নূপুর বাঁধা যেখানে পর্ব-৩০+৩১

0
967

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-৩০
#মিফতা_তিমু

ফোন হাতে সেন্টারের নির্জন এক কোণে দাড়িয়ে আছে ঝুমুর। তার থেকে হাত কয়েক দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সকলের কথাবার্তা চলছে। এখানে ঝুমুরের পরিবারের কোনো চেনা জানা নেই। তবুও সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কত জনমের চেনা একেকজন। আজমাঈন সাহেব আর শিহাব সাহেব মেহমানদের তদারকি করছেন। আজমাঈন সাহেবের এ এক আশ্চর্যজনক ক্ষমতা। যেখানেই যান খুব সহজেই সবাইকে নিজের আচরণে মুগ্ধ করেন। এই যেমন কত সহজেই শিহাব সাহেবের সঙ্গে পূর্বে কোনো চেনা জানা না থাকা সত্ত্বেও ঘন্টা খানেকের মধ্যে তার সাথে মিশে গিয়ে এখন কাধে কাধ মিলিয়ে সবটা সামলাচ্ছেন।

অবশ্য শিহাব সাহেবের সঙ্গে আজমাঈন সাহেবের পূর্বে একেবারেই কোনো যোগাযোগ ছিল না বললে ভুল হবে। আজমাঈন সাহেব এলাকায় উচ্চ পদস্থ সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন। ১৯৭১ এর সময়গুলোতে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আজমাঈন শাহজাহান যুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।

আজমাঈন সাহেবের বাবা করিম শাহজাহান ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান পালিত রাজাকারদের একজন। ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য ছিল ছেলের দুর্দমনীয়তাকে ব্যবহার করে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দিয়ে পালিয়ে দেশ ত্যাগ করে কাশ্মীর চলে যাবেন সপরিবারে।

কিন্তু আজমাঈন সাহেব তখনও মনে মনে লালন করেছিলেন স্বাধীন এক দেশের চিত্র। তাই বাবার ইচ্ছেকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হয়েছিলেন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আজমাঈন শাহজাহান। সেসময় তিনি নিজ দায়িত্বে থাকা চার ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব নিষ্ঠা ভরে পালন করেছিলেন।

তবে এসবের জন্যও আজমাঈন সাহেবকে বেশ বড় রকমের খেসারত দিতে হয়েছে। বাবার কথায় অবাধ্য হয়েছিলেন বলেই হয়তো বাবা করিম শাহজাহানকে শেষবারের মতো দেখতে পাননি। করিম শাহজাহানের সহচর পশ্চিম পাকিস্তানের মেজর সৈয়দ আজিম নিজ হাতে হত্যা করেছিলেন করিমকে। আফসোস করিম যাদের নিজের মিত্র ভেবেছিলেন তারাই তার জানের শত্রু হলো।

আজমাঈন সাহেব শেষ মুহূর্তে বাবার মুখ দেখার আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আজিমের আদেশে করিম শাহজাহানকে আর পাঁচজন মানুষের মতোই গণকবর দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানীদের কাছে করিম শাহজাহানের মূল্যায়ন না আগে ছিল আর না পরবর্তীতে কখনও হয়েছিল। তারা শুধু স্বার্থের খাতিরে লিপ্সা দেখিয়ে করিমকে নিজেদের মোহে আটক করেছিলেন।

বাবাকে শেষবার দেখতে না পাওয়ার আফসোস এরপর আর কখনো আজমাঈন সাহেবের পিছু ছাড়েনি। সেই আফসোস আর হতাশা থেকেই তিনি
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছিলেন। হতে পারে তিনি দেশকে মুক্ত করার জন্য আর্মিতে জয়েন করেছিলেন কিন্তু ছেলে হিসেবে দেশ রক্ষা করতে গিয়েই তো বাবাকে হারিয়েছিলেন। তাই পরবর্তীতে নিজ উদ্যোগেই এই দেশ রক্ষার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।

আজমাঈন সাহেব যখন অবসর নিয়েছিলেন তখন তিনি দুই সন্তানের বাবা ছিলেন,তাসনুবা আর তানিম। ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর স্ত্রীয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের এত বছরের সব জমাপুঞ্জি কাজে লাগিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেই ব্যবসায় আজ তাকে এতদূর এনেছে। তাকে করেছে সফল আর সম্মানীত।

বিগ্রেডিয়ার জেনারেল হিসেবে আজমাঈন সাহেবকে এই এলাকায় তেমন কেউ না চিনলেও একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে সকলেই চিনে। আজমাঈন সাহেব তো চেয়েছিলেনই তাকে কেউ দেশ রক্ষক হিসেবে না চিনে তার নিজ পরিচয়ে চিনুক। তাই নিজের মাতৃস্থান ঢাকা ছেড়ে গাজীপুরের মতো আধ শহুরে মফস্বলে এসে বাস শুরু করেছেন।

অবশ্য আজমাঈন সাহেব যখন গাজীপুরে প্রথম পা রেখেছিলেন তখন জায়গাটা নিতান্তই অজপাড়া গায়ের মতো ছিল। প্রত্যেকটা বাড়ির মাঝে দুইশ মিটারের দূরত্ব। দূর দূরান্ত অব্দি হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ি শুধু। মানুষজন কম, তেমন দোকানপাট নেই। এতদিন আরাম আয়েশে থাকা মনোয়ারা বেগমের তখন ছেলে মেয়ে আর স্বামী নিয়ে সংসার করতে খুব কষ্ট হতো। আধ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে বাজার করা, আধা ঘন্টার রাস্তা পাড়ি দিয়ে ছেলে মেয়েদের স্কুল থেকে আনতে যাওয়া আর নিজ হাতে বাসা বাড়ি পরিষ্কার করা ছিল নিতান্তই কষ্টকর কাজ।

আজমাঈন সাহেবও সেই সময় ব্যবসা, ছেলে মেয়েদের স্কুলে দিয়ে আসা আর সারাদিন পর বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে কাজে সাহায্য করেই সময় কাটাতেন। তিনি বরাবরই মনোয়ারা বেগমকে খুব ভালোবাসতেন তাই স্ত্রীয়ের এত কষ্ট সহ্য হতো না। বারবার ভাবতেন আবার ফিরে যাবেন ঢাকা। কিন্তু মনোয়ারা বেগমই তখন বলতেন একবার যখন ভবিষ্যৎ ঠিক করে নিয়েছেন তখন সেদিকে আগানোই ভালো। সফল হতে গেলে বাধা বিপদ আসবেই, তাই বলে তো থেমে যাওয়া যায় না।

সেই থেকে শুরু হলো আজমাঈন শাহজাহান আর মনোয়ারা ইশফাকের একলা এই এই মফস্বলের মাঝে টিকে থাকার লড়াইয়ের শুরু। এরপর পেরোলো বিয়াল্লিশ বছর। আজমাঈন সাহেব এখন সফল প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, বয়স তার ঊনসত্তর। এই সামনের বছরই সত্তরের কোঠায় পা দিবে। স্ত্রীয়ের সঙ্গে তার এই ছেচল্লিশ বছরের সংসারে অনেক চড়াই উৎরাই পার করেছেন। হাজারবার ঝগড়া হয়েছে তাদের তবুও কেউ কাউকে ছেড়ে যাননি, অভিমানে একদিনের বেশি দুদিন কথা বলা বন্ধ করেননি।

গাজীপুর এখন উন্নত আর লোক সমাগমে ভরপুর। এখন আর আগের মতো ভোরে চোখ মেললে মোরগের ডাক শোনা যায়না। রাতের নিস্তব্ধতায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ম্লান হয়ে আসে। সময় পেরোতে চায় না অথচ সেদিনই যেন আজমাঈন সাহেব স্ত্রী, ছেলে মেয়েকে নিয়ে গাজীপুর এসেছিলেন। কষ্টের সময়গুলো বুঝি এত দ্রুতই পেরিয়ে যায়, অপেক্ষা করতে থাকে সুন্দর সুন্দর স্মৃতিগুলো ?

ঝুমুর ফোনে রিলস দেখছে। অবসরে তার বই পড়তে ভালো লাগে কিন্তু সময় সুযোগ না থাকলে সে ফোনে ইনস্টাতে রিলস দেখে। যদিও ঝুমুরের এই ফোন নামক যন্ত্রটা বিশেষ পছন্দ নয় তবুও বিপদে এই জিনিসটাই কাজে লাগে তাই এর প্রতি সে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। তাই নিতান্তই যত্ন নিতে না পারলেও অবহেলাও যে করে তা নয়।

‘ বিরিয়ানি খেতে মন চাইছে ? ‘

চেনা কণ্ঠে ঝুমুর হুড়মুড়িয়ে লাফিয়ে উঠলো। বুকের ভেতরটা কেমন ধুকপুক করছে, হৃদস্পন্দন যেন এখনও শোনা যাচ্ছে। ঝুমুর আতঙ্কিত চোখে পাশে তাকালো। ফাহমান ওর হাতে থাকা ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছে। ফোনে বিরিয়ানির রিল চলমান, সেটাই দেখছিল এতক্ষণ ঝুমুর। ঝুমুর আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি দিলো। দেখলো আশেপাশে কেউ নেই। সে এবার হাফ ছেড়ে বললো ‘ এভাবে কেউ কানের কাছে এসে কথা বলে ? আরেকটুর জন্য মরতে করতে বেচেঁ গেছি। ‘

‘ আমি তো দেখছিলাম তুমি ফোনে কি দেখো। দেখলাম বিরিয়ানির ভিডিও দেখো। খেতে ইচ্ছে করছে নাকি ? ‘

ফাহমানের কথায় ঝুমুর মুখে হাত রেখে হেসে ফেললো নিঃশব্দে। বললো ‘ উহু, আমার খেতে ইচ্ছা করছে না। যেকোনো ফুড আইটেমের রিল দেখা আমার পছন্দ। আমি খাওয়ার চেয়ে দেখতে বেশি পছন্দ করি। খাবার নিয়ে রিসার্চ করতে আমার ভালো লাগে। ‘
‘ যদিও ব্যাপারটা অদ্ভুত কিন্তু দারুন। কিন্তু তার থেকে দারুন তোমার হাসিটা। আচ্ছা এত সুন্দর হাসি তুমি সবসময় সবার থেকে লুকিয়ে রাখ কেন ? আজ অব্দি কোনওদিন কারোর সামনে হাসতে দেখিনি। কারোর সামনে হাসো না অথচ আমার সামনে দিব্যি হাসো। ‘ ফাহমান অবাক হয়ে বললো।

‘ কথা ঠিক তবে হাসি আর কান্না, এই দুটো হলো আমাদের দুর্বলতা। আর দূর্বলতা সবাইকে দেখাতে নেই। যা আপনাকে দেখানো সাজে তা অন্যদের ক্ষেত্রে বেমানান। ‘ ঝুমুর ঠোঁটের কোণে তার সেই চিরচেনা হাসি টেনে বললো।

ফাহমান ঝুমুরের চোখের তারায় নিজেকে দেখলো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বললো ‘ আপনার এই চোখে আমি নিজেকে দেখতে পাচ্ছি বাগান কন্যা। কেন বলুন তো ? এর মানে কি ? ‘
ঝুমুর ফাহমানের কথা শুনে আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখলো। পরিবেশ অনুকূলে ভেবে খানিকটা এগোলো ফাহমানের দিকে। ফাহমানের বুকের বা পাশটায় নিজের মখমলের মতো নরম হাতটা রেখে হেসে বলল ‘ কারণ আমার এখানে আপনার বাস। ‘

ফাহমান নিঃশব্দে ঝুমুরের হাতে হাত রাখলো। কিছু বললো না। একাকি তাদের সময়টা কাটছে নীরবে। অনুষ্ঠানে যারা এসেছিলেন তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে চলে গেছেন। রাত বাড়ছে হু হু করে। চারিদিকে অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছে। সময়ের কাটা এগিয়ে যাচ্ছে মধ্য রাতের দিকে আর ফাহমান ঝুমুর তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে।

এক জোড়া ক্রুদ্ধ চোখ তাকিয়ে আছে ফাহমান ঝুমুরের পানে। ওদের এই ঘনিষ্ঠতা তার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছে। এই সম্পর্কের রসায়ন ঠিক সে ধরতে পারছে না। সব কেমন জটিল জটিল লাগছে। শিল্পপতি মোতালেব হোসেনের জৈষ্ঠ্য কন্যা অঙ্গনা ঝুমুর এতকাল ধন, ঐশ্বর্যে বড় হয়ে যে এমন বোকার মতো এক গরীব ঘরের সাধারণ ছেলের প্রেমে পড়বে সেটার জানা ছিল না। বিরক্তিতে মানুষটার কপালে কুঞ্চন রেখা পড়েছে।

বৌভাতের অনুষ্ঠান থেকে ঝুমুরদের ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হলো। ফেরার সময় হৈমন্তী যেন তার বিদায় বেলা থেকেও বেশি কাদছিল। তার এমন কান্নার জোর দেখে আসিফ বলে বসেছিল হৈমন্তী চাইলে মা ভাইয়ের সঙ্গে কয়েকদিনের জন্য বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু হৈমন্তী নিজেই কিছুক্ষণ কান্নাকাটি পরে বলেছিল সে এখনই যাবে না কারণ এখন সে মা ভাইয়ের সঙ্গে ফিরলে বাড়িতে আত্নীয় মহলে পাঁচ লোকে পাঁচ কথা বলবে। তার থেকে কয়েকদিন পর আত্মীয় স্বজন সকলে চলে গেলে তখন যাওয়া যাবে।

প্রথমে দুটো গাড়ি নিয়ে রওনা দিলেও পরে দারোয়ানকে ফোন দিয়ে আজমাঈন সাহেব ড্রাইভার দিয়ে আরেকটা গাড়ি পাঠাতে বলেছিলেন। সেই গাড়িতে করেই মারিয়াম আর ফাহমান ফিরছেন। রাত অনেক হওয়ায় রাস্তা ফাঁকা ছিল তাই তাড়াতাড়ি ফেরা। ফাহমানরা পৌঁছানোর মিনিট পাঁচেক পরেই একে একে আজমাঈন সাহেবদের বাকি দুটো গাড়িও এসে পৌঁছাল।

গাড়ি থেকে নেমে ফাহমান ঝুমুরের চোখাচোখি হলো। আজমাঈন সাহেব আর মনোয়ারা বেগম মারিয়াম আর ফাহমানকে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেলেন নিজেদের বাগান বাড়ির দিকে। সবশেষে ঝুমুর যখন বাড়িতে ঢুকলো তখনও শেষবারের মতো ঝুমুর পিছন ফিরে ফাহমানকে দেখলো। একে অপরকে দেখে হেসে বিদায় নিলো।

ঝুমুর ক্লান্ত পায়ে ঘরে এসে ঢুকলো। সময় নিয়ে লেহেঙ্গা খুলে ঘরের কনফর্টেবল আউটফিট নিলো। এতক্ষণে যেন টিশার্ট আর ট্রাউজারে শান্তি লাগছে। ঝুমুর ফ্রিজ খুলে তার ফেভারিট এনার্জি ড্রিংক গলাধঃকরণ করলো। এখন মনে হচ্ছে শরীরটা ফ্রেশ লাগছে। এরপর ঝুমুর সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে সমস্ত মেকআপ ক্লিন করে শরীর এলিয়ে দিল বিছানায়। আর দেখা গেলো পিঠ ঠেকাতেই নিদ্রায় ঝুমুরের চোখ দুটো বুজে এলো।

—-

জামা কাপড় বদলে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো আসিফ। ঘরের শুভ্র বাতি নিভিয়ে নীলচে আলো জ্বালানো। আসিফ গিয়ে ঘরের শুভ্র বাতি জ্বালিয়ে দেখলো হৈমন্তী অনুষ্ঠানের কাপড়েই বিছানায় শুয়ে আছে। ব্যাপারটা আসিফের কেমন অদ্ভুত লাগল। তবে ভাবলো মনে হয় সারাদিনের ক্লান্তি ভর করেছে দিনশেষে তাই শুয়ে আছে।

আসিফ হৈমন্তীর কাছে গিয়ে ডেকে দিলো। হৈমন্তী কোনমতে চোখ খুলে দুর্বল গলায় বললো ‘ কিছু বলবেন ? ‘
‘ বলছিলাম যে ফ্রেশ হয়ে আয়। ঘুমাতে হবে তো। তুই এলে ঘরের লাইট নিভিয়ে আমি শুবো। কাল বেরোতে হবে আমার। ‘

আসিফের কথায় উঠে বসলো হৈমন্তী। ধীরে সুস্থে পা রাখলো মেঝেতে। তারপর আস্তে করে উঠে পা বাড়ালো বাথরুমের দিকে। হৈমন্তীর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আসিফ। কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে হাঁটছে হৈমন্তী। ব্যাপারটা খটকা লাগলো। আসিফ বললো ‘ তোর কি কিছু হয়েছে ? তুই ঠিক আছিস তো ? ‘

হৈমন্তী নিঃশব্দে মাথা নাড়ল যে তার কিছু হয়নি। তবুও আসিফের সন্দেহ মিটলো না। ও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হৈমন্তীকে পর্যবেক্ষণ করলো। হৈমন্তী বাথরুমে গেলো তারপর সময় নিয়ে জামা কাপড় বদলে বেরিয়েও এলো কিন্তু আসিফকে এক জায়গাতেই দাড়িয়ে থাকতে দেখলো। হৈমন্তী ভাবলো এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে কেন। তাই ও জিজ্ঞেস করলো ‘ কিছু বলবেন ? ‘

আসিফ মাথা নেড়ে হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে এনে হৈমন্তীকে এনে বিছানায় বসালো। নিজে হৈমন্তীর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে প্রথমে হৈমন্তীর কপালে হাত রাখলো। শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক মনে হওয়ার পর আবার হৈমন্তীর পেটে হাত রাখলো। জিজ্ঞেস করলো ‘ তোর কি কিছু হয়েছে ? পেটে ব্যাথা করছে ? ‘

হৈমন্তী কিছু বললো না, নিশ্চুপ সে। আসিফ খানিকটা বিরক্ত হলো। আবারও বললো ‘ উত্তর দিচ্ছিস না কেন কথার ? তুই না বললে আমি বুঝব কি করে তোর কি হয়েছে ? ‘
হৈমন্তী এবার মুখ খুললো। চোখের কোণে অশ্রু মুছে বললো ‘ পেট অনেক ব্যাথা করছে আমার। ‘
আসিফ বুঝলো আসল সমস্যা কি। বললো ‘ তো এটা বলবি না ? না বললে বুঝবো কি করে ? আমি তো অন্তর্যামী নই। তোকে তো আমাকে মুখে বলতে হবে। আবার এমনও নয় যে এসব আমি বুঝি না। এগুলো তো কমনসেন্স। ‘
কথাগুলো বলে আসিফ উঠে দাড়ালো ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তবে হৈমন্তী ওর হাত টেনে ধরলো। জিজ্ঞেস করলো ‘ কোথায় যাচ্ছেন ? ‘

‘ তুই বস আমি আসছি ‘ বলে আসিফ বেরিয়ে গেলো। হৈমন্তী বসে রইলো আসিফের অপেক্ষায়। অপেক্ষার পালা ফুরোলো মিনিট বিশেক পর। আসিফ হটব্যাগ হাতে ফিরেছে। এগিয়ে এসে হৈমন্তীর হাত ধরে টেনে উঠিয়ে দাড় করালো। তারপর বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজে পাশে বসে হৈমন্তীর পেটে হটব্যাগ ধরে বললো ‘ এই সময়টাতে পেইন কিলার খাওয়া উচিত নয় তাই হটব্যাগ লাগা। একটু সহ্য কর, ব্যথা আস্তে আস্তে কমে যাবে। ‘

কথাগুলো বলে আসিফ ঘরের লাইট নিভিয়ে হৈমন্তীর পাশে শুয়ে পড়লো। হৈমন্তী পেট থেকে হটব্যাগ নামিয়ে পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করলো ‘ আচ্ছা আপনি কি করে জানলেন হটব্যাগ লাগালে পেট ব্যাথা কমে যায় ? ‘

আসিফ হৈমন্তীর নামিয়ে রাখা হটব্যাগটা এবার নিজে হৈমন্তীর পেটে ধরলো। তার বোঝা হয়ে গেছে হৈমন্তী ধরবে না। তাই তাকেই ধরতে হবে। সে হটব্যাগ ধরে রেখে উত্তর দিলো ‘ ভাবিস না ডাক্তারের বোন বলে শুধু তুইই এসব জানার এখতিয়ার রাখিস। আমার ঘরেও মা চাচী আছে। মায়ের কারণে এসবে অভিজ্ঞতা আছে আমার। বাবা বাড়ি না থাকলে আমিই পানি গরম করে মাকে হটব্যাগ দিতাম। ‘

‘ আপনি খুব ভালো, আসিফ ‘

আসিফ শুনলো হৈমন্তীর কথা। ভ্রু তুলে বললো ‘ বলছিস ? ‘ হৈমন্তী উত্তর দিলো ‘ হুম ‘
আসিফ এগিয়ে গিয়ে হৈমন্তীকে আগলে নিলো। জড়িয়ে ধরে হৈমন্তীকে আগলে রাখলো নিজের বুকে। হৈমন্তীকে সে চিনে অনেক বছর। হৈমন্তী অনেক মিশুকে আর চঞ্চল। কিন্তু বিয়েটা এমন পরিস্থিতিতে হয়েছে যে চাইলেও মেয়েটার মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। এখন এই পরিস্থিতিতে একমাত্র আসিফই সহায়। সেই পারে প্রেয়সীকে আগলে নিয়ে মানিয়ে নিতে।

হৈমন্তী নিশ্চুপ হয়ে আসিফের বুকে মাথা পেতে শুয়ে আছে। আসিফের বুকের ধুকপুকানি যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। আসিফ ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হৈমন্তীর চোখের কোণে অশ্রু। এত সুখ যেন কপালে সয়। এই ভালোবাসা এমনই থাকুক বাকি জীবন এটাই হৈমন্তীর চাওয়া। কারোর যেন নজর না লাগে তাদের এই ভালবাসায়।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-৩১
#মিফতা_তিমু

রাতের নিকষ কালো অন্ধকার কেটে গিয়ে ভোরের সূচনা হয়েছে। গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত প্রকৃতি। ঝুমুর নীরবে গাছে পানি দিচ্ছে। সবে ছয়টা বাজে, এখনও অনেকটা সকাল। আশেপাশে সকলে ঘুমিয়ে আছে কিন্তু ঝুমুর বরাবরের মতোই ভোর হতেই জেগে গেছে। প্রাতঃকালিন শরীর চর্চা সেরে সে বাগানে এসে দাঁড়িয়েছে।

ঝুমুর গাছে পানি দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার মাথায় ঘুরছে অন্য কথা। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে চিন্তিত। রাতে ঘুম হয়নি ভালোমত, ঘুরে ফিরে একই কথাই বারবার মস্তিষ্কে বিচরণ করছে। ফাহমান কি এখনও সেই নূপুর কন্যাকে ভুলতে পারেনি ? নাহলে এখনও সেই নূপুর এতটা সামলে রেখেছে কেন ? ফাহমানের মনে কি চলছে ? ঝুমুর কিছুই বুঝতে পারছে না কিন্তু এই প্রশ্নটা তাকে ভিতর থেকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ফাহমান অন্য কারোর কথা ভাবছে এটা যেন মন মানতেই চাইছে না।

ফাহমানও ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের ছাদ থেকে ঝুমুরের বাগান স্পষ্ট দেখা যায়। এই যেমন এখন দেখা যাচ্ছে ঝুমুর পাইপ দিয়ে গাছে গাছে পানি দিচ্ছে সঙ্গে ওর চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ। কি এমন ভাবছে মেয়েটা ? ফাহমান ধরতে পারলো না ঝুমুরের অস্থির চোখ মুখের কারণ। তবে ঝুমুর যতই অশান্তির মধ্যে দিয়ে যাক না কেন তার মনের অবস্থা সে কখনো কারোর কাছে প্রকাশ করে না। তাইতো বাড়ির ছাদে এসে দাড়ানো ফাহমানের চোখে চোখ পড়তেই মিষ্টি এক হাসি দিল।

ঝুমুরের মন ভোলানো হাসিটা দেখে ফাহমানের সস্তি হলো। হাসিটা যেন অদ্ভুত সুন্দর, মেঘ মেদুর আকাশে রোদের লুকোচুরি খেলা। ফাহমান নিশ্চিত হলো ভুলটা তারই, ঝুমুরের কিছুই হয়নি। ঝুমুর ফাহমানের দিকে তাকিয়ে হেসে আবারও নিজের কাজে মন দিল। বাগানে দাড়িয়ে সে কখনোই ফাহমানের সঙ্গে কথা বলে না। সম্ভবও নয়। কথা বলতে হলে দেখা যাবে এতদূরে নিজের কথা পৌঁছে দিতে চিৎকার জুড়ে দিতে হবে। তখন পাড়া শুদ্ধ লোক জেগে যাবে। এর থেকে নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয়।

ঝুমুর গাছে পানি দিয়ে ডালিয়া,কসমস,ক্যামেলিয়া, প্যান্সির ঝড়ে যাওয়া ফুলগুলো তুলে নিজের হাতে জমিয়ে উঠে দাড়ালো। ফুলগুলো ঘরের ল্যাভেন্ডার প্লান্টের প্লেটে রাখবে, সুন্দর লাগবে দেখতে। ঝুমুর ফাহমানদের বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে আরেকটু হেসে বিদায় নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। ঘরে এসে ফুলগুলো জায়গামতো রেখে ঘর ছেড়ে বের হলো সকালের নাস্তা তৈরি করার জন্য।

দ্রুত গতিতে তৈরি হচ্ছে ফাহমানে। শার্টের শেষ বাটন লাগিয়ে ইং করে নিলো। চুলে ব্যাক ব্রাশ করে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা ঘড়িটা হাতে পড়ে নিয়ে শেষবারের মতো আয়নায় নিজেকে দেখে নিল। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখার জন্য জিন্সের পকেটে হাত রেখে চেক করলো মানিব্যাগটা নেই। ওটা স্টাডি টেবিলের ড্রয়ার থেকে নিয়ে কাধে ব্যাগ তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। কিছু একটা মনে করে আবারও ফিরে এলো। বিছানার কাছে গিয়ে বালিশ উঠিয়ে নূপুর কন্যার নূপুরটা খুঁজলো, ড্রয়ারে সেফ জায়গায় রেখে যাওয়া প্রয়োজন ওটা।

ফাহমানের মাথায় হাত, নূপুরটা গেলো কোথায় ? ওটা এত সাবধানে রাখলো তবুও গায়েব হয়ে গেলো। কোথায় গেলো জিনিসটা ? ওটা হারালে চলবে না, অন্য কারোর আমানত ওটা। যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। তার জন্যই তো এত আগলে রাখা। নূপুর কন্যার সঙ্গে তার এখনও দেখা হয়নি কিন্তু ভবিষ্যতে যে দেখা হবে না তার গ্যারান্টি কি ? দেখা হলে তখন তার জিনিস ফিরিয়ে দিবে কি করে ?

অস্থির ফাহমান ঘরময় কিছুক্ষণ পায়চারি করলো। মনে শান্তি মিলছে না। এমন আগে কখনও হয়নি যে তার কাছে কারোর কোনো জিনিস রাখা আছে অথচ সে সেটা হারিয়ে ফেলেছে। ভিতরটা যেমন অস্থির লাগছে। নূপুরটা নূপুর কন্যাকে ফেরাবে কি করে ? জিনিসটা তো তার খুব প্রিয়ও হতে পারে। ফাহমান অস্থির চিত্তে ঘড়ির ডায়ালে একবার চোখ বুলালো। আর সময় নেই। এখনই বের হতে হবে নাহলে দেরি হয়ে যাবে।

ফাহমান আর কিছু ভাবতে পারলো না। আপাতত সে এটা বুঝতে পারছে যে তার এখন বের হতে হবে নাহলে হসপিটাল পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। ফাহমান ভেবে নিলো এখন বেরিয়ে যাবে। হসপিটাল থেকে ফিরে নাহয় আবার খোঁজা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ফাহমান ব্যাগ কাধে নিয়ে মাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো। দ্রুত পা চালিয়ে হোসেন মার্কেট এসে পৌঁছাল। দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে ওপারে গিয়ে দাড়ালো।

দ্রুত পৌঁছানোর জন্য ফাহমান এত দ্রুত হেঁটেছে যে তার এখন নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ফাহমান দুই মিনিট দাড়িয়ে নিজেকে স্টেবল করার চেষ্টা করলো। ঝুমুর পাশেই দাড়িয়েছিল। ফাহমানকে হাপাতে দেখে বললো ‘ আজ আবার দেরি যে!! ‘
ঝুমুরের কথা শুনে ফাহমান খানিকটা চমকেই উঠলো বোধহয়। অবাক হয়ে বললো ‘ তুমি এখানে!! বাস ধরোনি ? ‘

‘ ধরলে নিশ্চই আপনার সামনে দাড়িয়ে থাকতাম না। ধরিনি আপনার জন্য। অপেক্ষা করছিলাম, আমি আগে আগে বাস ধরে ফেললে আজ আমাদের দেখাই হতো না। ‘ ঝুমুর ফাহমানের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল।

ফাহমান এতক্ষণে ঝুমুরকে ভালো করে লক্ষ্য করলো। ঝুমুরের সাজপোশাক আজ অদ্ভুত রকমের। রোজকার বাহারি রকমের বাঙালিয়ানা সাজপোশাক ছেড়ে বিদেশিনী রুপে হাজির হয়েছে আজ। পরনে অদ্ভুত রকমের সাদার মাঝে খয়েরী স্ট্রাইপ দেওয়া হাটুর নিচ অব্দি একটা ঢলঢলে ফুল হাতা ড্রেস যার আবার সামনে দিয়ে শার্টের মতো পকেট দেওয়া। গলায় স্কার্ফও জড়ানো।

ফাহমান ভেবেই অবাক। এমন অদ্ভুত ধরনের পোশাক আগে কাউকে পড়তে দেখেনি সে। আজকাল মেয়েরা সাধারণত স্টাইলের জন্য টাইট, ফিটিং জামা কাপড় পড়ে বডি শেপ উন্মুক্ত করে রাখে। অথচ ঝুমুরের পরনে আলখাল্লা টাইপের পকেটওয়ালা ড্রেস। এটা আবার কোন দেশের ড্রেস… আগে কখনো দেখেনি ফাহমান।

ফাহমান ঝুমুরের সাজপোশাকের সঙ্গে সঙ্গে চেহারার ভাবও লক্ষ্য করলো। এবং এই প্রথমবারের মতো সে সূক্ষ্ম এক পরিবর্তন লক্ষ্য করলো। ঝুমুর আসলে চোখে মুখে পুরোপুরি বাঙালি নয়। সবসময় বাঙালি সাজে থাকে বলে বোঝা যায়না। কিন্তু আজ স্পষ্ট প্রতীয়মান যে আধুনিক পোশাকে ঝুমুরকে একদম ব্যতিক্রম লাগছে। পুরোপুরি নয় তবে চেহারা, সাজপোশাকে একটু আধটু কোরিয়া সংস্কৃতির ছোঁয়াও আছে। মুখটা তার তাইতো লম্বাটে ধারালো সৌন্দর্য্যের, হাত পাগুলো লম্বা লম্বা আর শরীর পুরোই এখনকার ডায়েট করা রমণীদের জিরো ফিগারের মতো।

তবে এটা স্বীকার করতে ফাহমান নিজেও বাধ্য যে এমন টিংটিংয়ে পাতলা গোছের ঝুমুরকে এমন ঢিলাঢালা ড্রেসেও বেশ সুন্দর লাগছে। যেন রোজকার বাঙালিয়ানায় সেজে ওঠা ঝুমুর আর আজকের এই আধুনিক পোশাক পরিহিতা ভিনদেশী ঝুমুর দুজনেই আলাদা সত্তা অথচ কোথাও না কোথাও তারা দুজনেই এক। সেই মন ভোলানো হাসি আর বরাবরের মতোই শালীনতা বজায় রেখে নিজেকে উপস্থাপন করার ভঙ্গি।

ফাহমানকে এভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঝুমুরের মনঃক্ষুণ্ণ হলো। মলিন গলায় বললো ‘ কেমন লাগছে আমাকে ? বড্ড বেশি বাজে লাগছে তাইনা ? ‘
ঝুমুরের কথায় ফাহমান বললো ‘ বাজে লাগছে ? ‘
ঝুমুর আবারও বললো ‘ লাগছে না ? তাহলে কিছু বলছেন না যে ? ‘
ফাহমান হাসলো। বললো ‘ সব সৌন্দর্য্যের কি ব্যাখ্যা হয় ? কিছু কিছু জিনিসের কোনো ব্যাখ্যা নেই, না আছে কোনো প্রশংসা করার মতো উপমা। তাছাড়া যার নামেই সুন্দরী কথার উল্লেখ আছে তাকে আলাদা করে কি সুন্দর বলবো ? ‘

ফাহমানের কথা শুনে ঝুমুর সরু চোখে তাকালো ওর দিকে। ঝুমুরের দৃষ্টি দেখে ফাহমান বললো ‘ অঙ্গনা অর্থ সুন্দরী। ‘
ঝুমুর হাসলো তবে কথা বাড়ালো না। বাস এসেছে ততক্ষণে। ফাহমান প্রথমে ঝুমুরকে বাসে তুলে দিলো তারপর নিজে উঠলো। কিন্তু আজ মনে হয় দুজনের ভাগ্য সহায় ছিল না তাই বাসে কোথাও বসার জায়গা নেই। ফাহমান চিন্তিত চোখে আশেপাশে তাকালো। কেউ যে ঝুমুরকে বসার জন্য জায়গা দিবে সেটাও না।

‘ সিট তো পাচ্ছি না ঝুমুর ‘ ফাহমান চিন্তিত মুখে বললো। ঝুমুর তখন বাসের হ্যান্ডেলে হাত রেখে দাড়িয়েছিল। ফাহমানের কথা শুনে ও বললো ‘ সমস্যা নেই, এখান থেকে এখানেই তো। এতটুকু রাস্তা আমি দাড়িয়েই যেতে পারবো। আপনি চিন্তা করবেন না। ‘

‘ না সেটা বললে কি করে হয় ? জ্যাম লাগলে সারাদিন লেগে যাবে কিন্তু তুমি উত্তরা পৌঁছাতে পারবে না। তাই তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি দেখছি সিট পাই কিনা। ‘ বলেই ফাহমান আশেপাশে চোখ বুলালো।

‘ এই যে আপা আপনি এখানে বসেন ‘

ফাহমান তখন ঝুমুরের জন্য সিট খুঁজছিল। আশায় ছিল যদি কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি নিজে উঠে গিয়ে তার প্রেয়সীকে জায়গা করে দেয়। কিন্তু জায়গা তো সে পেলোই না উল্টো ঝুমুরকে বসার জন্য প্রস্তাব দেওয়া লোকটার অশ্লীল চোখের চাহনি, মুখের ভাব আর তেলতেলে হাসি দেখে ফাহমানের পুরো শরীরে যেন আগুন ধরে গেল। ও বড় বড় চোখে চেয়ে রইলো লোকটার দিকে।

‘ ওই দেখুন পেয়ে গেছি সিট। আপনার আর চিন্তা করতে হবে না, আমি বসছি ওখানে ‘ বলে ঝুমুর লোকটার দেখানো সিটে অর্থাৎ লোকটার পাশে বসতেই এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ফাহমান ওর হাত টেনে ধরলো। দাতে দাত চেপে ঝুমুরের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো ‘ আর ইউ স্টুপিড মিস অঙ্গনা ? কি করতে যাচ্ছিলে এখন ? ওই খারাপ লোকটার কথায় তুমি ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে যাচ্ছ বসতে। মেয়ে মানুষদের স্বাভাবিক মেয়েলি সিক্সথ সেন্স থাকে অথচ তোমার সেটাই নেই। তুমি লোকটার চোখ মুখ দেখেও বুঝলে না, হাউ স্টুপিড!!! ‘

ফাহমানের কথার ধরনে ঝুমুর খানিকটা চুপসে গেল। ফাহমান এভাবে কথা বলে না ওর সাথে। ও সম্পূর্ণ ঘটনা বুঝতে লোকটার দিকে ফিরে তাকালো। এতক্ষণ খেয়াল করেনি কিন্তু ওর উপর লোকটার লোলুপ দৃষ্টি দেখে ওর নিজেরই অসস্তি হলো। ও হাত দিয়ে টেনেটুনে নিজের গলার স্কার্ফ আবারও ঠিক করলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলো, ফাহমান ভাগ্যিস টের পেয়েছিল নাহলে আজ বিপদ বাঁধিয়ে বসতো।

লোকটা ফাহমান ঝুমুরকে আড়ালে এভাবে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে বিচ্ছিরি ভাবে হেসে বললো ‘ কি ভাইজান ? আপা বুঝি আপনার প্রেমিকা ? তাই আমার লগে বসতে দিতে মন চায় না ? আমারে তেমন মানুষ ভাববেন না। আমি কইলাম আপনার প্রেমিকার দিকে চোখ তুইলাও তাকাবো না। ‘

লোকটার মুখে প্রেমিকা কথা শোনা মাত্র সঙ্গে সঙ্গে বাসে উপস্থিত জোড়া বিশেক চোখ ফাহমান ঝুমুরের উপর এসে পড়ল। উপস্থিত যাত্রীরা সকলে হতবাক চোখে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখছে। রাগে বিব্রত ফাহমান দাতে দাত চেপে মেকি হেসে বললো ‘ আপনার উদারতার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে ভাই কিন্তু বাসে দাড়িয়ে জার্নি করার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। ‘

সেই লোক ফাহমানের রক্তিম মুখ দেখে আর কিছু বলার সাহস পেলো না। ফাহমান দাড়িয়ে আছে লোকের পাশে ঝুমুরকে আড়াল করে। ভাব এমন ঝুমুরের দিকে সেই বদলোক যেন নজর দেওয়ার দুঃসাহস না করে তারই ব্যবস্থা করেছে। ঝুমুর এদিকে ফাহমানের কাজেকর্মে মিটমিটিয়ে হাসছে। ফাহমান লক্ষ্য করলো কিন্তু কথা বাড়ালো না।

মিনিট পাঁচেক পরই যাত্রী নেমে যাওয়ায় দুটো সিট খালি হয়ে গেলো। ফাহমান ঝুমুর গিয়ে দ্রুত বসলো সেখানে। ফাহমান সস্তির নিশ্বাস ফেললো। যাক এখন অন্তত ঝুমুরের উপর ওই লোকের নজর পড়বে না। এতক্ষণ ভিড়ভাট্টায় খেয়াল ছিল না কিন্তু এখন মনে পড়ছে মিস নূপুরের নূপুর তার গাফিলতিতেই হারিয়েছে সে। মুহূর্তের মনটা বিষিয়ে গেলো।

এতক্ষণ রাগে গজগজ করা মুখটা যখন মন খারাপের ভারে কালো হয়ে গেলো তখন ঝুমুর কিঞ্চিৎ অবাক হলো। এই একটু আগেই তো ফাহমান রাগে গজগজ করছিলো। তবে মুহূর্তেই কি এমন হলো যে মন এতটা খারাপ হয়ে গেলো। ঝুমুর জানে সে শান্তি পাবে না ফাহমানের মন খারাপের কারণ না জানা পর্যন্ত। তাই নিজেই জিজ্ঞেস করলো ‘ কি হয়েছে আপনার ? মন খারাপ নাকি ? কেমন অস্থির দেখাচ্ছে। ‘

‘ নূপুর কন্যার নূপুর আমার বালিশের কাছে রাখা ছিল। বর্তমানে খুঁজে পাচ্ছি না। ওটা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি হবে না আমার। ‘

ফাহমানের কথা শুনে ঝুমুরের ভিতরটা বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল। মানুষটা ওই নূপুর না পেয়ে এত অস্থির কেন হচ্ছে ? কেন এভাবে তার অনুভূতি নিয়ে খেলছে ? কি চাই তার ? সে কি জানেনা তার সামনে অন্য কারোর কথা মানুষটা মুখে আনলেও তার কষ্ট হয়। ঝুমুরের ইচ্ছে করলো একবার এই প্রশ্নগুলো ফাহমানকে করে বসুক। কিন্তু করা হলো না। উল্টো কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেলো।

‘ কি ভাবছো ? ‘ ঝুমুরকে চুপ করে যেতে
দেখে ফাহমান প্রশ্ন করলো।
ঝুমুর ফাহমানের কথায় মলিন চোখে তাকিয়ে মেকি হেসে বললো ‘ দোয়া করি আপনি যেন দ্রুতই নূপুরটা পেয়ে যান। ‘
ফাহমান ঝুমুরের কথায় শান্ত হয়ে বসলো। হাফ ছেড়ে বললো ‘ তাই যেন হয়। জিনিসটা নূপুর কন্যার আমানত আর আমানতের খিয়ানত আমি করিনা। তাকে কোনওদিন ফিরিয়ে দিতে না পারি অন্তত এটা ভাবতে পারবো যে কারোর স্মৃতি আমি আগলে রেখেছি। ‘

ঝুমুর এবার খানিকটা অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো ‘ আপনার তাকে নূপুরটা ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে নেই ? ‘
ফাহমান হেসে বললো ‘ থাকবে না কেন ? অবশ্যই আছে। তার জিনিস তাকে তো ফেরত দিতেই হবে। এখন যদি ভাগ্যে সহায় হয় তবে। ‘
‘ তারমানে আপনি এখন আর নূপুর কন্যার প্রতি দুর্বল না ? ‘

ঝুমুরের কথায় ভরকে গেল ফাহমান। অদ্ভুত চোখে চেয়ে বললো ‘ উনার প্রতি দুর্বল হবো কেন আমি ? আগে যেটাকে দুর্বলতা ভেবেছিলাম সেটা মোহ ছাড়া কিছুই ছিল না। বোঝার ভুল ছিল আমার। তাছাড়া দুর্বল কি যার তার প্রতি হওয়া যায় ? দুর্বল মাত্র একজনের প্রতিই হওয়া যায় যেটা আমি হয়ে গেছি। ‘

ঝুমুরের বুকের উপর থেকে পাষাণ ভার যেন নেমে গেলো। নূপুর কন্যার প্রতি হিংসা থেকেই সে চেয়েছিল ফাহমান ওই নূপুর আর কখনো খুঁজে না পাক। সে চেয়েছিল নূপুর কন্যা চিরতরে তার জীবন থেকে মুছে যাক, চেয়েছিল নূপুর কন্যার নূপুরও যেন তার কাছে না থাকে। অথচ এতদিন শুধু শুধুই উল্টাপাল্টা ভেবে নিজেকে কষ্ট দিয়েছে। তার ডাক্তার সাহেব তো সবসময় তারই ছিল। তাকে ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিবে এমন ক্ষমতা সামান্য ওই নূপুর কন্যার নেই। নূপুর কন্যাকে যে বিদায় নিতেই হতো। সে তো নেবেই বিদায়।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে