#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#নীলফড়িং
#পর্ব ১২
.
.
মা আব্বু আজ সকাল সকাল আমার সাথেই বের হলো। আমি হসপিটালে চলে এলাম তারা কার্ড বিলাতে গিয়েছে। আমি বুঝি না এত আনুষ্ঠানিকতার কী প্রয়োজন আছে? বিয়েতে তো যত কম খরচ হয় ততই ভালো। বাট এরা কী করছে এরাই জানে।
দুপুর দিকে বাসায় ফিরে দেখলাম তারা এখনো ফেরেনি। ফোন দিলাম। বলল দেরি হবে আমি জানো খেয়ে নেই। আরে একা একা খাওয়া যায় নাকি? কী আর করব খেতে তো হবেই। অল্প করে খেয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল কলিং বেলের শব্দে। উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কে? আব্বু বলল আমরা। তাই দরজা খুলে দিলাম। ভেতরে আসতে আসতে দেখলাম ঘড়িতে ৪ টা বাজে আরে বাবা এত দেরি?
…….খাবার খেয়েছ তোমরা?
……হ্যা খেয়েছি?
……কোথায় খেয়েছ? কী খেয়েছ?
……তোর খালামণির বাসায় খেয়েছি, এত জোর করল না খেয়ে আসতে পারলাম না।
……ওহ আচ্ছা। যাও ফ্রেশ হয়ে নাও গিয়ে, নাকি আবার যাবে?
……হ্যা যাবো তো নিশ্চয়ই। কিন্তু একটু জিরিয়ে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে এলাকায় যে কজন রয়েছে তাদের দেবো। আর বাকি সবাইকে কাল দেবো।
……এখনো বাকি রয়েছে?
……হ্যা তাহলে? তুই ভাবিস কী এত গুলো কার্ড দেওয়া কী এই সেই কথা?
…….মা এত গুলো কার্ড করার কী প্রয়োজন ছিলো?
…….তোর এত মাথা ঘামাতে হবে না। তুই যা তোর কাজে, এগুলো আমাদের উপর ছেড়ে দে।
…….ঠিক আছে তোমাদের যেমন খুশি।
আমি রান্নাঘরে গিয়ে চা করে মা আব্বু কে দিয়ে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। চায়ের কাপে চুমুক বসাতেই মনে হচ্ছে কেউ তাকিয়ে আছে। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে যখন কাউকে দেখতে পেলাম না তখন রাস্তায় চোখ পড়ল। একটা বাচ্চা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে দেখলাম খুব কিউট বেবিটা আমি হাতের ইশারা দিতেই সে ছুটে পালালো। আমি চা শেষ করে ঘুরে যেতেই দেখলাম স্যার দাঁড়িয়ে আছে তার রুমের বারান্দায়। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে চলে আসতে নিলাম। ঠিক তখনই সে বলে উঠলেন।
……আর তো মাত্র কয়েক দিন তারপর এই দূরত্বটা আর থাকবে না ইন’শা’আল্লাহ। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এদিক সেদিক খুঁজতে হবে না। পানি ছুতোয় ছাদে যাওয়ার সাধ ও আর জাগবে না।
বুঝতে পারছি স্যার কথা গুলো আমার উদ্দেশ্যেই বলল। কী বাজে লোক একটা? আমি নাকি ছাদে যাই পানির ছুতোয়? বারান্দায়ও আশি চায়ের ছুতোয়? যাক আর আসবো না এবার নিজেই খুঁজতে আসবে আমায়। আরে আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাই ভালো লাগে দেখে। আমি সকাল সকাল ছাদে যাই বাহারি বাতাস গায়ে মাখবো বলে। কিন্তু কত্তবড় দুর্নাম আমার বিরুদ্ধে। যা থাকব না আর বারান্দায়। আমি পা বাড়িয়ে চলে এলাম সেখান থেকে। ছিঃ ছিঃ কতবড় অপমান। ভাবছি চা খাওয়াই ছেড়ে দেবো। নাহ নাহ চা খাওয়া কেনো ছাড়ব? আমি বারান্দায় আসা ছেড়ে দেবো।
আমি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গেইটের সামনেই দেখলাম সে দাঁড়িয়ে আছে, আমি তার গাড়ী ওভারটেক করে চলে যেতে নিলাম। বাট সে আমার সাথে সাথে গাড়ী এগোচ্ছে। কিছুদূরে গিয়ে আমি রিকশা ডাকব ঠিক তখনই সে গাড়ী এনে আমার সামনে বাকা করে থামিয়ে দিল।
…….কী ম্যাডাম এখন জোর করে গাড়ীতে তুলতে হবে নাকি?
…….প্রয়োজন নেই আমি নিজে নিজেই যেতে পারব।
…….তা আমিও জানি। বাট একই তো পথ চলো উঠে আসো।
…….নাহ যাবো না।
……..ওকে।
আমি ভাবছি চলে যাবে কিন্তু না সে গাড়ী থেকে নেমে আমার হাত ধরে নিয়ে গাড়ীতে বসিয়ে দিল।
…….এখানে বসে থাকবে এক পা বাহিরে দেবে না, আমি না বলা অব্দি।
এই বলে স্যার গাড়ীর দরজা আঁটকে দিয়ে নিজেও গিয়ে গাড়ীতে উঠে বসে পড়ল। ইশ কী ঢং, নিজেই ঠ্যাস দিয়ে কথা বলে আবার নিজেই দরদ দেখায়।
স্যার গাড়ী চালিয়ে এগিয়ে গেল। আমি জানালার বাহিরে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম স্যার রাজাবাহাদুর রোড হয়ে মহিলা ক্লাবের সামনে দিয়ে ঘুরে গ্রিন পার্কের দিকে যাচ্ছে। এদিকে কেনো যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। সে গ্রিন পার্কের সামনে থেকে বেলের্স পার্কে গিয়ে একেবারে শেষে যেই বেল পুড়ির ছোট দোকানটা ছিলো তার সামনে গাড়ী থামিয়ে বলে উঠল।
…….বেল পুড়ি খাবে?
……এখানে?
…….হুম এই লোকটা খুব ভালো বেল পুড়ি বানায়, খাবে?
…….ওকে।
স্যার দু-প্লেট বেল পুড়ি অর্ডার করল। দুজনে গিয়ে গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভালো লাগছে মোটামুটি ভীড় জমে আছে চারিদিকে। দোকানী প্লেট এগিয়ে দিল দুটি। স্যার এক প্লেট নিলো আমাকে এক প্লেট দিল। এক পিস মুখে দিতেই ভালো লাগল।
…….হুম খুব টেস্ট তো।
…….হুম বলে ছিলাম না?
এরপর দু’জনে বেল পুড়ি শেষ করলাম।
…….আরও খাবে?
…….নাহ অল্প খেলে সাধ ভালো লাগে। বাট বেশি খেলে মুখ ফিরে আসে।
…….হুম তা ঠিক।
স্যার বিল মিটিয়ে গাড়ীতে বসতে বলল। দুজনেই বসে পড়লাম। অল্প সময়ের মাঝেই হসপিটালে চলে এলাম।
এভাবেই চলতে শুরু করে দিল দিন ক্ষণ প্রতিটি মূহুর্ত। কখনো রাগ, কখনো অভিমান, কখনো আনন্দ। বিয়ের তারিখটা খুব কাছে ঘনিয়ে এলো। এদিকে আমাদের সম্পর্কটাও আরও মধুর হতে লাগল।
আজ হসপিটাল থেকে ছুটি নিলাম। অল্প কিছুদিনের জন্য, শুধু অনুষ্ঠান যে কদিন চলবে, সে কদিনের। কাল থেকে শুরু হবে সব ফাংশন। তাই কাল বিকেল থেকে বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ। সব আত্মীয়স্বজনরা এক এক করে চলে এসেছেন।
বিকেল দিকে রুমে এসে মা বকনি দিয়ে উঠল।
…….কীরে এখানে বসে কী করছিস? বাহিরে কত মেহেমান, আনন্দ উৎসবে মেতে আছে, আর তুই রুমে বসে আছিস?
…….মা বাহিরে গিয়ে কী করব? আমার লজ্জা লাগছে। 🫣
…….এত লজ্জা কীসের? চল বাহিরে চল।
…….মা আমি যাবো না প্লিজ।
……চল বলছি।
মা জোর করে আমাকে এনে সবার সামনে বসিয়ে দিল। আর সবাই শুরু হয়ে গেল। আমাকে লজ্জা মাখানো কথা বলার জন্য।
সন্ধ্যার আগে আগে, সবাই মিলে আমাকে সাজিয়ে দিল, লাল হলুদ জামদানী শাড়ি, ফুলের গহনা দিয়ে। দুই ছাদে অনুষ্ঠানের সব ব্যবস্থা করা হয়েছে, ওপাশে বর পক্ষ, এপাশে কনে পক্ষ।
সন্ধ্যার পরে সবাই আমাকে নিয়ে ছাদে এগিয়ে গেল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে ছাদ দুটো। আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে আছে চারিদিক।
আমাকে নিয়ে স্টেজে বসিয়ে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে স্যারও চলে এলো তাদের ছাদে, দুজনার চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছুটা লাজুক হাসি ঠোঁট ছুঁয়ে গেল। সবাইকে ছেড়ে যাবো এই ভেবে মনে খারাপ লাগা আনতে চাইছি, বাট আসছেই না। মন উল্ট বলছে, মন খারাপের কী আছে? উঁকি দিলেই তো দেখব সবাইকে, তবে এত কষ্ট পাওয়ার কী আছে?
সবাই এক এক করে গায়ে হলুদ দিয়ে এলো স্যারকে। এরপর সেই হলুদ লাগিয়ে দিল আমার গায়ে, জাস্ট শুধু অনুভূতির কিছুটা ছোঁয়া, এটা যে নিয়ম তা নয় কিন্তু, এটা একটা অনুভূতি, এটা একটা অনন্দের মূহুর্ত শুধু।
সবাই গান বাজনা বাজাচ্ছে। কেউ নাচ করছে, কেউ গান গাইছে। খুব সুন্দর ভাবেই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল।
রাত তখন ১ টা আমি বিছানায় বসে ছিলাম। মাইনুল আমার পাশেই ছিলো। আরও একজন কাজিন ছিলো, খালামণির মেয়ে। দুজনে মিলে আমার সাথে খুব করে ফাজলামো করছে। বোনটা আমার ফোন নিয়ে স্যারকে ম্যাসেজ দিতে শুরু করে দিল, তাও আমার হয়ে।
……আসসালামু আলাইকুম।
……ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যা বলো?
……আমি কী বলব? তার থেকে আপনি বলেন আমি শুনবো।
…….ম্যাসেজ তো তুমি দিলে আমি কী বলব?
……নাহ আসলে ইচ্ছে করছিল আপনার সাথে কথা বলার তাই দিলাম।
…….ওহ আচ্ছা? তবে বারান্দায় আসো বলছি।
……নাহ নাহ বারান্দায় না, অনেক রাত হয়ে গেছে কেউ দেখলে সমস্যা হবে।
…….সমস্যা কী করে হবে? রুমের দরজা নক করে আসবে।
……আরে নাহ আমার সাথে কাজিনরা আছে তো।
……ওহ তবে তাদের নিয়ে আসো। তাদের সাথেও কথা হবে ভরপুর।
……উঁহু। তার থেকে এভাবেই বলেন, আমি শুনি?
…….হুম আগে বলো কতটা ভালোবাসো আমায়?
স্যারের ম্যাসেজ দেখে আমার একটু সন্দেহ হচ্ছে, স্যার এভাবে কথা বলছেন? স্যার এত রাতে বাহিরে যেতে বলার লোক তো নয়? তাও আবার মজা করছে এভাবে।
…….জুঁথি ওটা স্যার নয়। স্যারের কোনো কাজিন বা ভাই ম্যাসেজ দিচ্ছে সম্ভবত।
……তুই কীভাবে বুঝলি আপু?
…….আমার সন্দেহ হচ্ছে।
ওরা হাসি মুখে ভয় পেয়ে ফোন রেখে দিল। আমি রুমের আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
সকাল সকাল উঠে ফ্রেশ হয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। অনেক দিন বাদে ছাদে এসে ভালো লাগছে। ফুল গুলো অনেক সুন্দর ভাবে ফুটে আছে, একটা সাদা গোলাপ ফুটে ছিল, খুব ভালো লাগল দেখে, তাই এগিয়ে গেলাম ফুলের কাছে। তাকে স্পর্শ করে দেখছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে কারো কাশির শব্দে আঁতকে উঠলাম হটাৎ হওয়ায়। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম স্যার দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি লজ্জা পেয়ে আবার ঘুরে গেলাম।
……কাল ম্যাসেজ কে দিয়েছিল?
……জুঁথি আমার কাজিন।
……হুম বুঝতে পেরেছি।
……রিপ্লাই কে দিয়েছিল?
…….নয়ন আমার কাজিন।
……হুম জানতাম।
……এতদিন ছাদে কেনো আসোনি?
…….কেনো?
…….গাছ গুলো কাউকে খুব মিস করছিল।
……তাই? গাছ গুলো নাকি অন্য কেউ?
……হয়ত বা। বাট গাছে রোজ পানি দিতে হয়। না হয় তারা শুকিয়ে যাবে।
……কেনো আপনিই তো বলেছিলেন, ছাদে ভূত আছে যে কিনা রোজ পানি দিতে আসে। তবে আমি না এলেও তো চলবে।
……(হেঁসে দিয়ে) হুম বলেছিলাম। বাট ভূতটা আসছে না কিছুদিন ধরে।
……তবে আমি তো নাকি পানির ছুতোয় আশি, ভূত কেনো আসেনি?
…….(জোরে হেঁসে দিয়ে) ওহ আচ্ছা ম্যাডাম অভিমান করেছে বুঝি?
…….অভিমান কার সাথে করব? এমন কাউকে তো আশেপাশে দেখতেই পাচ্ছিনা।
…….কেনো ভাবী তুমি আমার ভাইকে দেখতে পাচ্ছ না?
কারো মুখে ভাবী ডাক শুনে পেছনে ঘুরে তাকালাম। দেখলাম ফারিজ আর নয়ন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁসছে স্যারের কাঁধে হাত রেখে। যা দেখে স্যার ও কিছুটা অপস্তুত হয়ে গেল। তার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আমি তো বেশ অনেকটা লজ্জা পেলাম। আমি ভাবছি কোথায় লুকাব বাট জায়গা খুঁজে পাচ্ছিনা। স্যার ওদের কে বলে উঠল।
……তোদের আর কোনো কাজ নেই নাকি?
……আছে তো সবাইকে এই কথাটা বলার।
স্যার ওদের সাথে কথা বলছিল, এই ফাঁকে আমি ছুটে পালালাম ছাদ থেকে।
……এই মিষ্টি ভাবী কোথায় যাচ্ছ? দাঁড়াও কথা বলে যাও আমাদের সাথেও একটু। শুধু ভাইয়ের সাথে বললেই হবে নাকি?
কে শোনে কার কথা আমি তো একদম নিচে এসে আমার রুমে চলে গেলাম। ওহ গড আমি তো একদম শেষ।
।
।
।
চলবে……….।