো না। আপনি আমার… এই অঙ্গনা ঝুমুর ওরফে ইউমির। ‘

ফাহমান আগলে ধরলো প্রিয়তমাকে। দূরে কোথাও ভেসে আসছে…

ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে

আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো
তোমার চরণমঞ্জীরে….

~সমাপ্ত….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে