#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-১৮
#মিফতা_তিমু
আকাশ ভেঙে নেমেছে বর্ষার ঢল। ঝুমুর হতবাক, আজ আবারও বৃষ্টি!! আজকাল এত বৃষ্টি কেন হচ্ছে কে জানে। তবে আজ ঝুমুরের মন খারাপ হলো না বর্ষণ দেখে। হয়তো ফাহমানের উচ্ছল অনুপস্থিতি তার মনে মন খারাপের মেঘ মেদুর ভাব জমতে দেয়নি। তবে ঝুমুর বিরক্ত। সামনে তার প্রিয় মামা ফারুক বৃষ্টি হওয়ার খুশিতে আরামে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটছে। সঙ্গে ওর প্রাণপ্রিয় বান্ধবীও যোগ দিয়েছে। এ কেমনতর কথা ? বৃষ্টিতে ছাতার ব্যবস্থা না করে এরা আনন্দচিত্তে হাসছে কেন ?
ঝুমুর ব্যক্তিগতভাবে বৃষ্টি পছন্দ করে না। বৃষ্টির প্রতি বিরক্তিকর ভাব নিয়ে সে বৃষ্টিতে ভেজা পছন্দ করে না। ঠিক এই কারণেই তার ব্যাগে সবসময় একটা ছোট মেরুন রঙ্গা ছাতা থাকে। ছাতাটা ফোল্ড করে ব্যাগে রাখার সময় এর আকার একটা ফোনের মতো ছোট হয়ে যায় বলেই ঝুমুর এই ছাতা ব্যবহার করে।
ঝুমুর ওর ছাতাটা বের করতে করতে দেখলো ফাহমান বৃষ্টিতে চোখ দুটো বুঁজে মনের সুখে বৃষ্টির ছটা উপভোগ করছে। ঝুমুর একবার ফাহমানকে দেখলো তারপর একবার ফারুক হৈমন্তীকে দেখলো। হতভম্ব সে ভেবে পাচ্ছে না এরা বৃষ্টি এত কেন পছন্দ করে। ঝুমুর দ্রুত ছাতা মেলে ধরলো। ফারুকের উদ্দেশ্যে বললো ‘ এই মামা, তুমি ছাতার নিচে না এসে বৃষ্টিতে কেন ভিজছ ? এখানে আসো তুমি। ‘
ফারুক ঝুমুরের কথা শুনতে পেলো না। সে তখন বৃষ্টিতে ভিজতে ব্যস্ত। তার সঙ্গে দাড়িয়ে দাড়িয়ে হৈমন্তীও মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে। তার চোখে মুখে লেপ্টে আছে এক রাশ স্নিগ্ধতা। দৃষ্টি তার মুদিত। ফারুকের দৃষ্টি স্থির হৈমন্তীর গোলগাল মুখটায়। মেয়েটার চোখে মুখে বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু জল দান করেছে অন্যরকম এক সৌন্দর্য। এতদিন পর ফারুক আবারও আবিষ্কার করলো আজ নতুন করে সে আবারও হৈমন্তীর প্রেমে পড়েছে। এ যে সে প্রেম নয়। হৃদয় বিদারক এক প্রেম যার প্রাপ্তি নাহলেও অপূর্ণতা কখনও হবে না।
ঝুমুর বুঝলো ফারুক ওর কথা শুনতে পায়নি। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই প্রথমবারের মতো জোর গলায় চেঁচিয়ে ডাকলো ফারুককে ‘ এই মামা বৃষ্টিতে ভিজছ কেন ? ছাতার নিচে আসো। ‘
এইবার ফারুক ওর কথা শুনতে পেলো বোধহয়। সে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ঝুমুরের দিকে চেয়ে মুখের কাছে হাত রেখে এই ভারী বর্ষণে চেঁচিয়ে বললো ‘ আমায় ডাকিস না বুড়ি। ভিজতে দে আমাকে এই বৃষ্টিতে। তুই বরং ছাতাটা ফাহমানের মাথায় ধর। ও বেচারা বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বরে কাবু হয়ে যায়। ‘
ফারুক লক্ষ্য করলো ওর কথা শুনে ঝুমুরের চোখ মুখ অপ্রতিভ হয়ে উঠেছে। ও আবারও হাসলো। বললো ‘ এতে এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে রে ঝুম ? ফাহমান আমার বন্ধু তারমানে তোরও মামা হয়। এত ভাবিস না, ভাগ্নি হিসেবে মামার সুবিধা অসুবিধা দেখা তোর দায়িত্ব। আর আমি জানি তুই নিজের দায়িত্বে কখনও গাফিলতি করবি না। ‘
ঝুমুর কি বলবে বুঝতে পারলো না। আড়চোখে দেখলো ফাহমান ফারুকের কথা মনে হয় কিছুই শুনেনি কারণ সে বৃষ্টিতে ভিজতে ব্যস্ত। ঝুমুর ভাবলো লোকটার কোনো কান্ডজ্ঞানই নেই। প্রত্যেকবার এমন বৃষ্টিতে ভিজে অথচ সে কিন্তু জানে তার জ্বর উঠতে পারে। এহেন পরিস্থিতিতে ঝুমুর আর সাতপাঁচ ভাবলো না। সোজা ছাতাটা ফাহমানের মাথায় ধরলো।
ফাহমান সেদিনের মতো আজও মাথার উপর বর্ষণের ছটা থেমে যেতে দেখে মুদিত চোখ জোড়া খুললো। দেখলো তার স্বপ্নের প্রেয়সী ঝুমুর ছাতা হাতে সামনে দাড়িয়ে আছে। তার গায়েও পড়ছে ফোটা ফোটা বৃষ্টি। চোখ মুখে লেপ্টে আছে বৃষ্টির ছটা। গায়ের শাড়িটার কাধের দিকে ভিজে গেছে। ফাহমান হাত রাখলো ঝুমুরের ছাতা ধরা হাতে। সিক্ত, শীতল হাতের স্পর্শে ঝুমুর কেপে উঠলো। দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নিলো ফাহমানের কাছ থেকে। ছাতাটা এখন ফাহমান ধরে আছে।
ঝুমুর ফাহমান হাঁটছে নীরবে। দুজনের মুখে রা নেই। তাদের দৃষ্টি আশেপাশে, সামনে হাটতে থাকা ফারুক হৈমন্তীর দিকে। ঝুমুর এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফারুকের দিকে। সে লক্ষ্য করেছে ফারুক হৈমন্তীর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিল। ওই দৃষ্টি সাধারণ ছিল না, তাতে ছিল এক রাশ মুগ্ধতা। কিন্তু ফারুকের চাওয়া কি আদৌ কখনো পূরণ হবে ?
দরজার নব খুলে ঢুকতেই মনোয়ারা বেগম আর আঞ্জুম আরার গলার আওয়াজ পেলো ঝুমুর আর ফারুক। ওরা ঘরে ঢুকলো। ঢুকে দেখল মনোয়ারা বেগম বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরেই ঘর গোছানোর কাজ লেগে গেছেন। মহিলার বয়স হলে কি হবে। এই বয়সেও মনের জোরে ঘরের সব কাজ করার মতো শক্তি তার আছে। এই ব্যাপারে উনার শরীরের শক্তি হতে মনের শক্তিই বেশি।
আঞ্জুম আরা রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া মাত্র তিনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে দাড়িয়ে থাকা ফারুক আর ঝুমুরকে দেখে উনি দৌড়ে গেলেন ঘরে গামছা আনতে। ফিরে এসে ফারুকের হাতে গামছা দিয়ে সিক্ত ঝুমুরকে নিয়ে বসার ঘরে এলেন। টি টেবিলে ঝুমুরকে বসিয়ে নিজ হাতে ঝুমুরের ভিজে চুলগুলো মুছে দিতে দিতে বললেন ‘ তোরা ভিজলি কি করে ঝুমুর ? তোর কাছে না সবসময় ছাতা থাকে ? ‘
ঝুমুর কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না। আঞ্জুম আরা তার শক্ত হাতে ঝুমুরের চুল টেনে টেনে মুছে দিচ্ছেন। ঝুমুর মুখের উপর থেকে কোনোমতে গামছা সরিয়ে আঞ্জুম আরার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো ‘ কি করছো কি মামী ? এভাবে চুল মুছলে আমার চুল আর থাকবে না। বলার সুযোগ দাও। ‘
আঞ্জুম আরা ঝুমুরের কথা শুনে চিমটি কাটলেন। বললেন ‘ সরি সরি, তুই বল কি বলছিলি। ‘
মনোয়ারা বেগম আঞ্জুম আরার কথার আওয়াজে বেরিয়ে এসেছেন। ঝুমুর আর ফারুককে বৃষ্টিতে ভিজে ফিরতে দেখে গরম চোখে বললেন ‘ ফারুক তোর আর কাজ নেই ? এই বৃষ্টির সময় ঝুমুরকে নিয়ে কেন বের হয়েছিলি ? ‘
ফারুক নিজের চুল মুছে নিচ্ছিল। মনোয়ারা বেগমের কথা শুনে সে বললো ‘ বৃষ্টি হবে সেই সিগনালই তো পেলাম না মা। যদি জানতাম আজ বৃষ্টি হবে তাহলে বেরই হতাম না। ‘
মনোয়ারা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। ঝুমুরকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি ‘ গরম স্যুপ খাবি ঝুমুর ? ‘
ঝুমুর মাথা নেড়ে বললো ‘ না আপি, খেয়ে এসেছি বাইরে থেকে। এখন শুধু এক কাপ আদা চা খেয়ে নিব। তাহলে একটু আরাম লাগবে। ‘
‘ আচ্ছা তাহলে জামা কাপড় বদলে আয়। ‘ বলে মনোয়ারা আবারও কাজে ফিরে গেলেন। ঝুমুর গেলো ওর ঘরের দিকে। ওর পিছন পিছন আঞ্জুম আরাও ছুটলেন। ঝুমুরের হেয়ার ড্রাই করা দরকার।
—-
গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে মারিয়ামের ঘরে এসে ঢুকলো ফাহমান। মারিয়াম রান্নাঘর গোছাচ্ছেন। হৈমন্তী ঘরে নেই তারমানে বাথরুমে ঢুকেছে। নিশ্চিত এই রাত বিরাতে গোসল করছে। ওই মেয়ে আবার বৃষ্টিতে ভিজলে গোসল না করে থাকতে পারেনা। ফাহমান ভাবছে ঘরে ঢুকেই ওরা মারিয়ামের কি ভয়ংকর রূপটাই না দেখেছিল। ছাতা না নিয়ে বেরিয়েছে বলে উনি আক্রোশে ফেটেই পড়েছিলেন।
তবে আহ্লাদী হৈমন্তী মাকে এটা সেটা বুঝিয়ে ঠান্ডা করেছে। ফাহমান মাঝে মাঝে ভাবে ওর বোনটা না থাকলে ওর কি যে হতো সে ও ভেবেই পায় না। এই বোনটা ওকে বারবার বাঁচিয়ে ফেলে।
ফাহমানের ভাবনার মাঝেই হৈমন্তীর ফোন বেজে উঠলো। ফাহমান বিভ্রান্ত হলো ধরবে কি ধরবে না। মনে হলো ধরা উচিত। তবে সে ফোন ধরতে ধরতে ফোন কেটে গেলো।
ফাহমান হাফ ছাড়লো আবারও ফোন বেজে ওঠাতে। হৈমন্তীর টেবিলের উপর থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিল। দেখলো স্ক্রিনে লেখা ‘ কলিজা ‘। ফাহমান ভরকে গেল। এই কলিজা আবার কে। হৈমন্তীর কোনো প্রেমিক আছে বলে তো মনে হয়না। না মনে হলেও কিছু করার নেই। আজকাল ছেলে মেয়েরা লুকিয়ে লুকিয়ে কতকিছুই করে।
‘ হ্যালো, কে বলছেন ? ‘
ফোনের ওপাশ থেকে পুরুষালি গম্ভীর গলা পেতেই ঝুমুর চমকে উঠলো। কান থেকে ফোন নামিয়ে একবার স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে নিলো। নাহ্, সে তো ভুলে অন্য কোথাও ফোন দেয়নি। তাহলে ফোনের ওপারে ওটা কার গলা। বিভ্রান্ত ঝুমুর ফোন কানে নিলো। দ্বিধান্বিত গলায় বললো ‘ জী, ঝুমুর বলছি। আপনি কে ? ‘
এবার মনে হয় ফাহমানের হৈমন্তীর উপর রাগ উঠলো। ও দাতে দাত চেপে রইল। এই মেয়েটার কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। কোন আক্কেলে বান্ধবীর নাম ‘ কলিজা ‘ দিয়ে সেভ করলো। এই ধরনের নাম মানুষ স্বামী বা প্রেমিককে দেয়। আর এই ছাগল মেয়ে কিনা বান্ধবীর নাম্বার কলিজা দিয়ে সেভ করেছে। আর সেও বা কি। না জেনেই গম্ভীর গলায় বলে বসলো ‘ কে বলছেন ‘। এর আগে একবারও এটা ভাবলো না ভদ্রতার খাতিরে হলেও সুন্দর করে কথা বলা উচিত ছিল।
ফোনের ওপারে কারো গলা না পেয়ে ঝুমুর একটু অবাক। কি ব্যাপার ? কেউ কথা কেন বলছে না ? একে হুট করে পুরুষালি গলা তার উপর চেনা যাচ্ছেনা। ওই বাসায় তো আর কোনো পুরুষ মানুষও নেই। তবে কি এটা ফাহমানের গলা ? সেটাই হবে। তবুও ঝুমুর দ্বিধান্বিত গলায় বলল ‘ ডাক্তার সাহেব বলছেন ? ‘
ফাহমান এতক্ষণে হাসলো। যদিও সে যে ডাক্তার সাহেবই বলছে তা আন্দাজ লাগানো ঝুমুরের জন্য কঠিন কিছু নয় তবুও ঝুমুরের মুখে ওই ডাক্তার সাহেব ডাকটা শুনতে তার একটু আলাদা ধরনের ভালো লাগে। মনের কোণে ইচ্ছেরা এই ডাক আবার শোনার রং মিছিল তোলে। ফাহমান বললো ‘ না, আমি আপনার কলিজার বান্ধবীর বড় ভাই বলছি। ‘
ঝুমুর হাসলো। শুনতে পেলো ফোনের ওপারে মৃদু স্বরে হৈমন্তীর গলা পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো দূর থেকে বলছে বলেই। হৈমন্তী বললো ‘ কে ফোন করেছে ভাই ? ‘ উত্তরে ফাহমান কি বললো ? ঝুমুরের ভেবেই হাসি পাচ্ছে। লোকটা এমনভাবে বললো ‘ তোর কলিজা ফোন করেছে ‘ যে ঝুমুরের বুক ফেটে হাসি আসছে। ভদ্রতার খাতিরে সে জোরেসরে হাসতেও পারছে না।
হৈমন্তী ফাহমানের কথা শুনে বাথরুম থেকেই বললো ‘ ওকে বলে দে আমি গোসল সেরে বেরিয়ে কথা বলবো। দেরি হলে ঘুমিয়ে পড়তে বল। ‘
‘ হ্যাঁ তোর সঙ্গে কথা না বলেই রেখে দিবে তাইনা ? তোর মতো বেকুব পেয়েছিস ওরে ? গর্ধব কোথাকার!! বান্ধবীর নাম্বার কলিজা নামে কে সেভ করে ? আরেকটুর জন্য ওকে খুন করতে করতে…. ‘
ফাহমান পুরো কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই শুনলো ফোনের ওপারে ঝুমুর খিলখিলিয়ে হাসছে। মধুর সেই ধ্বনি। ফাহমানের মনে হলো ঝুমুরের ওই হাসি তার মনের ঘরে বাদ্য বাজাচ্ছে। ফাহমান বুকের বা পাশটায় হাত রাখল। কান পেতে নীরবে প্রিয়তমার হাসি শুনলো। ঝুমুর একসময় তার হাস্যময় সঙ্গীতে ইস্তফা দিলো। হাস্যোজ্বল গলায় বললো ‘ আপনারা ভাই বোন ঝগড়াটা আমার আড়ালেই করেন নাহলে এই আমি হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাবো। ‘
ফাহমান উত্তর দিলো না। সে তখন স্বপ্নের রাজ্যে ঝুমুরকে নিয়ে চষে বেড়াতে ব্যস্ত। ফাহমানের নীরবতায় ঝুমুর বললো ‘ ডাক্তার সাহেব ‘। ফাহমান শুনতে পেলো তবে উত্তর দেওয়ার বোধ তার এখন হারিয়েছে। তার পাশে এক অদৃশ্য ঘোর। চোখ দুটোতে ভেসে বেড়াচ্ছে ঝুমুরের সেজেগুজে রিমঝিম চুড়ি হাতে বৃষ্টি সিক্ত চোখে হাসার দৃশ্য।
ফাহমানকে এখনও নীরব দেখে ঝুমুর কিঞ্চিৎ অবাক হলো। এবার সে বেশ জোর গলায়ই বললো ‘ ডাক্তার সাহেব শুনতে পারছেন ? ‘
এবার ফাহমান হকচকিয়ে উঠলো। তড়িঘড়ি করে বললো ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ শুনছি… বলো ‘
‘ বলছি যে আমি এখন রাখি। হৈমীকে বলবেন কাল কথা হবে। ‘ ঝুমুর হেসে কোমল গলায় বললো।
‘ হ্যাঁ…. হ্যাঁ হ্যাঁ রাখো। ‘
ব্যাস ওই এক কথা। তারপর আর দুজনে কথা হলো না। ফোন কানে কিছুক্ষণ পর ফাহমান টের পেলো টুট টুট শব্দে ফোনের ওপারে থাকা ব্যক্তি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। ফাহমান ফোন কান থেকে নামিয়ে রাখলো। চোখে মুখে প্রেয়সীর সঙ্গে কথা বলার মুগ্ধতা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে। তবে কিছু একটা মনে করে পিছিয়ে এলো আবারও। হৈমন্তীর ফোনটা হাতে তুলে নিলো। ফোনে পরিষ্কার জ্বলজ্বল করছে ঝুমুরের নাম্বারটা। ফাহমান সেই এগারো নম্বরের নাম্বারগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর গানের সুর কণ্ঠে তুলে ফোনটা রেখে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
—-
তাড়াহুড়ো করে কোনমতে নাকে মুখে খাবার গুঁজে দ্রুত বেরিয়ে এসেছে ফাহমান। আজ উঠতে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। কাল রাতে এসাইনমেন্টগুলো করতে গিয়েই এই দেরি হলো। সেই দেরির চক্করে সকালে উঠে ছাদেও যেতে পারেনি। এ নিয়ে তার আফসোসের শেষ নেই। ঝুমুরের সঙ্গে দেখা হলো না আজ তার।
ফাহমান দ্রুত রিকশা নিয়ে কলেজের গেটের দিকে রওনা দিলো। কলেজ গেট পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হলো। রাস্তা পেরিয়ে এপারে এসে দাড়াতেই তার কাঙ্ক্ষিত বাসটি এসে থামলো। ফাহমান শঙ্কিত হৃদয় বাসে উঠে গেলো। আজ ঝুমুরের সঙ্গে দেখা হয়নি, কথা হয়নি। এমনকি জানানোও হয়নি যে তার দেরি হবে। কে জানে মেয়েটা কি এখনও তার জন্য হোসেইন মার্কেট অপেক্ষা করছে ? ফাহমানের মনটা ভার হয়ে আছে। ঝুমুর কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছে কে জানে।
ফাহমান ভাবলো সিটে বসে ঝুমুরকে ফোন করবে। কিন্তু বাসে উঠতেই দেখলো আজ বাস অন্যদিনের মতো ভিড়ে ঠাসা নয়। বরং অনেকগুলো সিটই খালি। কি ব্যাপার ? আজ লোকজন এত কম কেন ? ফাহমানের মনে হলো আজ তো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা শুরু। তাই হয়তো পরীক্ষা শুরু হতেই কলেজ গেট পুরো খালি।
ফাহমান ভাবলো সিটে গিয়ে বসে ঝুমুরকে ফোন দিবে। তাই সে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। কিন্তু খানিকটা পিছনে যেতেই সে দেখলো ঝুমুর বসে আছে হাসিমুখে। তার সোনা বরণ মুখশ্রীতে ঝলমলে রোদ্দুর খেলা করছে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। পরনে কলাপাতা রঙের লোনের থ্রী পিস। কালো কুচকুচে কেশরাশি কাটা দিয়ে খোঁপা করা। পাশের সিটে ব্যাগ রেখে ফাহমানের জন্য জায়গা রেখেছে সে।
ফাহমানকে দেখে ঝুমুরের হাসি আরও বিস্তৃত হলো। পাশের সিট থেকে ব্যাগ সরিয়ে ইশারায় ফাহমানকে পাশে বসতে বললো। ফাহমান ওর ইশারা দেখে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়লো। বললো ‘ তুমি জানতে আমি কলেজ গেট থেকে বাস ধরবো ? ‘
‘ না তো ‘
ফাহমান অবাক হলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঝুমুরের দিকে। ঝুমুর সেটা দেখে বললো ‘ আন্দাজ করেছিলাম। ভাবলাম রাজা মশাই যদি এসে দেখেন তার জন্য জায়গা রাখিনি তাহলে সে রাগলেও রাগতে পারে। ‘
ঝুমুরের কথায় হেসে ফেললো ফাহমান। অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের হাসি আটকানো প্রাণপণ চেষ্টা করলো। আটকাতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে ঠোঁট টিপে বসে রইলো।
~চলবে ইনশাআল্লাহ্….
#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-১৯
#মিফতা_তিমু
কোচিং করে ফিরছে ঝুমুর। পশ্চিমে সূর্য তার দাপটের অহংকার লুটিয়ে অস্ত যাচ্ছে। ঝুমুর টের পাচ্ছে আজকাল শীত যেন কমে আসছে। মাঝে প্রচন্ড শৈত প্রবাহ চলছিল। এখন সেসব থিতু হয়েছে। ঝুমুর বাস থেকে নেমেই হোসেন মার্কেটের সোজা রাস্তা দিয়ে হাঁটা ধরেছে। সে রোজ এভাবেই বাড়ি ফিরে। সারাদিন এত বসে থাকার পর রিকশার পথটা হেঁটে আসলেও চলে। এতে পায়ের ব্যায়ামটাও হয়।
ঝুমুর হাঁটতে হাঁটতে প্রায় মসজিদের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর মিটার কয়েক দূরেই মসজিদ। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে ঝুমুর লক্ষ্য করলো রাস্তার একপাশে একখানা ছোটখাটো জটলা বেধে আছে। ঝুমুর খানিক ভ্রু কুচকালো। এই জনসমাগম কিসের ? এগিয়ে গিয়ে না দেখলে তো বোঝা যাচ্ছে না তাই ঝুমুর এগিয়ে গেলো।
লোকের ভিড়ের ফাঁকফোকরে দেখলো এক লোক দুই অবলা প্রাণীকে নিয়ে মৃত্যু খেলায় মেতে উঠেছে পাষাণ এক মানব। টাকার বিনিময়ে সবাইকে সাপ বেজির খেলা দেখাচ্ছে অথচ একটাবারও এটা ভাবলো তার ওই সামান্য অর্থের লিপ্সা ওই দুটো প্রাণীর কি মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। প্রাণী দুটো অকালে ঝরে যেতে পারে। ঝুমুরের খারাপ লাগলো। নির্দয় এই ইনসানের অর্থ লিপ্সার শিকার হয়ে প্রাণী দুটো এখন রক্তাক্ত। একে অপরকে আঁচড়ে খাচ্ছে তারা।
এমন দৃশ্য দেখে ঝুমুর আর দাড়াতে পারলো না। মনটা তার ভালো লাগছে না। তপ্ত রোদ্দুরের তাপে তার মাথা ধরে গিয়েছিল। তার উপরে এখন আবার এই রক্তাক্ত দৃশ্য দেখে মন খারাপে শরীরটা নুয়ে পড়েছে। তাই ঝুমুর সেই লোকজনের জটলা পেরিয়ে এগিয়ে গেলো। মসজিদ পেরিয়ে আরও দুটো মিনিট হেঁটে বাসার কাছের গলির সামনে এসে দাড়ালো।
গলির সামনে একটা বড় পাজেরো কার। ঝুমুর অবাক। ওর জানামতে আশেপাশে কারোর এত দামী গাড়ি নেই। ওদের নিজেরই তো টয়োটা নোয়াহ আছে। তাহলে এই পাজেরো গাড়িটা কার ? ঝুমুর বুঝে পেলো না। যেকোনো বহির্ভূত বিষয়ে তার অতিরঞ্জিত মাথা ঘামানোর অভ্যাস নেই তাই ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে দিলো। ভাবলো হয়তো আশেপাশের কারোর আত্মীয়র গাড়ি।
বাড়ি ফিরে ক্লান্ত ঝুমুর চেয়ারে বসে একটু জিরোচ্ছে। আজ এক্সট্রা ক্লাস ছিল। তার উপরে ব্যাংকে কিছু কাজও ছিল। সব মিলিয়ে দিন কেটেছে ভীষন ব্যস্ততায়। সেই সঙ্গে অ্যাডমিশন পরীক্ষার দিনও ঘনিয়ে আসছে। যদিও এখনও অনেকটা সময় আছে কিন্তু যতই একটা করে দিন কাটছে ঝুমুরের ততই ভয় বাড়ছে। মেডিক্যালে পড়া তার বহু দিনের স্বপ্ন। এই সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় না।
ঝুমুর দশ মিনিট জিরিয়ে উঠে গিয়ে বাথরুমে ফ্রেশ হলো। তারপর পরিপাটি হয়ে খেতে গেলো। খাওয়া দাওয়া সেরে বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বই পড়লেই এখন ক্লান্তি শরীরে তার ঘুম ধরবে। ধরলে ধরুক, আসলেই এখন তার ঘুমানো প্রয়োজন নাহলে শরীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাবে না।
মারিয়ামের কাছে আসিফ আর তার বাবা মায়ের আগমনের খবর পেয়ে ফাহমানের শরীর দিয়ে কারেন্ট বয়ে চলেছে। সে শুধু পারছে না ছুটি নিয়েই বাসায় ছুটে যেতে। জায়গাটা হাসপাতাল, চাইলেই হুটহাট ছুটি নেওয়া যায়না। এর বিভিন্ন প্রসিডিওর আছে। ওগুলো না মিটিয়ে সময় না নিয়েই কি করে চলে যায়।
কিন্তু এটা ভেবে ফাহমানের রাগ লাগছে যে আসিফের সাহস কি করে হলো ওর বোনের জন্য সম্বন্ধ নিয়ে আসে তাও আবার বাবা মাকে সঙ্গে করে। সবার সামনে অপমানিত হওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি ? কিন্তু ফাহমান তো সেটাও করতে পারবে না। ওর মধ্যে এখনও বদান্যতার এতটা অভাব দেখা দেয়নি যে গুরুজনের সামনে বিচ্ছিরি ভাষায় নিন্দা করবে।
কিন্তু ফাহমানের যে দেরিও সহ্য হচ্ছে না। ওইদিকে বাড়িতে কি অবস্থা কে জানে। মারিয়াম তো আসিফকে দেখতে পারেন না। কে জানে কি বলে বসেছেন। যদি রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কিছু বলে বসেন তাহলে আসিফের বাবা এমপি সাহেব ব্যাপারটাকে কিভাবে নিবেন কে জানে।
অবশেষে অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে সেই মহেন্দ্রক্ষন হাজির হলো যখন ফাহমান মুক্তি পেলো তার চাকরির ধরা বাধা সময় থেকে। মুক্তি পেয়ে সঙ্গেই সঙ্গে সে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে টঙ্গীর দিকে রওয়ানা দিলো। সে যখন বাড়ি এসে পৌঁছাল ততক্ষনে রাত প্রায় আটটা। গলির বাইরে দু তিনটে পাজেরো কার দেখে এসেছে সে।
এখান থেকে এখানে আসিফের লোক দেখানো এই মহা মূল্যবান গাড়ি চষে বেড়াতে আসাটা ফাহমানের মনে ধরলো না। আসিফকে পছন্দ না হওয়ার পিছনে এটাও একটা কারণ। আসিফ ওর যা আছে তা দেখাতে পছন্দ করে। তার কথা হলো তার যদি সহায় সম্পত্তি থেকে থাকে তাহলে সে কেন সেটা দেখাবে না ? সম্পত্তি, টাকা পয়সা নিশ্চই ঘরের সিন্দুকে সাজিয়ে রাখার জন্য নয়। এখন এসব দেখে মারিয়াম রেগে না গেলেই হলো।
ফাহমান আশাই করেছিল আসিফের এই বাড়াবাড়ি দেখে তার মা রেগে রণমূর্তি ধারণ করবে। আর হলোও তাই। ফ্ল্যাটে ঢুকেই বসার ঘরে আসিফ আর তার বাবা মাকে দেখলো ফাহমান। দাতে দাত চেপে তাদের যে অ্যাপায়ন করছেন মারিয়াম সেটাও দেখলো সে।
হৈমন্তী খাবার ঘরে চেয়ার টেনে বসে আছে। ভয়ে তার হাত পা কাপছে। তার মা ভাই কেউই আসিফকে পছন্দ করেনা। এখন দুজনেই যদি এক হয়ে আসিফ আর ওর মা বাবাকে কিছু বলে বসে তাহলে তো আর দেখতে হবে না। আসিফের রাগ তখন প্রলয়ংকরী রূপ ধারণ করবে। আর সেই রাগের আগুনে জ্বলবে হৈমন্তীর ছোট হৃদয়খানা। জ্বলবে বিরহের দহন বুকে নিয়ে।
ফাহমানকে দেখা মাত্র আসিফের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। ও খোশ মেজাজে বললো ‘ তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। এসে পড়েছিস ভালো করেছিস। আয় এখানে এসে বস। ‘
ফাহমান আসিফের কথায় চেয়েও খুশি হওয়ার ভান ধরতে পারলো না। রুমে ঢুকে আসিফের মুখোমুখি বসলো। আসিফের বাবা শিহাব সাহেবের দিকে চেয়ে হেসে বলল ‘ আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল, কেমন আছেন ? অনেকদিন পর আজ দেখা হলো। ‘
শিহাব সাহেব বরাবরই খোশ দিলের মানুষ। ফাহমানের কথা শুনে খুশি মুখে বিনয়ী গলায় উত্তর দিলেন ‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম, এই তো আছি খোদা যেমন রেখেছে। ঠিক বলেছো আজ অনেকদিন পর দেখা। আর দেখাটাও হলো বিশেষ দিনে। ‘
ফাহমানের মুখে হাসি তখনও অটুট। সে জানে শিহাব সাহেব তার অতি আদরের ছেলে আসিফের সঙ্গে ওর বোনের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ফাহমান কি সেটা মানবে ? মরে গেলেও ওই উগ্র মেজাজের, ভারিক্কি স্বভাবের অহংকারী ছেলের সঙ্গে নিজের বোনের বিয়ে হতে দিবে না।
‘ খুশির খবর ? কি খবর ? ‘ ফাহমান মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বললো।
বিনিময়ে শিহাব সাহেব বিনয়ী হেসে বললেন ‘ দেখো বাবা ফাহমান, আসিফ আমার একমাত্র ছেলে। আজ পর্যন্ত ওর কোনো ইচ্ছাই অপূর্ণই রাখিনি। যখন যেটা চেয়েছে সেটাই দিয়েছি। হয়তো এই কারণেই ও একটু বদ মেজাজি কিন্তু ছেলেটা আমার অনেক ভালো মনের। যাকে ভালবাসে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসে। ওর এই খুশির জন্য আমরা সব করতে পারি। তাইতো ও যখন বললো ও তোমার বোন হৈমন্তী মাকে বিয়ে করতে চায় তখন বিনা বাক্য ব্যয়ে আমরা হাজির তোমাদের বাসায় বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে। আমি আমার ছেলের জন্য তোমার বোনের হাত চাইছি। ‘
ফাহমান জানতো এমন কিছু একটা হবেই। সে ঘাড় ঘুরিয়ে মারিয়ামকে দেখলো। তিনি ছেলের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। ফাহমান এবার আসিফের উপর দৃষ্টি রাখলো। সে ফাহমান থেকে দেড় হাত দূরে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। ভঙ্গিমা তার রাজকীয় ভাব যেন রাজার ছেলে সে। যেহেতু এমপির ছেলে সেহেতু সে বড় তো রাজার হালেই হয়েছে কিন্তু লোকের বাড়ি গিয়েও যে সে তার ভাব ধরে রাখবে তা ফাহমানের ঢের জানা।
‘ কিন্তু আঙ্কেল… আমি আমার বোনকে এখনই এত অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে সংসারের ভার চাপিয়ে দিতে চাইছি না। ‘
ফাহমানের কথায় মিসেস কুমুদিনী অর্থাৎ আসিফের মা হেসে বললেন ‘ ওটা নিয়ে চিন্তা করো না বাবা। আমরা এখনই ওর উপর সংসারের কোনো ভার দিবো না। সবে তো ইন্টার দিলো। এখন ওর পড়ালেখা করার বয়স। ওর যতদিন ইচ্ছা পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তুমি এই ব্যাপারে ভেবো না। তুমি তো চেনো আসিফকে। আমাদের আসিফ যে তার কাছের মানুষদের নিয়ে কতটা প্রটেকটিভ সে তো তুমি জানোই। আফটার অল তুমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। ‘
মিসেস কুমুদিনীর কথায় ফাহমানের অন্তরটা বিষাক্ত অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। হ্যাঁ সে একসময় আসিফের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল বলেই তো আসিফের রাগ সম্পর্কে তার ধারণা আছে। যেদিন সে আসিফের আচার আচরণে আর কথায় হৈমন্তী সম্পর্কে তার অনুভূতি টের পেয়েছিল সেদিনই তো সে আসিফের সঙ্গে নিজের বন্ধুত্বটা চিরতরে শেষ করে দিয়েছে। আসিফের সঙ্গে নিজের বোনকে জড়িয়ে সে বোনের জীবন শেষ করতে চায় না। এমন অহংকারী, বড়লোক বাবার একমাত্র দাম্ভিক সন্তানকে বোন জামাই হিসেবে সে কখনোই মেনে নিবে না।
আসিফ বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান। সেই সূত্রে তার মধ্যে দাম্ভিকতা, রগচটা, অহংকার আর ত্যাড়ামি ভাব সবকটাই আছে। সে ভীষন রকমের একগুঁয়ে। যখন যেটা বলে তখন সেটাই করে। তার এই স্বভাব সম্পর্কে কম বেশি সকলেই জানে। মারিয়ামও জানেন। এই কারণেই ফাহমানের বন্ধু হিসেবে পূর্বে মেনে নিলেও মেয়ে জামাই হিসেবে মানবেন না এই ছেলেকে।
‘ দুঃখিত আঙ্কেল আন্টি। আপনাদের কথা রাখতে পারলাম না। আন্টি আপনি বললেন আমি আসিফের বন্ধু। বন্ধু বলেই হয়তো জানি ওর বদ মেজাজি খটমটে স্বভাব সম্পর্কে। তাই এহেন পরিস্থিতিতে দাড়িয়ে আমি পারছিনা আমার বোনের বিয়েটা আসিফের সঙ্গে দিতে। আসিফ বদ মেজাজি, অহংকারী দাম্ভিক মানুষ। ‘
ফাহমানের কথায় মিসেস কুমুদিনীর হাসিতে চিড় ধরলো। উনি একবার স্বামী আর ছেলের দিকে তাকালেন। আসিফের ঠোটের কোণে বাঁকা হাসি আর শিহাব সাহেব উৎসুক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন তার উত্তর শোনার জন্য। মিসেস কুমুদিনী বড় নিশ্বাস ফেললেন। আবারও হেসে বললেন ‘ বিয়ের আগে তো সব ছেলেদেরই এমন মেজাজ থাকে বাবা। হয়তো আসিফের একটু বেশিই কিন্তু বিয়ের পর ইনশাআল্লাহ্ ওটা ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের হৈমন্তী মা আছে না। ‘
‘ দুঃখিত আন্টি, সেটাই তো ভয়। আমার বোন হৈমন্তী কাউকে ধরে বেধে তার স্বভাব বদলাতে পারবে না। ফলস্বরূপ যা ঝড় যাওয়ার তার উপর দিয়েই যাবে। আমরা তখন সেটা বুঝবোও না। আমি তো আসিফের বন্ধু তাই ওকে চিনি। যেই ছেলে রেগে গেলে বাড়ির জিনিসপত্র ভেঙে ফেলতে পারে সে যে আমার বোনের গায়ে হাত তুলবে না তার কোনো গ্যারেন্টি নেই। ‘
মিসেস কুমুদিনী আর শিহাব সাহেবের মুখ ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো। অন্যদিকে আসিফের মুখে ক্রুর হাসি। ও ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়ালো। ‘ মা বাবা বাড়ি চলো, বিয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে। ‘ বলে এগিয়ে এলো সে। ছেলের কথা শুনে শিহাব সাহেব বললেন ‘ কিন্তু ফাহমান… ‘
‘ চিন্তা নেই বাবা। একবার যখন বলেছি তখন হৈমন্তী আমারই হবে। হয় আমার হবে নাহয় কারোর না। ‘
কথাগুলো বলতে বলতে ফাহমানের কাছে এগিয়ে এলো। ফাহমানের গা ঘেসে বেরিয়ে গেলো সে। ফাহমান যার পরনাই অবাক। আসিফ এখনও এতটা শান্ত কি করে ? সে যেভাবে ওদের প্রস্তাব নাখোচ করেছে তাতে আসিফের তো সঙ্গে সঙ্গে রেগে যাওয়ার কথা। তবে এ কিসের পূর্বাভাস ?
আসিফ বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। বেরিয়ে যেতে সময় হৈমন্তীর দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি। সোজা দরজার দিকে দৃঢ় পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেছে। এতে ফাহমান আর মারিয়াম খুশি হলেও এই অবহেলা হৈমন্তীর বুকে কাটার মতো বিধছে। এমন কখনও হয়নি যে সে আসিফের আশেপাশে অথচ আসিফ তার দিকে ফিরে তাকায়নি।
হৈমন্তী মেয়ে মানুষ। তার প্রতি আসিফের এই উন্মাদনা যে স্বাভাবিক নয় সে ও ভালই বুঝতে পারে। ওর অষ্টাদশী মন এই অনুভূতিকে প্রেম বলেই অভিহিত করেছে। অথচ তার প্রেমে মত্ত উন্মাদ প্রেমিক আসিফ জোহানের এ কি হলো ? মানুষটা কেন এমন করছে ?
হতে পারে আসিফ হৈমন্তীর প্রেমে পাগলপারা হয়েছে এবং চাইলেই সে ক্ষমতা খাটিয়ে হৈমন্তীকে নিজের করতে পারতো। কিন্তু কখনও এই সুযোগ থাকতেও সে হৈমন্তীকে স্পর্শ করেনি। অনেকবার তারা কাছাকাছি হয়েছে। একে অপরের নিশ্বাস গুনতে চেয়েছে। ক্যাডেট কলেজ থেকে ছুটিতে ফিরে চুপি চুপি হতো তাদের দেখা। নির্জন নিরালায় আসিফের প্রিয় পার্কে। সেখানে তারা সুযোগ পেয়েছে একটু একে অপরকে ছুঁয়ে দেখার।
প্রেয়সীকে ছোঁয়ার তীব্র বাসনায় বেসামাল হয়েছে আসিফ। মনটা আনচান হয়েছে একবার, শুধু একবার প্রেয়সীর ওই গোলাপ পাপড়ির মতো নরম ঠোঁটটায় নিজের রুক্ষ ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দিক। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ছুঁতে গিয়েও ফিরে এসেছে সে। নিজেকে সামলে হৈমন্তীকে স্পর্শ করা থেকে বিরত থেকেছে। উন্মাদ প্রেমিক হওয়া সত্ত্বেও অপেক্ষা করেছে তাদের প্রেম পরিণতির।
অথচ আজ যখন সেই দিন এলো তখন আসিফ মুখ ফিরিয়ে নিলো তার দিক থেকে। কেন ? হৈমন্তী জানে তার মা ভাই কখনও আসিফকে মেনে নেবে না কারণ আসিফ উগ্র মেজাজি, স্বাধীনচেতা, অহংকারী, দাপটে আর কারোর কথা না শোনা স্বভাবের মানুষ। সে নিজে যা মনে করে তাই করে আর অন্যের কথায় নাচে না। ঠিক এই গুণগুলোর কারণেই আসিফকে তারা পছন্দ করেনা। অথচ হৈমন্তী ওই দাম্ভিক লোকটাকেই নিজের হৃদয়খানা দিয়ে বসেছে। আচ্ছা এরকম কেন হলো ? হৈমন্তী কেন ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত জানার পরও পাগলা, খেপাটে মানুষটাকে ভালোবেসে ফেললো ? হৈমন্তীর কাছে উত্তর নেই এই প্রশ্নের।
~চলবে ইনশাআল্লাহ্….