#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-২
#মিফতা_তিমু
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ঝুমুরের কম্বল ছেড়ে বের হতে মন চাইছে না। আশপাশ ছেয়ে আছে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে। বৃক্ষ কুঞ্জের গায়ে শিশির নেমেছে। শিশিরে জানালার থাই গ্লাসও ভেজা। ঝুমুর উঠে বসলো। জানালার সিক্ত থাই গ্লাসের গায়ে আঙ্গুল দিয়ে লাভ মার্ক এঁকে দিলো। তারপর সেইদিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বিছানা ছেড়ে নেমে গেলো।
শরীরে শাল জড়িয়ে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চা হাতে বাড়ির ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে ঝুমুর। করোনা এক মহামারী। এই মহামারীর কারণেই বিগত দুই বছর তার পড়ালেখার অনেকটা ক্ষতি হয়েছে। গত বছর ইন্টারে ভর্তি হয়েছিল। তারপর থেকে এই বছর শুধু ইন্টারের ডেট পিছিয়ে পিছিয়েছে আর পিছিয়েছে। পিছতে পিছতে একবারে এই ডিসেম্বরের শীতে এসে ঠেকেছে।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বরাবর গ্রীষ্মকালের দিকে হয়ে এসেছে। অথচ ঝুমুরের ভাগ্য এতই অদ্ভুত যে স্বাভাবিক নিয়ম বদলে তার পরীক্ষা দিতে হয়েছে শীতকালে দাতে দাঁত পিষে। তার পরীক্ষা চলাকালীন সময় শীত অতটাও পড়েনি যতটা এখন পড়েছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ সে। ভাগ্যিস পরীক্ষা আরও পিছিয়ে যায়নি।
ঝুমুর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দূর দূরান্তে তাকালো। তার মনে হলো যদি পারতো ওই ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যেতে তাহলে কতই না ভালো হতো। তাহলে দিনশেষে ঘুমোতে গিয়ে মোতালেব সাহেবের ‘ আমি তোমার কাছ থেকে তোমার বেস্টটা এক্সপেক্ট করি ঝুমুর। আই হোপ তুমি আমার বিশ্বাস ভাঙবে না ‘ কথাটা মনে করে চোখ ভিজে উঠতো না।
তাসনুবা নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন এগারো বছর আগে যখন ঝুমুরের সবে সাত বছর। তখন সে পুরোপুরি কথা বলতে শিখেছে। ওই টুকু বাচ্চা যেন মাকে হারিয়ে আধাঁর জগতে হারিয়ে গেছিলো। দিনরাত কাদত সে মায়ের অপেক্ষায়। কিন্তু তাসনুবা ফিরেননি, তিনি নিরুদ্দেশ। তার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মোতালেব সাহেব একসময় উপলব্ধি করলেন ঝুমুরকে দেখলে প্রিয়তমার কথা তার আরও বেশি মনে পড়ে।
যার কারণে মেয়েকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন, তৈরি করলেন ঝুমুর আর তার মাঝে দূরত্ব। পাঠিয়ে দিলেন মেয়েকে বাংলাদেশে তার নানার বাড়ি। সেদিনের সেই দূরত্ব আজও অটুট। ঝুমুর আছে এই অচেনা, অজানা দেশে যেখানে তার আপন বলতে শুধুমাত্র গুটি কতক মানুষ। অথচ তার থাকার কথা ছিল কোরিয়ায় যেটা তার জন্মভূমি।
মোতালেব সাহেব তাসনুবা নিরুদ্দেশ হবার পর কোনওদিন দুদন্ড একলা বসে ঝুমুরের সঙ্গে গল্প করেননি,জানতে চাননি ঝুমুর কি চায়, তার কি বলার আছে। শুধু ঝুমুরের যা প্রয়োজন তা মনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে শুনে তার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু কোনওদিন নিজ থেকে জানতে চাননি। চাইলে হয়তো জানতেন ঝুমুর শুধু তার কাছ থেকে কিছুটা সময় ধার চায় যখন তারা দুজনে একলা বসে নীরবে সময়টা কাটাতে পারবে।
শুধু যে ঝুমুরের সঙ্গে মোতালেব সাহেবের এই দূরত্ব তা নয়। মোতালেব সাহেবের ছোট মেয়ে শাওমি, তার সঙ্গেও মোতালেব সাহেবের তেমন কোনো সখ্যতা নেই। তিনি শুধু নামেই বাবার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনওদিন জানতে চাননি তার মেয়েরা কি চায়। ঝুমুর আর শাওমির মাঝে একটাই পার্থক্য, শাওমি আর মোতালেব সাহেবের মাঝে দূরত্ব থাকলেও তারা এক বাড়িতে আছেন কিন্তু ঝুমুর আছে কোরিয়া থেকে অনেক দূর এক অচেনা দেশে।
চা খেতে খেতে নীরব প্রকৃতি উপভোগ করে একসময় ছাদ থেকে নেমে এলো ঝুমুর। ঘড়িতে তখন সকাল নয়টা। তানিয়া শাহজাহান নাস্তা বানানো নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। ঝুমুর এগিয়ে গিয়ে তাকে সাহায্য করায় হাত দিল। ঝুমুর পরোটা বেলছে আর তানিয়া শাহজাহান সেটা ভাজছেন। অনিল আর অনামিকা শীতের সকালে এখনও বিছানায় পড়ে ঘুম দিচ্ছে আর মাসুদ সাহেব একেবারে অফিসের জন্য রেডি হয়ে খাবার ঘরে হাজির হয়েছেন।
তানিয়া শাহজাহান রুটি ভাঁজতে ভাঁজতে বললেন ‘ কলেজ তো পার করে ফেললি। এখন প্ল্যান কি ? ‘
ঝুমুর রুটি বেলতে বেলতেই বললো ‘ আপাতত ডিএমসিতে চান্স পাওয়াটাই প্ল্যান। ‘
তানিয়া শাহজাহান ভাগ্নির কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেলেন। রুটি মাসুদ সাহেবের প্লেটে দিয়ে এসে বললেন ‘ বোকা, সে কথা কি আমি জানিনা ? আমি বলছি স্টেপ বাই স্টেপ তো আগাবি তাইনা ? কোচিং করবি কোথায় ? কোচিংয়ে আসা যাওয়া এসব কিভাবে করবি ? ‘
ঝুমুর বললো ‘ কোচিং উত্তরায় করবো। আসা যাওয়া বাস দিয়েই করবো। ‘
তানিয়া শাহজাহান বিরক্ত হলেন। এই এক জিনিস উনার মোটেই পছন্দ নয়। ঝুমুর সবসময় ক্ষমতা থাকা সত্বেও তার ব্যবহার করে না। যেকোনো জায়গায় গাড়িতে করে আসা যাওয়া করার সামর্থ্য তার আছে অথচ সে চলাফেরা করে বাসে করে।
কিন্তু ঝুমুরের কথার বিপরীতে তিনি কিছু বললেনও না। তিনি জানেন ঝুমুরকে বলে লাভ নেই। ঝুমুর কখনোই শুনবে না তার কথা। ঝুমুর হয়তো স্বভাবে নরম কিন্তু সে জেদিও বটে। আবেগী সে বটেই তবে সে বড্ড আবেগী ধরনের জেদীও। তার ধারণা সেও আর পাঁচজন মানুষের মতো নরমালি লাইফ লিড করতে পারবে।
টাকা পয়সা থাকলেই সেটা শো অফ করতে হবে, ইচ্ছে মতো খরচা করতে হবে জিনিসটা ঝুমুরের পছন্দ নয়। সে নিজেও যথা সম্ভব কম খরচ করার চেষ্টা করে এবং সবসময় এডজাস্ট করে চলার চেষ্টা করে। ঠিক এই কারণেই মনোয়ারা বেগম তাকে খুব বিশ্বাস করেন। তিনি জানেন ঝুমুর টাকা পয়সা হাতে থাকলেই উল্টোপাল্টা খরচ করে না।
বরং ঝুমুর সুযোগ থাকলে টাকা জমিয়ে সেসব দিয়ে মানসম্মত, শিক্ষণীয় বই কেনার চেষ্টা করে। নিজের টুকিটাকি শৌখিন জিনিস কেনে। নিজ ঘরের প্রয়োজনে সে আরও অনেক কিছুই কিনে। তাছাড়া খুব প্রয়োজন না পড়লে সে বড় ধরনের কোনো খরচা করে না। কিন্তু এটাও ঠিক যে ঝুমুর বেশ টিপটপ ধরনের। ঘর সুন্দর মতো সাজাতে সে টাকা খরচা করতে মোটেও কৃপণতা করে না। সেটা হবে অবশ্যই সীমার মধ্যে থেকে।
ঝুমুরের বিশ্বাস একটা শিক্ষণীয়, মানসম্মত বই পড়লে তার জ্ঞানের পরিধি বাড়বে, সে আরও অনেক কিছু জানতে পারবে জগৎ সম্পর্কে। তার এই চিন্তা ধারাকে সকলেই সম্মান করে। এই কারণেই তার বই কেনা নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তুলে না।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে অনামিকা, অনিলকে দোতলায় তাদের দাদুর বাসায় দিয়ে ঝুমুর আর তানিয়া শাহজাহান বেরিয়ে পড়লেন গাউসিয়ার উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্য ঝুমুর কিছু কেনাকাটা করবে। সে বাংলাদেশে আছে, তাই সেই রীতি অনুযায়ী খানিকটা চলার চেষ্টা করে। তবে ঝুমুর পুরোপুরি বাঙালি নয়। সে শুধু চেহারার দিক থেকেই বাঙালি। বাকি দৈহিক গড়ন, গায়ের রং,আচার আচরণ, পোশাক আশাকে তার মাঝে এখনও খানিকটা কোরিয়ার সংস্কৃতি রয়ে গেছে।
ঝুমুর খানিকটা কোরিয়ার সংস্কৃতি মেনে চললেও তার সবকিছুই শালীন। তার পোশাক পরিধান দেখে কখনও অশ্লীলতার আভাস পাওয়া যায় না। সে সবসময় শালীন ভাবে থাকতেই পছন্দ করে। অশালীন ভাবে চলা তার পছন্দ নয়। সুযোগ থাকলেই যে মানুষকে নিজের শরীর দেখিয়ে চলতে হবে এর কোনো মানে হয় না। তাই সে সবসময় ফুল হাতার সুতি জামা পড়ে
—-
আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন কাজেই ফাহমান আজ হসপিটাল যায়নি। ভোরে ঘুম ভাঙলেও বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে সকাল কাটিয়ে দিয়েছে। তারপর একসময় বিছানা থেকে উঠে গোসল সেরে জুম্মার নামাজ আদায় করে তৈরী হয় খাবার খাওয়ার জন্য। আলসেমি করে সকালের খাবার খায়নি সে।
আজ মারিয়াম শখ করে পোলাও আর মুরগি করেছেন। এমনিতেই রোজ শুক্রবারে তিনি কিছু না কিছু করেন। শুক্রবার দিনটায় ফাহমান বাড়ি থাকে তাই একটু ভালো কিছু করেন। ফাহমানের পোলাও খুব পছন্দ তাই ওটা করা হয় প্রায়ই।
ফাহমানের মতো মারিয়ামের স্বামী অর্থাৎ হৈমন্তী, ফাহমানের বাবাও খুবই পছন্দ করতেন পোলাও, মাংস কিন্তু আফসোস মানুষটা এখন আর নেই।
মারিয়াম এখন এক স্বনামধন্য বেকারির পরিচালক। প্রথম যখন বেকারী শুরু করেছিলেন তখনও ফাহমানের বাবা বেচেঁ ছিলেন। স্ত্রীকে সাহস জুগিয়েছিলেন তিনিই। বেকারী শুরু করাটা ছিল নিতান্তই শখের বশে। তবে এখন এই বেকারীই উনাদের আয়ের উৎস।
ফাহমানের বাবা সরকারি চাকরি করতেন। কিন্তু সহকর্মী আব্দুর রাজ্জাকের দেওয়া মিথ্যা অপবাদের দায়ে উনাকে যখন সাসপেন্ড করা হয় তখন আর সেই অপমান তিনি সহ্য করতে পারেননি। অপমানের বোঝা কাধে নিয়েই তিনি স্ট্রোক করে পরপারে পাড়ি জমান। তারপর থেকেই সংসারের হাল ধরেছে মারিয়াম এবং ফাহমান।
স্বামীর প্রয়াতের পর বেকারির সমস্ত কাজ মারিয়াম নিজেই করতেন। তখন আলাদা লোক রাখার সামর্থ্য ছিল না। ফাহমানও দিনশেষে কটা টাকার আশায় বাড়ি বাড়ি টিউশনি করাতো। এরপর কয়েক বছর কেটেছে। মারিয়ামের অবস্থার এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। তিনি এখন বেকারিতে লোক রেখে বাসায় নিজ হাতে সব কাজ করেন। নিজেও বেকারিতে যান। ফাহমানও এখন ইন্টার্নি করছে কাজেই তাকেও এখন আর টিউশনী করাতে হয় না। উনারা এখন স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবার।
একসঙ্গে দুপুরে খেতে বসেছে সকলে। ফাহমান খেতে খেতে হৈমন্তী বললো ‘ ভাইয়া একটা কথা শুনবে ? ‘
‘ কি কথা ? ‘
‘ আগে বলো রাগ করবে না ‘
‘ আরে বাবা বলবি তো। না বললে কি করে বুঝবো রাগ করবো কি করবো না ? ‘
‘ আমাকে আজ গাউসিয়া নিয়ে চল না। নতুন বছর আসছে, এখন থেকে ভার্সিটির কোচিং করতে হবে। কোচিং করার জন্য কিছু নতুন জামা কিনতে হবে। প্লিজ রাগ করিস না। প্লিজ এইবার নিয়ে যা। আই প্রমিজ আর বলবো না। ‘
কথাগুলো বলেই চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো হৈমন্তী কারণ ফাহমান এখন তাকে লাগাবে কয়েক ধমক। কিন্তু আজ ফাহমানের মন ভালো। নূপুর কন্যাকে স্বপ্নে দেখেছে আজ। যদিও মুখটা দেখতে গিয়েও দেখা হয়নি, তার আগেই ঘুম ভেঙে গেছে। কিন্তু তবুও তার মন ভালো। তাই হৈমন্তীর কথায় এক বাক্যে রাজি হয়ে গেছে সে।
নিজের ভাইয়ের এত ভালো রূপ দেখে হতবাক হৈমন্তী। ফাহমান এত সহজে তার কথা মেনে নেয় না। হয়েছে কি ওর ভাইয়ের ? হৈমন্তী ফাহমানের কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখলো জ্বর এসেছে কিনা। কই নাতো, জ্বর আসেনি। তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যে এভাবে রাজি হয়ে গেছে। হৈমন্তী চিন্তিত গলায় বললো ‘ কি হয়েছে তোর ? জ্বর তো মনে হয়না। তাহলে এত ভালো মানুষ কি করে ? ‘
‘ এত কথা বলিস না, চুপচাপ খা নাহলে নিয়ে যাবো না মোটু। ‘
ফাহমানের কথায় রেগে গেলো হৈমন্তী। চেঁচিয়ে উঠলো সে। তাকে চেঁচাতে দেখে রাগলেন মারিয়াম। ফাহমানকে বললেন ‘ কেন জ্বালাচ্ছিস ওকে বলতো ? একটু শান্তিতে বসে খা না। তোদের জন্য কি একটু শান্তি পাবো না। খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর তোরা। আমার আবার অর্ডারের আইটেম বানাতে বসতে হবে। ‘
মারিয়ামের কথায় ফাহমান কিংবা হৈমন্তী কেউ আর কথা বাড়ালো না। যে যার যার মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তবে মারিয়াম বললেন ‘ ঝুমুরের কি খবর ? কবে আসছে ? শুনলাম মেডিক্যাল কোচিং করবে। ‘
মায়ের কথায় মাথা নাড়ল হৈমন্তী। বললো ‘ শুনলাম তো কাল আসবে। এখন কখন আসে সেটাই দেখার পালা। উত্তরায় কোথাও একটা করবে। ‘
‘ তোর বান্ধবী ঝুমুর না নূপুর ও নাহয় মেডিক্যাল কোচিং করবে কিন্তু তুই কিসের কোচিং করবি ? কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারও আছে। ‘
‘ ওর নাম ঝুমুর। ওকে এভাবে নূপুর নূপুর করো না। আমি ধানমন্ডির ওদিকে কোচিং করবো। ইচ্ছা আছে বুয়েটে পরীক্ষা দেওয়ার। তবে চান্স না পেলে ঢাকা ইউনভার্সিটি, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, সাত কলেজগুলোতে দিবো। এখন যেটাতে হয় আর কি। ‘
ফাহমান আর কথা বাড়ালো না। নীরবে সকলে খেলো তারপর দুজন গেলো তৈরি হতে। তৈরি হয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়লো গাউসিয়ার উদ্দেশ্যে। বাস দিয়ে যাবে ওরা।
~চলবে ইনশাল্লাহ্…