#নীড়_তৃতীয়_পর্ব
#সুহা
নাইমা আমি কাজে বাইর হইলাম।(আনিক)
আচ্ছা যাও সাবধানে যাইয়ো কেমন।(নাইমা)
আনিক বের হতে দরজা খুলতেই বাইরে একজন লোককে দেখতে পেলো। লোকটির পোশাক দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ বড় এবং সনামধন্য ব্যক্তি সে।
আস্সালামুআলাইকুম, কে আপনি?(আনিক)
ওয়ালাইকুম আসসালাম, আমায় ভুলে গেলেন? অবশ্য ৩ মাস আগে দেখা হয়েছিলো ভুলেই যাওয়ার কথা। আচ্ছা ভিতরে এসে কথা বলি?(লোকটি)
জি আসুন ভিতরে আসুন।মাফ কইরেন আমাগো তেমন বসার জায়গা নেই, এই বিছানাতেই বসুন।(আনিক)
আরে সমস্যা নেই, আমার আবার এত বাছবিচার নেই। বেশ হাস্যজ্জল মুখেই কথাটি বললো লোকটি।
নাইমা দ্রুততার সহিত চা-বিস্কুট নিয়ে লোকটির সামনে রেখে মৃদু আওয়াজে বললো-
গরিবের ঘরে আসছেন সাহেব তেমন কিছুই দিতে পারলাম না যা ছিলো তাই দিলাম।(নাইমা)
আরে নাহ বেপার না।একটা কাজে আপনাদের সাথে কথা বলতে আসছিলাম।(লোকটি)
জি কেমন বেপার?(আনিক)
আসলে আপনি আমায় ভুলে গিয়েছেন কিন্ত ৩ মাস পূর্বে আপনি একজনকে হাসপাতাল এ নিয়ে গিয়েছিলেন মনে আছে?(লোকটি)
আনিক মাথায় নেড়ে সায় জানালেই লোকটি হেসে বলে উঠলো –
আমিই সেই লোক, আশরাফ মির্জা।ঐদিন জ্ঞান ফেরার পর আপনার তথ্য লেখা কাগজটা নার্স হতে পাই। আপনার মতন ন্যায়বান মানুষকে দেখার প্রবল ইচ্ছা আমার মনে জাগলো। অতঃপর আমার একটা লোক দিয়েই আমি আপনার সকল খবর নিলাম। আপনার ব্যাপারে সব কিছুই জানতে পারলাম। পর থেকেই আমার ইচ্ছে হলো আপনাকে আমি আপনার সহযোগিতার প্রতিদান দিবই।আমি এক সপ্তাহ পরই আপনার কাছে আসতাম কিন্ত পারিবারিক কিছু সমস্যাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ায় আর আশা হয়নি। তাই আজ এসেই পড়লাম আপনার পুরস্কার নিয়ে।(আশরাফ মির্জা)
সবই বুঝলাম কিন্ত কী পুরস্কার দীবেন আপনি আমায়? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।একটু খোলসা কইরা বলেন। (আনিক)
যেমনটা আমি আগেই বলেছিলাম আপনার সকল তথ্যই আমি জেনেছি। আপনি দিনমজুর এর কাজ করেন এটায় তেমন একটা আয় আপনার হয় না। তাই আমি আপনাকে আমার অফিসের সুপারভাইজার হিসেবে নিয়োগ দিতে চাই। (আশরাফ মির্জা)
লোকটার কথা শুনে তার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে আনিক আর নাইমা। এত বড় অফিসে চাকরি পাওয়াটা তাদের কাছে যেন আকাশের চাঁদ।
কিন্তু স্যার আপনে যদি আমার ব্যাপারে সব খোঁজ নিয়া থাকেন তাইলে জানার কথা যে আমি কলেজ পর্যন্তই পরসি। বড় বড় ডিগ্ৰী যে আমার নাই তাইলে এত্ত বড় অফিসের কাজ আমি কেমনে?(আনিক)
আমার একজন বিশস্ত লোকের দরকার যে সততার সাথে এসব কাজ সামলাবে। আমার অফিসে যেই কয়জন কেই সুপারভাইজারের পদে নিয়োগ তাদের মধ্যে দক্ষতা থাকলেও সততার অভাব লক্ষণীয়। আর আমি এই সততা আপনার মাঝে দেখতে পেয়েছি তাই আপনায় এই কাজটা দিচ্ছি।আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন আর কোথাও আটকে গেলে আমি তোহ আছিই। কাজ করতে করতে দক্ষ এমনিতেই হয়ে যাবেন।আশা রাখছি এতে কোনো সমস্যা নেই,এবার বলুন কবে থেকে কাজ করবেন?(আশরাফ মির্জা)
স্যার আপনি বলেন কবে থেকে আইতে হইবো আমি ঐদিন এ আসমু।(আনিক)
তাহলে আজকে মাসের ৩০ তারিখ কালকে আসুন কাজ বুঝুন ১ তারিখ হতে কাজে লেগে পড়ুন। আর এখন আপনাকে দিন মজুরি করা লাগবে না কেমন?(আশরাফ মির্জা)
জি জি স্যার আইসা পড়মু।(আনিক)
আচ্ছা আজ আসি তাহলে কালকে দেখা হচ্ছে।আসি কেমন। (আশরাফ মির্জা)
নাইমা এবং আনিক লোকটিকে হাসিমুখেই বিদায় জানায়। এবার হয়তো তাদের দুঃখের দিন ঘুচবে।
সময় তার আপন গতিতে বহমান। সময়ের বহমানতায় আজ প্রায় ১ বছর পেরিয়ে গেলো। নিজের সততা আর কঠোর কর্ম নিষ্ঠার কারণে আনিক নিজেকে কর্মস্থলে বেশ প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। সংসারেও নিয়ে এসেছে স্বচ্ছলতা। ওই ভাঙ্গা চূড়া বাড়িটাকেই ভালোভাবে মেরামত করে ওখানেই ভাড়া থাকছে তারা। আপন বলতে আজ তাদের বাড়িওয়ালা চাচা-চাচিই আছে। তাই তোহ এখান থেকে চলে যেতে মন মানে না। মোট কথায় বেশ বড়োসড়ো পরিবর্তনই হয়েছে তার জীবনযাত্রার মানে।
আজ আনিক এবং বাকি কর্মচারীরা বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় কাজ করছে।তাদের অফিস প্রদর্শনে আসছে কিছু বহিরাগত লোক। তাই সব কর্মচারীই নিজের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ দিচ্ছে। দিবেই বা না কেন যদি তাদের আজকের আচরণে বহিরাগত লোকেরা সন্তুষ্ট হলো তোহ মালিকপক্ষ চাইলে পদন্নতি ও হতে পারে, আর ভুল হলে চাকরিটা যে যাবেই যাবে। আর চাকরি নামক সোনার হরিণটিকে যে কেই বা হারাতে চায়!
বিল্ডিং এর সামনে কয়েকটা গাড়ি এসে থামতেই, সবাই বুঝে যায় যে পরিদর্শকরা উপস্থিত হয়েছে। সবাই নিজেকে শেষবারের মতো ঠিকঠাক করে নিজ নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে পরে। এক এক করে সকল পরিদর্শক ভেতরে আসতে থাকে, বাকি সবার মতো আনিকও সবাইকে স্বাগতম করতে থাকে কিন্তু সর্বশেষ ব্যক্তিকে দেখে সে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে পরে। হবেই না কেন আবিরকে এখানে এভাবে এতদিন পর দেখবে তা তার ধারণার বাইরেই ছিলো। আবির ও কম অবাক হয়নি, আনিকের মতো লোক এত বিশাল অফিসে কাজ করে কিভাবে এটা তার ভাবনার বাইরে বটে। কিন্ত সে নিজেকে সামলে এমন একটা ভাব নিলো যেন কিছুই হয়নি। আনিক অবশ্য বেশ একটা অবাক হয়নি তার মতো ছোটোলোককে নিশ্চই আবিরের মতো বড় সাহেব নিজের ভাই হিসেবে পরিচয় দিবে না।
যথারীতি পরিদর্শন শুরু হলো পর্যায়ক্রমে সবার পরিদর্শন হলো। এখন অফিসের উচ্চ পর্যায়ের লোকেদের সাথে বৈঠক হচ্ছে। মিটিং এর শেষ পর্যায়ে আবির হটাৎ চিল্লিয়ে উঠলো তার মানিব্যাগ চুরি হয়েছে ওখানে প্রায় দশ হাজার টাকা আরও দরকারি কিছু কার্ড ছিলো। মুহূর্তেই সারা অফিস জুড়ে থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে পরে। সব কর্মচারীরাই নিজ নিজ অবস্থান হতে ভীতিগ্রস্থ না জানি কখন দোষটা কার ঘাড়ে পরে যায়! কিন্ত আনিক কিছুটা নিশ্চিত কেননা সে জানে সে চুরি করে নি কিন্তু এত কর্মচারীর মধ্যে চুরি করলো টা কে তাও ভাবার বিষয়। এরই মধ্যে সব কর্মচারী এবং পুরো অফিসের তল্লাশি শুরু হয়, তল্লাশি করছে পরিদর্শকদের সাথে আশা দুইজন সহকারী। তল্লাশির মাঝামাঝি দ্বিতীয় সহকারী চিল্লিয়ে বলে উঠলো-
পেয়ে গেছি স্যারের মানিব্যাগ পেয়ে গেছি! এই সুপারভাইসারই চোর! ওর ডেস্ক এর ড্রয়ারেই পাওয়া গেছে মানিব্যাগ।(দ্বিতীয় সহকারী)
মুহূর্তেই সকলের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পরে আনিক। সকলেই নিজেদের মধ্যে কানাঘুসা শুরু করে দিয়েছে আর আনিক? সে যে ঘটনার আকস্মিকতায় হতোব্বিহল। শেষমেশ টার উপর চুরির দোষ পড়লো! কিন্ত সে তো করেনি তাকে মিথ্যা আরোপ দেয়া হচ্ছে। নিজেকে সামলে কিছু বলবে তার পূর্বেই ঠাশ করে চর পড়লো তার গালে, তাল সামলাতে না পেরে সে পাশের ডেস্ক এর সাথে মাথায় বাড়ি খেলো। মাথায় তরল কিছুর অস্তিত্ব পেতেই হাত দিয়ে দেখলো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। অবাক নয়নে সামনে তাকাতেই বুঝতে পারলো আঘাতটা আর কেউ নয় স্বয়ং আবির করেছে।
ছোটোলোক! ফকিন্নি! সাহস কি করে পেলি তুই আমার ব্যাগ চুরি করার। কয়টা টাকা দেখেই লোভ সামলাতে পারলি না চুরি করে বসলি!(আবির)
আনিক আপনি এই কাজ করলেন?আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! আপনি এমন লোক বের হবেন তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি । (আশরাফ মির্জা )
স্যা…স্যার আমায় বিশ্বাস করেন আম… আমি এগুলা করি নাই। আমি কেন করমু এগুলা? আমার যা কামাই হয় এতেই আমি সন্তুষ্ট আমি কেন চুরি করমু স্যার! আপনি তো আমায় চিনেন স্যার আমি কি এমন করতে পারি?(আনিক)
আরে এসব ছোটোলোকদের কি নিয়তের ঠিকঠিকানা থাকে নাকি? ছোটোলোক কোথাকার! বাবা-মা শিক্ষা দেয় না কিছু না করবে……(আবির)
বলে শেষ করার পূর্বেই তাকে মারতে লাগলো আনিক। সব এতদিন চুপচাপ সহ্য করলেও বাবা-মায়ের শিক্ষা! এটা সহ্য করা সম্ভব হলো না কিভাবে বললো সে এই কথা! তারও যে বাবা-মা একই , নিজেকে বড় দেখাতে নিজের মৃত বাবা-মা কেও অপমান করতে একটিবার গায়ে বাজলো না তার!
সিকিউরিটি সিকিউরিটি! একে ঘাড় ধরে বের করো। এর মতন লোকের দরকার নেই আমাদের। আমারই দোষ এমন লোককে চাকরি দিয়েছি। (আশরাফ মির্জা)
সিকিউরিটি এসে আনিককে বের করে দিলো। আর আশরাফ মির্জা আবিরকে সম্মানের সাথে বসিয়ে তার সেবা করতে লাগলো।
স্যার আপনার বেশি লাগেনি তো? আমি এক্ষুনি ডক্টর ডাকছি। আর ওই বেয়াদব এর পক্ষে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আপনি দয়া করে রেগে থাকবেন না। (আশরাফ মির্জা)
আরে আপনি এত্ত ব্যস্ত হবেন না। এসব ছোটোলোকেরা এমনি করে। পরের বার থেকে লোক নিয়োগের পূর্বে যাচাই বাছাই করে নিয়েন। (আবির)
জি জি পরের বার হতে আমি খেয়াল রাখবো। পিয়ন ডক্টর কে ফোন দিয়ে স্যারের জন্য জুস আনো যাও।(আশরাফ মির্জা)
সবাই আবিরকে মহৎ বলে তার গুনগান করতে লাগলো। আর আবির এসবের মাঝে এক কুটিল হাসি হাসলো যা রয়ে গেলো সকলের আড়ালে।
চলবে………………
#নীড় #চতুর্থ_পর্ব
#সুহা
স্যার আপনি যেভাবে বলেছেন আমিও ঠিক সেভাবেই তল্লাশি দেয়ার বাহানায় ওই সুপারভাইসারের ড্রয়ারে আপনার মানিব্যাগ রেখেছি।আর পরে ওকেই চোর বানায় দিসি। স্যার আমি আমার কাজ ঠিকভাবেই করেছি এবার আপনি বড় স্যারের কাছে আমার পদন্নতি নিয়ে কথা বলবেন তাই নাহ? (দ্বিতীয় সহকারী)
আবির টেবিলে রাখা পেপারওয়েট টা ঘুরাতে ঘুরাতে বললো –
কিসব কথা বলছেন মহিবুল সাহেব? আমি আপনাকে কখন এরকম কাজ করতে বললাম? আর আপনি আমার মানিব্যাগ নিয়ে সুপারভাইজার এর ড্রয়ারে রেখেছিলেন? O my god! ছি ছি মহিবুল সাহেব আপনি এসব কাজ করলেন! আপনার থেকে এই আচরণ আশা করি নি! (আবির)
আবিরের এহেন কথায় মহিবুল হতভম্ব হয়ে পরে। অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে আবিরের পানে। কত দ্রুত মানুষটা নিজের রূপ বদলিয়ে ফেললো! আবির এমন একটা চেহারা বানিয়ে বসে আছে যেন সে কিছুই জানে না।
স্যার এসব কী বলছেন আপনি? আপনি আপনিই তো আমায় বললেন………(মহিবুল)
দেখুন মহিবুল সাহেব আপনি কী বলছেন কিছুই আমার মাথায় আসছে না, আপনি প্লিজ যান এখান থেকেই আমায় বিরক্ত করবেন না তো যান। (আবির)
দেখুন স্যার আপনি কথা দিয়েছিলেন আমায় যে আমি আপনার কথা মতো কাজ করলে আপনি আমার চাকরির পদন্নতির জন্য সুপারিশ করবেন। এখন কেন আপনি কথা থেকে পিছুপা হচ্ছেন। আম ……… আমি কিন্তু বসকে সব সত্যি বলে দিবো।
প্রমান? প্রমান কী? আমি আপনায় বলেছি কাজটা করতে তার প্রমান আছে? নেই তো! কিন্ত কাজটা যে আপনি করছেন তার প্রমান কিন্তু আছে আমার কাছে।আমি যেখানে আপনাকে কাজটা করতে বলেছি ওখানে কোনো সিসি টিভি ছিলো না কারণ ওটা অফিসের বাইরের এরিয়া। কিন্ত আপনি কাজটা কিন্তু অফিসের ভিতরেই করেছেন,এখনই ওই অফিসের সিসি টিভি ফুটেজ আনলেই ধরা খাবেন আপনি। তা বলুন আপনি কী যেই অবস্থায় আছেন ওভাবে চাকরি করবেন নাকি চাকরিটাই হারাবেন?
আবিরের এই সহজ কথাটিও যেন মহিবুলের কাছে পাহাড়সম। হবেই বা না কেন কতটা জঘন্য মানুষ আবির তা এখন সে হারে হারে টের পাচ্ছে। আর এটাও বুঝছে যে সে বাজে ভাবে আবিরের জালে ফেঁসে গেছে। কিন্তু বাঁচার কী কোনো উপায় নেই? তখনি তার মনে পড়লো আবিরের কেবিনেও তো সিসি ক্যামেরা আছে। আশা নিয়ে ক্যামেরার দিকে নজর দিলেই আবির বলে ওঠে –
আপনার নিশানা বরাবর লাগলেও পয়েন্ট ভুল মহিবুল সাহেব।আমার রুমের ক্যামেরা আছে বটে কিন্ত তা দুইদিন ধরে নষ্ট তাই লাভ নেই। আফসোস কিছুই রেকর্ড হয়নি।(আবির)
আবিরের কটাক্ষযুক্ত বানিগুলো শুনে মহিবুলের রাগ উঠলেও সে নিরুপায়। তাই সে চুপচাপ মাথা নিচু করে কেবিন থেকেই বেরিয়ে গেলো।অমনি আবিরের ফোনে অনিমার কল এলে বেশ গৌরবের সাথেই তাকে সব বলতে লাগলো।
আচ্ছা আবির সত্যিই কী সিসি ক্যামেরাতে সব রেকর্ড হয়েছে? (অনিমা)
তুমি কী বোকা নাকি? মানুষ চিন্তায় পড়লে দিকবেদিকশুন্য হয়ে পরে। আর তাঁরই স্বদব্যবহার করেছি আমি।অতি সহজেই একটা মিথ্যা কাহিনী বানিয়ে শুনিয়ে দিলাম। আর দেখো সে কিনা আমার মিথ্যা কাহিনী বিশ্বাস করে নিলো! আমি এত্ত বড় কাহিনী করালাম আর সেগুলো ক্যামেরাতে বন্দি রেখে আসবো তাও আবার অন্যের খাঁচায়! ওটার ব্যবস্থা আমি আগেই করেছি।আর রইলো আমার কেবিনের ক্যামেরা কথা …………(আবির)
ওটার কারসাজি তো তুমি বহু আগেই করেছো। (অনিমা)
নয়তো এত্ত এত্ত দুই নাম্বারি কাজ এই কেবিনে বসে করতাম কী করে? (আবির)
আবিরের কথা শেষ হতেই ফোনের দুপাশে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো দুটি কলুষিত মনের অধিকারী মানুষ। এই হাসিটা কী তাদের অধরে চিরস্থায়ী হবে নাকি হারিয়ে যাবে কোনো অজানা আঁধারে?
বড় একটি ব্রিজের কিনারায় থম মেরে বসে আছে আনিক। আজকের ঘটনা তাকে ভিতরে ভিতরে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কিন্তু সে নিরুপায় অনেক সময় মানুষ সত্য হলেও নত হতে হয় আজ তার সেই পরিণতি। আর কিই বা করবে সে! ক্ষমতার জোরে আজকাল বিচার চলে আর আবিরের ক্ষমতার সাথে লড়ার সামর্থ যে তার নেই! পরমুহূর্তেই নিজের প্রতিই রাগ হয় তার আবিরকে তো সেই বড় করেছে, তাহলে তার শিক্ষাতেই ত্রুটি আছে যার ফলে আবির আজ এমন মানুষরূপী জানোয়ার হয়ে পড়েছে। আবার ভাবছে নাইমা কে কী জবাব দিবে সে? সারাজীবন মেয়েটাকে কষ্ট আর অপমান বাদে কী দিলো সে? কিছুই না! কিছুই দিতে পারলো না সে, যাও একটু সুখের পথে পা বাড়ালো তাও কিনা ………….। কী করলো সে জীবনে! আর ভাবতে পারছে না সে নিজেকে একটা অহেতুক বোঝা মনে হচ্ছে তার! সে একটা অভিশাপ, সে যার জীবনে থাকবে সেই ধ্বংস হয়ে পড়বে। হটাৎ তার মাথায় আসলো – যদি সেই না থাকে এই পৃথিবীতে! হুম তাহলেই সব সমস্যার সমাধান! কেউ আর কষ্টে থাকবে না কেউ না! তার ভাবনার মাঝেই পাশে থেকেই কেউ বলে উঠলো-
এক্কেবারে সঠিক ভাবসিস তুই।তোর মতো অভিশাপের দুনিয়ায় থাকার কোনোই মানে হয় না!মরে যা তুই যাহ মর!
আনিক তাকিয়ে দেখলো তার মা কথাটা বলছে। কিন্তু মা কিভাবে?
একদম সঠিক তুই মরে যা তুই অভিশাপ! যার জীবনে যাবি ধ্বংসই আনবি!
আনিক বিপরীত পাশে তাকিয়ে দেখলো তার বাবা। অতঃপর একদিক থেকে একেক জন আনিকের সামনে উদয় হলো আর তাকে অভিশাপ হিসেবেই আখ্যা দিয়ে মরতে বলতে লাগলো। আনিক তাকিয়ে দেখলো নাইমাও তার দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে তাকে বলছে –
কেন আমার জীবনটা নষ্ট করলা কেন?
আনিক কে চারপাশে মানুষ ঘিরে ফেলতে লাগলো, নানান মানুষের নানা কথা সে কিছুই ঠিকভাবে শুনতে পারছে না। কিন্তু বুঝতে পারছে সবাই তাকে দোষী বলছে।
চুপপপপ চুপ আর কিছু কইও না তোমরা আল্লাহর দোহাই লাগে চুপ করো তোমরা। (আনিক)
সে সামনে তাকাতেই দেখলো কেউ নেই মাত্রই যেখানে মানুষের ভীড় ছিলো চোখের পলকে তা হাওয়া হয়ে গেছে! কিন্ত সে আপাতত এসব নিয়ে ভাবলো না তার এখন অনেক বড় কাজ করতে হবে। নিজেকে পৃথিবী থেকেই বিদায় করে সবার জীবনে অভিশাপ মুক্ত করতেই হবে। আর এই ভাবনা থেকেই সে ব্রিজের রেলিং এ উঠে দাঁড়ালো। মনের আয়নায় বার বার নাইমার মুখটি ভেসে উঠছে। সে আপন মনেই বিড়বিড় করে বললো –
আমারে মাফ কইরা দিয়ো বৌ। আমি তোমার স্বপ্ন, শখ, আল্হাদ কিছুই পূরণ করতে পারলাম না কিছুই না ………
যেই না সে ঝাঁপ দিতে যাবে অমনি কেউ একজন তাকে পিছন থেকে টেনে নামিয়ে নিচে ফেলে দিলো। হটাৎ করে ফেলে দেয়ায় বেশ ব্যাথাই অনুভব করলো সে। কিন্ত তার কাজে বিঘ্নকারীর মুখ দেখতে ব্যাথাকে পাত্তা না দিয়ে সামনে তাকালো।
কালো ফ্রেমের চশমা পরিপাটি শাড়ি তার উপর এপ্রোন পরে দাঁড়িয়ে আছে এক রমণী। যে কেউ এক দেখাতেই আন্দাজ করতে পারবে যে রমণীটি বেশ সম্ভান্ত। আনিক ও বুঝলো কিন্তু তার মাথায় এখন নিজেকে শেষ করার ঝোক চেপেছে আর তার মাঝের বাধা এই রমণী। তাই বেশ ক্রোধানিত্ব আওয়াজেই রমনীকে উদ্দেশ্য করে বললো –
আমারে টাইনা নামাইলেন কেন? আমি মরতে গেসিলাম মরতে দিলেন না কেন? আপনি জানেন আমি কত বড় অভিশাপ! আমি আজকে মইরা গেলে আমার লগে জুইরা থাকা প্রত্যেকটা মানুষ মুক্ত। সরেন আমারে মরতে দেন!(আনিক)
আনিক অগ্রসর হতে লাগলেই পিছন থেকে রমণীটি শান্ত স্বরে বলে ওঠে –
মুক্তি! আসলেই কী আপনি মরলে আপনার সাথে জড়িত লোকেরা মুক্তি পাবে?কিভাবে পাবে?
কথাগুলো শুনে আনিকের পা থেমে যায়। সে একটা ধাঁধায় আটকে যায়। রমণী এবার আনিকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে –
কী হলো বলুন? আমি বলছি তারা মুক্তি পাবে না বরং তাদের জীবন আর কঠিন হয়ে পড়বে। আপনার জীবনে কে কে আছে? স্ত্রী, বাবা-মা, সন্তান এরা? এরা কেউই আপনাকে ছাড়া ভালো থাকবে না বরং আপনার মৃত্যু তাদের জীবন করে দিবে দুর্বিষহ!
আনিক চুপচাপ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রমণীর দিকে। যার অর্থ কিভাবে।রমণী বুঝতে পেরে পূর্ণরায় বলে উঠলো-
এইযে আপনি আজ এখান থেকে ঝাঁপ দিতেন পরে কী হতো মরে যেতেন। এরপর হয় আপনার পরিবার আপনার লাশ পেতো নয়তো পেতো না। পেলে কী হতো আপনার পরিবার সহায়সম্বলহীন হতো, আপনার বাবা-মা সন্তানহিনা হতো, আপনার সন্তান পিতৃহিনা হতো,আপনার স্ত্রীর গায়ে বিধবা, অপয়ার তকমা লাগতো। আর সমাজ তারা তো কয়দিন আপনার এবং আপনার পরিবারকে সমালোচনার মেইন টপিক করতো পরে ভুলে যেত। কিন্তু আপনার পরিবার আজীবন আপনার অভাবে ভুগতো। আর যদি আপনার লাশ না পেতো তাহলে! তাহলেও সমাজ আর আপনার একই ভূমিকায় থাকতো। আর আপনি? আত্মহত্যা মহাপাপ, এটা করে নিশ্চই স্বর্গে যেতেন না।মোট কথায় আপনার আত্মহত্যা কাউকেই মুক্তি দিতো না বরং আরও নতুন সমস্যা উদ্ভব করতো। কিন্ত আপনি বেঁচে থাকলে আপনার পরিবার আর কিছু পাক বা না পাক ভরসার স্থল পেতো। আর রইলো সমাজ?সে সর্বদাই সমালোচক এর ভূমিকায় থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে আপনি আমিও এই সমাজের সমালোচকের ভূমিকা পালন করে থাকি। যাকগে অনেক কথাই বলে ফেললাম পরিশেষে একটা কথাই বলবো এতকিছুর পরেও আপনি যদি আত্মহত্যা করতে ইচ্ছুক তাহলে প্লিজ করুন। আমি আপনায় আর বাধা দিবো না।
কিন্ত আমি যে তাগো লাইগা কিসুই করতে পারি না। বার বার ব্যার্থ হই! কী করমু আমি? (আনিক)
কয়বার ব্যার্থ হয়েছেন হুম? একবার দুইবার বড়োজোর ধরলাম তিনবার। এতেই আপনি নিজেকে ব্যার্থতার পথিক করে দিলেন?
এই দেশের মানুষরা ব্রিটিশ দের হাতে ২০০ বছর শোষিত হয়েও ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ছেড়েছিলো। বাঙালিরা টানা কত রক্ত ঝরালো কিন্তু বাংলাদেশ অর্জন করেই ছাড়লো। স্কটল্যান্ডের রাজা টানা ৬বার হেরেও ৭ম বার নিজের জয় নিশ্চিত করলো। এরা যদি এত্ত ব্যার্থতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সফলতার তাজ অর্জন করতে পারে আপনি পারবেন না কেন? আপনি কেন একটুতেই পরাজয় শিকার করছেন? ছোটো বেলা পড়েন নি-
পরিবো না পরিবো না কেন বলো বার বার?একবার না পারিলে দেখ শতবার।
আনিক মাথা নেড়ে সায় জানায় যার অর্থ হ্যা সে পড়েছে।
রমণী মুচকি হাসি দিয়ে বলে – তাহলে হার মানছেন কেন। পরাজয় কে পরাজিত করে সফলতার মুকুট অর্জন করুন।
আনিকের উপর রমণীর কথা গুলো জাদুর মতো কাজ করলো। সে বুঝতে পারলো ঠিক কতোটা ভুল পথে পা বাড়িয়েছিল সে। সে কিছু বলবে তার পূর্বেই রমণী বলে উঠে –
উহু এমন হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বলে ফেলবেন না।কেননা মানুষ তার হুটহাট নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর কারণে জীবনে কোনো না কোনো সময় সিদ্ধান্তহীনতায় পরেই। কারণ এই হুটহাট নেয়া সিদ্ধান্ত গুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল প্রমাণিত হয়। আপনাকে ৭ দিন সময় দিলাম এই ৭ দিন পরেও যদি আপনি আপনার সিদ্ধান্ত এ অটল থাকেন তাহলেই আমায় বলবেন। এই নিন আমার কার্ড।
আনিক কার্ড হাতে নিতেই দেখলো তাতে গোটা গোটা অক্ষরে সুন্দর করে লেখা – ড. অঙ্কিতা চ্যাটার্জী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। নামটা কেন জানি আনিকের বেশ পরিচিত মনে হলো কিন্ত কোথায় শুনেছে তা মনে করতেই পারছে না। তার ভাবনার অবসান ঘটে অঙ্কিতার কথায় –
রাত প্রায় ২টা বাজে এত রাতে গাড়ি পেতে সম্যসা হবে তার উপর আপনার পরিবারও অপেক্ষায় আছে। চলুন আমি আপনায় বাড়িতে পৌঁছে দেই। যদিও আনিক যেত না কিন্ত অনেক রাত হয়ে গেছে নাইমা বাসায় তার অপেক্ষায় আছে যদিও চাচা-চাচি আছে তার পাশে তারপরেও ……।তাই বিনবাক্য ব্যয় করে গাড়িতে উঠে বসলো। অতঃপর যাত্রা শুরু হলো গাড়ি অগ্রসর হলো, কিছু স্মৃতি বন্দি করে নির্জন সেতুটি সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
চলবে………