#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-৬
#মিফতা_তিমু
কোচিংয়ের এডমিশনের ঝামেলা মিটিয়ে হোসেন মার্কেটের উদ্দেশ্যে বাস ধরেছিল ঝুমুর। সেই যাত্রার অবসান হতেই আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি নামলো। ঝুমুর দ্রুত ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মাথায় ধরলো। তারপর ছাতা হাতে একটু ভিতরের দিকে গিয়ে দাঁড়ালো। এখন রিকশার জন্য দাড়িয়ে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে।
বৃষ্টি জিনিসটা ঝুমুরের মোটেও পছন্দ নয়। পছন্দ হতো যদি দেশটা বাংলাদেশের জায়গায় কোরিয়া হতো। কোরিয়া পরিষ্কার ঝকঝকে দেশ। সেখানে বৃষ্টি হয় ঝিরঝির করে আর রাস্তাগুলো বৃষ্টির পর চকচক করে। অথচ বাংলাদেশে হয় তার উল্টো। যখন নামে তখন দুই তিন ঘণ্টা অবিরাম ঝরে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই নামে। উপরন্তু সঙ্গে রাস্তাও হয়ে পরে কাদায় চিটচিটে।
তো এহেন সময় ঝুমুর যখন বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে রিকশা খুঁজতে ব্যস্ত তখনই সে দেখলো একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে সামনে। মাথার উপর ছাতা নেই তাই পুরোই বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু অবস্থা। নির্ঘাত আজ এই লোকের জ্বর উঠবে। অথচ লোকটাকে দেখো। কি সুন্দর দাড়িয়ে লম্বা লম্বা হাত দুটো দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে এই বিরক্তিকর বৃষ্টি উপভোগ করছে। নির্ঘাত এই মানুষ প্রকৃতি প্রেমী নাহলে সাধারণ কোনো মানুষ বৃষ্টিতে দাড়িয়ে ভেজা পছন্দ করে না।
ঝুমুরও প্রকৃতি প্রেমী তবে তার পছন্দ টিপ টিপ বৃষ্টি। এমন ঝুমঝুম করা বৃষ্টি তার মোটেই পছন্দ নয়। এরকম বৃষ্টিতে কোনো রোমান্টিকতা নেই। শুধু মনে হয় এই বৃষ্টির আগমনই হয়েছে গায়ে জ্বর লাগিয়ে শরীরে কাপন ধরানোর জন্য। ঝুমুর বিরক্তিকর নিশ্বাস ফেললো। বুঝতে পারলো না ছেলেটাকে কি সাহায্য করবে কি না করবে। অপরিচিত একটা মানুষ অথচ মানবতার খাতিরে করা উচিত। বিবেক বুদ্ধির সাথে লড়াই করে মানবতার হাত জিতিয়ে দিয়ে ঝুমুর ছাতা হাতে এগিয়ে গিয়ে দাড়ালো ছেলেটার পাশে। ছাতাটা ধরলো ছেলেটার মাথায়।
ফাহমান মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টিতে ভিজছিল। আজ অনেকগুলো দিন পর বৃষ্টির দেখা পেয়েছে সে। এতদিন তার বড্ড মনে পড়েছে এই বর্ষাকে। বৃষ্টি যে তার বড্ড পছন্দ। বিশেষ করে অনিমন্ত্রিত এই ঝুম বৃষ্টি একটু বেশিই পছন্দ। এমন বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে তার। মনে হয় ভিজেও আনন্দ। তবে মারিয়াম তার এই বৃষ্টিতে ভেজা পছন্দ করেন না। জানেন ছেলে বৃষ্টিতে ভিজলেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই সবসময় এই ব্যাপারে সতর্ক হয়ে থাকেন।
ফাহমান চোখ বুজে বৃষ্টির ফোঁটা অনুভব করতে করতেই লক্ষ্য করলো তার গায়ে এখন আর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে না। সে অবাক ভঙ্গিতে তাকালো মাথার উপরে। দেখলো কেউ একজন মাথায় ছাতা ধরে আছে। এবার সে ছাতার মালিককে পাশ ফিরে দেখলো। তার দৃষ্টি থমকেছে, নিশ্বাসে ভাটা পড়তে চলেছে অথচ বিকার নেই সামনে দাড়িয়ে থাকা পাষাণ নারীর। সে ফাহমানের দিকে তার কাজল চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে আছে। ফাহমানের বিশ্বাস হচ্ছে না তার সামনে দাড়িয়ে আছে সেই বাগান রানী যাকে আজ ও সকালে দেখেছিল।
ঝুমুর দেখলো ছেলেটা কেমন হাভাতের মতো তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দৃষ্টিতে মুগ্ধতা আর ঠোঁটের কোলে সূক্ষ্ম হাসি। এই ছেলের কোনো জ্ঞান নেই। কিছু একটা পেলেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকবে বা অনুভব করবে। ঝুমুর বললো ‘ এই যে সাহেব ছাতাটা ধরুন ‘।
ফাহমান চমকে গেলো। বড় বড় চোখ করে অনিমেষ তাকালো এবার ঝুমুরের দিকে। ঝুমুর ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো ‘ এভাবে তাকিয়ে না থেকে ছাতাটা ধরুন। আপনি তো দেখি ভারী অদ্ভুত। মানুষ বৃষ্টি হলে কি করে মাথা বাঁচিয়ে বাড়ি ছুটবে সেটা ভাবে আর আপনি বৃষ্টিতে ইচ্ছে করে ভিজছেন। ‘
কথা বলতে বলতেই ঝুমুর লক্ষ্য করলো ছেলেটা এখনও তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়েই আছে। বড় বড় চোখ দুটো যেন না বলা অনেক কথা বলছে তাকে। ছেলেটা দেখতে আহামরি কিছু নয়। শুধু চেহারাটাই সুদর্শন বাদ বাকি ড্রেসিং সেন্স থেকে পরনে থাকা সবকিছুই সাধারণ। তবুও তার মুখে আছে এক পৃথিবী সমান সরলতা আর মুগ্ধতা। সরল চেহারায় ফুটে উঠেছে তার বিস্ময় ভাব।
ছেলেটার দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলো না ঝুমুর। সে বিচক্ষণ, অচেনা এই ছেলের দিকে এক মনে বোকার মতো তাকিয়ে থেকে নিজের অনুভূতিদের নাড়িয়ে দেওয়ার কোনো মানেই হয়না এটা তারও জানা। তাছাড়াও ছেলেটার ওই গোল গোল চোখ দুটোয় বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকার সাধ্যও তার নেই। তাই সে বললো ‘ ছাতাটা ধরুন আর দ্রুত বাড়ি যান। এই আবহাওয়ায় বেশিক্ষন দাড়িয়ে থাকলে সর্দিকাশি লাগিয়ে বসবেন। ‘
কথাটা বলেই ঝুমুর সামনে হাঁটা দিল। ফাহমান ওকে হাঁটতে দেখে যেখানে দাড়িয়েছিল সেখান থেকেই বললো ‘ আর তোমার এই ছাতাটা ? এটা কিভাবে ফেরত দিবো ? ‘
ঝুমুর রিকশায় উঠে বসেছিল। হেসে রিকশা থেকে মুখ বাড়িয়ে বললো ‘ ওটা রেখে দিন আপনার কাছে। কোনওদিন আবার দেখা হলে নাহয় দিবেন। ‘
ফাহমান দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঝুমুরের রিকশায় করে চলে যাওয়া দেখলো। রিকশার বাহিরে খানিকটা বেরিয়ে আছে ঝুমুরের সাদা ওড়না। তা ভিজে একাকার। ফাহমানের মনে অনুভূতিদের দোলাচল। কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না সে। শুধু এটা বুঝতে পারছে এই ঝুম বর্ষায় বাগান রানী যেতে যেতে তার মনও হরণ করে নিয়ে গেছে। সে সাধারণ মানুষ নয়, মনোহরিনী সে।
বাসায় ঢুকে প্রশ্নের মুখোমুখি হলো ঝুমুর। মনোয়ারা বেগম রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন ছাতা নেওয়ার পরও কি করে সে ভিজে গেলো। উত্তরে ঝুমুর বলেছিল ছাতা হারিয়ে গেছে। এরপর আর কিছু বলেননি মনোয়ারা। ঝুমুর সস্তির নিশ্বাস ফেলে ঘরে এসে ঢুকলো। যাক বেশি প্রশ্ন করা হয়নি তাকে।
জামা কাপড় বদলে গোসল করে ঝুমুর কফি নিয়ে বসেছিল বারান্দায়। কোচিংয়ের কাজ আজ সব মিটিয়ে এসেছে সে। দুই দিন পর থেকে কোচিং। এই কদিনের ছুটি কত তাড়াতাড়িই না ফুরিয়ে যায়। সময় বয়ে চলে চোখের পলকে। জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে করতে পথিক ক্লান্ত হয়ে যায় তবুও সময় থমকে দাঁড়ায় না। সে নিরন্তর চলতে থাকে তার মতো।
ঝুমুরের বারান্দার মুখোমুখি যেই বারান্দা সেটা হৈমন্তীর বড় ভাইয়ের। ও নাম শুনেছিল তার। ফাহমান মনে হয়। তার মধ্যে যে খানিক সৌখিন সৌখিন ভাব আছে সে বারান্দা দেখলেই বোঝা যায়। বারান্দার গ্রিল জুড়ে আর্টিফিসিয়াল লিফ লাগানো। কোণায় ঝুলছে দু চারটে মিনি প্ল্যান্ট আর আরেক কোণায় একটা খাঁচা। সেই খাঁচায় আছে এক জোড়া বাজরিগার পাখি। পাখি দুটোর একটা হলুদ আর আরেকটা নীল। দেখে বোঝা যায়না কোনটা মেয়ে আর কোনটা ছেলে।
—-
ছাদে দাঁড়িয়ে দূর দূরান্তে যতদূর চোখ যাচ্ছে তত দূর নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে ঝুমুর। শরীরে জড়ানো মোটা জ্যাকেট। বাতাবরণ দেখে মনে হচ্ছে আজ নিশ্চই অনেক ঠান্ডা পড়বে। তাপমাত্রা এখন কত হবে ? ১৭° বা ১৮°। বাংলাদেশের পরিবেশে যারা অভ্যস্ত তাদের জন্য নেহাতই অনেক ঠান্ডা। ঝুমুরেরও অনেক ঠান্ডা লাগছে। তাই ছাদে আসবার আগে গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে এসেছে।
একটু আগের বর্ষণমুখর আকাশটা এখন ঝা চকচকে। দেখে মনে হচ্ছে না ঘন্টা দুয়েক আগেও মেঘেরা গর্জন করছিলো। যদিও এখনও কিছুটা মেঘমন্ত ভাব আছে কিন্তু সবটাই শীতের প্রভাব। শীতের সময় পরিবেশ তো একটু কুয়াশাচ্ছন্ন থাকবেই।
রোজ বিকেলে সুযোগ পেলেই ছাদে চলে আসা ঝুমুরের এক প্রকার অভ্যাস। এই অভ্যাস সে চাইলেও ছুটাতে পারে না। তাইতো শীতকালেও তাকে বিকেলে এসে হাজির হতে হয় ছাদে। এটা তার নিত্য দিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যদি কোনোদিন ঝুমুর এই ছাদে আসার ব্যাপারটা না ঘটায় সেদিনই রাতে তার ঘুম হয়না। তাই এর থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই।
‘ কি এত ভাবছিস রে ? ‘
ঝুমুর ভাবনার মাঝেই হৈমন্তীর গলা পেলো। হৈমন্তী দাড়িয়ে আছে ওদের বাড়ির ছাদে। ঝুমুর ওকে দেখে বললো ‘ তুই কখন এলি ? ‘
‘ আমি তো মাত্র এলাম কিন্তু তুই কি ভাবছিলি ? দেখে মনে হচ্ছে ভাবতে ভাবতে হারিয়ে গেছিস। ‘
‘ আহামরি কিছু নয়। ভাবছিলাম কোচিংয়ের জন্য বই কেনা প্রয়োজন। এখন নীলক্ষেতে গিয়ে কেনার সুযোগ নেই। তাই এখানেই পুরনো লাইব্রেরীতে খোঁজ করতে হবে। এখন তোকে বলবো কি বলবো না সেটাই ভাবছিলাম। তুই বই কিনবি নাকি ? ‘ ঝুমুর ইনিয়ে বিনিয়ে বললো।
‘ এত ভাবাভাবির কি আছে ? আমি এটাই বুঝিনা তুই কিছু হলেই এত ডিপলি চিন্তা করতে বসে যাস কেন ? তোর প্রয়োজন হলে আমাকে বলবি। আমি ম্যানেজ করতে পারলে যাবো আর না পারলেও যাবো। ‘ হৈমন্তী সরু চোখে বললো।
জবাবে আর কিছু বললো না ঝুমুর। তার জানা আছে সে এখন কিছু বললেই হৈমন্তী বলবে সে সবকিছুতে বাড়াবাড়ি করে, বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে এত হেসিটেশন কিসের। কিন্তু সে এটা বোঝে না বন্ধু বান্ধব আর নিজের ব্যক্তিগত জীবন আলাদা। সেই ব্যক্তিগত জীবনে কারোরই ঢুকে পড়া উচিৎ নয়।
‘ ভাবছি আজ ভেজিটেবল স্যুপটা বানাবো। তাফিমকে দিয়ে তোর কাছে পাঠাবো নী। ‘
ঝুমুরের কথায় হৈমন্তীর খুশি যেন বাঁধ মানে না। ঝুমুর বয়সে ছোট হলে কি হবে। ইন্টারনেটের বদৌলতে সে মোটামুটি অনেক ধরনের রান্নাই পারে। তবে দেশী রান্না অপেক্ষা তার হাতের বিদেশি রান্নাই বেশি মজার হয়। ক্যাডেট কলেজের ছুটিছাটায় যা শিখেছিল আর কি। সুযোগ তো তেমন হয়নি। বহু দিন রান্নাও করা হয়না। কে জানে রান্নার কি অবস্থা হবে।
—-
আজমাঈন সাহেব নাস্তা খেতে বসেছেন। আর কেউ খাক না খাক তার অন্তত রোজ সন্ধ্যার নাস্তা খেতে হয়। তিনি আবার ডায়েবেটিস রোগী। তাই তাকে চলতে হয় নিয়ম মেনে। আজমাঈন সাহেব খাঁটি বাঙালি মানুষ। ওসব বিদেশি খানা তার জন্য নয়। এসব থেকে তিনি শত হাত দূরে। তবে ঝুমুরের তৈরি স্যুপ তার খুবই পছন্দের একটা জিনিস। যেমন স্বাদ তেমনই স্বাস্থ্যকর।
আজমাঈন সাহেব স্যুপ খেয়ে সস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ঝুমুর তখন কোমরে আঁচল বেধে পাশেই দাড়িয়েছিল। সে জিজ্ঞেস করলো ‘ আরও দেবো তোমাকে ? ‘
‘ নারে আর দিস না। বয়স হচ্ছে, তোর হাতের রান্না এত খেলে তুই যখন আর কাছে থাকবি না তখন খেতে ইচ্ছা করলে কে করে খাওয়াবে ? ‘ আজমাঈন সাহেব ঝুমুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন।
‘ কেন ও কোথায় যাবে আব্বা ? ‘ আঞ্জুম আরা এটো বাটিগুলো একসঙ্গে করে বললেন।
আজমাঈন সাহেব বললেন ‘ বুঝলে না ? ও তো বড় হচ্ছে। একদিন না একদিন বিয়ে তো হবেই। আমি আমার নাতনিকে বিয়ে দিবো শিক্ষিত, ধনী পরিবারে যেখানে আমার ঝুমের কোনো কষ্ট করতে হবে না। ‘
এবার ঝুমুর কথা না বলে থাকতে পারলো না। সে সাধারণত এসব ব্যাপারে নাক গলায় না। বিয়ে নিয়ে তার আলাদা কোনো শখ আহ্লাদ নেই। কিন্তু ধনী পরিবারে বিয়ে হলেই যে সে সুখী হবে এমনটা আজমাঈন সাহেব ভুল ভাবছেন। তার ধারণা ভাঙ্গা প্রয়োজন।
‘ ধনী ঘরে বিয়ে হলেই সুখী হওয়া যায় না নানু। আমার বান্ধবী টাপুর, ওর বিয়ে হয়েছে এক বছর আগে, সেশনের আগেই। পরিবার বিরাট ধনী অথচ মনুষ্যত্ব নেই। টাপুরকে দিয়ে কামলা খাটনি খাটায় আর মানুষ হিসেবে তো ধরেই না। বেলা শেষে সবার খাওয়া দাওয়া হওয়ার পর যতটুকু খাবার বাঁচে সেগুলোই খায়। এই বিয়ে জিনিসটা না ভাগ্যের ব্যাপার।কথাটা মনুষত্বের, অর্থ বিত্তে তৈরি করা সামাজিক মর্যাদার না। ‘
আজমাঈন সাহেব ঝুমুরের কথায় হাসলেন। বললেন ‘ ঠিকাছে তোকে বেছে বেছে একটা মানুষের মতো মানুষের কাছে তুলে দিবো যে তোর যত্ন করতে পারবে। আমি আজমাঈন মোসহাব, আমার নাতনী ঝুমুরকে ভালো মানুষের হাতেই তুলে দিবো। এটা আমার প্রমিজ। হয়েছে ? ‘
ঝুমুর নিঃশব্দে মাথা নেড়ে হাসলো। আঞ্জুম আরার কাছে এটো থালা বাসন ধোয়ার দায়িত্ব দিয়ে সে গেলো চুলার কাছে। চুলা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। আঞ্জুম আরা রান্নাবান্না ভালো করতে পারেন। তবে তিনি তেমন সংসারী নন। জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা, পরিষ্কার রাখা এসব পারেন না তিনি। বলা ভালো পারেন না নয় করেন না।
এতকাল মনোয়ারা বেগমই ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে এসেছেন। তারই টুকিটাকি পরিষ্কার করতে হয়েছে। এর জন্য তার আফসোসের শেষ নেই। ছেলের বউ আছে অথচ এসব তারই করতে হয়। আঞ্জুম আরা গ্রামের মেয়ে আর গ্রামের মেয়েরা আরও বেশি কাজেকর্মে পটু থাকে অথচ আঞ্জুম আরা এসব কিছুই জানেন না। এ নিয়েই মূলত তার আফসোস।
তবে এখন ঝুমুরও সঙ্গে সাহায্য করে। সে ছোট থেকে দেখে এসেছে ঘর সামলানোর প্রতি আঞ্জুম আরার উদাসীনতা। ঠিক উদাসীনতাও কিনা বলা যায়। তিনি ঘর গুছিয়ে, পরিষ্কার করে রাখতে জানেন না। সবাই যে একই রকম হবে তাতো নয়। কেউ কেউ আছেন একটু অগোছালো।
ঝুমুর চুলার স্ট্যান্ডগুলো সরিয়ে মাজুনি দিয়ে ঘষে ময়লা তুললো। ঘষতে ঘষতে ওর হাতের চামড়া উঠে যাচ্ছে। ঝুমুর তার হোস্টেল দিনগুলোতে নিজের রুম গুছিয়ে, পরিষ্কার করে রাখতো নিয়মিত। সে ভীষন পরিষ্কার ধরনের মানুষ। ঘর নোংরা পছন্দ নয়। তাই নিজের হোক কিংবা রুমমেটের সাইড। সে যখন গুছিয়ে রাখে তখন পুরো ঘরটাই গুছিয়ে রাখে।
ঝুমুরের রুমমেট ছিল শ্যামলী। নামটা একটু অদ্ভুত, সে গায়ের রং শ্যামলা বলেই কিনা। তবে সে ছিল অগোছালো ধরনের। তাই ঝুমুর তার সবকিছুই গুছিয়ে রাখত। তবে শ্যামলীর জামা কাপড় গুছিয়ে সে জায়গামতো রাখতো না। ওসব শ্যামলী নিজেই করতো। এমন কি ঝুমুর শ্যামলীর নিজস্বতা ক্ষুণ্ণ হবে এমন কোনো কাজও করতো না।
ঝুমুর অন্যরকম। সারাদিন ঘরের কাজ নিয়ে থাকতে ওর ভালো লাগে। নিজের মায়া মমতা দিয়ে ছোট সংসারটা সাজাতে ভালো লাগে তার। এসব সে তাসনুবা হতে পেয়েছে। তিনিও এমনই ছিলেন। নিজ হাতে সবটা সাজাতেন, গুছাতেন আর পরিষ্কার করতেন। তিনি ছিলেন সৌখিনও।
ঝুমুরও সেই গুণ পেয়েছে। তার রুমে মিনি বুকশেলফের উপর সাজানো শোপিস আছে। রুম ডেকোরেটও করেছে সে নিজের পছন্দে। ঝুমুরের রুমে ঢুকতেই যে বড় দেওয়াল তার মাঝ বরাবর রাখা এক শৈল্পিক চিত্র। রুমের চারদিকে ছোট ছোট হলদে রংয়ের রুম ডেকোরেশন লাইট আছে। বুকশেলফের কাছের জায়গাটায় আলাদা হলদে আলোর ল্যাম্পশেড আছে। ওই ল্যাম্পশেডের পাশেই রাখা আছে এক অর্ধ গোলাকার উডেন লবি চেয়ার যেখানে সাধারণত ঝুমুর বসে বই পড়ে।
আছে এক থ্রী ইন ওয়ান বুকশেলফ যেটা ঝুমুরের নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করা। বুকশেলফটা দেখতে তিন পাল্লার আলমারির মতো। শুধু দরজা খোলার বিপরীতে বইয়ের লম্বাটে পাল্লাগুলো টেনে খুলতে হয়। এই বুকশেলফের আইডিয়া ঝুমুরের নিজের বললে ভুল হবে। এটা সে পিন্টারেস্ট ঘাটতে ঘাটতে পেয়েছিল। তারপরই সেই ডিজাইন দেখে বানিয়ে ফেলেছে। এতে ঘরের অনেকটা জায়গা বেচেঁ গেছে সঙ্গে একসাথে অনেকগুলো বইও রাখা যাচ্ছে।
ঝুমুর একটি ব্যতিক্রম ধর্মী। তার মেঝেতে পাতা বিছানা খুবই পছন্দ। তাই সে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নিজের ঘরে কোনো খাট রাখেনি। সে ঘুমোয় মেঝেতে বিছিয়ে রাখা তোষক, জাজিম দিয়ে পাতানো বিছানায়। তার শান্তি সেখানেই। তাছাড়া আছে ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল আর টুল। শান্তি প্রিয় মানুষ হিসেবে ঘর বড় হওয়া সত্ত্বেও ঝুমুরের ঘরে গুটি কতক আসবাবপত্রই আছে। তার ধারণা ঘর যত ফাঁকা থাকবে ততই ভালো নয়তো দম বন্ধ লাগে।
~চলবে ইনশাআল্লাহ্….