#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৬
অয়নের দাফন সম্পন্ন করে চার ভাই ও ইমদাদুল হোসেন উঠানে এসে দাঁড়াল। মাথা থেকে টুপি খুলে পাঞ্জাবির পকেটে রেখে পারুলের দিকে তাকাল সকলে। অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে জননী। ইমদাদুল হোসেন নিজেকে ধাতস্থ করে বললেন, “এখানে আরুর কোনো দোষ নেই ভাইজান। পারুলের সাথে আপনিও পা/গ/ল হয়ে গেলেন। কেন মেয়েটাকে পুলিশে দিলেন ভাই? মেয়েটা এমনিতেই অসুস্থ। প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল। একা ওখানে কেমন আছে, কে জানে?”
“চিন্তা করিস না। ওকে পুলিশে দেইনি, ওকে ভালো রাখার ব্যবস্থা করেছি। পারুল ছেলেকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে গেছে। এই সময়ে আরুকে ওর সামনে রাখা ঠিক হবেনা।” মোতাহার আহসান বললেন।
শাহিনুজ্জামান বললেন, “পারুলকে বাড়িতে নিয়ে চলেন ভাই, এখানে রাখা ঠিক হবেনা।”
তদানীং অপূর্ব টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে সন্দিহান ভাবে পা ফেলছে বাড়ির ভেতরে। বুকটা খাঁখাঁ করছে। আরুকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পার হয়েছে গোটা এক দিন। রোয়াকে টিফিন ক্যারিয়ার রেখে মোতাহার আহসানের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কপালে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভ্রুতে ভাঁজ ফেলে বলল, “বাবা, তোমরা এখানে? বাড়িতে এত ভিড় কীসের?”
“অয়ন পানিতে পড়ে মা/রা গেছে। দাফন সম্পন্ন করে এলাম।” বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো শাহিনুজ্জামানের। অপূর্ব দিশেহারা হয়ে উঠল। সমুদ্রের চেয়েও বিশাল এক জলরাশিতে তলিয়ে গেল। যার কোনো কূলকিনারা নেই। ভ্রম ভাঙতেই আরুর কথা মস্তিষ্ক গোচর হলো। সবকিছুর জন্য আরুকে দায়ী করবে পারুল। দৃঢ় গলায় বলল, “আরু কোথায় এখন?”
“আছে। তোর সাথে আমার একটু কথা আছে।” অপূর্বর কথার পরিপ্রেক্ষিতে কথাটা বললেন মোতাহার আহসান। লহমায় অপূর্বর মস্তিষ্ক আগুনের ফুলকি ছাড়ল। কঠোর গলায় বলল, “আরু কোথায়, আমি জানতে চাই।”
সবাই নীরব, প্রতুক্তি দেওয়ার ভাষা নেই। অপূর্ব এতে আরও রুষ্ট হলো। উচ্চৈঃস্বরে আবার জানতে চাইল আরুর খবর। অপূর্বর বাজখাঁই গলায় এক মিলি সেকেন্ডের জন্য বাড়ি নীরব হয়ে গেল। তুর উঠানে বসে কাঁদছে অয়নের জন্য। অপূর্ব তা লক্ষ করে ডাকল তুরকে। আংশিক কথা শুনতেই আরুর দাদিজান তেড়ে এসে বলল, “তোর বউকে পুলিশে কোমরে দড়ি পরিয়ে নিয়ে গেছে। তোর বউয়ের জন্য আমার নাতি পানিতে পড়ে ম/র/ছে। ইচ্ছে করে ওকে পানিতে ফেলে দিয়ে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েছিল। অলক্ষ্মী একটা। ওর জন্য আমাদের মৃধা বাড়ি সার্কাসে পরিণত হয়েছে।”
“মুখ সামলে কথা বলবেন। আমি আপনার ছেলে না যে আপনার কটূক্তি শোনার পরেও চুপ করে থাকব। এত নাতি নাতি করেন, আগে কোথায় ছিল আপনার নাতি? এদিকে তো ঘুরেও আসতেন না। এখন নাচতে নাচতে কাঁদছেন।” দাদি শাশুড়ির মুখের ওপর লাগাম না টেনে বলল অপূর্ব। অপূর্বর উগ্র আচরণে হতবাক হলো সকলে। পারুল দ্বিরুক্তি করে, “অয়নকে গোসল করাতে বলে আমি রান্না করতে গিয়েছিলাম। আরু গোসল না করিয়ে ঘরে এসেছিল জামাকাপড় বদলাতে। ও তো জানত, অয়ন সাঁতার জানেনা। তবুও কেন ওকে দিঘির পাড়ে রেখে এলো।”
“ঘাটলার ওপর গোসল করছিল অয়ন?”
“না! আমি পানি তুলে দিয়েছিলাম উঠানে। এইখানটায় বসে আমার অয়ন গোসল করছিল কিছু ঘণ্টা আগে। এখন আমার ছেলে ঐখানে শুয়ে আছে।” কাঁদতে কাঁদতে বললেন পারুল। প্রবল রাগে অপূর্ব দাঁতে দাঁত চেপে চোখ গ্রথন করে নিজেকে দমানোর প্রচেষ্টা করল। প্রিঞ্চ করে দাদি শাশুড়ি কিছু বলার প্রচেষ্টা করতেই অপূর্বর কথায় লাভা ছড়াল, “আপনাকে না আমি চুপ করতে বললাম? যথেষ্ট সম্মান দিয়েছি আপনাকে, আর দিতে পারছি না। আমার স্ত্রীকে এই অবস্থায় আপনার বাড়িতে কেন এনেছিলেন, অয়নের বডিগার্ড বানাতে? আমার স্ত্রী আমার বাড়িতে রানি হয়ে থাকে। মেয়েকে আপনি কোনো কালেই সহ্য করতে পারতেন না। নিঃসন্তান হয়ে চেয়েছিলেন না? মৃধা বাড়িতে দাঁড়িয়ে অপূর্ব আহসান বলে যাচ্ছে, আরুর কোনো মা নেই। আপনি নিঃসন্তান।”
অনিতা সবকিছু ফেলে উঠানে ছুটে এলেন। রাগান্বিত গলায় বললেন, “তুই দিনদিন বে/য়া/দ/ব হয়ে যাচ্ছিস অপু। বড়োদের সাথে এ কেমন আচরণ তোর! আমার বাবা মা তোকে এই শিক্ষা দিয়েছে?”
“তোমার ননদ যদি মেয়ের প্রতি অ/মা/নবিক হয়, তবে আমি বে/য়া/দ/ব হলে কীসের সমস্যা?” পরপর দম নিয়ে বলল, “আমার বাবা বোনের প্রতি ভালোবাসায় এতটা অন্ধ যে, বিচারকার্য তিনি ভুলে গেছেন। চেয়ারম্যান হয়ে গ্ৰামের বিচার করতে পারলেও নিজের পরিবারের বিচার করতে পারেনা। যেখানে বোনের জন্য ভাগনে/পুত্রবধূর সাথে অ/বিচার হয়, সেখানে তাদের না থাকাই ভালো। আরুকে নিয়ে আমি বহুদূরে চলে যাব।”
“তুই ভুল ভাবছিস অপু, পারুলকে সান্ত্বনা দিতে আরুকে পুলিশে দেওয়ার অভিনয় করা হয়েছে। কাল সকালে ওকে নিয়ে তুই আমার ভাইকের কাছে চলে যাইস।” আশ্বাস দিলেন পারুল। তবুও অপূর্ব বেপরোয়া, “ফুফু বাচ্চা? তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কী আছে? অথচ যে বাচ্চা, তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নেই।”
অপূর্ব উঠানের জাম গাছটার সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজের রাগ সংযত করছে। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে গ্ৰামবাসীদের। তখনই ধীরপায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল হাবিলদার। ব্যতিব্যস্ত হয়ে ইমদাদুল হোসেনকে বললেন, “আপনার মেয়ের পেইন উঠেছিল। ধাত্রী ঠিক করে এতক্ষণে বোধ হয় ডেলিভারি হয়ে গেছে। সকাল থেকেই নাকি ব্যথা ছিল, সারাদিন ব্যথা পাত্তা না দিলেও ভ্যানগাড়ির ঝাঁকুনিতে অস্থির হয়ে উঠেছে। আপনারা কেউ যেতে চাইলে আসুন।”
অপূর্ব দুহাতে চুল টেনে ধরল। রাগে দুঃখে একফোঁটা জল পড়ল চোখ বেয়ে। গলা ধরে এলো আনন্দে। বহু কষ্টে বলল, “ওকে কোথায় দেখে এসেছেন?”
“থানায়।”
জিম করা দেহের শক্তির প্রমাণ এতদিনে না মিললেও, আজ মিলল। একটা শক্তপোক্ত ডাল ধরে ভেঙে ফেলল উঠানের মাঝে। সৌজন্য হেসে উন্মাদের মতো বলল, “চেয়ারম্যান বাড়ির সন্তানের জন্ম হয়েছে থানায়। বাহ্! তোমাদের প্রতি আমার আর কোনো অভিযোগের বাকি নেই। সব পূর্ণ করে দিয়েছ তোমরা। আমার সন্তান চোখ মেলে দেখল তার মা অপরাধ করে থানায় তার জন্ম দিয়েছে। আরেকজন মা, তার মেয়ের কষ্টটাই বুঝতে পারল না।”
চম্পা অপূর্বর হাত ধরে বললেন, “আমি ওর কাছে যাব অপু।”
“এতক্ষণ যখন কেউ যেতে পারেনি, এখন আর যেতে হবেনা। এখন আমার স্ত্রীর জন্য আমি একাই একশো।” এই বাক্যটিই বোধ হয় সবচেয়ে কোমল ছিল। অতঃপর অপূর্ব অগ্রসর হলো থানার দিকে। একবারও পেছনে চেয়ে দেখল না কারো মুখ।
__
গ্ৰাম জনশূন্য। গ্ৰামবাসীরা ভিড় করেছে মৃধা বাড়িতে। হাবিলদারের সাথে সাথে এগিয়ে যাচ্ছে অপূর্ব। মনে অভিমান ও অভিযোগ ছাড়া কিছু নেই। দীর্ঘক্ষণ পর তারা পৌঁছাল সুন্দরনগর থানায়। চকিতে কর্ণপথে পৌঁছাল নবজাতকের কান্নার শব্দ। একজন ধাত্রী শুভ্র রঙের কাপড়ে জড়িয়ে রেখেছে নবজাতককে। অপূর্ব শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আরুর থেকেও রূপবতী সেই শিশুটি। শিশুটির গালে হাত দিয়ে বলল, “আমি ওর বাবা। ওকে কোলে নিব একটু?”
“অবশ্যই। এতক্ষণে আসার সময় হলো? মেয়ের কান্না থামছে না। বাবার কোলে গেলে থামে কি-না দেখি।” বলে ধাত্রী অপূর্বর কোলে তুলে দিল ছোট্ট পাখিকে। অপূর্ব তার মুখমণ্ডলে হাত বুলিয়ে জড়িয়ে নিল বুকে। ললাটে প্রথম আঁকল ভালোবাসার চিহ্ন। অবিলম্বে কান্না থেমে গেল তার। অপূর্বর গচ্ছিত অশ্রু ঝরে পড়ল পাখির চোয়ালে। মৃদু স্বরে বলল, “আমার পাখি। সরি মামুনি, তোর বাবা তোকে রাজকন্যার মতো সিংহাসনে তুলে দিতে পারল না। আমাকে ক্ষমা করিস মামুনি।
আরু কোথায়?”
“ও অসুস্থ। আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন ওর কষ্টের কথা। ভেতরে গিয়ে দেখা করে ওর পাশে থাকুন।
পুশ করতে গিয়ে চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরেছে।”
অপূর্ব পাখিকে আগলে ভেতরে প্রবেশ করে আরুর ক্লান্ত মুখ দেখল। পাশে বসে আরুর হাতটা মুঠো করে ধরল। চোখ মেলে তাকাতেই অপূর্ব বলল, “আরুপাখি, আমাদের পাখি এসেছে। অপূর্ব দেখতে তার মুখ।”
চলবে.. ইন শা আল্লাহ
#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৭
“তবে আমার ভাইটা যে চলে গেল। আমি যদি আরেকটু সময় ওখানে দাঁড়াতাম তবে অয়নকে হারাতে হতো না।”
বলতে গিয়ে আরুর চোখে বর্ষণের সূচনা হলো। পাখিকে আগলে নিয়ে আরুর সেই বর্ষণ মুছে দিল অপূর্ব। জড়ানো গলায় বলল, “কাঁদিস না আরুপাখি। এটাই নিয়তি। তবে আমার তীব্র আফসোস, সে সময়ে তোর পাশে থাকতে পারলাম না। বৃক্ষের মতো তোকে ছায়া দিতে পারলাম না।”
“অয়নকে দাফন দিয়েছে? মায়ের অবস্থা এখন কেমন?” আরুর পালটা প্রশ্নে প্রথমে অপূর্বর প্রতুক্তি দেওয়ার স্পৃহা জন্মালেও পরবর্তীতে রুষ্ট হলো। দৃষ্টি সরিয়ে খোলা জানালার বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে স্থির করে বলল, “তোর মা নেই। আমারও পরিবার নেই।”
অপূর্বর থমথমে কণ্ঠ আচমকা আবির্ভাব হয়েছিল বিধায় আরু খানিক ভড়কালো। ভীত অথচ কৌতূহলী গলায় বলল, “মানে? কী বলছেন আপনি?”
“যেটা শুনেছিস সেটাই। আমাদের সন্তান এখানে জন্ম নিয়েছে কেবল তোর মায়ের জন্য। এক সন্তান মা/রা গেলে বলে, সে নিঃসন্তান হতে চেয়েছিল। তাই আমি তাকে নিঃসন্তান করে এসেছি। আমার পরিবার তোর মাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। তাই পরিবার ছেড়ে চলে এসেছি। আমি আর ওই বাড়িতে ফিরব না তোদের নিয়ে।”
থমথমে গলায় কথাটা বলে ফের আরুর দিকে তাকাল অপূর্ব। নজরবন্দি হলো দেহের বিভিন্ন জায়গায় রক্তের ছিটা লেগে আছে। চকিতে অপূর্ব স্পর্শ করল সেই ক্ষতগুলো। রক্ত উঠে গেলেও সেখানে রয়ে গেলে দাগ, কিঞ্চিৎ ফুলে উঠেছে জায়গাটা। ভ্রুতে ভাঁজ ফেলে অপূর্ব বলল, “এগুলো কীভাবে হয়েছে?”
সত্যিটা বলা মানে অপূর্বর রাগে ঘি ঢালা। সত্য আড়ালের প্রচেষ্টা করতে হাত বাড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
“পাখিকে আমার কাছে দিন। খালা সেই মধু খাওয়াতে নিয়ে গেল, আর কোলে দিল না। পরিবার পরিকল্পনার কর্মীরা বলেছিল, জন্মের এক ঘণ্টার ভেতরে তার শাল দুধ খাওয়াতে হয়। কোলে দিন।”
“স্টপ আরু। আমি একজন ডাক্তার, আমাকে শেখাতে আসিস না, কখন কী করতে হবে! উত্তর না পেলে পাখিকে কোলে পাবিনা। তাড়াতাড়ি মুখ খোল।”
“অয়নকে আমিই দিঘি থেকে তুলে এনেছি। ডুব দিয়ে দিঘির মাঝে যখন খুঁজেছি, তখন বাঁশের কঞ্চির সাথে লেগে শরীর এভাবে আঁচড়ে গেছে।” নত গলায় বলে অপূর্বর থেকে পাখিকে কোলে নিয়ে নিল আরু। চট করে উঠে সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো অপূর্ব। পেছন থেকে আরু ডেকে থামাতে পারল না অপূর্বকে।
মিনিট ত্রিশ পর অপূর্ব ফিরত এলো জুনিয়র গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ইরফানকে নিয়ে। আরুকে পরীক্ষা করে ওকে জানাতেই অপূর্ব ব্যাকুল হলো আরুকে নিয়ে যেতে। পাখিকে ইরফানের কোলে দিয়ে আরুকে পাঁজাকোলা করে নিল। বিতৃষ্ণা ও ব্যথায় আরুর দেহ অবশ হয়ে আছে। অপূর্বর গলা জড়িয়ে ধরে আরু বলে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? এই অবস্থায় আমি যেতে পারব না।”
“ইরফানের সাথে এই বিষয়ে আমার কথা হয়েছে। সঠিক যত্নের সাথে নিলে সমস্যা হবেনা। আমি ভ্যানগাড়ির ব্যবস্থা করেছি। তুই শুধু ধৈর্যের বাঁধটা আরেকটু উঁচু কর।”
আরু রাজি হলো। ভ্যানগাড়িতে আরুকে তুলে, পাখিকে ঠান্ডা থেকে আঁকড়ে রাখল হৃদমাঝারে। ইরফানকে সাথে নিয়ে আহসান বাড়ির রাস্তা পেরিয়ে শহরের রাস্তা ধরতেই আরু থতমত খেয়ে বলল, “একি, গাড়ি এদিকে কোথায় যাচ্ছে? এটা তো বাড়ির রাস্তা নয়।”
“আমরা বাড়িতে যাব না আরু। আমরা ইরফানের বাড়িতে যাচ্ছি। আজ রাতটা ওর বাড়িতে থেকে আগামীকাল নতুন বাড়ি খুঁজে শিফট হব।” অপূর্ব নিজ সিন্ধান্তে অনড় থেকে বলল। আরু দুঃখের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে মরিয়া হয়ে উঠল। মেনে নিতে পারছে না পরিবার ছাড়া বসবাস। ইরফান তার স্ত্রী মিতাকে নিয়ে হাসপাতালের পাশের এক গলিতে বসবাস করে। অপূর্ব ও আরুর থাকার কথাটা মিতাকে জানাতে সে সব ব্যবস্থা করেই রেখেছে। ভ্যানসহ সেখানে পৌঁছাতে নজর এলো মিতাকে। দাঁড়িয়ে ছিল অপূর্বদের ফেরার অপেক্ষায়।
_
আহসান পরিবার ও মৃধা পরিবার দাঁড়িয়ে আছে সেই পরিস্থিতিতে। পারুল চাতালে বসে ভাবছে অপূর্বর কথাগুলো। ইমদাদুল হোসেন গামছা গলায় ঝুলিয়ে মোতাহার আহসানকে বলল, “পারুলকে আপনাদের বাড়িতে নিয়ে যান ভাইজান। যদি পারেন, ওকে পা/গ/লা গা/র/দে ভর্তি করে দিয়েন। পুরোপুরি সুস্থ হলে আমি নিয়ে আসব। এখন আমি আরুকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি। এক সন্তান হারিয়ে আমি শেষ হয়ে গেছি। আরেক সন্তানকে হারাতে পারব না। আমি আরুকে ফিরিয়ে আনতে গেলাম।”
বলে ইমদাদুর হোসেন থানার দিকে অগ্রসর হলে পারুল হিংস্র হয়ে এগিয়ে গেল ইমদাদুলের দিকে। শার্টের কলার টেনে উচ্ছৈঃস্বরে বলল, “আমাকে কী মনে করেন আপনি, আমি পা/গ/ল?”
“তুমি পাগল কি-না আমি জানি না। তবে তুমি এখন বিকৃত মস্তিষ্কের একজন মানুষ।” বলতে বলতে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো পেয়ারা গাছের ডালের দিকে। দুইশো ভোল্টের হলদেটে আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঝুলন্ত তাবিজ খানা। ইমদাদুল হোসেন আগেও একবার দেখেছিল সেই ঝুলন্ত তাবিজ। এগিয়ে গিয়ে পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পায়ের আঙ্গুলিতে
ভর দিয়ে উচ্চতা বৃদ্ধি করল। তাবিজ ধরে টান দিতেই শুষ্ক গাছের ডালটা ভেঙে পড়ল মাটিতে। এপিঠ-ওপিঠ করে দেখে বলল, “তাবিজটা তুমি এখানে ঝুলিয়েছ পারুল?”
“না।” পারুলের একরোখা জবাব।
“আমার সংসার ভাঙার পেছনে যে দায়ী তাকে এত সহজে আমি ছেড়ে দিব না।” তাবিজটা লুঙ্গিতে গুঁজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল ইমদাদুল হোসেন। শাহিনুজ্জামান মোতাহার আহসানের গা ঘেঁষে বলল, “ভাইজান, এভাবে কতদিন চলবে? আহসান বাড়ির বড় নাতনি জেলে থাকবে কতদিন? আপনি পারুলকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে থানায় চলুন। আমাদের অপূর্ব, আরুর পাশে থাকা দরকার। ওদের বোঝানো উচিত।”
“হুঁ।” বলেই দাদাজান ডানলেন চম্পাকে। চম্পার পেছনে পেছনে এসে দাঁড়ালেন অনিতা। সাথে এলেন জাহানারা, মণি ও মল্লিকা। শাহিনুজ্জামান আকারে ইঙ্গিতে স্ত্রীর মাধ্যমে রাগ দেখালেন সবাইকে, “দলবেঁধে চলে এসেছে। তোমাকে কেউ এখানে ডাকেনি, কাজে যাও। পারুলকে নিয়ে বাড়িতে যাও।”
গায়ে লাগতেই সবাই পা বাড়াল ফিরতি পথে। শাহিনুজ্জামান অনিতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি থাকো ভাবি, বাকিরা যাক।”
জায়গাটা নির্জন হলো। সন্তান হারা মাকে তৈরি হতে ঘরে নিয়ে গেল। অনিতা পরিষ্কার তার মত জানাল, “ওটা আমার ছেলের বাপের বাড়ি আবার পারুলেরও বাপের বাড়ি। দুজনের সমান অধিকার। ননদ হিসাবে আমার মতো যত্ন কেউ করে না। ‘ওর জন্য যদি আমার ছেলে বাড়ি ছাড়ে’ তাহলে দেখবে, ভাবির অত্যাচার কেমন হয়। পারুল তার সন্তানকে জলে ফেলে দিতে পারলেও আমি পারব না।”
অনিতা দ্বিতীয় মুহুর্তের আগমনের অপেক্ষায় রইল না। ধপাধপ পা ফেলে এগিয়ে গেল আহসান বাড়ির দিকে। পুরুষেরাও অগ্রসর হলো থানার দিকে। মহিলাদের জন্য প্রহরীর ব্যবস্থা করেছে। আসার সময় পায়ে হেঁটে এলেও, যাওয়ার সময় ভ্যানে বসে চলে গেল থানার দিকে।
__
গাছ গাছালির জন্য থানার সেই জমিটা ঘন হয়ে আছে সবুজ রঙে। শুকনো পাতা গাছ থেকে খসে পড়ছে টিনের ওপর। অনেক পাতায় রাস্তাঘাট দেখাই যাচ্ছেনা টর্চের আলোতে। মোতাহার আহসান থানার দোরগোড়ায় পৌঁছানোর পূর্বেই দারোগা সহ কনস্টেবল চলে গেছে, রয়েছে দুইজন হাবিলদার। কিছুটা এগিয়ে দেখতে পেল, ইমদাদুল হোসেন মাথায় হাত দিয়ে সরু বেঞ্চিতে বসে আছে। মোতাহার আহসান তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “এখানে বসে আছো কেন? ভেতরে চলো।”
“ভেতরে গিয়ে কী করব? অপূর্ব আরু কেউ নেই। অপূর্ব এসে আরুকে জোর করে কোথায় নিয়ে গেছে। ঠিকানা দিয়ে যায়নি।” ইমদাদুল হোসেন হতাশ হয়ে বললেন। বিনিময়ে মোতাহার আহসান দাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করলে একই কথা বলল। অপূর্বর নাম্বারে ডায়াল করল, বন্ধ বলছে একটি মেয়ে। কখনো বাংলায়, কখনো ইংলিশে। দাদাজান বিরক্তির সাথে বললেন, “সংযোগ কেন দিবে না? দিতেই হবে। আমাদের ফোনে টাকা আছে। আমরা সুন্দরনগরের চেয়ারম্যান।”
“শাহিন, তুই একটা ফোন কিনে দিস বাবাকে। তাহলে ফোন সম্পর্কে তার ধারণা জন্মাবে। কেউ যদি ফোন বন্ধ করে রাখে, তাহলে কীভাবে সংযোগ দিবে?” মোতাহার আহসান ইঙ্গিতে তার পিতাকে বলেন।পরপর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ইমদাদ বাড়িতে চলো, সেখানে গিয়ে কথা হবে।”
“আমি আমার বাড়িতে যাব, ভাইজান। পারুলকে দেখে রাখবেন। অপূর্ব ও আরুর কোনো খবর পেলে আমাকে জানাবেন।” দেহের ধুলাবালি ঝেড়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে চলে গেলেন ইমদাদুল হোসেন। অতঃপর সেই ভ্যানে করেই বাড়ির দিকে চলে গেল আহসান পরিবার।
স্বামী, দেবর ও শ্বশুরকে দেখে আশা আলো জ্বলে উঠেছে অনিতার মনে। কাছাকাছি যেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “পাখিকে দেখেছ? কেমন হয়েছে দেখতে, আমাদের মতো নাকি পারুলদের মতো দেখতে?”
“আমরা যাওয়ার আগেই অপূর্ব আরুকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে।” শাহিনুজ্জামান বলতেই মোতাহার আহসান নিজের ঘরে চলে গেলেন। আশার প্রদীপ দমকা হাওয়ায় নিভে গেল। অনিতা নিজের ঘরে গিয়ে দেখল, তার প্রাণনাথ জানালা খুলে অন্ধকার দেখছে। অনিতা কোমরে হাত দিয়ে কঠোর গলায় বলল, “তোমার কাছে আমার কথা কোনো মূল্য নেই, তাই তো? নিজের ছেলের প্রতি তোমার একটুও ভালোবাসা নেই?”
“আমাকে কি করব, বলো তুমি? আমি হাঁপিয়ে উঠেছি! আর এই বোঝা বইতে পারছিনা।” অশ্রুসিক্ত নয়নে নরম গলায় বলল, “ছেলের মুখের দিকে তাকালে নিজেকে সেরা অপরাধী মনে হয়না। পারুলের দিকে তাকালে নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়। এই যাতনা সহ্য করতে না পেরে কবে জানি আমি বাড়ি থেকে চলে যাই। মিলিয়ে যাই ঘোর অন্ধকারে।”
চলবে.. ইন শা আল্লাহ