নূপুর বাঁধা যেখানে পর্ব-২৮+২৯

0
1022

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-২৮
#মিফতা_তিমু

উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ফারুক। শরীরটা কেমন অবশ হয়ে আসছে। মাথার ভেতরটা ভো ভো করছে, চারিপাশ কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন। হৈমন্তীর বিয়ের খবরটা একটু আগেই মনোয়ারা বেগমের কাছ হতে পেয়েছে সে। তিনি জানিয়েছেন সময়ের স্বল্পতায় কোনো অনুষ্ঠানাদি ছাড়াই বিয়ে দিয়ে তুলে দিয়েছেন হৈমন্তীকে। ফারুক উপস্থিত থাকতে পারেনি বলে মারিয়াম যে হাহুতাশ করেছেন মনোয়ারা বেগম সেটাও জানালেন।

মায়ের কাছ থেকে প্রিয় মানুষটার বিয়ের খবর পাওয়ার পর থেকেই ফারুকের সম্পূর্ণ জগৎ যেন উলটপালট হয়ে গেছে। সবকিছু কেমন এলবেলে ঠেকছে। চোখ দুটো রক্তিম, চুল উষ্কখুষ্ক। শার্টের ইং বেরিয়ে গেছে। টলমল পায়ে বেদিশার মতো বাড়ি ফিরেছে সে। এতটা রাস্তা যে সে কি করে ফিরেছে সেটাই ভাবতে পারছে না সে। শুধু মনে হচ্ছে তার সমস্ত পৃথিবী দোদুল্যমান।

বারান্দার অন্ধকারে কোণায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছিল ফারুক। সে কোনোদিনই এসব খায়নি। বন্ধু মহলে তাকে সকলে নিপাট ভদ্রলোক হিসেবেই চেনে। এসবে তার আর ফাহমানের যে বড়ই দক্ষতার অভাব সে আর বলতে অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু আজ প্রথম মনে হচ্ছে জিনিসটা না ছুঁলেই নয়। নাহলে হৈমন্তীকে ভোলা তার পক্ষে সহজ হবে না। হৈমন্তীকে ভোলার জন্য তার কঠিন থেকে কঠিন নেশার সন্ধান চাই যেই নেশা হৈমন্তীকে তার মন থেকে চিরতরে মুছে দিবে। কিন্তু আদৌ কি এমন কোনো নেশা এই ইহজগতে আছে ?

—-

বেডের হেডে হেলান দিয়ে বসে আছে ঝুমুর। চোখ দুটো বুজে রাখা হলেও তার চোখে ঘুম নেই। আদতে সে ঘুমনোর চেষ্টা করছে ঠিকই কিন্তু নিদ্রা দেবী তার কাছে ধরা দিচ্ছেন না। ক্ষণ কয়েক মুহূর্ত পরে যান্ত্রিক ভো ভো শব্দে ঝুমুর সোজা হয়ে নড়েচড়ে বসলো। চোখ দুটো মেলে হাতটা খানিক এগিয়ে পাশে অবলীলায় পরে থাকা ফোনটা হাতে তুলে নিল। ডিসপ্লে স্ক্রিনে প্রিয় মানুষটার নাম্বার স্বগর্বে জ্বলজ্বল করছে।

রাত বারোটা বেজে দশ। এই রাতে ফাহমান ফোন দিবে এমনটা অস্বাভাবিক নয়। ঝুমুর জানতো ওই মানুষটার মনের কথা বলার মানুষ একমাত্র সে নিজেই। অপর পাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ আসছে না। শুধুমাত্র কারোর নিশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেলো। ঝুমুর নীরব, ওপাশের মানুষটাকে নিজেকে সামলে নেওয়ার সুযোগ দিয়ে বললো ‘ ডাক্তার সাহেব বলছেন!! ‘
ওপাশ থেকে ফাহমান অসহিষ্ণু গলায় বললো ‘ জি, ফাহমান বলছি। আপনি বুঝে যান কি করে বলুন তো? ‘

ফাহমানের গলাটা কেমন বিষণ্ণ শোনালো। ঝুমুর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো ‘ শুধু আপনার নিশ্বাসের আওয়াজটা শুনে চেনার ক্ষমতাও আমার আছে। তাছাড়া নাম্বারটা সেভ করা ছিল। গলা এমন কেন শোনাচ্ছে ? খারাপ লাগছে শরীর ? ‘
ফাহমান মলিন গলায় বললো ‘ হৈমন্তী নেই, ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাড়িতে শুধু মা আর আমি। মায়ের মন খারাপ, থেকে থেকে কেঁদে উঠছে। ‘

‘ নিজেকে আজই সামলে নিন ডাক্তার সাহেব। আপনাকে মনিকে সামলাতে হবে। আপনি ভেঙে পড়লে উনাকে দেখবে কে ? মনির জন্য হলেও আপনাকে নিজেকে শক্ত করতে হবে। মেয়েদের ভবিতব্যই এটা। উনিশ থেকে বিশ বছর এক বাবার মেয়ে, এক ভাইয়ের বোন হয়ে থেকে নিজের চিরচেনা গণ্ডি ছেড়ে একসময় অচেনা এক বাড়িতে কারোর ছেলের বউ তো কারোর স্ত্রীয়ের দায়িত্ব পালন করতে হয়। কাজেই এ চিরন্তন সত্য যত তাড়াতাড়ি মেনে নিবেন কষ্ট ততই কম হবে। ‘

ঝুমুরের কথায় ফাহমান উত্তর দিলো না। ঝুমুর এবার দুষ্টু হেসে বললো ‘ গতবার আমার নাম্বার পেয়েছিলেন কি করে ? আমি তো আমার নাম্বার আপনাকে দেইনি। তবে কি আপনি এটা মনি অথবা হৈমীর ফোন থেকে নিয়েছেন ? বলুন বলুন বলুন… না বললে আপনার শাস্তি হবে। মাঝ রাতে একটা মেয়েকে ফোন করার শাস্তি, বলুন আপনি রাজি ? ‘

ঝুমুরের কথার ধরনে হেসে দিল ফাহমান। বললো ‘ হৈমীর ফোন থেকে নিয়েছি। হ্যাঁ, আমি রাজি মিস ঝুমুর। আপনার দেওয়া সব শাস্তি আমি মাথা পেতে নিতে রাজি। ‘
‘ তবে এখন ফোনটা রেখে ঘুমোন। আপনার কাল ডিউটি আছে, সকাল সকাল উঠতে হবে। আমিও কোচিং যাবো কাল। দুজনে একসঙ্গেই বের হবো। ঠিক আছে ? ‘

ঝুমুরের কথায় উত্তরে ফাহমান হেসে বললো ‘ ঠিক হ্যা, আপকা হুকুম স্যার আখোপার।’
এতক্ষণে যেন তার বিষন্ন মনটা প্রেয়সীর সঙ্গে কথা বলে একটু ভালো হলো। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ছড়িয়ে গেলো। এই মানুষটাকে সবসময়ের জন্য নিজের কাছে নিয়ে আসার চিন্তা আরও প্রকটভাবে জেকে বসলো মনের মধ্যে।

—-

সকাল হতেই আসিফের সঙ্গে দেখা করতে পার্টির লোক এসে হাজির। আসিফকে তারা বিয়ের শুভ কামনা জানিয়েছেন। আসিফ আলতো হেসে বিনিময়ে ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের নিয়ে নিজের অফিস ঘরের দিকে এগিয়ে গেছে। হৈমন্তী ঘুম থেকে উঠেই বিছানা ছেড়ে ঘরটা গুছিয়ে নিয়ে নিজেও তৈরি হয়ে নিয়েছে। বাছ বিচার করে মায়ের দেওয়া শ্যাওলা রংয়ের শাড়িটা শরীরে জড়িয়ে নিয়েছে।

সকাল নয়টা বেজে পঁয়তাল্লিশ। হৈমন্তীর ডাক পড়েছে নিচে। নিচে একগাদা আত্মীয় স্বজন বসে আছেন। তাদের সাথেই পরিচয় করিয়ে দিবেন মিসেস কুমুদিনী আর মিসেস লিমা, দুই জা তারা। নতুন বিয়ে হয়েছে আসিফ হৈমন্তীর। হৈমন্তী এখনও এই বাড়ির নিয়ম কানুন, আত্মীয় স্বজন কিছুই জানে না। তাই তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া আর কি।

তাছাড়াও এই পরিচয় পর্বের মাধ্যমে সবার মধ্যে আসিফ আর হৈমন্তীর বিয়ে নিয়ে যে ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে সেটাও দূর করা যাবে সেটাই জানিয়েছেন মিসেস কুমুদিনী। হৈমন্তীকে ডাকতে এসেছিলেন তিনি। সকাল সকাল পুত্র বধূর আদুরে মুখখানা দেখে হৈমন্তীর ললাটে চুমু খেয়ে জানালেন হৈমন্তী যেন এই কটাদিন একটু সকাল সকাল উঠে যায়। বাড়ি ভর্তি মানুষ। এখন দেরি করে উঠা মানেই জোহান বাড়ির বউ অলক্ষ্মী কথাটা মুহূর্তের মধ্যেই আত্মীয় মহলে চাউর হয়ে যাওয়া।

তাছাড়া মিসেস কুমুদিনী হৈমন্তীকে এও জানিয়েছেন আজ তার আর আসিফের বৌভাতের অনুষ্ঠান হবে সন্ধ্যায়। যেহেতু আজ অনেক কাজকর্ম করার আছে তাই আজ কোচিংয়ে যাওয়াটা সম্ভবপর নয়। বরং বৌভাতের ঝামেলা মিটিয়ে কাল যাওয়াটাই শ্রেয়। হৈমন্তী মেনে নিয়েছে কথাটা। তার বিয়ে হয়েছে এখন, কিছু কিছু জিনিস তো মানিয়ে নিতেই হবে।

বাড়ির পুরুষ মানুষদের খাওয়া দাওয়া শেষে মহিলারা যখন একসঙ্গে খেতে বসলেন তখন তার মাঝে এক ভদ্র মহিলা বলে উঠলেন ‘ তা বউ তোমার বাবা কি করে ? ‘
হৈমন্তী উত্তর দিতে পারলো না। হঠাৎ করেই দুঃখে তার বুকটা ভার হয়ে এলো। মুখে তোলা রুটির টুকরোটা গলা দিয়ে নামলো না। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। হৈমন্তীর চোখের জল দেখলেন মিসেস কুমুদিনী। ভদ্র মহিলার উদ্দেশ্যে বললেন ‘ হৈমন্তীর বাবা যে গত হয়েছেন সে তো একটু আগেও আপনাকে বললাম কাকিমা। ‘

মিসেস কুমুদিনীর কথার বিপরীতে ভদ্রমহিলা চুপসে গেলেন। তিনি মিসেস কুমুদিনীর সম্পর্কে কাকী শাশুড়ি হন। শাশুড়ি মানেই মায়ের মতো। কিন্তু উনার ক্ষেত্রে মা কথাটা ঠিক যায় না। মানুষকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার দুর্বল জায়গায় আঘাত করে তিনি যেই পৈশাচিক আনন্দ পান তার বর্ণনা তো কল্পনাতীত। এমন ধারার বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষদের আনন্দ বিনোদন নিয়ে কথা বলা সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই নয়।

এবার আরেকজন মুখ খুললেন। সম্পর্কে তিনি মিসেস কুমুদিনীর ফুপু শাশুড়ি। নিজের ভাইয়ের বউয়ের পক্ষ নিয়ে বললেন ‘ এতে অত মনে নেওয়ার কি আছে বউ ? বুড়ো মানুষ, মনে না থাকতেই পারে। তাই বলে কি অত রাগ করতে আছে ? আর তোমার বউও তো কত মাইয়া মানুষগো লাহান কানতে পারে। মাইয়া মানুষ শক্তপোক্ত হইবো নাইলে সংসারের হাল ধরবো কেডা। এতো পুরাই ননীর পুতুল। শশুড় বাড়িতে একদিন হইলো না তার আগেই শাশুড়ির কথায় নাকের পানি মুখের পানি সব এক করতাছে। ‘

মিসেস কুমুদিনী চেয়েছিলেন এই কথার জবাব দিতে তবে তার আগেই তার ছোট জা মিসেস লিমা তেলতেলে হাসি হেসে বললেন ‘ কি করবো ফুপুজান কন দেহি। আমাগো ঘরে তো ব্যাটাছেলের অভাব নাই। একখান মাইয়া মানুষের অভাবটাই আছিলো। হেইডা আসিফের বউ পুরা করছে। মাইয়াডা বেশি নরম বইলাই আমরা তারে বউ করছি। আমগো পুরুষ মানুষের লাহান আমড়া কাঠের ঢেকির দরকার নাই, আমাগো লেইগা ননীর পুতুলই ঠিক আছে। ‘

হৈমন্তীর চোখে তখনও জল। মিসেস কুমুদিনী লক্ষ্য করলেন হৈমন্তীকে। বললেন ‘ হৈমন্তী… তুমি ঘরে গিয়ে বসো। আমি আর লিমা টেবিল গুছিয়ে ফেলবো। ‘
হৈমন্তী শাশুড়ির কথা মাটিতে ফেলতে দিলো না। সঙ্গে সঙ্গে তা বাস্তবায়ন করলো। দ্রুত পায়ে উঠে ঘরে চলে গেলো। তার প্রস্থান সকলেই দেখলেন। মিসেস কুমুদিনী আর মিসেস লিমার দেওয়া জবাবের কথা মনে করে ভদ্রমহিলা দুজন আর কথা বাড়ানোর সাহস পেলেন না। তারা চুপচাপ খাওয়ায় মন দিলেন।

জানালার ধার ঘেসে দাড়িয়ে আছে হৈমন্তী। বাহিরে তখন কড়া রোদ্দুর। জোহান বাড়ির আশেপাশে যেসব ছায়া ঘেরা মায়া মায়া গাছগুলো আছে সেসব তখনও অবিলম্বে বাড়িটাকে ছায়া দিয়ে চলেছে। এ যেন তাদের আবশ্যকীয় কর্তব্য। হৈমন্তী সেই গাছগুলো দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছে আর ভাবছে আচ্ছা মানুষ এমন কেন। কেন তারা অন্যের দুর্বলতায় আঘাত করে আনন্দ পায় ? কেন তাদের মধ্যে কোনো বিবেক বোধ নেই ? কি আনন্দ পায় তারা কারোর বুকে আগুন জ্বালিয়ে ?

এই পৃথিবী আর এর বাসিন্দারা বরাবরই স্বার্থপর। নিজেদের স্বার্থে তারা সবকিছু করতে পারে। যতটা নিচে ইচ্ছা ততটা নিচে নামতে পারে। তবুও তাদের বোধবুদ্ধি কাজ করেনা যে তারা যা করছে আদৌ ঠিক করছে তো ? এর পরিণাম কি হবে সেটা একবারও ভেবে দেখেনা তারা। যার ফলস্বরূপ তাদের এই অমানবিকতায় অন্যরা আঘাত পায়, তাদের দুর্বলতা ভেঙেচুরে আরও মিইয়ে যায়।

‘ হৈম ‘

চেনা স্পর্শ, চেনা কণ্ঠে হৈমন্তী পিছন ফিরল। আসিফ তাকে জড়িয়ে ধরেছে পিছন থেকে। আসিফের উষ্ণ হাতটা হৈমন্তীর গলার কাছে। হৈমন্তী সেই হাতে হাত রাখলো। নিঃশব্দে ঠোট ছোঁয়ালো। আসিফ যেন হৈমন্তীর মনের বিষণ্ণতা টের পেলো। উপরে আসার সময় মায়ের মুখে খাবার টেবিলে হওয়া সার্কাসের কথা শুনেছে সে।

ঘটনা শোনা মাত্র আসিফের চোখ মুখ পরক্ষণেই শক্ত হয়ে গিয়েছিল। ভদ্র মহিলা দুজন আসিফের সেই শক্ত চোখ মুখ দেখে নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়েও আমতা আমতা করে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। আসিফের রাশভারী স্বভাব তাদের জানা আছে। এসব যে সে তার মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা কেউ। তাই চাওয়া সত্ত্বেও কেউ আর কিছু বলার সাহস পায়নি।

‘ হুম ‘

হৈমন্তীর সাড়া পেয়ে আসিফ হৈমন্তীর রেশমি চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো ‘ তোকে কেন আমার বউ করেছি জানিস ? ‘
আসিফের কথায় হৈমন্তী খানিকটা নড়েচড়ে উঠলো। ওর মাথাটা আসিফের বুকে এলিয়ে দিয়ে আসিফের মুখ দর্শন করার চেষ্টা করলো। কিন্তু না পেরে একসময় নিজের শরীরের সমস্ত ভার আসিফের উপর ছেড়ে দিয়ে বললো ‘ জানি না, কখনও বলেননি।

‘ তুই হলি মোমের মেয়ে। সামান্য উষ্ণতা লাগলেই গলে যাস। তোর এই মোমের মত নরম মন একমাত্র আমিই সামলে নিতে পারবো। এই মন অনেকে দুর্বল করে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাতে ভালোবাসার প্রলেপ লাগিয়ে সেই ভেঙে যাওয়া মন আমি জোড়া লাগাবো। ‘

আসিফের কথা বাস্তবিকই ঠিক। হৈমন্তী বড্ড নরম মনের। তাইতো আসিফের ওই শক্ত পক্ত মুখে বলা কঠিন কথাগুলো শুনেও সে আবেগী হয়ে পড়ল। আসিফকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কাদতে কাদতে বললো ‘ আজ যেমন বললেন একমাত্র আপনিই আমার নরম মন সামলে রাখতে পারেন, তেমনই সারাজীবন সামলে রাখবেন আমার মনকে। দয়া করে কখনও ছেড়ে যাবেন না। কারোর জন্য আমায় ভালোবাসা কমিয়ে ফেলবেন না। ‘

হৈমন্তীর কথা শুনে প্রতিউত্তর করলো না আসিফ। শুধু হৈমন্তীকে আগলে ধরে দাড়িয়ে রইলো। সে অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। নিজের ভালোবাসার কথা অত আবেগ দিয়ে বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এতটা আবেগী কথাবার্তা তার দ্বারা সম্ভব নয়। তবুও সে চেষ্টা করেছে কিন্তু শেষ অব্দি পারেনি। এখন এটাই দেখার পালা হৈমন্তী তার মনের কথা মুখে আসার আগেই ধরতে পারে কিনা।

~চলবে ইনশাল্লাহ্…

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-২৯
#মিফতা_তিমু

হৈমন্তী আর আসিফের বৌভাতের অনুষ্ঠান শুরু হতে বেশি সময় বাকি নেই। রাত আটটার দিকে অনুষ্ঠান শুরু। সন্ধ্যা ছয়টা বাজতে না বাজতেই ঝুমুর ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজতে বসে গেছে। হৈমন্তীর বৌভাতে সে নো মেকআপ লুকে যাবে। তার পরনে নেভি ব্লু রঙের হাফ স্লিভ ব্লাউজ আর এমব্রয়ডারি কাজ করা লেহেঙ্গা। কালো কুচকুচে চুলগুলো এলো খোঁপা করে সামনের গুটি কতক চুল ছেড়ে দেওয়া। বাম হাতে ব্রেসলেট আর দুই কানে স্টোন বসানো ইয়ারিং। গলায় নেকলেস না পড়ার দরুন ভেসে উঠেছে ঝুমুরের বিউটি বোন । ঝুমুরের ইচ্ছে করলো না গলায় কিছু পড়তে। এভাবেই তো ভালো লাগছে।

সব শেষে ঠোঁটে ভ্যালভেট পিংক লিপস্টিক দিয়ে সাজাসাজির পর্বে সমাপ্তি টানলো ঝুমুর। টুল ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে চারদিকে ঘুরে আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিলো সে। কিসের যেন কমতি আছে মনে হচ্ছে। ঝুমুর মস্তিষ্কে জোর দিলো কিন্তু মনে পড়ছে না। খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখলো। খেয়াল হলো তাকে অনেকটা লম্বা দেখাচ্ছে যা ফাহমানের পাশে দাঁড়ালে একেবারেই বেমানান।

ঝুমুর আবার টুলে বসলো। নিজের পায়ে থাকা চার ইঞ্চির হাই হিল খুলে ফেললো। তার বদলে দুই ইঞ্চি এপ্রিকট পেন্সিল হিল পড়ে নিল। এখন ঠিক আছে। এবার আর তাকে ফাহমানের সমানে সমানে লাগবে না এবং কেউ বিদঘুটেও ভাববে না। নিজে তৈরী হয়ে ঝুমুর আশেপাশে সব ঘরগুলোতে একবার করে উকি দিলো। আঞ্জুম আরা তৈরি হচ্ছেন আর সামি তাফিম তৈরি।

ঝুমুর দেখলো ফারুক তৈরি না হয়ে অদ্ভুত চোখ মুখ নিয়ে বসে আছে। হতাশ ঝুমুর ফ্লোরে হিলের ঠকঠক আওয়াজ তুলে এগিয়ে গেলো সেদিকে। নীরবে বসলো ফারুকের মুখোমুখি। তার উপস্থিতি টের পেয়ে ফারুক মুখ তুললো আর এই বিষণ্ণ মন নিয়েও সে আশ্চর্যজনকভাবে চমকে গেলো। আবারও ঠাওর হলো ভাগ্নিটা তার দিনে দিনে যেন রূপবতী হয়ে উঠছে। আজ বৌভাতের অনুষ্ঠানে নিশ্চিত ছেলেগুলো ঝুমুরের এই মন ভোলানো রুপে ঘায়েল হবেই।

‘ মনে হচ্ছে আকাশ থেকে মেঘবতী নেমে এসেছে। কিরে পরী, নিজের স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যলোকে তোর কি ? ‘

ঝুমুর হাসলো ফারুকের কথায়। হেসে মুখে হাত দিয়ে বললো ‘ পরী বলে প্রশংসা করছো আবার পরীকেই তুই তুই করে ডাকছো। তোমার কি মনে হয় তুমি পরীকে অপমান করছো না ? ‘
ফারুক হেসে বললো ‘ করছি বৈকি কিন্তু তুই তো আমাদের ব্যক্তিগত পরী। আমাদের চৌদ্দ গুষ্টিতে মনে হয় তোর মতো এমন পুতুল নেই। ‘

ঝুমুর আর সে বিষয়ে কথা বাড়ালো না। বরং গম্ভীর মুখ করে বললো ‘ তৈরি হচ্ছো না কেন ? হৈমী ফোন দিয়েছিল, পইপই করে তোমাদের সবাইকে যেতে বলেছে। ‘
ঝুমুরের কথায় ফারুকের মুখ আগের মতোই আবার পাংশুটে হয়ে গেলো। সে আগের মতোই বিছানার গায়ে হেলান দিয়ে বললো ‘ তোরা যা, আমি যাবো না। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না রে। ‘

ঝুমুর ফারুকের কথায় বিশেষ পাত্তা দিল বলে মনে হয়না। ও উঠে দাড়িয়ে আলমারির দরজা খুললো। বেছে বেছে অফ হোয়াইট সুট বের করলো ফারুকের জন্য। অফ হোয়াইট সুটের সঙ্গে হোয়াইট শার্ট। দারুন এক কম্বিনেশন। ঝুমুর যত্নে সেটা বিছানার এক পাশে রেখে বলল ‘ পাস্ট ইজ পাস্ট। তুমি যদি সত্যি সত্যি একদিনের জন্য হলেও হৈমীকে ভালোবেসে থাকো তাহলে আজ চলো। নিজ চোখে ওর রঙিন মুহূর্তগুলো উপভোগ করো। প্রিয় মানুষটির হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখার সৌভাগ্য সকলের হয়না। যে ভালোবাসে সে ভালোবাসার মানুষটার সুখেই সুখী হতে জানে। ‘

ফারুক প্রতি উত্তর করলো না। এই কথাগুলোর বিপরীতে হ্যাঁ না কিছু বলার ক্ষমতা তার নেই। ঝুমুর তার মনে থাকা হৈমন্তীর প্রতি ভালোবাসার কথা জানে। এই কথাগুলো সে সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে ফেরার পরেরদিনই জিজ্ঞেস করেছিল। আর আত্মবিশ্বাসী ফারুকও সেদিন অকপটে নিজের অব্যক্ত অনুভূতির কথা স্বীকার করেছিল। কিন্তু কে জানতো যে তার অনুভূতিগুলো এমন অধরাই রয়ে যাবে। তাদের জানা হবে না কারো।

ঝুমুর ধীর গতিতে মনোয়ারা বেগমের ঘরে ঢুকলো। মনোয়ারা বেগম তখন শাড়ির কুচি ঠিক করছিলেন। আজমাঈন সাহেব বাথরুমে আছেন। ঝুমুর বললো ‘ আর কতক্ষন লাগবে আপি ? ‘

মনোয়ারা বেগম ঝুমুরের কথা শুনে শাড়ি ঠিক করতে করতে ঝুমুরের দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে নাতনীর চাঁদ মুখখানা দেখে চমকে উঠলেন। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ঝুমুরের মায়ের মুখটা। ঝুমুর ঠিক যেন নিজের মায়েরই প্রতিচ্ছবি। তার আচরণে ব্যবহারে সে কোরিয়ামুখী হলেও মুখের আদল ঠিক যেন মায়ের সঙ্গে মিলে যায়। মায়ের মত লম্বা চওড়া, কুচকুচে কালো চুলের ঝুমুর চোখ ধাঁধানো সুন্দরী নয়। ভিনদেশী বাবার রূপ সে পুরোপুরি পায়নি। তার মুখ বলে সে বাঙালি। দেখতে খুবই সাধারণ তবুও সাধারণের মাঝেই অসাধারণ সে।

পুরনো স্মৃতি মনে করতে চাইলেন না মনোয়ারা। সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলেন মেয়ের পরিবর্তে মেয়ের মেয়েকে তাকে দেওয়ার জন্য। ঝুমুরকে দেখলেই তো তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের কথা মনে পড়ে। ঝুমুর আশেপাশে থাকলে মনে হয় ঠিক যেন তার মেয়ে তাসনুবারই আশেপাশে সে। মনোয়ারা বেগম চোখ সরিয়ে নিলেন ঝুমুরের দিক থেকে। বললেন ‘ আর দশ মিনিট। তুই গিয়ে দেখ তো হৈমন্তীর মা তৈরি হয়েছে কিনা, ফাহমান এসেছে কি ? ‘

‘ মনি বলেছে উনি সোজা হসপিটাল থেকেই সেখানে যাবেন। বাসায় ফিরে যেতে যেতে লেট হয়ে যাবে। ‘

ঝুমুরের কথায় প্রতি উত্তর করলেন মনোয়ারা বেগম ‘ তাহলে তোর মনিকে দেখে আয়। সে তৈরি হলে একবারে তাকে নিয়ে গলি পার হ। আমি তোর মামাকে আর নানুকে বলছি গাড়িটা বের করুক। ‘

ঝুমুর আর কথা বাড়ালো না। সাবধানে সিড়ি পেরিয়ে হৈমন্তীদের বিল্ডিংয়ে ঢুকলো। লেহেঙ্গা সামলে সিড়ি দিয়ে উঠে ডোর বেল দিলো। মারিয়াম এসে খুলে দিলেন। ঝুমুরকে দেখে খুশি হয়ে বললেন ‘ মাশাআল্লাহ… পুতুলের মতো লাগছে তোকে। আয় মা, ঘরে আয়। তুই ফাহমানের ঘরে ফ্যানটা ছেড়ে বস। বসার ঘরের রেগুলেটর নষ্ট হয়ে গেছে, ঠিক করতে হবে। ‘

ঝুমুর কোনো কথা বললো না। মারিয়াম কথাগুলো বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। তার এখনও তৈরি হতে একটু সময় লাগবে। ঝুমুর মারিয়াম প্রস্থান করতেই আস্তে করে ফাহমানের ঘরের দিকে গেলো। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখলো। চোখ দিয়ে খুঁজে বেড়াল প্রিয় সেই নূপুরটা। শেষবার ওটা ফাহমানের টেবিলে রাখা পেন হোল্ডারে দেখেছিল। এখনও নিশ্চই ওখানেই আছে।

ঝুমুর নিঃশব্দে এগিয়ে গেলো সেদিকে। টেবিলের সামনে দাড়িয়ে দ্রুত খুঁজলো নূপুরটা। কিন্তু খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। ফাহমান রেখেছে কোথায় ওটা ? ঝুমুর সবকিছু আতিপাতি করে খুঁজলো। কিন্তু নেই। ফাহমানের টেবিলের প্রত্যেকটা তাক খুঁজলো তবুও নেই। আবার মনে হলো টেবিলের ড্রয়ারে আছে কিনা। থাকতেই পারে, হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে রাখতেই পারে। ঝুমুর দ্রুত ড্রয়ার খোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু ড্রয়ার লক করা।

বিরক্তিতে ঝুমুরের চোখ মুখ কুচকে এলো। যেকোনো সময় তার মনি চলে আসতে পারে ঘরে। তার আগেই নূপুরটা খুঁজে বের করতে হবে। ঝুমুর সন্ধানী দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো। চোখ পড়ল বিছানায় থাকা বালিশের উপরে। বালিশের নিচে চাবি থাকতে পারে। ঝুমুর দ্রুত সেদিকে গেলো। কিন্তু বালিশ সরিয়ে চাবির সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া নূপুরটাও পেলো। কিন্তু এই নূপুর বালিশের নিচে কি করছে ? এত ভাবনার সময় নেই। ঝুমুর দ্রুত নূপুরটা নিজের হাতে থাকা সিলভার স্টোনের কাজ করা পার্সে ঢুকিয়ে নিলো। তারপর ঘরের লাইট নিভিয়ে বেরিয়ে গেলো।

তিন চারটা গাড়ি লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে একের পর এক। আজমাঈন সাহেবদের বাড়ির নিচে গ্যারেজ আছে ঠিকই কিন্তু গলি ছোট হওয়ায় গাড়ি ঢোকানোর ব্যবস্থা নেই। যার ফলস্বরূপ জায়গা থাকা সত্ত্বেও গলির বাহিরে আলাদা করে জায়গা কিনে নিজেদের গাড়ি রাখার জন্য আরেকটা গ্যারেজ করেছেন আজমাঈন সাহেব। সেখানে একসঙ্গে ছয় থেকে সাতটা গাড়ি রাখার ব্যবস্থা আছে।

ফারুক গাড়ি বের করেছে আর আরেকটা গাড়ি ড্রাইভার বের করেছে। ড্রাইভার আসাদ সাহেবকে মূলত ঝুমুরের জন্যই রাখা। মোতালেব সাহেব মেয়ের সুবিধার জন্যই টাকা খরচা করে গাড়ি আর গাড়ির ড্রাইভার দুটোই রেখেছেন। সেই গাড়ির ক্লিনিং সার্ভিস আর ড্রাইভারের পিছনে মাসে মাসে বেশ ভালো রকমের খরচাই হয় কিন্তু যার জন্য গাড়িটা কেনা সেই গাড়ি চড়ে না।

ঝুমুর বেশিরভাগ সময় বাস, রিকশা দিয়ে কিংবা পায়ে হেঁটে আসা যাওয়া করে। গাড়ি চড়ে বেরিয়ে সে বড়লোক বাবার মেয়ে এটা সবার সামনে শো অফ করার কোনো ইচ্ছাই নেই তার। কিন্তু মোতালেব সাহেবের আবার মেয়ের এই গোয়ার্তুমি পছন্দ নয়। সামর্থ্য থাকলে শুধু শুধু কষ্ট কেন করা ? তাই ঝুমুর যে বাসে করে আসা যাওয়া করে এই কথা মোতালেব সাহেবের কানে পারতপক্ষে কেউই তোলে না।

ফারুক যেই গাড়ি ড্রাইভ করবে সেটাতে আজমাঈন সাহেব, মনোয়ার বেগম আর সামি তাফিম উঠবে। ঝুমুরদের গাড়িতে মারিয়াম, আঞ্জুম আরা আর ঝুমুর নিজেসহ ড্রাইভার। ড্রাইভার আসাদ সাহেব ড্রাইভ করতে করতে বললেন ‘ অবশেষে আপনি আসলেন আপামনি। আমি তো ভেবেছিলাম এই জীবনে আপনাকে গাড়িতে উঠতে দেখবো না। ‘

আসাদ সাহেবের কথায় হাসলো ঝুমুর। সে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার আকাশ ঝা চকচকে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। ঝুমুরের মাথায় ঘুরছে অন্য এক চিন্তা। নূপুরটা বালিশের কাছে পেয়েছিল তারমানে ফাহমানের হাতের নাগালেই ছিল ওটা। ফাহমান ওই নূপুরে এখনও কেন এত আগ্রহী ? যদিও নূপুর কন্যা আর বাগান কন্যা দুজনে একই মানুষ তবুও ঝুমুরের ভিতরটা কেমন করছে। ভালো লাগছে না। ফাহমান কি এখনও সেই নূপুর কন্যাকে নিয়ে ভাবে ?

চারদিকে জমকালো আয়োজন। দুর্দান্ত সাজে পিচ কালারের লেহেঙ্গা পরনে হৈমন্তী স্টেজের উপর অর্কিড দিয়ে সাজানো আলিশান সোফায় বসে আছে। চোখে মুখে হাসির রেশ। ক্রমাগত তার ছবি তুলচ্ছে ফটোগ্রাফার। আসিফ হৈমন্তীর থেকে খানিকটা দূরে স্টেজের বাহিরে দাড়িয়ে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে। সে কথা বলায় ব্যস্ত ঠিকই কিন্তু মন অন্যদিকে। বারবার আড়চোখে প্রিয়তমাকে দেখছে। এত দেখেও যেন মন ভরে না, ইচ্ছে করে শুধু দেখেই যাক।

হৈমন্তী মুখে হাসি টেনে ফটোগ্রাফারের বলা পোজে ছবি তুলছিল। কিন্তু ঝুমুরদের হলে ঢুকতে দেখে ও আর শান্ত মনে ছবি তুলতে পারলো না। জানালো আপাতত কিছুক্ষণ পরে ছবি তুলবে। ফটোগ্রাফার হৈমন্তীর কথা শুনে ক্যামেরা নিয়ে ছুটলো সুন্দরী রমণীদের ছবি তুলতে। ঝুমুর ততক্ষণে হৈমন্তীকে খুঁজতে খুঁজতে স্টেজে পৌঁছে গেছে। হৈমন্তী হেসে কাছে ডাকলো। ঝুমুর লেহেঙ্গা সামলে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রিয় সখিকে।

‘ তোকে বড্ড মিস করেছি রে ঝুম। আমার ভালো লাগছে না তোদের ছাড়া। তুই নেই, মা ভাই নেই। কেমন একা একা লাগে। ‘

হৈমন্তীকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে ঝুমুর দুষ্টু হেসে বলে ‘ কেন রে আসিফ ভাই কি তোর আদর যত্ন করছে না ? আসিফ ভাই থাকতে তোর আবার আমাদের মনে পড়ে এ তো বিশ্বাস যোগ্যই নয়। ‘

আসিফ ঝুমুরকে দেখে এগিয়েই আসছিল তাই ঝুমুরের কথা শুনে বললো ‘ তোমার বান্ধবীকে যত্ন করবো কি। যেই মেয়ে জামাইয়ের জায়গায় বান্ধবীর নাম কলিজা দিয়ে সেভ করে তাকে আমার আর আলাদা করে আদর যত্ন করে কি হবে ? তার মন তো পড়ে আছে তোমাদের কাছে। ‘

ঝুমুর হৈমন্তী হেসে দিল আসিফের কথায়। ঝুমুর বললো ‘ আমাদেরকে কলেজে দুই দেহ এক প্রাণ বলতো সকলে। এমনই এমনই আমরা প্রাণের সখি নই। উই আর সোলমেটস ব্রো। ‘
আসিফ উত্তর দিলো না তবে ঝুমুরকে দেখে হৈমন্তীর চোখে মুখে যেই হাসির দেখা মিললো তাতে ওর অন্তঃকরণ শীতল হলো। দিনশেষে এই মেয়েটাকে হাসি মুখে দেখার জন্যই এতকিছু করা। নাহলে এত আয়োজন করে লোক সম্মুখে নিজের বিয়ের এনাউন্সমেন্ট করার লোক সে নয়। এসব আনুষ্ঠানিক ঝুট ঝামেলা থেকে সে বরাবরই দূরে। লোক সমাগম থেকে যত দূরে থাকা যায় তত ভালো।

দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফাহমান যখন বোনের বৌভাতের অনুষ্ঠানে এসে হাজির হলো তখন এই প্রথমবারের মতো ঝুমুরকে এত সাজসজ্জায় দেখে ফাহমানের নিজেকে কেমন পাগল পাগল ঠেকলো। চোখের দৃষ্টি ঝুমুরের উপর গিয়েই আটকেছে। নিশ্বাস নিতে কেমন কষ্ট হচ্ছে, ভেতরটা উষ্ণ মনে হচ্ছে।

‘ ওই যে ভাই এসে গেছে ‘ হৈমন্তী বলে উঠলো। হৈমন্তীর কথায় আসিফ আর ঝুমুর সামনে তাকিয়ে দেখলো ফাহমান দাড়িয়ে আছে। ঝুমুরের অধর কোণে হাসি ছড়িয়ে পড়লো। সেটা দেখে ফাহমানের বুকের ভিতরটা এমন শূণ্য শূণ্য লাগছে কেন ? আসিফ এগিয়ে এসে ফাহমানের কাধে হাত রেখে বলল ‘ এসে ভালো করেছো শালা সাহেব। তোমার বোন তোমাকে দেখার জন্য অস্থির। ‘

আসিফের কথা শুনে ফাহমান এগিয়ে গেলো বোনের দিকে। হৈমন্তীর সঙ্গে কথা বললো, খোঁজ নিলো ওই বাড়িতে কেমন লাগছে তার। তবে পুরোটা সময় সে আড়চোখে বারবার ঝুমুরকেই দেখছিল। ফাহমানকে এভাবে বারবার তাকাতে দেখে ঝুমুরের গাল দুটো শিমুল ফুলের মতই রক্তিম হয়ে উঠলো। সে ঠোঁট টিপে দাড়িয়ে রইলো ফাহমানের দৃষ্টি এড়িয়ে। কিছুক্ষণ পরপর ফাহমানের এভাবে তাকানোতে সে যে বড্ড লজ্জা পাচ্ছে।

এরপর শিহাব সাহেব, মিসেস কুমুদিনী, মিসেস লিমা আর বাকিদের সঙ্গেও ফাহমানের কথা হলো। মিসেস কুমুদিনী জানালেন এসব আত্মীয় মহলের ঝামেলা মিটলে সময় সুযোগ করে আসিফ আর হৈমন্তী গিয়ে ওই বাড়িতে বেরিয়ে আসবে। নিয়ম বলে কথা, মানতে তো হবেই।

কথাবার্তা শেষে সকলে যে যার যার মতো খেতে বসে পড়লেন। গোটা আটেক সিটের টেবিলে ঝুমুররা সকলে বসলো। আজমাঈন সাহেবরা সকলে মিলিয়ে সাতজন আর মনোয়ারা বেগম। ফাহমানের জায়গা হয়নি তাই সে অন্য টেবিলে বসেছে। কিন্তু অন্য টেবিলে বসলে কি হবে। ফাহমানের দৃষ্টি পুরোটা সময় ঝুমুরের উপরই ছিল। মেয়েটার দিক থেকে সে হাজার চেয়েও চোখ সরাতে পারছেনা। যেখানে সাজসজ্জাবিহীন সামনে আসলেই নিজের দৃষ্টি সামলাতে পারেনা ফাহমান সেখানে সেজেগুজে এমন ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়ে সামনে আসলে ফাহমান যে কি করে নিজের বেহায়া দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে সেটা ভেবেই তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে