নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৪৭+৪৮

0
428

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৭

দোতলা ছোটো লঞ্চ। ওপর থেকে নিচে তাকালে পানি দেখা যায়। এই প্রথম লঞ্চে উঠেছে আরু। আনন্দে রেলিং ধরে নিচে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তুর পাশে দাঁড়িয়ে ইশারা করছে ঘাটের দিকে। আরু কৌতূহল নিয়ে পাশে তাকাতেই বিস্মিত হচ্ছে। প্রয়াস ট্রাভেলিং ব্যাগ নিয়ে ঘাটের দিক থেকে এদিকে এগিয়ে আসছে। শঙ্কায় আরু জমে পেছনে তাকাল, অপূর্ব হেসে হেসে কথা বলছে। ঘনঘন পলক ফেলে তুরকে ঠ্যালা দিয়ে বলে, “প্রয়াস ভাই এদিকে আসছে কেন? ওনি দেখলে কিন্তু ভয়ংকর কিছু ঘটবে।”

“আমি তাকে আসতে বলেছি।”

“মাথা খা/রা/প তোর? আমি সিউর আজ কোনো ঝামেলা হবে। তুই তাড়াতাড়ি প্রয়াস ভাইকে যেতে বল।”

“সব প্ল্যান করা আছে। নো টেনশন ডু ফুর্তি।”

আরুর চিন্তার অন্ত নেই। করতে পারছে না ফুর্তি। প্রয়াস জ্যাকেটের পকেটে এক হাত রেখে অন্য হাতে ট্রাভেলিং ব্যাগ ঠেলতে ঠেলতে উপস্থিত হলো। মুচকি হেসে আরুকে অভিনন্দন জানায়, “ভাবী, কেমন আছেন? আমি যে ফুফা হচ্ছি, জানালেন না কেন?”

“আপনি কীভাবে জানলেন?” আরুর বোকা প্রশ্ন। জবাবে এক‌ গাল হেসে প্রয়াস বলে, “তুর জানিয়েছে।”

মাথায় হাত দিল আরু। মেয়েটা ঠোঁট কাটা। প্রকাশ হওয়ার আগেই প্রয়াসকে জানিয়ে দিয়েছে। আরু এই প্রসঙ্গ পালটে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে বলে, “আমার বাবুর না হওয়া ফুফাকে এখানে দেখলে আমার বাবুর বাবা তাকে পানিতে ফেলে দিবে। ফুফা হতে চাইলে এখান থেকে যেতে হবে।”

“দূরে দূরে থাকলে ফুফা হব কীভাবে? দেখা যাবে, বিয়েটাই হবে না।”
তিন জনের কথপোকথনের মাঝে এলো অপূর্ব। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলে, “আপনি কে?”

চেনার সত্ত্বেও অজানার ভান ধরে প্রয়াস বলে, “আপনি কে?”

“আমার বোন আর আমার বউ।”

“ওহ্। আসলে ঘাট থেকে দেখলাম, দুজনে নিচের দিকে ঝুঁকে নদী দেখছে। মাথা ঘুরে যদি পড়ে যায়, তাই বারণ করলাম ভাই।”
প্রয়াসের কথায় অপূর্বর মনে পড়ল, আরু ইদানীং মাথা ঘুরে। আরুকে টেনে কিনার থেকে মধ্যে আনল। সৌজন্য হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “ধন্যবাদ।”

হাত মিলিয়ে প্রয়াস বলে, “এটা আমার কর্তব্য। তা আপনারা কোথায় যাচ্ছেন ভাই?”

