#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-২৬
#মিফতা_তিমু
আজ হৈমন্তীর ফিরতে ফিরতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল। সময় এখন সন্ধ্যা ছয়টা বেজে পনেরো মিনিট। সাধারণত সাড়ে পাঁচটায় বাড়ি ফিরে সে। অথচ আজ দেরি হয়ে গেলো। সব দোষ বাস চালকের। দুই মিনিট পরপর যাত্রীর জন্য বাস দাড় করালে দেরি তো হবেই। বিরক্তিতে হৈমন্তীর কপালে ভাঁজ পড়ল। ও পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলো।
হৈমন্তী যখন ফ্ল্যাটের সামনে এসে পৌঁছাল তখন সাড়ে ছয়টা বাজে। ডোর হোল দিয়ে দেখলো ঘরের বাতি জ্বলছে। তারমানে বাসায় কেউ না কেউ আছে। তাই সে আর চাবি দিয়ে লক খুললো না। ডোর বেল টিপে দিল। বেল বাজতেই মারিয়াম এসে দরজা খুললেন। তার চোখে মুখে হাসি। মাকে এই সকাল সন্ধ্যায় হাসতে দেখে হৈমন্তী ঠোঁট টিপে বললো ‘ কি ব্যাপার হাসি কেন ? ‘
মারিয়াম মেয়েকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা দিলেন। বসার ঘর থেকে ভেসে আসা হাসির শব্দে হৈমন্তী সেই ঘরে উকি দিলো। আর যা দেখলো তারপর চোখ দুটো যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। আসিফের বাবা মা এসেছেন। ঘরে আরও অনেকে উপস্থিত। ঝুমুর, আঞ্জুম আরা, মনোয়ারা বেগম, আজমাঈন সাহেব, ফাহমান, সামি, তাফিম।
হঠাৎ বিনা নোটিশে আসা অতিথিদের দেখে চমকে যাওয়া হৈমন্তীকে দেখে মিসেস কুমুদিনী হেসে ডাকলেন ‘ কাছে এসো হৈমন্তী। ‘
মিসেস কুমুদিনীর ডাকে হৈমন্তী এগিয়ে গেলো। সে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আড়চোখে একবার ঝুমুরের দিকে তাকালো। ঝুমুর কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো কি ঘটছে সেও জানেনা।
মিসেস কুমুদিনী হৈমন্তীকে পাশে বসিয়ে হৈমন্তীর ঘর্মাক্ত মুখ নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে ধীর হাতে মুছে দিয়ে বললেন ‘ আমার অনেকদিনের স্বপ্ন পূরণ করলে মা। কতদিনের শখ ছিল আমার ছেলেটাকে শান্ত,সংসারী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিবে। অবশেষে সেই ইচ্ছা পূরণ হলো। এখন আর কোনো চিন্তা নেই আমার। এখন শুধু ওকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারলেই আমার শান্তি। ‘
হৈমন্তী থমকে তাকিয়ে আছে মিসেস কুমুদিনীর দিকে। ওর মাথায় একটা কথাও ঢুকেনি। ওর হাতে ছেলেকে তুলে দিবেন মানে ? হৈমন্তী এই উষ্ণ শীতল পরিবেশে তিরতির করে ঘামছে। ও শুকনো ঢোক গিলে কপালের ঘাম মুছে নিলো। আশপাশে চোখ ফিরিয়ে ভাইকে খুঁজলো। ভয় হচ্ছে, ভাই যদি একবার এসব দেখে তাহলে কি হবে ভাবতেই হৈমন্তীর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
‘ আপা আমি আর অপেক্ষা করতে চাইনা। যতদ্রুত সম্ভব আমার বৌমাকে ঘরে তুলতে চাই। ‘
মিসেস কুমুদিনীর কথায় মারিয়াম বিব্রত হাসলেন। অসস্তি নিয়ে বললেন ‘ কিন্তু আপা ফাহমান বা আসিফ কেউই তো এখনও ফিরলো না। ওরা না ফিরলে বিয়েটা হবে কি করে ? ‘
হৈমন্তী এবার দ্বিতীয়বার চমকালো। বিয়ে মানে!! কার বিয়ে, কোন বিয়ে, কার সাথে বিয়ে ? এসব হচ্ছেটা কি ? হৈমন্তীর কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।
হৈমন্তীর ভাবনার মাঝেই আবারও ডোর বেল বেজে উঠলো। ঝুমুর ইশারায় জানালো সে উঠে দরজা খুলছে, মারিয়াম যেন সস্তি নিয়ে বসেন। মারিয়াম ঝুমুরের ইশারায় আর উঠলেন না। ঝুমুর এগিয়ে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলে দেখলো আসিফ আর ফাহমান পাশাপাশি দাড়িয়ে।
আসিফের পরনে ওশিয়ান গ্রীন টি শার্ট আর ডিপ ব্লু জিন্স। চুল পরিপাটি করে জেল দেওয়া। হাতে কালো রংয়ের ঘড়ি। তার আপাদমস্তক পুরোটাই ফিটফাট অথচ ঝুমুরের দৃষ্টি তো ঘর্মাক্ত ফাহমানের দিকেই। অবাধ্য দৃষ্টি সরছে না প্রিয় পুরুষের উপর থেকে। ঝুমুরের নিজেকে কষে চড় দিতে ইচ্ছে করলো। এমন বেহায়াভাবে তাকিয়ে আছে, না জানি মানুষটার উপর তার নিজেরই নজর লেগে যায়।
ফাহমানও তাকিয়ে আছে বহু কাঙ্ক্ষিত মানুষটার দিকে যাকে এক পলক দেখার জন্য সে সারাদিন তড়পে তড়পে মরে। শুধু ইচ্ছে করে প্রেম বিরহে ভেঙেচুরে যাওয়া মনটা নিয়ে একবার গিয়ে হাজির হোক প্রেয়সীর সামনে। তবেই তার মনে বাজতে থাকা বিরহের সুর তার উপস্থিতি বাতাসের গায়ে মিলিয়ে দিয়ে হারিয়ে যাবে দূরে কোথাও।
‘ দেখা শেষ হলে সরে দাড়ানো যায়। আমাকে আমার বউয়ের কাছে যেতে হবে। ‘
আসিফের রাশভারী, গম্ভীর কণ্ঠে বলা কথাগুলো হৈমন্তী পাশের ঘরে বসেও শুনতে পেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হৈমন্তী সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণচূড়ার রঙে রঙিন হয়ে উঠলো। লজ্জার লালিমা তার কপোল দুটো ছুঁয়ে দিলো। মাথা নামিয়ে নিলো সে। এদিকে এই ক্ষেপাটে লোকের কথা শুনে তড়িঘড়ি করে সরে দাড়ালো ঝুমুর। এই হৈমন্তীর ক্ষেপাটে প্রেমিকের কোনো কান্ড জ্ঞান নেই। একবার বলার আগে ভাবলোও না বাড়ির বড়রা কি ভাববেন। অবশ্য তার মতো দাম্ভিক আর আত্মকেন্দ্রিক মানুষের কাছ থেকে আর কিইবা আশা করা যায়।
আসিফের কথায় ফাহমানও কিঞ্চিৎ অসস্তিতে পড়লো। হাতে থাকা মিষ্টির বক্সগুলো এগিয়ে দিলো ঝুমুরের দিকে। ঝুমুর সেই বক্স হাতে নিয়ে সেই স্থান দ্রুত ত্যাগ করলো। ঝুমুর বেরিয়ে যেতেই ফাহমান আসিফের পানে শক্ত চোখে তাকালো। আসিফ সেই দৃষ্টি গ্রাহ্য করলো না। বরং রাজকীয় ভঙ্গিতে হেঁটে বসার ঘরের দিকে গেলো। ঘরে ঢোকা মাত্র সবাইকে দেখে সালাম দিলো।
হৈমন্তী আড়চোখে আসিফকে দেখলো। কি সুন্দর সবাইকে দেখে হাসি আড়াল করেও ভদ্রতা বজায় রেখে সবাইকে সালাম দিল। মানুষটার আদব কায়দাই অন্যরকম। সবকিছু কেমন যেন অভিজাত পূর্ণ। বুদ্ধিমতী হৈমন্তী এতক্ষণে সবার কথায় এটা অন্তত বুঝেছে আজ তার আর আসিফের শুভ পরিণয়, প্রণয় থেকে পরিণয়। কিন্তু সে আদৌ পারবে তো মানুষটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে ? পারবে তার মন মানিয়ে চলতে ?
কাজী আর ইমাম সাহেব হাজির হয়েছেন। অভিভাবক ফাহমান, যেহেতু তাদের বাবার অনুপস্থিতিতে সেই হৈমন্তীর অভিভাবক। আসিফ, হৈমন্তী দুজন দুই ঘরে। ইমাম সাহেব খুতবা পাঠের পর স্পষ্ট উক্তি করলেন ‘ আলম সওদাগর কন্যা হৈমন্তী সওদাগরকে তিন লক্ষ টাকা দেনমোহরে শিহাব জোহান পুত্র আসিফ জোহানের নিকট বিবাহ দেওয়া হচ্ছে। বলুন আপনি কি রাজি আছেন জনাব আসিফ জোহান ? তাহলে কবুল বলুন। ‘
আসিফ কবুল বলা মাত্র আনন্দে সকলে সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করলেন। এরপর ইমাম সাহেব আর কাজী সাহেব চললেন ভেতরের ঘরের দিকে যেখানে হৈমন্তীকে বসানো হয়েছে। হৈমন্তীকেও একই ভাবে প্রশ্ন করা হলো এবং জবাবে সেও কেপে উঠা গলায় কবুল বললো। কবুল অনায়াসে বলে ফেললেও কাবিননামায় সই করতে গিয়ে তার হাতটা অসম্ভব ঘামতে লাগলো। ভীত হৈমন্তী তখন দৃষ্টি তুলে পাশে বসে থাকা ভদ্রমহিলা ওরফে তার শাশুড়িকে দেখলো।
মিসেস কুমুদিনী হৈমন্তীর পাশেই বসেছিলেন হাসিমুখে। ভীত হৈমন্তীকে মুখ তুলতে দেখে তিনি হেসে আশ্বস্ত করলেন। সাহস পেয়ে হৈমন্তীও সই করে দিলো। অবশেষে কাবিননামায় খসখসে আওয়াজে সই করার মাধ্যমে আসিফ আর হৈমন্তী আইনী ও ইসলামিক শরীয়তে স্বামী স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা পেল।
ঘরে একলা বসে আছে হৈমন্তী। বাহিরে সকলে বিয়ের আনন্দে হইচই করতে করতে মিষ্টি বিলোচ্ছে। ঝুমুর, ফাহমান বেরিয়েছে আশেপাশের বিল্ডিংগুলোতে বিয়ের মিষ্টি দিতে। এই দায়িত্ব তাদের মনোয়ারা বেগমই দিয়েছেন। মনোয়ারা বেগম আর আঞ্জুম আরা রাতের খাবারের দিকটা দেখছেন। মিসেস কুমুদিনী আর মারিয়াম উপস্থিত অতিথিদের মিষ্টি দিচ্ছেন হাসিমুখে। ‘ কবুল ‘ ছোট একটা শব্দ অথচ এর দাপটে আজ সকলের চোখে মুখে রাজ্য জয় করা হাসি।
হৈমন্তীর ভাবতেও অবাক লাগছে যে মাত্র কয়েক ঘন্টার তফাতে সে এখন কারোর বিবাহিত স্ত্রী। সবটা কেমন স্বপ্নের জগৎ মনে হচ্ছে। এই বিয়ে হলো কি করে ? তার মা, ভাই আসিফের মতো রগচটা মানুষকে মেনে কি করে নিলেন ? দেখে তো মনে হচ্ছে না আসিফ কোনোভাবে হুমকি ধামকি দিয়ে তাদের রাজি করিয়েছেন। এমনটা হলে তাদের চোখ মুখে কখনোই ওই তৃপ্তির হাসি থাকতো না। তবে, কি কারণ এর পিছনে ?
এবাড়ি ওবাড়ি মিষ্টি দিয়ে অবশেষে ফিরছে ঝুমুর, ফাহমান। ঝুমুরের চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। প্রাণপ্রিয় সখির বিয়ে হয়েছে তার ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে এর থেকে বড় খুশির খবর আর কি হতে পারে। মেয়েটা কতদিন এই দিনের অপেক্ষায় ছিল। অবশেষে তার অপেক্ষার প্রহর ফুরোলো ভেবেই ঝুমুর আনন্দে গুনগুন করছে।
ফাহমান ঝুমুরকে আড়চোখে লক্ষ্য করছিলো। ঝুমুরকে গুনগুন করতে দেখে বলল ‘ গুনগুন যখন করছোই তখন গানটা জোরেই গাও না। ‘
ঝুমুর জিভ কেটে বললো ‘ ওমা, কি বলেন এগুলো। এখন রাত বিরাতে গান গাইলে লোকে পাগলই না বলবে আমাকে। আপনার শখ হলে আপনি গাইতে পারেন। ‘
‘ এইসময় গান গাইলে যদি লোকে তোমাকে পাগল বলতে পারে তাহলে কি আমাকে সভ্য মানুষ ভেবে ছেড়ে দিবে ? আমাকে বলবে পাগলা। তখন আলটিমেটলি এমনিতেই তুমি পাগল উপাধি পাবে। কজ আফটার অল পাগলের বউ পাগলই হয়। ‘ ফাহমান ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে বললো।
ঝুমুর ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল ‘ আমি আপনার বউ ? কে যেন সেদিন বলছিলো আমাদের প্রেম হয়নি ? উহু মনে তো পড়ছে না। আপনার মনে আছে ডাক্তার সাহেব ? মনে থাকলে বলুন না কে সেই মহৎ ব্যক্তি। ‘
ফাহমান বুঝলো ঝুমুর আবারও ওকে খোঁচাচ্ছে। ঔ ঠেস মেরে বললো ‘ কেউ একজন বলেছিল আমি তার চোখে কোনওদিন বান্ধবীর বড় ভাই ছিলাম না, তবে আমি তার কি ? ‘
মুহূর্তেই ঝুমুরের দুই গালে যেন সিঁদুরে মেঘের ছটা লাগলো। ঝুমুর রক্তিম মুখ নামিয়ে নিলো। ঝুমুরের লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলা দেখে ফাহমান হাসলো। গুনগুন করে গান ধরলো। ঝুমুর টের পেলো গানটা, কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এই রাত তোমার আমার গানটা। এই গান ঝুমুর আগেও লক্ষাধিকবার শুনেছে। পুরনো সময়ের হিসেবে তার বেশ পছন্দের গান।
হৈমন্তীর বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। বাপের বাড়ি থেকে তার শশুর বাড়ি কাছেই বলা যায়। পায়ে হেঁটে যাওয়া আসায় ত্রিশ মিনিটের পথ। এত কাছে অথচ তবুও হৈমন্তীর কান্নাকাটির শেষ নেই। সে তখন থেকে হু হু করে কেঁদেই চলেছে। আসিফ ওকে থামাবে কি নিজেই অসস্তিতে পড়ে যাচ্ছে। সবার সামনে রগচটা আচরণ করা তার স্বভাব বলেই হয়তো নিজ স্ত্রীকে সকলের সামনে ভালোবেসে দুটো মিষ্টি কথা বলা তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ।
ভালোবাসা অনুভব করার জিনিস। একে বলে কয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে প্রকাশ করা যায়না। অপরদিকের মানুষটাকে নিজের অনুভূতির সর্বস্ব দিয়ে অনুভব করতে হয়। সেটা প্রকাশ করতে না পেরেই আসিফ বিব্রত বোধ করছে। এই এক হৈমন্তী ছাড়া আর কেউ তাকে অসস্তিতে ফেলতে পারে না।
এই এক জীবনে মেয়েটা যে তার কলিজা কতবার ভাজা ভাজা করে খেয়েছে তার হিসাব রাখা নেই আসিফের। রাখা থাকলে হয়তো জানা যেত তার ঘর সেই কবেই হাজার পেরিয়েছে। কারণে অকারণে বহুবার হৈমন্তীর ওই বিড়াল চক্ষুর জলে আসিফ ভেসে গেছে। মেয়েটার চোখে জল দেখলেই বুকের ভিতরটা উত্থাল পাতাল কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যায়। কিন্তু ও যে মুখ ফুটে বলতেও পারছে না ‘ হৈমন্তী তুই কাদিস না, তুই যখনই চাইবি এখানে চলে আসবি। আমি নিজে তোকে নিয়ে আসবো। ‘ কথাগুলো বলতে না পেরে আসিফ চুপ করে বসে থেকে প্রেয়সীর চোখের জল ফেলার দৃশ্য দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারলো না।
অবশেষে মাকে কাদিয়ে, ভাইয়ের চোখের কোণে অশ্রুদের ভিড় জমিয়ে আর প্রিয় বান্ধবীর গলা জড়িয়ে কেঁদেকেটে হৈমন্তী একসময় বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করলো শশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। আসিফরা মানুষ যেহেতু মাত্র চারজন তাই তারা একটাই গাড়ি এনেছিল। আসিফ কাজ আছে বলে কিছুক্ষণ পর ফিরবে জানিয়েছে। শিহাব সাহেব গাড়ি ড্রাইভ করছেন আর হৈমন্তী এবং মিসেস কুমুদিনী গাড়ির পিছনের সিটে বসেছেন।
হৈমন্তীর এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না বিয়েটা তার হয়ে গেছে। অনুভূতিগুলো তাকে এখনও নাড়া দেয়নি। এ কেমন অদ্ভুত বিয়ে হলো। না বাজলো সানাই, না হলো কোনো আংটি বদলের অনুষ্ঠান আর না হলো বিয়ের বেনারসি পড়ে বউ সেজে বিয়ে করার স্বপ্ন পূরণ। সবটা কেমন অদ্ভুত ভাবেই হঠকারিতায় ঘটে গেলো। কোচিং থেকে ক্লান্ত পায়ে ফিরেই সেই ময়লা জামা কাপড়ে তার বিয়েটা হয়ে গেলো। না সে জানলো, না সে বুঝলো। শুধু দেখলো ছোট এক শব্দ উচ্চারণ করতেই আসিফ আজ তার স্বামী। সবকিছুই কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। প্রিয় মানুষটাকে একেবারে অনাড়ম্বরে পেয়ে গেলো সে। হৈমন্তীর এতে যেন আফসোস নেই। কোলাহলবিহীন এক সন্ধ্যায় কি সহজেই না পেয়ে গেলো প্রিয় মানুষটাকে।
আসিফ কাজের কথা বলে ফাহমানদের বাড়িতেই রয়ে গেছে। ওবাড়িতে সবাই জানে তার কাজ আছে। কথা সত্য বটে, কাজ তো তার আছেই। বহুদিন পর এককালের প্রিয় বন্ধু আর সম্পর্কে শালা সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করা যায়না। আর যদি প্রস্তাবটা শালা সাহেব নিজেই দেন তাহলে তো আর কথাই নেই।
আসিফ আর ফাহমান পাশাপাশি ফাহমানদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। ফাহমানের মুখভঙ্গি গম্ভীর, আসিফ সামনের দিকে তাকিয়ে হাত দুটো বুকের কাছে ভাঁজ করে দাড়িয়ে আছে। প্রথম কথাটা ফাহমানই তুললো। বললো ‘ তুই অবাক হচ্ছিস তাইনা যে তোর আর হৈমন্তীর বিয়েতে রাজি কি করে হলাম ? ‘
আসিফ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বললো ‘ অবাক হইনি তবে এটা জানতাম না প্রেমিকার কথায় বোনের বিয়েতে রাজি হয়ে যাবি এমন মানুষ তুই। তোর কাছে তোর প্রেমিকাই অধিক প্রিয় বোন হতে। তাছাড়া তুই রাজি নাহলেও বা কি হতো। আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম দরকার পরে হৈমন্তীকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো তবুও অন্য কারোর হতে দিবো না। ‘
আসিফের গা জ্বালানো কথায় ফাহমানের রাগ হলো। দাতে দাত চেপে নিজেকে শান্ত রেখে বললো ‘ বোনের স্বামী হয়েছিস বলে যে তোকে ছেড়ে দিবো এটা ভাবিস না। তুই হৈমন্তীর স্বামী পরে, আমার বন্ধু ছিলি আগে। তুলে নিয়ে যাওয়ার কিংবা ঝুমুরের কথায় রাজি হওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। আমার বিবেকবোধ আর চোখ দুটোই আছে। আমি ভালো করেই দেখতে পারছিলাম আমার বোন তোকে কত ভালবাসে। এই বিয়েতে রাজি হওয়াটা একমাত্র ওর জন্যই। ওর জন্যই তোকে সুযোগ দিয়েছি। ‘
‘ ছিলাম বলছিস ? বন্ধুত্বের ভাঙনটা তুইই ধরিয়েছিলি। আমার কি অপরাধ ছিল ? শুধু তোর বোনকে পছন্দ করতাম বলে ? ‘ আসিফ ক্ষুদ্ধ গলায় বললো।
আসিফের কথায় ওর দিকে ফিরে দাড়ালো ফাহমান। বললো ‘ আমি বন্ধুত্ব কখনোই ভাঙ্গিনি আসিফ। আমি শুধু বলেছিলাম আমার বোনের দিকে চোখ দিবি না। ও আমার মান,আমার সম্পদ। বাবার রেখে যাওয়া আমানত ও। কাজেই ওর দিকে কারোর নজর পড়বে সেটা আমি মেনে নিবো না। ‘
‘ তাহলে এখন কেন মেনে নিলি এই সম্পর্ক ? তুই তো জানতিস আমি তোর বারণ সত্ত্বেও হৈমন্তীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি, তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছি এমনকি নির্জনে তাকে নিয়ে গানও গেয়েছি। ‘ শেষের কথাগুলো বলার সময় আসিফের ঠোঁটের কোণে নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠলো। চোখ মুখ শক্ত আর গলা ক্রুদ্ধ।
আসিফের কথায় হাসলো ফাহমান। আসিফ যে তাকে রাগিয়ে দিতে এসব গা জ্বালানো কথা বলছে তা ওর ভালো করেই জানা। কিন্তু ছেলেটা জানে না ফাহমানের রাগ উঠানোর জন্য ভাষার অপপ্রয়োগ আরও জোরালো করতে হয়। কিংবা যেচেই বলতে পারেনি ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে কোনো নোংরা কথা।
‘ মেনে নিয়েছি কারণ যেই মানুষটা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমার বোনকে সামান্যতম স্পর্শ করতেও দ্বিধাবোধ করেছে তার কাছে আমার বোন সুরক্ষিত এটাই আমার বিশ্বাস। ‘
~চলবে ইনশাআল্লাহ্….
#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-২৭
#মিফতা_তিমু
আসিফ আড়চোখে তাকালো ফাহমানের দিকে। এই ছেলে বরাবরই উদ্ভট। কখনও মুখে বলবে না কিন্তু আসিফের উপর যে তার ষোলো আনা বিশ্বাস আছে সেটা ঠিকই প্রকাশ পাবে তার কাজেকর্মে। যদি এতই বিশ্বাস তার উপর তাহলে সেই বন্ধুত্বের বন্ধন কেন ভেঙে দিয়েছিলো ?
‘ এত বিশ্বাস থাকলে হৈমন্তীকে আমার থেকে দূর কেন করেছিলি ? ‘
আসিফের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফাহমান। অসহায় কণ্ঠে বলল ‘ ভয় পেয়েছিলাম তোকে, তোর রাগকে। আমার বোনটা বড্ড নরম মনের। যদি না পারে তোর বেপরোয়া স্বভাব সামলে সম্পর্কের হাল ধরতে। তাই ভয় হচ্ছিল। ‘
আসিফ শুনলো, ফাহমানের দূর্লভ বাক্যগুলো শুনে মনটা খানিক নরম হলো। বললো ‘ তোর বোন হলো সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ কলির মতো যাকে সযত্নে আগলে রাখতে হয়, তাকে অবহেলা করতে নেই। আমিও আগলে রাখবো তবে তোর জন্য নয়, নিজের জন্য। ওই ছোট্ট পাখিটা আমার সব অ-সুখের সুখ, আমার উগ্র মেজাজকে শান্ত করার একমাত্র উপায়। তার সান্নিধ্যে আমার অশান্ত মন মুহূর্তেই শান্ত হয়ে যায়। তাই নিজের জন্য হলেও দু মুহূর্তের জন্য তার চোখে অশ্রুদের ভিড় করতে দিবো না। ‘
এরপর আর কেউ কথা বললো না। দুজনেই চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর আসিফ বাড়ি ফেরার তাড়া দেখালো। ফাহমান ওকে এগিয়ে দিতে বেরিয়ে এলো বিল্ডিং থেকে। গলি পার হতেই ফাহমান কৌতুক স্বরে বললো ‘ আমার সম্পদকে তোর কাছে দিলাম। তার ঠিকঠাক যত্ন নিস। ওর চোখে যদি তোর জন্য জল আসে তাহলে তোর চৌদ্দ গুষ্টিকে চৌদ্দ শিকের রুটি খাওয়াবো। ‘
আসিফ উত্তর দিলো না। শুধু কয়েক মুহূর্ত ফাহমানের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর হঠাৎই বছর পুরোনো এই প্রিয় বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে পরমুহূর্তেই বেরিয়ে গেলো। ফাহমান শুধু তাকিয়ে রইলো। আজ বোনের সঙ্গে বন্ধুর বিয়েটা দিয়ে আবারও পুরনো সেই মরে যাইয়া বন্ধুত্বকে জাগিয়ে তুলেছে সে।
বিয়েতে কনের বাড়ি সাধারণ ভাবে কোনো সাজগোজ ছাড়া দিব্যি দাড়িয়ে থাকলেও পাত্রের বাড়ি সেজে উঠেছে রঙিন সব রকমারি ঝকমারি আলোতে। হলুদ, নীল আলোয় আধুনিক মননের বাড়িটা ঝলমল করে চোখের তারায় মুগ্ধতা এনে দিচ্ছে। বাড়ির আঙিনায় স্বগর্বে পানির ফোয়ারা তুলে যাচ্ছে এক নারীর পাথুরে মূর্তি।
হৈমন্তী আশেপাশের সবকিছু দেখতে দেখতে ধীর পায়ে হেঁটে গেলো সদর দরজার দিকে। সবুজ ঘাসে ঘেরা লন পেরিয়ে সে এগোচ্ছে। চোখ তখনও সামনে দাড়িয়ে থাকা শুভ্র রঙের দোতলা বাড়িখানার দিকে। হৈমন্তী বাড়ির দরজায় এসে দাড়াতেই আত্মীয় স্বজনদের মাঝে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেলো। বিয়ের পরপরই ছেলে বাড়ি না ফিরে কোথায় গেলো। বিয়েও হলো এক প্রকার তাড়াহুড়োয়। কনের গায়ে না আছে কোনো গহনা না বিয়ের বেনারসি। তবে কি এই বিয়ে মতের বিরুদ্ধে হলো ? কিন্তু কানে তো এসেছিল আসিফ নিজেই বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। চেয়েছিল যত দ্রুত সম্ভব হৈমন্তীকে বিয়ে করে নিয়ে আসবে। তাহলে বিয়ের পরে বউ রেখে বেরিয়ে যাওয়ার কারণ কি ?
অবশ্য মিসেস কুমুদিনী সেসবে কান দিলেন না। তিনি এগিয়ে এলেন পুত্র বধূকে বরণ করতে। বিয়েতে হৈমন্তীদের বাড়িতে কোনো আত্মীয় স্বজন না থাকলেও আসিফদের দিক থেকে আত্মীয় স্বজন এসেছেন কালই। পুরো বাড়ি এখন আত্মীয় স্বজনে গিজগিজ করছে। বধূ বরণ শেষে হৈমন্তীর সঙ্গে পরিচিত এবং খুব কাছের কিছু মানুষজনের পরিচয় করালেন মিসেস কুমুদিনী। অল্প কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়েই হৈমন্তীকে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। আজ সারাদিন নানা রকমের ধকল গেছে কাজেই এখন আর এত রাত অব্দি জেগে থাকা ঠিক হবে না।
হৈমন্তী দুরুদুরু বুকে দাড়িয়ে আছে আসিফের ঘরের দরজার সামনে। ভিতরে যেতে তার সাহস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেই ঘরটা এতদিন শুধু আসিফের ছিল সেটা আজ থেকে তারও। কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য সেই তৈরি ছিল না। সে আসিফকে ভালোবাসে, তার উগ্রতা ভালোবাসে, তার বেপরোয়া ভালোবাসাকে সম্মানও করে কিন্তু এই মুহূর্তে বিয়ের জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। মানসিকভাবে তার প্রস্তুতি নিতে খানিকটা সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আবার এটা ভেবে শান্তিও লাগছে যে এখন থেকে সে নিজেকে আসিফ জোহানের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে।
শিহাব সাহেব মনের দিক থেকে ও শরীরের দিক থেকে এখনও বেশ শক্ত সামর্থ্য হলেও রাজনীতি থেকে সেচ্ছায় তিনি অবসর নিচ্ছেন। অবসর নেওয়ার মতো বয়স তার এখনও হয়নি তবুও ছেলের জন্য এই সুযোগ হাতছাড়া করছেন। একমাত্র ছেলেকে ভবিষ্যৎ এমপি হিসেবে দেখার তার অনেকদিনের ইচ্ছা।
ছেলেকে শিহাব সাহেব বড্ড ভালোবাসেন। ছেলেও তেমনই, স্বভাবে উগ্র হলেও বাবার কথার কোনো নড়চড় করেনা। তাছাড়া সে নিজেও রাজনীতিতে বেশ আগ্রহী। তাই এবার সে নির্বাচন নিয়ে বেশ উৎসুক। এর জন্য তাকে বেশ কদিন ধরে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। টানা কিছুদিনের ব্যস্ততার পর এই তিন চারদিন হলো সে সুযোগ পেয়েছে কাজ ছেড়ে অন্যদিকে চোখ দেওয়ার। সেই সুযোগেই আজ হৈমন্তীকে স্ত্রী করে জোহান বাড়িতে আনা।
ঘরের দরজা খুলতেই অমানিশ অন্ধকারে কোনোকিছু ঠাওর করে উঠতে পারলো না হৈমন্তী। কিছু দেখাই যাচ্ছে না। সে নিঃশব্দে ঘরের দরজা দিলো। বারান্দার দরজা খোলা, দখিনা বাতাস ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে। হৈমন্তী ভাবলো বারান্দায় গিয়ে দাড়ানো যায়। উৎকন্ঠিত শরীর ও মন শান্তি পাবে। বারান্দায় কেউ নেই, পুরো খালি। অবশ্য থাকার কথাও না। সে তো জানেই আসিফ ফিরেনি। কথাটা তো আসিফ জানিয়েই বের হয়েছিল। কিন্তু হৈমন্তীর দুশ্চিন্তা হচ্ছে মানুষটা গেলো কোথায়।
হৈমন্তী এগিয়ে গিয়ে বারান্দার রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে দাড়ালো। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হৈমন্তী চোখ বুজে দীর্ঘ নিশ্বাস নিলো। গরম লাগছে তার। অসহ্য সেই গরম। বুকের ভিতরটা দিরিমদিরিম শব্দে ঢাক পিটাচ্ছে। চোখের কোণে অশ্রু। ভাই আর মায়ের কথা মনে পড়ছে। এতদিন তাদের কাছে থেকে ভাবতো কখন সেই ক্ষণ আসবে যখন সে আসিফকে নিজের করে পাবে, রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে তার প্রিয় মুখ দর্শন করবে। অথচ আজ বিয়ের প্রথম দিনেই মনটা মা, ভাইয়ের জন্য কাদছে।
হৈমন্তী বুঝলো শরীর ও মন শান্ত করতে হবে, ভেতরের অস্থির ভাবটা কাটানো উচিত। শাওয়ার নিলে মনটা শান্ত হবে, শরীরটা ফ্রেশ লাগবে। হৈমন্তী বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকলো। লাগেজ খুলে জামা কাপড় ঘাটাঘাটি করলো। তার ঘরে ঢোকার আগেই মিসেস কুমুদিনী স্টাফ দিয়ে ঘরে লাগেজ পৌঁছে দিয়েছেন। হৈমন্তী লাগেজ ঘেঁটে একটা সুতির থ্রী পিস বের করলো। তারপর বাথরুমে ঢুকলো গোসল সারতে।
গোসল সেরে ফুরফুরে মন নিয়ে বেরোলো হৈমন্তী। গুনগুন করতে করতে লাগেজ থেকে নিজের লোশন, ক্রিম নামালো। তারপর হাতে পায়ে, মুখে লোশন ক্রিম লাগিয়ে ফোনটা হাতে তুলে বিছানার ধারে পা উঠিয়ে বসলো। ফোনের কন্ট্যাক্ট লিস্ট ঘেটে খুঁজে বের করলো আসিফের নাম্বার। বার কয়েক ফোন দিল সেই নাম্বারে। কিন্তু নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই হৈমন্তীর ফুরফুরে মনটা বিষাদ বেদনায় নীল হয়ে উঠলো। হৈমন্তী ব্যাথাতুর মনে দুশ্চিন্তায় ঘরময় পায়চারি শুরু করলো। ভালো লাগছে না, কিছু ভালো লাগছে না। মানুষটা কোথায় এখন, কি করছে সে ?
হৈমন্তী বুঝতে পারছে না কি করবে। তার শাশুড়ি মাকে জানাবে কি ? কিন্তু জানালে যদি কথাটা পাঁচকান হয় তাহলে ? তখন তো লোকে তার আর আসিফের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা বলবে। নাহ্ হৈমন্তী কিছুই ভাবতে পারছেনা। চুলে পেঁচিয়ে রাখা গামছাটা বড্ড প্যারা দিচ্ছে। অস্থির হৈমন্তী চুলের গামছা খুলে বারান্দায় গেলো সেটা মেলতে।
গামছা বারান্দার দড়িতে মেলতে গিয়ে আনমনা হয়ে উঠলো হৈমন্তী। মস্তিষ্কে হাজার রকমের চিন্তা ভিড় করছে। মা, ভাই কেমন আছেন, কি করছে তারা, আসিফ কোথায় এখন, ফিরছে না কেন সে, বিপদ হলো নাতো এসবই তার চিন্তার উৎস। অতিরিক্ত চিন্তায় হৃদস্পন্দন যেন বেড়ে যাচ্ছে। নিশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। সেই সঙ্গে হঠাৎই যেন সমস্ত শরীরে শীতল স্রোতের দমকা হাওয়া বয়ে গেল। হৈমন্তী বুঝতে পারছে পিছন থেকে কেউ তাকে জাপটে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই সে বরফের মতো জমে গেলো।
আসিফের বুকের সঙ্গে হৈমন্তীর পিঠ ঠেকে গেছে। হৈমন্তীর সদ্য শ্যাম্পু দিয়ে ধোয়া চুল থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। আসিফ সেই ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে হৈমন্তীকে আরও গভীর আলিঙ্গন করে বললো ‘ এত রাত অব্দি অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত। জরুরী কাজ পড়ে গিয়েছিল তাই ফিরতে দেরি হলো। ‘
হৈমন্তী আসিফের হাত ছাড়িয়ে পিছন ফিরল। নত মুখে জিজ্ঞেস করলো ‘ তবে যে ফোন দিয়ে বন্ধ পেলাম ? ‘
আসিফ হৈমন্তীকে নিজের কাছে টেনে নিলো। হৈমন্তীর ঠোঁটে গভীর স্পর্শ টেনে নরম গলায় বললো ‘ ফোনের ব্যাটারি ডেড হয়ে গেছে তাই বন্ধ হয়ে আছে। ‘
আসিফের গভীর স্পর্শে হৈমন্তী চোখ দুটো বুজে নিলো। লজ্জায় তার দশা খারাপ। চোখ দুটো খুলে আসিফের চোখে চোখ রেখে তাকাতেও লজ্জা করছে। সে বলল ‘ বলছিলাম যে বাহির থেকে এসেছেন, একটু ফ্রেশ যদি হয়ে নিতেন। ‘
‘ করে নিয়েছি ‘
আসিফের কথায় হৈমন্তী এবার চোখ খুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সেদিকে। আসলেই আসিফ ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। তার পরনে থাকা বাহিরের জামা কাপড়ের বদলে এখন গায়ে জড়ানো টিশার্ট আর ঢোলাঢালা ট্রাউজার। কিন্তু সে ঘরে এলো কখন ? এলেই বা হৈমন্তী টের পায়নি কেন ? সেকি এতটাই চিন্তায় মগ্ন ছিল যে একটা মানুষ ঘরে অব্দি চলে এলো কিন্তু সে টের পায়নি। তাছাড়া আসিফ ঢুকলোই বা কি করে ? দরজা তো লক ছিল।
‘ কখন এলেন ? টের পেলাম নাতো, ঘরে ঢুকলেন কি করে ? ‘
হৈমন্তীর কথায় হাসলো কি আসিফ ? বোঝা গেলো না অন্ধকারে। তবে সে হৈমন্তীর ললাটে ঠোঁট ছুয়ে বললো ‘ এই ঘরের পাশেই আমার নিজস্ব স্টাডি রুম আছে। ওখানে বাথরুমেই ফ্রেশ হয়েছি। জামা কাপড় ওই ঘর থেকেই নেওয়া। ঘরটা আমার ছিল, কাজেই এক্সট্রা কি থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয় তাইনা ? ‘
হৈমন্তী উত্তরে বললো ‘ ওহ… কিন্তু ছিল বলছেন কেন ? ঘর তো এখনও আপনারই আছে। ‘
‘ আছে বৈকি তবে সেটা শুধু আমার নয়। সেখানে আজ থেকে তোরও অধিকার আছে। এই ঘরের প্রত্যেকটা জিনিসে তোর অধিকার আছে। হোক সেটা এই ঘরে থাকা বাসিন্দা কিংবা জিনিস। ‘
হৈমন্তী কিছু বললো না, চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। আসিফ বললো ‘ ঘুমাবি না ? ‘
হৈমন্তী মাথা নেড়ে বোঝালো সে ঘুমাবে। আসিফ কিছু না বলে এবার হৈমন্তীকে কোলে তুলে নিলো। হৈমন্তী আসিফের টিশার্টের কলার চেপে ধরে আসিফের বুকে মুখ লুকালো। আসিফ ছোট ছোট কদমে হেঁটে গিয়ে হৈমন্তীকে বিছানায় শুয়ে দিল। তারপর নিজেও হৈমন্তীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
হৈমন্তী সোজা হয়ে শুয়ে আছে ঠিক যেভাবে আসিফ তাকে শুয়ে দিয়েছিলো। আসিফ তার পাশেই শুয়ে আছে অথচ তাকে স্পর্শ করেনি। সেই যে বারান্দায় ঠোঁটে আর কপালে ঠোঁট ছুঁয়েছিল এরপর আর হৈমন্তীর দিকে হাত বাড়ায়নি। হৈমন্তী ভেবেছিল আজ তাদের বাসর রাত, আসিফ তাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিবে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে কিন্তু সেসব কিছুই হলো না। মানুষটা কেমন যেন অদ্ভুত। বিয়ের আগেও কাছে আসেনি এবং এখনও কাছে আসতে চাইছে না। এমন কেন সে ?
‘ হৈম ‘
বহুদিন পর শুনলো নামটা। শরীরটা কেমন কাটা দিচ্ছে। আসিফের মুখে এই ডাক শোনার জন্য কতদিন অপেক্ষা করেছে সে তার হিসাব নেই। কিন্তু যান্ত্রিক শহরের এই ব্যস্ততায় তার সেই সুযোগ হয়নি। তার ডাক শোনা তো দূর মানুষটাকেই কতদিন পর দেখলো সেদিন। তার তো ফোনও ছিল না যে আসিফের খোঁজ নিবে। হৈমন্তী ভেবে অবাক যার প্রেমে সে সারাক্ষণ মজে থাকে তাকে না দেখে কি করে কাটাল এতগুলো মাস। কি মৃত্যুসম যন্ত্রণাময় সময়টাই না ছিল তখন।
আসিফের পুনরায় ডাক শুনে হৈমন্তী ওর দিকে ফিরে শুলো। আসিফের মুখ দেখা যাচ্ছে না, অন্ধকারে পুরো ঘর ছেয়ে আছে। কিন্তু হৈমন্তী টের পেলো তার হাত দুটো এক জোড়া উষ্ণ হাত নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিয়েছে। হৈমন্তী বললো ‘ কিছু বলবেন ? ‘
‘ তুই আমাকে ভয় পাস ? ‘
‘ ঠিক ভয় পাই না, আপনাকে আমি শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। সেই শ্রদ্ধা থেকেই ভয়টা মনে আসে। আবার আপনাকে ভালোও বাসি। সেই ভালোবাসাটাই আপনাকে শ্রদ্ধা করার ইচ্ছার জন্ম দেয় মনে। ‘
হৈমন্তীর উত্তরে আসিফের মুখভঙ্গির ভাব দেখা গেলো না অন্ধকারে। তবে সে হৈমন্তীকে নিজের বুকে টেনে নিল। হৈমন্তীকে আদুরে বিড়ালের মতো আগলে নিয়ে বললো ‘ তোকে একদিন নিজের এতটা কাছে নিয়ে আসবো বলেই এতটা অপেক্ষা করিয়েছে তোর ভাই। তখন প্রতিনিয়ত ভেবেছি তোর ভাইকে সামনে পেলেই মেরে ফেলবো।
কিন্তু আজ বুঝতে পারছি ও যদি তোর জন্য আমাকে এভাবে অপেক্ষা করতে বাধ্য না করতো তাহলে তুই হয়তো এতটা মূল্যবান হতি না আমার কাছে। যা কিছু খুব সহজে পাওয়া যায় তার মূল্য থাকে না আমাদের কাছে। তুই আমার অমূল্য এক রত্ন। কোনোকিছু বিনিময়ে আমি তোকে হারিয়ে যেতে দিবো না, সবসময় নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রাখবো। ‘
হৈমন্তী হাসলো, আসিফের বুকে মুখটা গুজে চুপচাপ শুয়ে রইলো। আসিফ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আচ্ছা মানুষটা কি করে টের পেয়ে গেলো তার মনের কথা ? হৈমন্তী অনেক ভেবেও উত্তর বের করতে পারলো না অগত্যা ভালোবাসার মানুষটার স্পর্শে ধীরে ধীরে নিদ্রার কোলে হারিয়ে গেলো।
~চলবে ইনশাআল্লাহ্….