#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪০
“তোমাদের ঘরে কোনো সন্তান নেই। মায়ের কাছে শুনেছি তোমরা অনেক চেষ্টা করেছিলে। আমি মনোচিকিৎসক হলেও এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারব। চাচার সাথে কথা বলে পরামর্শ নিতে আমার কাছে দুজনে এসো।” অপূর্বর কথাতে থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হলো। চম্পাকে ধাক্কা দিয়ে মণি বলে, “দেখেছেন মা, আপনার নাতি আমাকে কী বলল? আমি ওর চাচি হই। বয়সে আমি ওর সমবয়সী হলেও সম্পর্কে চাচি। ও কীভাবে এমন কথা আমাকে বলছে?”
“গতকাল আমি তোমাকে বারণ করলাম। আজকেও তুমি এমন কোনো কথা বলেছ নিশ্চয়ই, যাতে অপূর্ব লজ্জাজনক কথা বলেছে। আমার ছেলে ইদানীং ঠোঁট কাটা হয়ে যাচ্ছে। কথা বললে লজ্জা তুমিই পাবে।” এঁটো বাসন একত্রিত হয়ে মল্লিকার হাতে তুলে দিল অনিতা। তখনই সেখানে মিষ্টি নিয়ে উপস্থিত হলো কালাচাঁন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বড়ো করে সালাম দিল। সালাম বিনিময়ের পর কালাচাঁন ভেতরে এলে মল্লিকা হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বলে, “এত মিষ্টি আনার কোনো দরকার আছে কালাচাঁন? গতকাল কতগুলো মিষ্টি নিয়ে আসলে।”
“মা পাঠিয়েছে। আমি আজকে আসতে চাইনি, মা জোর করে পাঠিয়েছে।” বলতে বলতে চেয়ার টেনে কালাচাঁন বসতেই আরু উঠে দাঁড়াল। অবাধ্য দৃষ্টি আরুর দিকে পরতেই কালাচাঁন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আরুর রূপ ক্রমশ প্রকট হওয়াতে সবাই ঘায়েল হচ্ছে, বাদ নেই কালাচাঁন। ঠোঁট চেপে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে টেবিলে তাকাল। শেফালীর সাথে বিয়েতে মত দেয়নি কালাচাঁন, সুন্দরীর কথায় সায় দিয়েছে। ‘আরুর দিকে তাকাবে না’ – এই পণ করে কালাচাঁন এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে পান করে। মল্লিকা জামাতার জন্য খাবার সাজাতে সাজাতে বলে, “বেয়ানকেও আসতে বলতে। কুটুম বলে কথা, তার থাকা প্রয়োজন।”
“আসলে বাড়ি ফাঁকা রেখে মা বের হয় না।”
“এই শেফু, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জামাইকে নিজের হাতে খেতে দে।” থালা এগিয়ে শেফালীর দিকে দিয়ে বলে মণি। রোষে থালাটা কেড়ে নিয়ে শব্দ তুলে টেবিলের উপরে রাখে শেফালী। আরুর চুলের খোঁপাও খুলে গেল সেই কম্পনে। মল্লিকার হাত ধরে টেনে শেফালী নিয়ে গেল তার ঘরে। দরজাটা বন্দ করে অবাধ্য গলায় বলে, “তোমরা কী চাইছ মা? তোমাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি, আমি এই বিয়ে করব না।”
মল্লিকা বলে, “কালাচাঁন আগের থেকে ভালো হয়ে গেছে।”
“তুমি দেখেছ, ও আরুকে এখনো ভালোবাসে। গত পাঁচ বছর ধরে আরুকে ভালোবাসে কালাচাঁন। এক নিমেষে আমার সাথে বিয়ে হয়ে গেলে, তারপরে আমি কি আদৌ ওর সাথে সংসার করতে পারব? ওর মনে আরু চলাচল করবে।” বুকে হাত গুজে বলে শেফালী। নিজের ভালোবাসাকে ভুলে অন্য কাউকে আপন করে নেওয়া সম্ভব নয় শেফালীর। বাম হাত ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে শেফালীকে ধমকায়, “এক চড়ে তোর সব দাঁত আমি খুলে ফেলব। কালাচাঁনের মনে আরু থাকবে, নাকি তোর মনে তিয়াস থাকবে। কী ভেবেছিস, আমি কিছু জানি না! আমি সব জানি।
তোর সাথে আমি অনেকদিন কথা বলিনি এরজন্য। তুই থাকলে তুই, তিয়াস ও সুমি কেউ সুখী হতে পারবি না। তাই কালাচাঁনকে বিয়ে করতেই হবে তোকে, নাহলে আমাকে মা বলে ডাকবি না।”
“মা!” বাক্য স্ফুট করার পূর্বেই শেফালী চোখ রাঙায়, “চুপ! একদম চুপ! ভাইজান আমার থেকে সুযোগ চেয়েছে, আমার বিশ্বাস সে ভুল করবে না। সে এলাকা মেরামত করে দেয়, আমার মেয়ের জীবন মেরামত করতে পারবে না? (থেমে) শোন মা, যাকে চেয়েছিস তাকে পাবি না বলে জীবনটা শেষ করে দেওয়া মহৎ কাজ নয়। তুই আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কালাচাঁনকে একটা সুযোগ দে। কালাচাঁন তোর মন ভালো বুঝবে, তুই বুঝবি কালাচাঁনের মন।”
অতঃপর মল্লিকা চলে গেল উঠানে। ইতোমধ্যে আরুকে দেখতে এসেছে গ্ৰামবাসীরা।
__
সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে এলো। মৃধা বাড়ি থেকে আরুর সাথে দেখা করতে এসেছে আরুর অভিভাবক। অবিলম্বে আরু ছুটে গিয়ে ইমদাদ হোসেনকে জড়িয়ে ধরে। মিষ্টির প্যাকেট ডানহাতে, বামহাতে আরুকে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “কাঁদছিস কেন? আমরা তো চলে এসেছি। পাগল মেয়ে আমার।”
“বাবার কাছেই যাবি, আবার কাছে আসবি না।” বলেই পারুল কাছে টেনে নিল আরুকে। অয়ন মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে পরিবেশ। একরাতে বোনকে হারানোর যাতনা অনুভব করেছে বলেই পেছন থেকে আরুকে জড়িয়ে ধরে বলে, “বুবু, আমার খোঁজ করলি না?”
মাকে ছেড়ে আরু হাত বুলিয়ে দিল অয়নের মাথায়। সন্দিহান গলায় বলে “তুই কি আর আমাদের সাথে থাকবি না বুবু?”
“না। যাবো, দুই একদিন থেকে চলে আসব। আমি যাবো না বলে, তুই তো অনেক খুশি হয়েছিস! এখন আর কেউ বাবার নিয়ে আসা খাবারে ভাগ বসাবে না, কেউ তোর যত্ন নেবে না, তোর জন্য দিঘি থেকে পানি তুলে তোকে গোসল করিয়ে দেবে না। এখন পুরো বাড়ি তোর।” আরুর কথায় অয়নের মন ভার হয়ে এসেছে। যে মেয়েটার উপস্থিতিতে ঈর্ষা প্রকাশ করত, আজ তার অনুপস্থিতিতে উৎফুল্ল প্রকাশ করার কথা। অথচ অয়নের চোখে পানি। অপূর্বকে হলুদ পাঞ্জাবি পরে উপস্থিত হতে দেখা গেল শ্বশুর শাশুড়িদের সামনে। সালাম বিনিময়ের পর অয়নকে কোলে নিয়ে বলে, “সালা বাবুর কী খবর? আজ বোনের সাথে এত ভাব কেন?”
“ভাইয়া বুবুকে আমি নিয়ে যাই? ও আমাদের সাথে থাকুক।”
“তাহলে আমি থাকব কীভাবে? বিয়ের পর স্বামীর বাড়িই স্ত্রীর বাড়ি। ও গিয়ে দুই একদিন থেকে আসতে পারবে, কিন্তু আজীবন আমার কাছেই ওকে থাকবে হবে।” অপূর্ব বলে থামতেই একদল যুবতি ভেতরে প্রবেশ করে বলে, “তাই বুঝি দুলাভাই? এখনই বউকে ছাড়া থাকতে পারছেন না।”
অপূর্ব মুচকি হেসে বলে, “কেমন আছো তোমরা?”
“ভালো। আপনি কেমন আছেন? আমাদের দেওয়া শর্তের কথা ভুলে গেছেন?”
“শ্যালিকা হচ্ছে আধা ঘরওয়ালী। পাঁচজন শালির আড়াই ঘর আর আরুর একাই এক ঘর। কোনটা বড়?” বলে অপূর্ব মুঠো করে বাকি টাকা দিয়ে দিল। তন্বীরা আরুকে টেনে নিয়ে এলো দোতলায়। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে শেফালী না এলেও বাদ গেল না তুর। আরুকে গোল করে বসে মিতু বলে, “কাল রাতে কী কী হলো?”
তন্বী আগ্রহ প্রকাশ করে, “দেনমোহর পরিশোধ করেছে?”
আড়ষ্ট হয়ে আরু চুপ করে আছে। তুর বেজায় বিরক্ত হয়ে বলে, “আমি চেয়েছিলাম, ওদের ঘরে একটা ক্যামেরা ফিট করে রাখতে। কিন্তু একবার ধরা পড়লে জামিন নেই। তাই দুঃসাহসিকার কাজ করিনি।”
আরু চোখ রাঙায়, ‘যার অর্থ অপূর্ব ভাইকে বলে দিবে।’ আঁখি রঙ্গ করে বলে, “আমাদের বোঝার বাকি নেই, তোর ভেজা চুল বলে দিচ্ছে সব। (থেমে) কী কী হয়েছে, না বললে বুঝব কীভাবে?”
আরু উঠে বারান্দার দরজা খুলে দিল। ছয় জনে বারান্দার নীলপদ্ম দেখে ত্বরা হয়ে ছিঁড়তে গেলেই বাদ সাধল আরু। এই পদ্মে কেবল তার অধিকার। বলতে শুরু করল লজ্জায় রাঙানো সেই মুহুর্ত। সব শুনে বিস্মিত যুবতির দল। অপূর্বর প্রেমমূলক বার্তা শুনে অবাক। থমকানো মুখে আঁখি বলে, “তোর জামাই এত রোমান্টিক? আমার ভাগ্যে যেন এমন অপূর্ব জোটে।”
“অপূর্ব আহসান একটাই, সে শুধু আমার। তারমতো কেউ হতে পারবে না।” গর্বে আরুর বুক ফুলে উঠে। আরুর কথা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অনিতা শুনে ফেলে। না শোনার ভান ধরে বলে, “তোমরা সবাই এখানে বসে আছো, কষ্ট করে আরুকে হলুদের শাড়িটা পরিয়ে দাও। আমরা হলুদ বাটছি।”
“দিন।” তারপরে সবাই মিলে আরুকে শাড়ি পরাতে ব্যস্ত হলো। আরু খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবে সেদিনের কথা। যেদিন ‘অপূর্বর বউয়ের’ ভাগ্য নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছিল।
চলবে.. ইন শা আল্লাহ