অপূর্ব বলে, “আমরা আনন্দনগর যাচ্ছি। ভালো ডাক্তারের খোঁজে। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

“আমি সাধারণত ট্যুরিস্ট। সময় পেলেই দেশ ঘুরি। কোথায় যাচ্ছি ঠিক জানি না। যেখানে যাই মিনিমাম চার দিন থাকব।” শুরু হলো হবু শ্যালক ও দুলাভাইয়ের কথপোকথন। অপূর্ব বিদেশে থাকতে সময় পেলেই বনভোজনে যেত। সেই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির করছে প্রয়াসের সাথে‌। আওয়াজ তুলে লঞ্চ অগ্রসর হলো যাত্রাপথে। আরু চেয়ারে বসে প্রকৃতি দেখছে। ঠান্ডা লাগলেও এই দৃশ্য এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সুন্দরীর দুই পাশে শেফালী ও কালাচাঁন বসে আছে। সম্পর্কে বিরাজমান কিন্তু। সুন্দরী চায়, এই দম্প্রতি সুখী হোক। চেয়ার থেকে উঠে আরুকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমার সাথে একটু ওয়াশরুমে যাবে?”

“চলুন।” আরু ও তুর দুজনে চলল সুন্দরীর সাথে। সুজন ভালো ছবি তুলতে পারে। ক্যামেরা ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে প্রয়াস। শেফালীদের থেকে কিঞ্চিৎ দূরে তিস্তার ছবি তুলে দিচ্ছে সুজন। শেফালী কাতর দৃষ্টিতে তিয়াস ও সুমিকে দেখছে। কালাচাঁন জানে শেফালীর ভাঙা হৃদয়ের কথা। ফাঁকা চেয়ারে শেফালীর পাশে বসে বলে, “শেফু, চলো একটু হেঁটে আসি।”

“ইচ্ছে করছে না।”

কালাচাঁন উঠে এগোল। না বলার পরেও শেফালী কালাচাঁনের পেছনে পেছনে গেল। তিস্তা ওদের লক্ষ করে বলে, “একসাথে দাঁড়া, ছবি তুলে দেই। তোদের তো কাপল পিক নেই।”

তারপরে ক্যামেরাবন্দি করল দুজনের ছবি। অপূর্ব প্রয়াসের সাথে কথা বলতে বলতে বলে, “আমার বউ কোথায়? আমিও কাপল পিক তুলব।”

“অপূর্ব ভাই, সব জায়গায় জোড়া জোড়া। কিন্তু আপনারা তিন জন। এজন্য আরু জোড়া নিয়ে আছে, আপনাকে পাত্তা দিচ্ছেনা।”

“এই শীতে বউ ছাড়া থাকা যায় না। তাই বউ রাগ করে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সাথে সাথে রাগ ভাঙিয়ে নিয়ে এসেছি।” অপূর্বর কথায় মাঝেই সেখানে এলো আরু। শুরু হলো তাদের ছবি তোলার মুহূর্ত। দুপুর গড়িয়ে আসতেই টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খেতে বসল সকলে। প্রয়াস সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই অপূর্ব তাকে থামায়‌। খিচুড়ি রান্না করে দিয়েছি। অপূর্ব নিচের টিফিন ক্যারিয়ান নিয়ে আরুকে নিজের হাতে খাওয়ায়। চাদর খামচে ধরে ঠকঠক করে শীতে কাঁপছে ও খাচ্ছে আরু। অপূর্ব নিজের জ্যাকেট খুলে আরুর কোলের ওপর রেখে বলে, “একটু আগেও তুই এতটা কাঁপিসনি।”

“ওয়াশরুমে গেলাম না? ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তুরের জন্য দাঁড়িয়েছি। পেছনে অনেক বাতাস। সেই বাতাসে কাঁপা শুরু হয়েছে, থামার নাম নেই।” খেতে খেতে কথা ও কম্পন চালিয়ে যাচ্ছে আরু। উঠল মস্তকে। ছিপি খুলে বোতল তুলে পান করল পানি। মাথায় চাপড় দিয়ে বলে, “আস্তে আস্তে খা।”

“আর খাবো না।”

“ঠিক আছে।” অতঃপর অপূর্ব নিজে খেতে থাকল। দীর্ঘক্ষণ পূর্বে রান্নার ফলে খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছে। খেয়ে সবাই কাঁপছে। প্রয়াস খেয়ে সবাইকে প্রস্তাব দিল, “চলুন সবাই মিলে চা খাই। ঠান্ডা খিচুড়ি আর পানি খেয়ে ভেতরটা বরফ হয়ে গেছে।”

প্রয়াসের দেওয়া প্রস্তাব পছন্দ হলো সকলের। ধাপে ধাপে পা ফেলে সবাই নিচতলায় চায়ের দোকানে গেল। এগারো কাপ চায়ের অর্ডার দিল। অর্ডার দেওয়া চা মনোমতো না হলেও ঠান্ডা কমানোর ওষুধ হিসেবে কাজ করছে। তিয়াস খানিক কৌতূহল নিয়ে বলে, “অপূর্ব ভাই, আমরা কোথায় যাচ্ছি? মানে আনন্দনগরে গিয়ে আমরা কোথায় থাকব?”

আরুর চায়ে ফুঁ দিয়ে সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে এলো অপূর্ব। চা আরুর হাতে দিয়ে নিজে এক কাপ নিয়ে প্রতুক্তি করে,
“তোমার-আমার দাদির বাবার বাড়িতে। দাদি হচ্ছে তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ছেলে না থাকার কারণে তাঁদের মৃত্যুর পর বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। সেকেলের এক কর্মচারী বাড়িটার দেখাশোনা করে। বাবা প্রতি মাসে ডাকপিওনের মাধ্যমে চিঠি ও টাকা পাঠায়। আমাদের যাওয়ার কথা ফোনে জানিয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন তিনি।” বলতে বলতে অপূর্ব চা-টুকু খেয়ে ফেলেছে। প্রয়াস ছক কষে বলে, “যদি কিছু মনে না করেন, তবে আমি কি আপনাদের সাথে যেতে পারি? আসলে পরিত্যক্ত বাড়ি ভ্রমণ করার ইচ্ছে অদম্য।” বিরতি দিয়ে বলেন, “প্রয়োজনে আমার খাবারের খরচ আমি বহন করব।”

“আমার বাবা হচ্ছে, সুন্দরনগর গ্ৰামের চেয়ারম্যান। আপনি তার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে টাকার বিনিময়ে খাবেন? এতে বাবা অপমানিত হবে। আপনার সমস্ত খরচ আমাদের।” আরুর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায় অপূর্ব। চায়ের বিল পরিশোধ করার পূর্বেই প্রয়াস মিটিয়ে দিল। কেবল মুচকি হাসল সকলে। ইতঃপর আরুকে নিয়ে গেল নিচতলার ইঞ্জিনের কাছে। ইঞ্জিন ঘরের বাইরে বেশ গরম লাগছে। অপূর্ব আরুর হাত চাদরের নিচ থেকে বের করে লোহার সাথে লাগাল। কিঞ্চিৎ সময়ে উষ্ণ হয়ে এলো হাত। অপূর্ব হাসি দিয়ে আরুর অপূর্ব ভাই বলে, “ঠান্ডা কমেছে?”

“হুঁ। এখানে ঠান্ডাই লাগছে না। সবাইকে এখানে ডেকে নিয়ে আসি।”

“উঁহু। জাহাজে আমাদের একটু প্রাইভেট সময় কাটানোর দরকার। বাবু আসলে তখন তোমার সাথে গোপন সময় কাটাতে পারব কি-না, জানা নেই। আসো।” দুহাত বাড়িয়ে আরুকে কাছে ডাকল অপূর্ব। চাদর ফাঁক করে অপূর্বর ডাকে সাড়া দিয়ে জড়িয়ে ধরল আরু। ঢেকে দিল অপূর্বকেও। আরুর তুলতুলে শরীরের তাপ অপূর্বকেও উষ্ণ করে দিয়েছে। বুকে মাথা রেখে পরম শান্তি অনুভব করে আরু বলে, “আমাকে এত কেন ভালোবাসেন?”

“তোমাকে ভালোবাসি না। আরুপাখিকে ভালোবাসি, নিজের বাম পাঁজরের একটি হাড়কে ভালোবাসি। যাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”

অদূরে এক ঝাঁক গাঙচিল উড়ে আসছে লঞ্চের পেছনে পেছনে। মাছ খোঁজা রেখে তার সাক্ষী হচ্ছে অপূর্ব আরুর প্রেমময় লগ্নের।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৮

এক দিকে নদী অন্য দিকে সারিবদ্ধ গাছ। গাছের পর বিশাল বিশাল ধানখেত। তার অধিকাংশ ধান কে/টে ঘরে তোলা হয়েছে। অবশিষ্ট কুটো কে/টে ফেলা রাখা হয়েছে খেতে। সবকিছু অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে ছাদ খোলা গাড়ি। ইতোমধ্যে মাগরিবের আজানে মুখরিত চারপাশ। আরু উঁকি দিয়ে আনন্দনগর দেখার চেষ্টা করছে। অপূর্ব আরুর মাথাটা ভেতরে টেনে থমথমে গলায় বলে, “সমস্যা কী? বাইরে মাথা বের করছিস কেন? অতিরিক্ত ঠান্ডায় কুয়াশা হিমাঙ্কের নিচে নেমে তুষারের মতো পড়ছে। এমনিতেই আমরা লঞ্চে করে এসেছি। এখন তুই এমন পা/গ/লা/মি করলে ঠান্ডার লাগবে।”

“লাগবে না ঠান্ডা। দেখুন, কী সুন্দর! হালকা হালকা তুষার পড়ছে। মনে হচ্ছে আমি অ্যান্টার্টিকা মহাদেশে আছি।”

“অ্যান্টার্টিকা মহাদেশে থাকে পেঙ্গুইন, সেখানে মানুষ থাকতে পারে না। তুই কি মানুষ না? পেঙ্গুইন? তোর পেটে মানুষ পাখি না-কি পেঙ্গুইন পাখি।” অপূর্ব বিস্মিত হয়ে বলে। উপস্থিত সবাই হাসল। জানা সত্ত্বেও অজানার ভান ধনে প্রয়াস বলে, “ভাই, আপনি বুঝি বাবা হবেন?”

“হুঁ। আমিও তাই জানি। আমার মতে, এই সময়ে মেয়েদের সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু তোমার ভাবি আমার কথা শোনে না।”

“কচুর ডাক্তার আপনি। ডাক্তার হয়েও আপনি আমার অসুখ বুঝতে পারেননি। আমি যতটা মেধাবী ছাত্রী ,আপনি ততটা মেধাবী ছিলেন না। নির্ঘাত টুকে পাস করেছেন।” ভেংচি কা/ট/ল আরু। অপূর্ব তো মনের ডাক্তার। তার বোঝা উচিত ছিল আরুর মন খা/রা/পের কারণ। এক নিমেষে অন্যের রোগ সারিয়ে দিতে পারলেও বউয়ের কাছে টুকে পাস করা ডাক্তার। ততক্ষণে গাড়ি এসে থেমেছে তার গন্তব্যে। এগারো জন গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করে দাঁড়ায় প্রবেশদ্বারের কাছে। ফোন বের করে কর্মচারীর নাম্বারে ডায়াল করল। ঘন কুয়াশায় নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে কল ঢুকল না। তবে কিছুক্ষণের ভেতরে হারিকেন হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো একজন চাদর ঢাকা লোক। পাকা দাড়ি, শ্যাম বর্ণ গায়ের রং, গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। অন্যহাতে লাঠি। ঠুকঠুক করে লাঠিতে ভর দিয়ে বলে, “তোমরা কি আহসান বাড়ির লোক, মির্জা বাড়িতে এসেছ?”

“জি। আপনি ইলিয়াস আলী?”

“জি। ভেতরে আসুন। পরিত্যক্ত মির্জা বাড়িতে আপনাদের স্বাগতম। অনেকদিন পর এই বাড়ি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠল। ভেতরে আসুন সকলে।” হারিকেনের আলো ধরে সবাইকে ভেতরে নিলেন ইলিয়াস আলী। গা ছমছমে পরিবেশ। ক্ষমতার কারণে মোতাহার আহসান বাড়িতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পারলেও এখানে বিদ্যুৎ নেই। প্রতিটা মেয়ে তার প্রিয়তমর হাত জড়িয়ে ধরে আছে। অপূর্ব খানিক কৌতূহল নিয়ে বলে, “এখানে আলোর ব্যবস্থা নেই? বড় বাড়িতে আমরা এই কয়জন। ভয় করবে রাতে।”

“আলো নেই। হারিকেনের ব্যবস্থা করেছি সবার জন্য। নিচতলা তালাবদ্ধ, আপনাদের থাকার ব্যবস্থা দোতলায় করেছি। আপনারা সবাই ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিন। কাল সকালে আপনাদের গ্ৰাম ঘুরিয়ে দেখাব।”

“আচ্ছা।”

ইলিয়াস আলী বালতি ভরতি করে রেখেছিলেন পানি। সেই পানি দিয়ে সবাই হাতমুখ ধুয়ে পরিপাটি হয়ে নিল। খাবার টেবিলে বসতেই দেখতে পেল গোরুর গোশত ও রুটি। তরকারির রং যেমন, স্বাদও তেমন। তিয়াস খেয়ে বলে, “চাচা, কে রান্না করেছে এই খাবার?”

“আপনাদের ভালো লাগেনি?”

“অসাধারণ হয়েছে। আপনাকে দেখে মনে হয়না, আপনি রেঁধেছেন।”

“আমার স্ত্রী। আপনাদের আসার খবর শুনেই হাট থেকে গোরুর গোশত ও আটা কিনে এনেছি। স্ত্রী রান্না করে দিয়েছে।”

“আপনিও বসুন। আমরা সবাই একসাথে খাই।” সুজনের কথায় তাল মেলাল সবাই। কিন্তু ফলাফল শূন্য। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেয় ইলিয়াস, “আপনাদের চাচি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে না খাইয়ে সে খায় না। তাই বাড়িতে ফিরে একসাথে খাবো।”

বিয়ের এত বছরেও জীবন্ত ভালোবাসা। সবাই হাসে। তাকায় তার সহধর্মিণীর দিকে। অপূর্ব বলে, “তবে আপনি চলে যান‌। আমরা খেয়ে শুতে যাব।”

“এঁটো থালা-বাসন আমাকে ধুয়ে রেখে যেতে হবে। নাহলে দুর্গন্ধ আসবে।”

“আপনি যান, আমরা এইটুকু করে রাখতে পারব।” অপূর্ব লোকটাকে যাওয়ার অনুরোধ করলেও তিনি নাকচ করে। কিন্তু অপূর্ব যে একরোখা। তাই বেশিক্ষণ জেদ ধরে রাখতে পারে না ইলিয়াস।‌ সবকিছুর দায়িত্ব সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। খাওয়াদাওয়া শেষ করে তিস্তা ও সুমি মিলে থালা-বাসন ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলে।
__
ঘড়ির কাঁটা তখন দুইটার ঘরে। দোতলায় ছয়টা ঘরে এগারো জন মানুষ শুয়েছে। সবাই গভীর তন্দ্রায় ব্যস্ত। সবার কিনারের গোপন ঘরটিতে শুয়েছে অপূর্ব, আরু। তার সাথের ঘরটিতে সুজন, তিস্তা। তার পাশের ঘরে তিয়াস ও সুমি। বিপরীত দিকের ঘরে প্রয়াস। দ্বিতীয় ঘরে তুর ও সুন্দরী, শেষের ঘরে কালাচাঁন ও শেফালী। একদম পাশে হওয়ার কারণে ঠান্ডা একটু বেশিই। ভারী ভারী কাঁথায় শীত ঠেকাতে পারছেনা। দুজনের মাঝে তখন পাহাড় সমান দূরত্ব। যার নিচে হাওয়া প্রবেশের ব্যবস্থা করা। কালাচাঁন কাত হয়ে শেফালীর দিকে ফিরে বলে, “এদিকে আসো‌। ফাঁক দিয়ে হাওয়া ঢুকছে। এমন হাওয়া ঢুকতে থাকলে কাঁথা গরম হবেনা, ঘুমও হবে না।”

“নাহলে নেই।”

“লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, এদিকে এসো। নাহলে আমি কাঁথা টেনে নিয়ে যাবো।” কথাটা বলে শেফালীকে কিছু সময় দিল কালাচাঁন। সময়কে সঠিক ব্যবহার করতে পারল না শেফালী। বিনিময়ে এক টানে সবটুকু কাঁথা টেনে নিল কালাচাঁন। খামচে ধরলেও শেষ রক্ষা হলো না। চাপা রোষে শেফালী ওড়না দিয়ে দেহ ঢেকে নিল। ঠকঠক করতে কাঁপতে থাকে অনবরত। সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে শীতের তাণ্ডব তত বেড়ে চলেছে। নিরুপায় হয়ে শেফালী উভয়ের দূরত্ব ঘোচাল। কাঁথা ও কথা, উভয় টানতে টানতে বলে, “ছাড়ুন। শীত করছে।”

কালাচাঁন ছাড়ল। শেফালী কেবল কাঁথার ভেতরে ঢুকল না, ঢুকল কালাচাঁনের বাম পাঁজরে। যেন ভেঙে অন্য পাশ দিয়ে চলেও যাবে। কালাচাঁন তার উষ্ণ শরীর দিকে শেফালীর ঠান্ডা শরীর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে হেসে বলে, “তুমি এক লাইন কম বুঝলে হয় না? এই শীতে কাঁথা ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব। সেখানে তুমি অযথা আমাকে রাগ দেখিয়েছ।”

ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল কালাচাঁন, শেফালী। শোনা গেল নূপুরের শব্দ। ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে শব্দ। আরুর কানে যেতেই নিভুনিভু দৃষ্টিতে তাকাল। ফাঁকা ঢোক গলা বেয়ে নেমে গেল ভয়ে। অপূর্বকে জড়িয়ে রাখা হাতটা বুকের কাছে এনে ধাক্কা দিয়ে বলে, “শুনছেন, কে জানো নূপুর পরে নাচছে। আমার ভয় করছে।”

“কোথায়? আমি তো শুনতে পাচ্ছি না। বোধ হয় তুমি তোমার পায়ের নূপুরের শব্দ শুনতে পারছ, আরুপাখি। আমার বুকে শুয়ে থাকো। কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।”

“ভূত, পেতনি। অপূর্ব ভাই, আপনি শুনতে পারছেন না নূপুরের শব্দ?” আরু ভয়ে অপূর্বকে শক্ত করে ধরে কাঁপছে। অপূর্ব চোখ পরিষ্কার করে তাকাল। চোখে হলদে আলো পড়ার আগে কানে এলো নূপুরের শব্দ। অপূর্ব লক্ষ করল আরু নিশ্চল, অথচ বেজে চলেছে নূপুরের ধ্বনি। এবার অপূর্বর মনে ভয় হানা দিল। দুজনে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে থাকল। কানে এলো দরজা ধাক্কা দেওয়ার মতো শব্দ। দরজায় করাঘাত করতে করতে কেউ যেন তিস্তার‌ গলায় বলে, “অপূর্ব ভাই, দরজা খুলুন।”

অপূর্ব সাড়া দিল না। মাঝে মাঝে অন্যের কণ্ঠে কথা বলে তারা। শুনতে পেল তুরের গলা, “ভাইয়া দরজা খুলুন!”

“দরজা খুলুন।” তিয়াসের গলা।

“ম/রে গেলাম গো। দরজা খুলুন।” শেফালী বলে। চারটার বেশি গলা শুনলে অপূর্ব আরুকে নিয়ে উঠে বসে। এক হাতে আরুকে ধরে অন্য হাতে হারিকেন নিল। দরজার ছিটকিনি খুলতেই যুবক-যুবতিরা ঘরের ভেতরে ঢুকে হাঙ্গামা শুরু করে দিল, “চলুন আমরা এখন বাড়িতে ফিরে যাই।”

প্রয়াস বলে, “ভাই আমি পরিত্যক্ত বাড়ি ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন, ভূতের বাড়ি না।”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে