নূপুর বাঁধা যেখানে পর্ব-১০+১১

0
1250

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-১০
#মিফতা_তিমু

‘ তোমাকে ‘

কিছু কিছু সময় আমাদের মনে হয় আমরা স্বপ্নলোকে বাস করছি। তখন জাগতিক কিছু আমাদের ছুঁতে পারে না। মনে হয় যা শুনলাম তার সবটাই মস্তিষ্কের আশপাশে ঘুরেই চলে গেছে। মস্তিষ্কে আর স্পষ্টভাবে জায়গা করতে পারছে না। মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে। মনে হয় যা শুনলাম ঠিক কি শুনলাম ? নিজেকে নিজেই তখন বিশ্বাস হয় না।

এমনটাই এখন হচ্ছে ঝুমুরের সঙ্গেও। সে বিশ্বাস করতে পারছে না তার উদ্ভট প্রশ্নের উত্তরে ফাহমান এরকম একটা কথা বলবে। সে কি তবে ভুল শুনলো ? দ্বিধান্বিত সে উচ্চারণ করলো ‘ এ্যা ? কি বললেন ? ‘
ফাহমান এবার সামনের দিকে ঘুরে সিটের গায়ে হেলান দিয়ে সটান হয়ে বসলো। বললো ‘ আমার মনে হয় আমি যা বলেছি সে তুমি নিজেও সেটা শুনতে পেয়েছ। ‘

ঝুমুরকে কিছুটা অন্যরকম দেখালো। তার চোখে মুখে তখন চিন্তা, আগ্রহ, অসস্তি সবকিছুর মিশেল এক অনুভূতি। সে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে ফাহমানকে দেখলো আরেকবার। ফাহমান ঝুমুরের এই বারবার ঘুরেফিরে তাকে দেখা লক্ষ্য করলো। ব্যাগ থেকে ইয়ারফোন বের করে ফোনের সঙ্গে কানেক্ট করে কানে গুঁজে দিয়ে বললো ‘ সবসময় সবকিছু বুঝতে নেই মিস নূপুর। কিছু কিছু সময় দ্বিধা এক পাশে সরিয়ে রেখে মুহূর্তটা উপভোগ করতে হয়। জীবন কিন্তু সবসময় দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না। আর সবকিছু পেলেও এরকম শীতের সকালে চলন্ত বাসে জানালার ধারে বসে এই মিষ্টি রোদটা উপভোগ করার মতো সুযোগ আর নাও পেতে পারেন। ‘

ফাহমানের কথা শুনে ঝুমুর কিয়ৎক্ষণ তাকে এক দৃষ্টে দেখলো। ফাহমান ততক্ষণে কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বুজেছে। ভাবখানা এমন যেন ঝুমুর তার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা তার জানাতেই নেই। ঝুমুর বুঝলো না মানুষটা কেমন যেন অদ্ভুত। ঠিক কেমন অদ্ভুত সে ও নিজেও জানে না। বাংলা ভাষায় প্রকাশ করবার মতো সেই ঐশ্বরিক ক্ষমতা তার এখনও হয়নি। এমনিতেই সে সাহিত্যে প্রচন্ড রকমের কাচা। সে হয়তো বাংলা সাহিত্য পড়ায় বেশ আগ্রহী তবে তার ব্যবহার সবসময় করতে পারে না। কাজেই নিজের মনের ভাব তার বাংলায় বোঝাতে প্রায় সময় বিপদে পড়তে হয়।

ঝুমুর চেষ্টা করেছিল ফাহমানকে পড়তে, তাকে জানতে। কিন্তু অপারগ সে এই দেশের ক্ষণিক সময়ের বাসিন্দা হয়ে পারলো না জন্ম থেকে এই দেশে বড় হওয়া ফাহমানের মন পড়তে। আচ্ছা এই দেশের সবাই কি এমন জটিল ? কোথায় মনোয়ারা বেগম, আজমাঈন সাহেব, আঞ্জুম আরা, তানিয়া শাহজাহান, ফারুক এরা কেউ তো এমন জটিল নন। এমন ধারার জটিল কথাবার্তাও তারা বলেন না। তারা এই ছন্নছাড়া তো এই দায়িত্বশীল নন। তারা যেমন তেমনই থাকেন সবসময়।

অথচ ফাহমান পেশায় ডাক্তার। ঝুমুর শুনেছে যারা ডাক্তার তারা তো আরও গোছালো হন। তাদের কথাবার্তায় থাকে এক আলাদা ধরনের স্মার্টনেস আর ব্যবহারে থাকে সামাজিক দায় বদ্ধতা। কিন্তু ফাহমান একদম অন্যরকম। তার কথাবার্তার ধরন সুন্দর, গোছালো অথচ আচার আচরণ কেমন ছন্নছাড়া, নীড় হারা পাখির মত। কিন্তু কেন ?

এসব ভাবতে ভাবতেই ঝুমুরের চোখটা লেগে এসেছিল। কাল রাতে তার ঘুম হয়নি তাই দিনের বেলাতে চোখ বন্ধ হয়ে আসা স্বাভাবিক। তার হুস হলো ফাহমানের ডাকে। ফাহমান তখন তাকে পাশ থেকে ডাকছে মৃদু স্বরে। ঝুমুর চোখ দুটো খুলে দেখলো ফাহমান তার কাঁধে হাত রেখে তাকে ডাকছে। সে ভ্রু কুঁচকে বললো ‘ কি হয়েছে ? ‘

‘ তোমার না কোচিং ? ‘

ঝুমুর চমকালো। আসলেই তো, তার তো কোচিং। এটা কোন জায়গা ? সে কি এসে পড়েছে ? তবে শুনলো না কেন ? যাক এসব ভাবনা গোল্লায়। ঝুমুর দ্রুত এত ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে ব্যাগ কাধে উঠে দাড়ালো। ফাহমান তাকে বেরোনোর জায়গা করে দিয়েছে। বাস এখন অনেকটা খালি তাই পূর্বের মতো ধাক্কাধাক্কি করে এগোতে হলো না ঝুমুরের।

ঝুমুর বেশ অনাড়ম্বরে এগিয়ে গিয়ে বাস থেকে নামলো। তবে সে বাস থেকে নামতেই ফাহমান এগিয়ে এলো। বাসের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে তেরছা ভাবে হেসে বললো ‘ কোচিং করতে এসে এভাবে ঘুমিয়ে পড়লে জীবনেও ডাক্তার হতে পারবেন না মিস নূপুর। ওসব স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। ‘

বাস চলে গেছে অনেকক্ষণ তবে ঝুমুর এখনও তাকিয়ে আছে সেদিকে। রাগে তার কপাল জলে যাচ্ছে। লোকটার আসলে তাকে খোঁচা না মারলে পেটের ভাত হজম হয় না। সেই থেকে খোঁচা মেরেই যাচ্ছে। যেই দেখলো ঝুমুরের মন ভালো ওমনিই খোঁচাটা সুযোগ বুঝে মেরে দিলো। লোকটার কথা ভাবলেও এখন রাগ উঠছে ঝুমুরের। কি তাচ্ছিল্য ভরা গলাই না বললো ঝুমুরের যোগ্যতা নেই ডাক্তার হবার। না সরাসরি বলেনি কিন্তু কথায় তো তাই বোঝা যায়।

এসব কথায় কথায় খোঁচা মারা মানুষ ঝুমুরের কোনো কালেই পছন্দ নয়। এসব নারী জাতির অভ্যাস থেকে সে শতহাত দূরে। এমন কথায় কথায় খোঁচা মারা, নিজেকে নিয়ে অহংকার করা, আড্ডা দিতে বসলে অন্যদের নিয়ে গসিপ করা তো মেয়েদেরই মুদ্রা দোষ। তাই এসব ঝুমুরের একদমই পছন্দ নয়। সে নিজেই ঠিক এই কারণেই সব ধরনের ফ্যামিলি গ্যাদারিং থেকে দূরে থাকে। কারণ সে জানে মহিলারা এক জায়গায় হলে অন্যদের নিয়ে গসিপ করবেই। তখন তাদের মাঝে থেকে ঝুমুরও সেসবে তাল মেলাবে। আজকাল ট্রেন্ডই তো ওসব। নিজের অসস্তি জেনেও শুধুমাত্র নিজেকে স্মার্ট জাহির করার জন্য মিথ্যে ভান ধরতে হয়। কাজেই এসবে ঝুমুর নেই।

অথচ এহেন খোঁচা মারা লোককে দেখলেই নাকি ঝুমুরের হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার যোগাড় হয়। পলক থমকে যায়, দৃষ্টিতে ছেয়ে থাকে এক রাশ মুগ্ধতা। অবাধ্য মনটা ঘুরেফিরে সেই লোকটার কথাই চিন্তা করে। এ হয়েছে ঝুমুরের এক জ্বালা। যার কথা চিন্তাই করতে চায়না সেই তার মন মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে। উফফ উফফ উফফ যতসব অসহ্য কারবার। ঝুমুর মানুষটাই না কত বিভৎস রকমের অসহ্য।

প্রথম ক্লাস হিসেবে ঝুমুরের ক্লাসটা আজ ভালই ছিল। অন্তত বোরিং লাগেনি। এমনিতেই পড়াশোনাকে ঘিরে যাবতীয় জিনিসের প্রতি ঝুমুরের অনেক আগ্রহ। তার ইচ্ছা যতদিন সে বেচেঁ থাকবে ততদিন শুধু পড়েই যাবে। আর সেটা যদি হয় ডাক্তারি তাহলে তো কথাই নেই। ডাক্তারদের কিছুদিন পরপরই প্রাকটিসের জন্য মেডিক্যাল বই আওড়াতে হয় যেটা ঝুমুরের আনন্দের আরেকটা কারণ।

ঝুমুর ক্লাসের প্রত্যেকটা ইম্পর্ট্যান্ট নোটস টিচার বলতেই টুকে নিয়েছে। এসব সে বাড়ি গিয়ে আরও কয়েকবার দেখবে তারপর পুরোপুরি মাথায় এটে নিবে। মেডিক্যালে চান্স পেতে হলে ইচ অ্যান্ড এভরিথিং সিরিয়াসলী নিতে হবে। কোনোকিছুই লাইটলি নিলে চলবে না। তাই ঝুমুর এখন থেকেই সব প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে। বাড়ি গিয়ে এসব আবার ল্যাপটপে সেফ করে রাখতে হবে যাতে কাজের সময় দ্রুত খুঁজে পাওয়া যায়।

কোচিংয়ের শেষে ঝুমুর যখন বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে তখন প্রায় পনে একটা বাজে। ঝুমুর একবার ঘড়ির ডায়ালে চোখ বুলিয়ে নিলো। উত্তরা থেকে হোসেন মার্কেট অব্দি আসতে তার পনে এক ঘন্টা লেগেছে শুধুমাত্র যানজটের জন্য। অথচ রাস্তা পঁচিশ মিনিটের। এই যানজটই দেশটাকে রসাতলে ডোবাচ্ছে। যানজট না থাকলে দেশের বড় একটা অংশের কার্যক্রম দীর্ঘ সময়ের জন্য থেমে যেত না। আসলে লাক ভালো নাহলে কিইবা করার থাকে।

ঝুমুর হয়তো বাংলাদেশে থাকছে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি মেনে চলছে কিন্তু বিবেক বন্ধনে সে এখনও সুদূর কোরিয়ার মানুষ। কোরিয়া তার জন্মভূমি, তার জীবনের সাতটা বছর তো সেখানেই কেটেছে। তবে এও ঠিক কোরিয়ার জায়গায় কোরিয়া আর বাংলাদেশের জায়গায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কোরিয়ার অনেককিছুই ছাপিয়ে যাবে। সেই বিছনাকান্দি, রাতারগুল আর চা বাগানের স্মৃতিগুলো ঝুমুরের মানসপটে এখনও জ্বলজ্বল করছে। মনে পড়ছে বছর দুয়েক আগে এসএসসির পর নানার বাড়ির সকলের সঙ্গে ঘুরে আসা সিলেটের চাঞ্চল্যকর স্মৃতিগুলো।

তবে স্প্রিং সিজনে কোরিয়াও অন্যরকম বেশভূষায় সেজে উঠে। তখন সিওল ভরে উঠে চেরি ব্লসমের গোলাপী আভায়। বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলোতে দেখতে পাওয়া যায় মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চেরি ব্লসম নিয়ে দাড়িয়ে থাকা গাছেদের। জ্যংদগ লাইব্রেরী থেকে সেই দৃশ্য আরও নয়নাভিরাম।

ঝুমুর বরাবরই বই পড়া নিয়ে অনেক কৌতূহলী ছিল। বই পড়ার কাজটা তার ভীষন প্রিয়। ঠিক এই কারণেই তাসনুবা আর মোতালেব সাহেব ওকে ছোট থেকেই বই পড়ার জন্য উৎসাহ দিতেন। জ্যংদগ লাইব্রেরীতেও তার আসা যাওয়া ছিল। তখন ঝুমুরের বয়সই বা কত ছিল ? বড়জোর ছয়, ঠিক তাসনুবার নিরুদ্দেশ হওয়ার এক বছর আগে। এর আগেও ঝুমুর লাইব্রেরীতে আসা যাওয়া করতো কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার বই পড়ার শুরু তো সেই বছর থেকেই। তখন সে পড়তো শিশুতোষ সাহিত্য। এখনকার মতো সব জনরার সাহিত্য সে তখন পড়তো না। আসলে যেকোনো জিনিসেরই একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। কমিকস পড়ার বয়সে সে তো আর প্রেমের উপন্যাস কিংবা সমাজের বাস্তবতা ঘিরে সমকালীন উপন্যাস পড়তে পারবে না।

ঝুমুরের স্পষ্ট মনে আছে। সেদিনও তাসনুবা তার সঙ্গে গিয়েছিলেন লাইব্রেরীতে। দুই মা মেয়ে সামনাসামনি বসে বই পড়ছিলেন। ঝুমুর আড়চোখে জানালা দিয়ে অদূরে স্বগর্বে বুক ফুলিয়ে দাড়িয়ে থাকা চেরী ব্লসম দেখছিল। তাসনুবা বলেছিলেন ওই গাছের ফুল ধরা যাবে না, এমনকি গাছের নিচেও বসা যাবে না। বসলে শাস্তি পেতে হবে। ঝুমুর সেই দিনের কথাটা আজও ভুলেনি। সেইই তো ছিল মায়ের সঙ্গে শেষবারের মতো লাইব্রেরীতে বসে সময় কাটানো আর চেরী ব্লসমের গোলাপী আভাযুক্ত ফুলগুলোর অপার সৌন্দর্য অবলোকন করার তার শেষ সময়। এরপর আরও কত বসন্ত আসলো গেলো অথচ ওর অমনি আর এলো না।

ঝুমুর ক্লান্ত পায়ে কলিং বেল টিপছে। দরজা কেউ খুলছে না আর এদিকে ঝুমুরের শক্তিও নেই এতক্ষণ দাড়িয়ে থাকার। মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করার পর সামি এসে দরজা খুলে দিল। ঝুমুর সামিকে দেখলো তবে কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না। ব্যাগ কাধে সে ধীর পায়ে বাসায় ঢুকলো। মনোয়ারা বেগম ভিতরের দিকে ছিলেন তাই কলিং বেলের আওয়াজ পাননি। আঞ্জুম আরা ছাদে গিয়েছেন কবুতরের খাবার দিতে।

মনোয়ারা বেগম ঝুমুরকে ফিরতে দেখে বললেন ‘ খাবি কয়টায় ঝুম ? ‘
‘ রুমটা সট আউট করে খাচ্ছি আপি। ‘
ঝুমুরের কথায় আর প্রতি উত্তর করলেন না মনোয়ারা। তিনি চললেন রান্নাঘরে। ঝুমুর ক্লান্ত পায়ে তার ঘরে ঢুকে ব্যাগটা স্টাডি টেবিলের উপর রাখলো। শরীরটা ক্লান্ত লাগছে হুট করে। ঝুমুর বুঝতে পারছে আস্তে আস্তে তার শরীরের স্ট্যামিনা কমে যাচ্ছে। কিন্তু কেন ? খাওয়ায় অনিয়ম করার জন্য কি ?

তবে আজ থেকে প্রপার ডায়েট মেইনটেইন করতে হবে। খাবারে আরও জোর দিতে হবে। নিয়মিত হাঁটাচলা করতে হবে। নিউট্রিশনিস্টের সঙ্গে কনসালট করা প্রয়োজন। এসব ভাবতে ভাবতেই ঝুমুর কাবার্ড খুলে জামা কাপড় নামাচ্ছিল। জামা কাপড় ছাড়া প্রয়োজন। ঝুমুর বাহির হতে এসে বেশিক্ষন ময়লা কাপড়ে থাকতে পারে না।

জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমের দিকে এগোতে গিয়ে দেখলো সামি এখনও দাড়িয়ে আছে। সামিকে আজ বহুদিন পর ভালো করে দেখলো সে। লম্বায় বেড়েছে মনে হচ্ছে। বয়স কত হবে ? সাড়ে আট মনে হয়। ঝুমুর হতে দশ বছরের ছোট। অথচ এই ছোট ছেলেই নাকি তার মুখের উপর কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছে যেটা ওর একেবারেই মনঃপুত হয়নি।

‘ কি ব্যাপার ? তোমার এখানে কি ? ‘ ঝুমুর তির্যক চোখে চেয়ে প্রশ্ন করলো। সামি আমতা আমতা করে মুখ খুললো। অসস্তিতে গাট হয়ে বললো ‘ আসলে আমি সরি বড়পী। আমি বুঝতে পারিনি কাল ওভাবে তোমাকে বলবো। আসলে তুমি মাঝে কথা বলছিলে বলে রাগ হয়েছিল। ‘

ঝুমুরের দৃষ্টি শান্ত। মুখভঙ্গি কঠোর কিনা বোঝা গেলো না। তবে গমগমে গলায় বললো ‘ আমি তোমার বড় সামি। কত বছরের বড় সেটা ম্যাটার করে না। আমি তোমার বড় মানে বড়। শুধু আমি না বাকিরাও অনেকে বড়। তোমার ভাইও বড়। কাজেই ছোট আছো ছোটর মতো থাকো। তুমি যদি ভেবে থাকো গলা চড়িয়ে চেঁচামেচি করলেই তুমি ছোট থেকে বড় হয়ে যাবে তাহলে তোমার ধারণা ভুল।

এটা ভদ্রলোকের বাড়ি তাই নিজের ডিসেন্সি আর ভয়েজ কন্ট্রোলে রাখো। কন্ট্রোললেস ইনএপ্রপ্রিয়েট মানুষদের আমি পছন্দ করিনা। কথাটা মাথায় রেখো। তোমার পজিশন বজায় রাখো। নিজেকে বড় হিসেবে প্রেজেন্ট করতে গিয়ে তোমার অবস্থান আমার চোখে নষ্ট করো না। ‘

কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো ঝুমুর। এত কথা সে কোনোকালেই বলে না। সে বরাবরই চেষ্টা করে অল্প কথায় নিজের মনোভাব বোঝাতে। এই স্বভাব তার মোতালেব সাহেব হতে পাওয়া। তিনি ছিলেন স্বল্পবাকের মানুষ। বেশি কথা তাকে কখনই বলতে দেখেনি ঝুমুর। এমনকি নিজের জানামতে সে কোনওদিন তার বাবাকে বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা ফুর্তি করতেও দেখেনি। ঠিক এই কারণেই ঝুমুরের মাঝেও ওসব নেই।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-১১
#মিফতা_তিমু

ছাদের কাজ সব মিটিয়ে ঘরে এসে বসেছিলেন আঞ্জুম আরা। দেখলেন ছেলে ঝুমুরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। তিনি চোখের ইশারায় ছেলেকে ডাকলেন। বললেন ‘ বড়পীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলি ? ‘

আঞ্জুম আরার কথায় সামিরের মুখ মলিন হয়ে গেলো। আঞ্জুম আরা তাকে পাঠিয়েছিলেন ঝুমুরের কাছে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু ঝুমুর তাকে ক্ষমা করেছি কিনা সেটা তো ও জানেই না। উল্টো ঝুমুরের কড়া কথায় ওর এখন মন খারাপ। মন খারাপের সুরে সে বলল ‘ চেয়েছিলাম কিন্তু বড়পীকে দেখে মনে হলো ওর শরীর ভালো না। বললো আমি যেন ছোটর মতোই থাকি। অযথা চেঁচামেচি করলে আমি বড় হয়ে যাবো না। আর ভাইয়ার সাথেও যেন ভালো করে কথা বলি। ‘

আঞ্জুম আরা বুঝছেন সামির কথার অর্থ। বললেন ‘ ও বুঝি এটা বলেছে ? ‘
সামি মাথা নাড়ল। আঞ্জুম আরা আবারও বললেন ‘ ঝুমুর হয়তো এসব রাগ করে বলেছে কিন্তু ওর কোনো কথাই ভুল না। তোমার ভাইয়া আর বড়পী দুজনেই তোমার বড় কিন্তু তুমি ওদের সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করেছো। তুমি জানো তোমার বড়পী চেঁচামেচি পছন্দ করে না। ও শান্ত মানুষ, ঘরে চেঁচামেচি ঝগড়াঝাঁটি হলে ওর মন খারাপ হয়। ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তাই তোমার উচিত ছিল ঘরে শৃঙ্খলতা বজায় রাখা। আশা করি ভবিষ্যতে তুমি এমন ভুল আর করবে না। ‘

সামি সবটাই মন দিয়ে শুনলো। সত্যি বলতে সে নিজেও নিজের কাজে লজ্জিত। তাফিমের সঙ্গে তো সে মেজাজ দেখিয়েছেই সঙ্গে ঝুমুরের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করেছে যেটা ঝুমুর সে ছোট বলেই বরদাস্ত করেছে। নাহলে ঝুমুরের কখনও এই জিনিসটা পছন্দ না যে কেউ তার উপর চেঁচামেচি করবে। বড় হওয়ার খাতিরে ঝুমুরই ওদের উল্টো শাসন করে অভ্যস্ত তবে সেটা গলার আওয়াজ নামিয়ে। পারতপক্ষে সে গলার আওয়াজ বড় করেনা। সেখানে ও কিনা ঝুমুরের উপর রাগ দেখিয়েছে। এরকম ভুল সে আগেও দুবার করেছে আর দুবারই ঝুমুর তাকে সাবধান করেছে। তবে কালকের ভুলটা বাড়াবাড়ি রকমের ছিল।

ঝুমুর সব ভাই বোনদের মধ্যে বড় তার উপর যথেষ্ট বুঝদার মানুষ। সেখানে ছোট ভাইয়ের তার উপর চেঁচানোর ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি। যদি ঝুমুরের কোনো ভুল থাকতো মানা যেত কিন্তু তার তো কোনো দোষই ছিল না। সে শুধু চেয়েছিল তাফিম আর সামিকে থামাতে। মনে হচ্ছে সেটাই তার ভুল ছিল। আর সেই কারণেই সামি নিজের কাজে অনুতপ্ত। সে ক্ষমা তো চেয়েছে এখন ঝুমুর ক্ষমা করলে হয়।

খেতে বসেছে সকলে। ঝুমুর তার দুপুরের ফিক্স করা খাবার খাচ্ছে। সচরাচর দুপুরে সে কম ভাত আর বেশি বেশি সবজি, তরী তরকারি খেয়ে থাকে। আজও সেই নিয়মের ব্যাঘাত ঘটেনি। ঝুমুরের আজ শরীর ভালো যাচ্ছে না বলে চামচ দিয়ে খাচ্ছে। বাংলাদেশের খাবার এমন ধরনের যে ঝুমুর চপস্টিক দিয়ে খেতেও পারবেনা।

ঝুমুর তখন নীরবে খেতে ব্যস্ত। ওর খাওয়ার মাঝেই মনোয়ারা জানালেন কাল তাদের এক বিয়ের দাওয়াত আছে। মনোয়ারা বেগমের ভাতিজির ছেলের বিয়ে। সেখানেই তারা চলে যাবেন দুপুরের দিকে। ফিরবেন পরশু বিকেলের পর। তো ঝুমুর কি পারবে বাসায় থাকতে ?

ঝুমুর মন দিয়ে শুনলো মনোয়ারা বেগমের কথা। আজমাঈন সাহেবও স্ত্রীয়ের বক্তব্য শুনলেন। কিন্তু ঝুমুর কিছু বলার আগে নিজেই বললেন ‘ ঝুমুরের একা ঘরে থাকার প্রয়োজন নেই। তার থেকে ও হৈমন্তীদের ওখানে যাক। একা থাকাটা রিস্কি। ‘

আজমাঈন সাহেবের কথা শুনে ঝুমুরের চোখ দুটো যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। বলা ভালো সে আতকে উঠেছে। হৈমন্তীদের ওখানে থাকা মানে ওর ওই ডাক্তার ভাইয়ের খোঁচা মারা কথা শোনা। অসম্ভব, এটা সম্ভবই না। কিছুতেই যাওয়া যাবে না ওখানে। নানুকে তার বোঝাতে হবে।

কিন্তু এবারও ঝুমুর কিছু বলার সুযোগ পেলো না। তার আগেই আঞ্জুম আরা বললেন ‘ কিন্তু আব্বা ওই বাসায় তো হৈমন্তীর বড় ভাইও থাকে। ছেলে অবিবাহিত। ওখানে কি আমাদের ঝুমুরকে রাখা ঠিক হবে ? ‘

ঝুমুর আঞ্জুম আরার কথায় সায় দেওয়ার ভান করলো। মুখে কিছু বলল না কিন্তু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে সেও এগ্রী করছে এই কথায়। কিন্তু এ কথা সেও জানে আঞ্জুম আরা যেমনটা ভাবছেন ফাহমান মোটেই সেরকম নয়। হয়তো সে সময় অসময়ে ঝুমুরকে খোঁচা মেরে কথা বলে কিন্তু মানুষ হিসেবে ভালো। খারাপ হলে ঝুমুরই আগে টের পেত কারণ বয়স অল্প হলেও তার নিজস্ব এক অভিজ্ঞতা আর মেয়েলি সিক্সথ সেন্স দুটোই আছে।

আঞ্জুম আরার কথার বিপরীতে মনোয়ারা বেগম বললেন ‘ ফাহমান সারাদিন বাসায় থাকে না আঞ্জুম। সে ফেরে রাত বিরাতে। ঝুমুরের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার নিশ্চয়তাই কম। আর ফাহমানকে আমি তুমি অপেক্ষা বেশি চিনি। ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ পুরনো সময়ের। ‘

শাশুড়ির কথায় আর পাল্টা কিছু বলার সাহস পেলেন না আঞ্জুম আরা। এমনিতেই শাশুড়ি তাকে বিশেষ পছন্দ করেন না। তার উপর আরও কিছু বললে রেগে গিয়ে কড়া কথা শোনাবেন বাচ্চাদের সামনে। ঝুমুর বড় আর ম্যাচিওর কিন্তু তার ছেলেরা তো আর অতশত বুঝে না। তারা তো এটাই দেখবে তাদের দাদু তাদের আম্মুকে বকছে। তাই তিনি আর কথা বাড়ালেন না।

এরপর আর কি!! আজমাঈন সাহেব ঠিক করলেন ঝুমুর কাল বিকাল অব্দি এই বাড়িতেই থাকবে। সন্ধ্যার দিকে হৈমন্তীদের বাড়ি চলে যাবে আর রাতে সেখানেই ঘুমাবে। ঝুমুরও না পারতে মেনে নিল। তাছাড়া কথা তো ভুল নয়। ওই অসভ্য, অভদ্র ছেলে তো সারাদিন হসপিটালেই থাকে। শুধু রাতের সময়টাতে বাসায় থাকে যেটা খুব সহজেই ঝুমুরের জন্য ম্যানেজেবল।

মনোয়ারা বেগম ফোন করেছিলেন মারিয়ামকে। জানিয়েছেন কালকে রাতে ঝুমুর তাদের বাড়িতেই থাকবে, সন্ধ্যার দিকে ওই বাড়িতে যাবে সে। খবর পেয়ে খুশি হয়েছেন মারিয়াম। স্বাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ঝুমুরকে। সস্তি পেয়ে ফোন রাখলেন মনোয়ারা বেগম। ঝুমুরকে জানালেন মারিয়ামের সঙ্গে তার কথা হয়ে গেছে। ঝুমুর প্রতি উত্তরে কিছু বললো না।

ঝুমুর বিকেলে চা নিয়ে ছাদে পায়চারি করছিল। হৈমন্তীও উঠে এসেছে ছাদে। ঝুমুরকে দেখে ছাদের কিনারে এগিয়ে এলো। হাসি খুশি গলায় বললো ‘ কতদিন পর কাল তুই আমাদের বাড়িতে আসছিস। আমার তো ভাবলেই খুশি লাগছে। ‘
ঝুমুর শুনলো হৈমন্তীর কথা। মনে মনে বললো ‘ তুই তো আছিস তোর আনন্দ নিয়ে এদিকে তোর ভাই মহাশয় যে আমাকে জালিয়ে খায় সেটা আর কেউ দেখে না। ‘

হৈমন্তী ঝুমুরকে দেখছিল। ঝুমুরের মুখভঙ্গি দেখে ওর মনে হলো ঝুমুর কিছু একটা বললো। ও বললো ‘ কিছু বললি নাকি ? ‘
ঝুমুর অন্যমনস্ক ছিল। সে গভীর চিন্তা ভাবনা করার মানুষ। সুযোগ পেলেই ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে যায়। কাজেই ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটতেই হকচকিয়ে উঠলো। ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে বললো ‘ না…না কি বলবো ? কিছু বলিনি।’

হৈমন্তী ব্যাপারটা আর ঘাটালো না। নিজের মনের ভুল ভেবে কথার ঝুলি খুলে বসলো। জানালো কাল থেকে তারও কোচিং শুরু। তাকে যেতে হবে ধানমন্ডি কোচিং করতে। এখন থেকে তারও ব্যস্ততম দিন কাটবে। দুদন্ড বসে কথা বলার সুযোগ হবে না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে খাওয়া, ঘুম ছাড়া বাকি সময় শুধুই পড়া নিয়ে থাকতে হবে।

হৈমন্তীর কথা শুনলো ঝুমুর। হৈমন্তী সারাবছর পড়াশোনা করে না সিরিয়াসভাবে। পরীক্ষার আগে দিয়ে দুমছে লাগে। তার কথা হলো সে যদি পরীক্ষার আগে দিয়ে পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করতে পারে তাহলে সারাবছর পড়ে নিজের মজা নষ্ট করার তো প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে ঝুমুর আবার অন্য ধরনের। তার কাছে পড়াশোনা জিনিসটাই মজার। সে যেকোনো ধরনের জিনিস পড়ে মন দিয়ে, আগ্রহ নিয়ে। একাডেমিক হোক কিংবা নন একাডেমিক দুটোর প্রতিই তার অনেক আগ্রহ। গোটা পড়াশোনা জিনিসটাই ঝুমুরের খুব পছন্দ।

ঝুমুরের বেশিরভাগ সময় কাটে বই পড়ে, পড়াশোনা করে, তার নিজ হাতে গড়া বাগিচায় সময় কাটিয়ে এবং টুকটাক ঘরের কাজ করতে করতে। আর হ্যা সকালবেলার এক ঘণ্টা এক্সারসাইজও তার রুটিনের মধ্যে আছে। সে প্রানান্তর চেষ্টা করে যাতে তার ওই এক্সারসাইজ স্কিপ না হয়। এছাড়াও ঘর থেকে বেরিয়ে কোথাও গেলে সম্ভব হলে সে পায়ে হেঁটেই যায় যদি দূরত্ব সেরকম হয়। এতে পা চালানোর প্রাকটিস থাকে।

ঝুমুর যেমন ধরনের তাতে হৈমন্তীর মতো টো টো করে ঘোরার সময় কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই নেই তার। সে সবসময় নিজেকে ব্যস্ত রাখাই পছন্দ করে। কখনও সেটা বইয়ের ভাজে তো কখনো বাগানের শুভ্র ফুলদের ভিড়ে তো কখনো আবার সাংসারিক কাজের মাঝে। লাইফ ইজ অল এবাউট এভরিথিং। এই দুর্মূল্যের দুনিয়ায় টিকতে হলে সবকিছুর অভিজ্ঞতাই থাকতে হবে। সব কাজে এক্সপেরিয়েন্সড হওয়া তো আর অসম্মানের কিছু নয়। বরং স্কিলফুল হলে লোকে আরও বাহবা দেয়, সম্মান করে।

ঝুমুর হৈমন্তীর সঙ্গে বিকেলের বার্তালাপ সেরে নিচে নেমে এলো। বিকেলে সে তেমন একটা স্নাক্স প্রেফার করে না। তাকে যদি খাদ্যভিলাষী বলা হয় তবে বড়ই অন্যায় করা হবে। সে নিতান্তই নিজেকে সুস্থ রাখতে প্রয়োজনীয় খাওয়া দাওয়া করে। নাহলে খাবারের প্রতি তার অনেক অরুচি। বরং খাবার খাওয়ার পিছনে সময় নষ্ট না করে সেই সময়টুকু নিজের ঘরের বুকশেলফ গোছানোর কাজে ব্যয় করতে পারলে ঝুমুর বরং খুশি হবে।

ঝুমুর আনুষঙ্গিক ঝক্কি ঝামেলা মিটিয়ে ঘরের দরজা দিয়ে বই খাতা নিয়ে বসলো। আপাতত তার ঘরের বাহিরে ডোন্ট ডিস্টার্ব মি লেখা সাইন বোর্ড ঝুলছে। কাজেই তাকে এখন কেউ জালাতে আসছে না। ঝুমুর কানে নয়েস ক্যানসেলেশন এয়ার বাড গুঁজে দিয়ে কোচিংয়ের নোটগুলো খুলে বসলো। শ্রবণ ইন্দ্রিয় জেগে উঠেছে তখন মেডিক্যাল সম্পর্কিত কিছু টপিকের উপর বিস্তারিত আলোচনা শুনে।

পড়া শেষ করে খেয়ে দেয়ে শুতে শুতে ঝুমুরের রাত এগারোটা বাজলো। দিন এত ছোট হয়েছে যে কোনদিক দিয়ে কখন গড়িয়ে যায় সেটাই বুঝে উঠতে পারে না। যেই ও দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস সেই ওই পড়াশোনা মিটিয়ে শুতে শুতে রাত এগারোটা বাজিয়ে ফেলে। আর শীতের রাতে রাত এগারোটা নেহাতই মধ্যরাত।

বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঝুমুরের দু চোখ জুড়ে ঘুম নামলো। সে ডুবে গেলো নিদ্রার অতল সাগরে। ঘুম যখন ভাঙলো তখন কাক ডাকা ভোর। ঝুমুর বিছানা গুছিয়ে নিলো। বাথরুমে গিয়ে চোখমুখ ধুয়ে এলো। চুলায় চা বসিয়ে দিয়ে হাই দিতে দিতে পুরো ঘরময় পায়চারি করলো ঘুম কাটানোর জন্য। এরপর চা হতেই কাপে চা ঢেলে ঝুমুর চললো বাগানের দিকে।

ঝুমুরের পরনে লং টি শার্ট আর ট্রাউজার। গলায় জড়ানো স্কার্ফ। আজ ঝুমুরকে বাগানে কিছু কাজ করতে হবে বলেই সকালের এক্সারসাইজ পিরিয়ড স্কিপ করতে হবে। সেটা নাহয় সকালের জায়গায় বিকেলে করে নিবে।

নতুন আনা গাছগুলো টব হতে সরিয়ে মাটিতে পুঁতে দেওয়া প্রয়োজন। ওগুলো এখন মাটিতে পুঁতে দেওয়ার বয়স পেরিয়েছে। কাজেই এখন না পুঁতে দেওয়া হলে আর সুযোগ হবে না। ঝুমুর বাগানে পায়চারি করতে করতে সময় নিয়ে আকন্ঠ ভরে চা পান করলো। তারপর কাপটা বাগানের উডেন শেলফের উপর রেখে কাজে নেমে পড়লো।

যদিও কোনো মানুষই নিজের বানানো কিছু পছন্দ করে না তবে ঝুমুর খানিকটা ব্যতিক্রম। তার অন্যদের অপেক্ষা নিজের বানানো আদা চাই পছন্দ। আঞ্জুম আরাও চা বানান কিন্তু তাতে উনি এলাচ দারচিনিসহ আরও কি কি যেন দেন যেগুলো ঝুমুরের পছন্দ নয়। সে চা খায় আদা আর আস্ত গোল মরিচ দিয়ে। ওই দুটো জিনিসই তার জন্য যথেষ্ট। তার তো লেবুরও প্রয়োজন পড়ে না।

কিছু কিছু মানুষ থাকে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত চমকপ্রদ সব গুনে গুণান্বিত। তাদের হেন কোনো গুণ নেই যাতে লোকে মুগ্ধ না হয়ে পারে না। ঝুমুর তাদেরই একজন। তার সবথেকে বড় গুণ হলো সে ভালোবেসে নিজের এবং কাছের মানুষদের জন্য সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে সুগন্ধি তৈরি করে। ঝুমুর একবার হৈমন্তীকে তার জন্মদিনে নিজ হাতে বানানো ল্যাভেন্ডার পারফিউম উপহারস্বরূপ দিয়েছিল। অবশ্য এর জন্য ওকে বেশ বড় রকমের খেসারত দিতে হয়েছে।

বাংলাদেশের দূর্লভ এক ধরনের পুষ্প বৃক্ষ হলো ল্যাভেন্ডার। ল্যাভেন্ডার দিয়ে প্রাণপ্রিয় সখীর জন্য পারফিউম তৈরি করতে ঝুমুরকে তার প্রিয় হোম রুম ল্যাভেন্ডার প্লান্ট ব্যবহার করতে হয়েছে। যদিও মিনি সেই প্লান্ট তার খুব প্রিয় ছিল কিন্তু বান্ধবীর মুখে সেই এক টুকরো হাসি দেখার জন্য সে অতটুকু করতেও রাজি ছিল। তার সেই ত্যাগের সুমিষ্ট ফলও পেয়েছে সে। উপহার পেয়ে হৈমন্তীর চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এতটা খুশি সে আগে কখনো হয়নি।

এরপর ঝুমুর আরও দুটো মিনি ল্যাভেন্ডার প্ল্যান্ট কিনেছে। সেগুলো এখন শোভা পাচ্ছে তার ঘরের শুভ্র সফেদ জানালার ধারে। বর্ষার মৌসুমে দুই পাল্লার খিড়কির ওপারে যখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি আছড়ে পড়ে তখন সেই স্বর্গীয় পরিবেশে ল্যাভেন্ডার মিনি প্ল্যান্টও যেন হেসে উঠে। নয়ন ভরে দেখতে দেখতে একসময় সেও বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুলের মতো অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে। কি অনিন্দ্য সুন্দর সেই দৃশ্য!!

ঝুমুরের প্রিয় ফুলেদের মধ্যে ল্যাভেন্ডার আর ম্যাগনোলিয়া শীর্ষে থাকলেও ঝুমুরের প্রিয় সুগন্ধি এই ফ্রেগ্রেন্স নয়। ঝুমুর লেমন ফ্রেগগ্রেন্সের অনেক বড় ভক্ত। নিজ বাগিচার লেমন ট্রি হতেই এই সুগন্ধি তৈরী করে সে। তার দিনপঞ্জি ভাজে ভাজেও লেমন লিফের উপস্থিতি। ঝুমুর এতটাই ভক্ত সেই মন মাতানো সুবাসের যে তার আশেপাশে থাকলেও সমীরণে অনুভব করা যায় লেমনের মিষ্টি তীব্রতা।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে