নীড় পর্ব-০৮

0
952

#নীড় #অষ্টম_পর্ব

#সুহা

লন্ডন শহরের বিশাল অট্টালিকার বারান্দার দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে অঙ্কিতা ও রবি। মূলত রবির মানসিক সম্যসার সমাধানেই অঙ্কিতার লন্ডনে আগমন।

রবি ঘোষ, লন্ডনের একটি নামিদামী কলেজ এর ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট এর শিক্ষক।বাংলাদেশী নাগরিক হলেও বাবার কর্মসূত্রে ছোটো থেকে লন্ডনেই তার এবং তার পরিবারের বসবাস। জীবনে কোনোকিছুরই অভাববোধ করতে হয়নি তার,পারিবারিক আর আর্থিক দুই দিক থেকেই সে ছিলো সমৃদ্ধিশালী। কিন্ত বলে না জীবন মানেই সুখ আর দুঃখের সমাহার। ঠিক তেমনি তার জীবনেও দুঃখের কালো মেঘের আবির্ভাব ঘটে। তার জন্মদিন উপলক্ষে এক হোটেলে পার্টি রাখা হয় যেখানে অনাকাঙ্খিত অগ্নিকান্ডে তার পরিবারের সবাই দগ্ধ হয়ে মারা যায় কিন্ত ভাগ্য জোরে সে সেদিন ট্রাফিক এ আটকা পরে যায় যাতে সময় মতো হোটেল এ উপস্থিত হতে পারে না।তাই সে এই অগ্নিকান্ড হতে সে বেঁচে যায়। এই ঘটনার পর সে শারীরিক দিকে থেকে জীবিত থাকলেও মানসিক দিক থেকে সে মৃতই বটে। এক সাথে পুরো পরিবার এর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারছিলো না সে দিন দিন নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো।তাই তার এক কাছের বন্ধু অঙ্কিতাকে জরুরি ভিত্তিতে রবির চিকিৎসা করতে অনুরোধ করে। যার ফলে অঙ্কিতাকে সব ফেলে লন্ডনে আসতে হয়।

রবিকে সামলাতে অঙ্কিতার বেশ কাঠখর পুড়াতে হচ্ছিলো, সে কিছুতেই অঙ্কিতার কথা বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তার একই সুর ছিলো যার জীবনে অপূর্ণতা থাকে তার জীবনে বেঁচে থাকাটাই সম্ভব না। অঙ্কিতা না পেরে শেষমেষ নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা যা সে পৃথিবীর কোনো প্রাণীকে জানায়নি সেটা রবির সামনে তুলে ধরেছিলো। রবিকে প্রশ্ন করেছিল – যদি মানুষ অপূর্ণতা নিয়ে নাইবা বাঁচতে পারে তো সে কিভাবে বেঁচে আছে? এর পর থেকে রবি কিছুটা শান্ত হয়েছে, নিজেকে পূর্ণরায় গুছিয়ে নিতে উদ্যোত হয়েছে। আর তার এই কাজে তার সহায়কের ভূমিকা পালন করেছে অঙ্কিতা। কখনো বন্ধু, কখনো পরামর্শদাতা কখনোবা পথপ্রদর্শক হয়ে রবিকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে এনেছে।এখন রবি প্রায় অনেকটাই সুস্থ, তাই অঙ্কিতার এখানে কোনো প্রয়োজন আছে বলে সে মনে করে না, তাই আগামীকালই বাংলাদেশে ফেরত যাচ্ছে সে। এসবই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলো সে তার ওপর পাশেই রবি আকাশ দেখতে ব্যস্ত। নীরবতা ভেঙে রবি বলে উঠে –

কালকেই চলে যাবেন আর কটা দিন থাকা যায় না?

জি কালকেই চলে যাবো। থেকেই বা আর কি করবো বলুন? যেই উদ্দেশ্যতে এসেছিলাম সেটা তো সফল হয়েই গেছে, মানে আপনি এখন যথেষ্ট সুস্থ আছেন। তাই চলে যাচ্ছি। (অঙ্কিতা)

আর কখনো আসবেন না? (রবি)

জানি না, হয়তো কোনো কাজে আসতেই পারি আবার নাও আসতে পারি। নিদিষ্ট করে বলতে পারবো না।(অঙ্কিতা)

রবি হুট্ করেই অঙ্কিতার হাতদুটো আঁকড়ে ধরে বলে উঠলো –

তোমার আমার অপূর্ণতার জীবনকে একত্র করে কি এই শূন্যতাকে পূর্ণতার রূপ দান করবে অঙ্কিতা? তুমি কি আমার আঁধারিয়া জীবনটার এক ফালি চাঁদ হবে? (রবি)

অঙ্কিতা ঝাটকা দিয়ে রবির হাতটা সরিয়ে দূরে সরে যায়। অতঃপর টানা নিশ্বাস নিয়ে রবিকে উদ্দেশ্য করে বলে-

আপনি এরকম কেন করছেন রবি সাহেব? আপনি ঠিক আছেন তো?কিসব আবোল-তাবোল বকছেন?

রবির হুশ আসে সে ঠিক কি করলো মাত্র। আসলেই এভাবে একটা মেয়ের কাছে যাওয়ার তার মোটেও ঠিক হয়নি। তাই মাথা নিচু করেই সে বলে উঠে –

আ…… আম সরি! আসলে হুট্ করে আমার কি হয়ে গিয়েছিলো আমি নিজেও বুঝি নি। এভাবে আপনাকে টাচ করাটা আমার ভুল ছিলো। কিন্তু আমি যা বলেছি সেখানে একটুও মিথ্যা ছিলো না। আমি সত্যিই আপনার প্রতি নিজের অজান্তেই দুর্বল হয়েছি, আপনাকে আমার আঁধার জীবনে এক ফালি চাঁদ বানানোর স্বপ্ন বুনেছি। আপনি কি আমার স্বপ্ন টাকে পূরণ করবেন?

অঙ্কিতাকে নীরব দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রবি স্মিত একটা হাসি দিলো। অতঃপর অঙ্কিতার সামনে গিয়ে বললো –

আপনি আপনার সময় নিন অঙ্কিতা, তাড়াহুড়োর দরকার নেই। আপনি যাই সিদ্ধান্ত নিবেন আমি সেটা নির্দ্বিধায় মাথা পেতে নিবো। কিন্তু এটাও আমি সর্বদাই আপনায় ভালোবাসবো। এখন সিদ্ধান্ত আপনার একটিবার আমায় বিশ্বাস করে আমার সাথে নতুন করে পথচলা শুরু করবেন নাকি আমায় প্রত্যাক্ষত করবেন। আসছি যদি কখনো আমার প্রণয় নিবেদন আপনি মঞ্জুর করেন তবেই আমি দেখা দিবো তার পূর্বে নয়।

অতঃপর রবি নীরবে বারান্দা ত্যাগ করতে লাগলে অঙ্কিতা মাথা তুলে নিস্প্রান নয়নে রবির প্রস্থানের পানে তাকিয়ে থাকে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

আমি শুনেছি সেদিন তুমি , সাগরের ঢেউ এ চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো।

আমি শুনেছি সেদিন তুমি নোনাবালি তীর ধরে…………

বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বেশ মনোযোগ দিয়েই মৌসুমী ভৌমিকের গানটা শুনছিলো অঙ্কিতা। হটাৎ গানটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশ বিরক্তবোধ করলো অঙ্কিতা,কিন্তু চোখ খুলে সামনে তাকালেই তার সব বিরক্তি ধুয়ে গেলো। কেননা সামনে তার ঠাম্মা তার জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু আর একমাত্র সঙ্গী দাঁড়িয়ে আছে। বাবা-মা তো নিজেদের নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে তার কথা মনেই থাকে না করোর,এক এই ঠাম্মাই তো আছে তার জন্য।

আরে ঠাম্মা যে! গ্রামে বেড়ানো শেষ করে এলেন তাহলে! আমি তো ভাবলাম আরও কয়েক যুগ আপনি তো দূর আপনার ছায়াটারও দর্শন পাওয়া যাবে না!(অঙ্কিতা)

আমি বুঝি জানতাম যে আপনি চলে এসেছেন? একটা বার তো ঠাম্মিকে জানালেন পর্যন্ত না! আর এখন সব দোষ আমার তাইনা ? (ঠাম্মি)

না না সব দোষ আমার! ঠাম্মি বুঝি কখনো ভুল হয়!(অঙ্কিতা)

হয়েছে হয়েছে দুপুরের কটা বাজে জানেন? শুনলাম তো আমি দুপুরে খাবার না খেয়ে গান শোনা হচ্ছে হুম!(ঠাম্মি)

আমার খিদে নেই তো লাগলে আম.………. (অঙ্কিতা)

কোনো কথা নয় আমি খাবার আনছি চুপচাপ খাবেন। (ঠাম্মি)

ঠাম্মির আদেশ শুনে অঙ্কিতা ভদ্র বাচ্চার মতন বসে থাকে আর ঠাম্মি খাবার আনতে যায়। ঠাম্মি খাবার আনতে গেলে অঙ্কিতা আপন মনেই বিড়বিড় করে-

এই দুনিয়ায় তুমি একাই আমায় এত্ত ভালোবাসো কেন ঠাম্মি?

শুধু ঠাম্মিই ভালোবাসে? আমি বাসি না?

কারো আওয়াজ শুনে অঙ্কিতা সামনে তাকাতেই দেখে রবি তার থেকে স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে তার খেলছে এক মিষ্টি হাসি। কিন্ত তাকে দেখে অঙ্কিতা মোটেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না কেননা সে জানে তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে রবি নয়। নিছকই তার মনের কল্পনা যা কয়েক মুহূর্তেই গায়েব হয়ে যাবে, হলোও তাই। তার লন্ডন থেকে ফেরত আসার পর থেকেই এমন হচ্ছে যখন তখন লোকটা তার কল্পনায় সামনে আসে আবার মুহূর্তেই গায়েব হয়ে পরে। সামনে আশা থেকে মনে পরে যায় যেদিন সে ফেরত চলে আসছিলো লোকটা সত্যিই তার সামনে আসেনি কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এসেছিলো তা অবশ্য অঙ্কিতার দৃষ্টিতে পরেই গিয়েছিলো কিন্তু সে কিছুই করেনি বরং লোকটার পাগলামি গুলো দেখেছে। এসব ভেবেই অঙ্কিতা আনমনেই হেসে উঠে পরোমুহূর্তেই নিজের মাথায় চাটি মেরে বলে –

পাগল হয়ে গেলি নাকি তুই? কিসব হচ্ছে তোর সাথে? মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে কিনা নিজের মনের অবস্থাই বুঝতে পারছিস না? লোকে শুনলে হাসবে।

অঙ্কিতার ভাবনার মাঝেই ঠাম্মি খাবার আনলো আর নিজেই খাইয়ে দিতে লাগলো। অঙ্কিতাও ঠাম্মির হাতে আনন্দের সহিত খেতে লাগলো, খাওয়ার মাঝেই ঠাম্মি আনিকের কথা জিজ্ঞাসা করলে অঙ্কিতার আনিকের বাড়িতে যাওয়ার কথা মনে পড়লো। সে দ্রুত আনিকের নাম্বারে কল করললো অতঃপর ……………

চলবে.………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে