নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
481

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৭

“আরুপাখি, আজ নিজের ইচ্ছায় তুই আমার কাছে এসেছিস। আমার গলা জড়িয়ে ধরেছিস। তুই কি সত্যি আমার আরুপাখি?” দুহাত আরুর পিঠে রেখে অপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রেমময় কণ্ঠে বলে অপূর্ব। আরু আজ লজ্জা পায় না, নিজের দৃষ্টি অপূর্বর চোখে নিবদ্ধ করে বলে, “এই যে আংটি পরিয়ে আপনি আমাকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাই তীব্র অধিকার বোধ থেকে আপনার সান্নিধ্যে এসেছি।”

“এই কথাটা যাতে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত তোর মুখ শুনতে পারি। তখন যাতে তোর মাথা নতজানু হয়ে না যায়।”

“শুক্রবার কী?”

“আনুষ্ঠানিকভাবে তুই চিরতরে অপূর্ব আহসানের হয়ে যাবি।” অপূর্ব ও আরুর এই মধুমাখা মুহুর্তে খলনায়িকা হয়ে প্রবেশ ঘটে তুর ও শেফালীর। দুই মানবের আগমনে তুই তৃষ্ণার্ত কপোত কপোতী বিচ্ছিন্ন হলো। অপূর্ব উঠে পোশাক ঠিক করতে করতে নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস করে বলে, “তোরা এখানে কেন এলি? ডাকলেই তো পারতি।”

“আমাদের আরুর সাথে কথা আছে। বাবা আপনাকে ডাকছে, কিছুক্ষণের ভেতরে আমরা বাড়ির দিকে যাত্রা করব।” নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলে তুর হেলে পড়ে শেফালীর কাঁধে। অপূর্ব দুকদম এগিয়ে বোনদের আড়ালে আরুর হাতে বাটন ফোনটা গুঁজে দেয়। আরু খানিক প্রশ্ন করে, “কী এটা?”

“প্রেম বার্তা পাঠানোর মাধ্যম। সবসময় সাথে সাথে রাখবি, কল করলে যাতে সাথে সাথে পাই। কলে কথা বলতে না পারলে মেসেজ পাঠাবি।” অপূর্ব চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে গেল আরুর ঘর থেকে। অপূর্বর অনুপস্থিতে আরুকে ঝোঁকে ধরল দুই বোন।
__
আহসান বাড়িতে লেগেছে বিয়ের আমেজ। নারীরা অপূর্বর জন্য হলুদ মেহেদী বাটছে পাটায়। অপূর্বর পরনে লুঙ্গি ও সেন্টো গেঞ্জি, গলাতে লাল গামছা ঝুলানো। অপূর্ব ঘরের ভেতরে লজ্জানত হয়ে আছে, তাকে পচাচ্ছে তিয়াস। তিস্তা ও সুজন গতকাল রাতে ফিরেছে। বৈঠকখানায় বোনদের আনন্দের ঢেউ উচ্ছে পড়ছে। তখনই পান, সুপারি ও মিষ্টি নিয়ে কালাচাঁন ও তার মা সুন্দরী উপস্থিত হয় আহসান বাড়িতে। আনন্দপূর্ণ লগ্নে কালাচাঁনের আগমনে দফায় দফায় বিরক্ত হয় সদস্যরা। তিস্তা সবাইকে টপকে বলে, “আপনারা আমাদের বাড়িতে কী করছেন? এখানে আমার ভাইয়ের সাথে আরুর বিয়ে হচ্ছে, এই মুহুর্তে আপনারা কোনো ঝামেলা করবেন না।”

“আমরা বিয়েতে ঝামেলা করতে আসিনি, চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছি। যদি ওনাকে একটু ডেকে দিতেন।” সুন্দরীর কথায় নিরুপায় হয়ে তিস্তা তার বাবা চাচা ও দাদাকে ডেকে নিয়ে আসে। আনন্দের মাঝে কালাচাঁনদের আপ্যায়নে ত্রুটি রাখা হয় না। সুন্দরী নিজ থেকে ছেলের বিয়ের প্রস্তাব রাখে, “আমার কালাচাঁন আগের থেকে ভালো হয়ে গেছে। এখন তো চাকরি করে কোম্পানিতে। আপনার বাড়ির মেয়ে শেফালীকে সেদিন আমার ভালো লেগেছে। তাই কালাচাঁনের সাথে শেফালীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।”

“অসম্ভব। এমন একটা ছেলের সাথে আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ওর জীবনটা ন/ষ্ট করতে পারব না। আমি শেফালীর জন্য রাজপুত্র খুঁজে দিয়ে আসবো।” কথাটা বলে শাহিনুজ্জামান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। শেফালীর বিয়ের ব্যাপারে উপস্থিত সবাই আপত্তি জানায়। অপূর্ব আগ বাড়িয়ে বলে, “বাবা, চাচা, দাদু। আপনাদের সাথে আমার জরুরি কথা আছে। যদি সময় করে আমার কথাটা শুনতেন।”

“আমিও যেতে চাই।” তিয়াস বলে। বড় ছেলের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে সাতজন মানুষ চলে গেল আলাদা এক কক্ষে। কিছুক্ষণে তাদের আলোচনা সেরে বের হয়ে অনিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ওনাদের মিষ্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি কালাচাঁনের সাথে শেফালীর বিয়েটা মেনে নিয়েছি।”

একমাত্র মেয়ের জীবনের এমন একটি সিদ্ধান্ত শুনে ছুটে এলো মণি। করুন গলায় বলে, “ভাইজান, আমি সবসময় আপনার মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছি। আমার বিশ্বাস আপনি কখনো ভুল করতে পারেননা। কিন্তু তাই বলে, আপনি আজ আমার মেয়ের সাথে এই লম্পট ছেলেটার বিয়ে ঠিক করছেন।”

“আমি ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাকে তোমরা কম বিশ্বাস করোনা, আরেকবার বিশ্বাস করে দেখো। শেফালীর জন্য আমরা কালাচাঁনকে উত্তম বলে মনে করছি।” মোতাহার আহসান মণিকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললে মণি রাগান্বিত হয়ে বৈঠকখানা ত্যাগ করে। শাহিনুজ্জামান স্ত্রীকে বুঝাতে ছুটে গেল। সময় গড়িয়ে গেলেও, পরিবেশটা ছিমছাম থেকে যায়। খানিকক্ষণ পর মণি ফিরে এসে মেয়ের মাথায় হাত রেখে জানায়, “এই বিয়েতে আমি মত দিলাম। তবে আমার মেয়ের ওপর কোনো নির্যাতন হলে সাথে সাথে শেফালীকে নিয়ে আসবো।”

“ঠিক আছে।”

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। এখন আকাশ স্বচ্ছ, বর্ষকাল বলে লহমায় লহমায় বৃষ্টিরা নৃত্য পরিবেশন করে উঠানে। আকাশ মেঘের ভেলা সাজিয়ে ফেলেছে দেখে সুজন ছুটে এলো বাইরে থেকে। বাইকে তাড়া দিয়ে বলে, “চাচি বৃষ্টি আসবে, তার আগে অপূর্ব ভাইয়ের হলুদ শেষ করতে হবে। একবার বৃষ্টি শুরু হলে কখন থামবে তার ঠিক নেই।”

সুজনের কথা শুনে মনে পড়ল, অপূর্বর হলুদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে নিয়ে চলে গেল সাজানো স্টেজে। প্রথম হলুদ ছোঁয়াল মোতাহার আহসান ও অনিতা। তারপরে এক এক করে সবাই ছোঁয়াল। প্রতিটি দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে স্টুডিও থেকে লোক ভাড়ায় আনা হয়েছে। গ্ৰাম্য গানের মাধ্যমে অপূর্বর গোসলের কাজ শেষ হলে সুজন তাকে কাঁধে তুলে কলতলায় নিয়ে গেল। বিয়ের হলুদের ছোঁয়ায় অপূর্বর সুশ্রী দ্বিগুণ হয়ে উঠছে ক্রমশ। আরু প্রথম সাক্ষাতে অপূর্বকে গহীন চোখে দেখেছিল, আজ অপলক চেয়ে থাকত।
_
সিঁথি, সাথি, সাবিত ও মেঘলা চাচাতো ভাই বোন ছাড়াও বিয়েতে অংশ নিয়েছে আরুর বিবাহিত বান্ধুবী মিতু ও তন্বী। উপস্থিত সবাই আরুর গায়ে হলুদ ছুঁয়েছে। সবাই একসাথে পানি দিয়ে গোসলের নিয়ম সমাপ্ত করে। হলুদের পর ঘরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত কাউকে না কাউকে কোলে নিতে হয়। কিন্তু তেমন কাউকে চোখে পড়ছে না পারুলের। ইমদাদ হোসেন মেয়েকে হলুদ দিয়ে রান্নার দিকে গেছেন। পারুলের তখন মনে পড়ল মিহিরের কথা। ভাসুরের ঘরের দিকে পা ফেলতেই নজরে এলো ট্রাভেলিং ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছে শিরীনেরা। পারুল তাকে পরিপাটি বেশে দেখে প্রশ্ন করে, “আপা ব্যাগ পত্র নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?”

“আমরা শহরে ফিরে যাচ্ছি। কল এসেছে, জরুরি আমাদের ঢাকাতে যেতে হবে।” শিরীনের একরোখা জবাব।

“আরুর বিয়ের দাওয়াত খেয়ে যাবেন না?”

“না। আমরা আরুর বিয়ে খেতে আসিনি। আমরা যেই কাজে এসেছিলাম, তা যেহুতু হচ্ছে না। তাই ফিরে যাচ্ছি।” বলে রওনা হলেন শিরীন। পারুল তার পথ আটকে দিয়ে অয়নকে পাঠাল ইমদাদ হোসেনকে ডেকে আনতে। বোনের ফেরার কথা শুনে উল্কার বেগে হাজির ইমদাদ। বোনের হাত থেকে ট্রাভেলিং ব্যাগ নিয়ে বলে, “মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোদের? কাল আরুর বিয়ে আর তোরা আজ চলে যাবি?”

“মাথা আমার ঠিকই আছে, আপনার খারাপ হয়েছে। আরুকে আমি মিহিরের জন্য পছন্দ করে রেখেছি আর আপনি অপূর্বর সাথে বিয়ে দিচ্ছেন। এরপরেও আমার এখানে থাকা শোভা পায়?” বলতে বলতে শিরীনের চোখে ধরা দিল পানি। উপস্থিত সবাই থমকে গেছে। ইমদাদ নিজেকে সামলে বলে, “তুই কখনো আমাকে বলিস নি, আরুকে মিহিরের জন্য পছন্দ করেছিস।”

“কাল সকালে আমি আপনাকে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছি, এরপরেও বোঝানো বাকি থাকে?”

আরু পিঁড়ির উপর থেকে নেমে ছুটে গেল ঘটনাস্থলে। সে মিহিরকে কেবল নিজের ভাইয়ের নজরেই দেখেছে। অপূর্বকে ভেবেছে নিজের অর্ধাঙ্গ। শিরীন পুনরায় বলে, “মিহির আরুকে ভালোবাসে, এজন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে গ্ৰামে আসত আরুকে দেখতে। ছেলেটা আমার ভেঙে পড়েছে। কীভাবে সামলাবো আমি?”

আরু একপা একপা করে এগিয়ে গেল মিহিরের দিকে। অস্ফুট স্বরে বলে, “তুমি আমাকে পছন্দ করতে মিহির ভাই?”

মিহির তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। দুহাতে আরুর দুই বাহু খামচে ধরে হিংস্র হয়ে বলে,

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৮

“একটা মেয়ে ‘কোন ছেলে দূর থেকে, তাকে কেমন নজরে দেখে’ সব বুঝতে পারে। আমি সবকিছু ফেলে তোর কাছে আসতাম ভালোবাসার টানে। এখন তুই বলছিস তুই আমাকে ভাইয়ের নজরে দেখিস নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছিস?” আরুর বাহু খামচে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কথা ব্যক্ত করে মিহির। টুস করে অবাধ্য অশ্রু কণা আরুর চোখ থেকে ঝরে পড়ে‌। আরুর চোখের পানি সহ্য করতে ব্যর্থ হয়ে ছেড়ে দিল মিহির। পারুল আরুকে পিছিয়ে বলে, “এখানে আমাদের কোনো দোষ দেখছি না, সেদিন এসেই আরুর জন্য প্রস্তার দেওয়া উচিত ছিল। আমরা কেউ আরুর বিয়ে অপূর্বর সাথে ঠিক করে রাখিনি। তখন বললে, আরুকে মিহিরের হাতে তুলে দিতাম।”

“না! বিয়ের আসরেও যদি ভাইজান আরুর সাথে অপূর্বর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হতেন। তবে আমি সেই বিয়ে ভেঙে অপূর্বর সাথেই আরুর বিয়ে দিতাম। মোতাহার আহসানের কারণে আমার মেয়ে এখনো শ্বাস নিচ্ছে। তাই তাকে খুশি করা আমার দায়িত্ব।” দৃঢ় গলায় নিজের মতামত জানায় ইমদাদ। অতঃপর ব্যাগটা ফিরিয়ে দিল শিরীনের কাছে। ছেলের মুখে এমন কথা শুনে বলে, “আমি ওকে পেটে ধরেছি নাকি ঐ চম্পা তোকে পেটে ধরেছে? সবসময় তুই আহসান বাড়ির টান টানিস। তোর মেয়ের বিয়েতে আমি থাকব না, ঢাকাতে চলে গেলাম।”

“মা, আরু তোমার নাতনি।”

“যেখানে আমার মতামতের গুরুত্ব নেই, সেই বিয়েতে আমি থাকব না।” বলে মেয়ের সাথে ঢাকাতে যাওয়ার জন্য রওনা হলেন। বিয়ের দিন এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার কারণে মেয়ের উপর ত্রুব্ধ হলেন পারুল। আরুর গাল চেপে ধরে রোষ নিয়ে বলে, “এত সুন্দর কে হতে বলেছে তোকে? তোর জন্য আমাকে যতটা অন্যের কাছে হেয় হতে হয়, অন্যের মেয়ে থাকার পরেও তাদের হতে হয় না।”

ব্যথায় আরুর চোখে পানি চলে এসেছে। ইমদাদ মেয়েকে ছাড়িয়ে উঁচু গলায় বলে, “বিয়ের দিনেও তুমি মেয়েটার গালে হাত দিলে? মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে কী পাও তুমি?”

“ওর জন্য শিরীন আপার সাথে তোমার সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল।”

“আমার বোনের সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে, তাতে আমার কোনো আফসোস হচ্ছে না। তোমার কেন হচ্ছে?” আঙুল তুলে বলে ইমদাদ। আরু হেঁচকি তুলে কেঁদে চোখমুখে ছাপ ফেলেছে। ভেজা শাড়িটা অঙ্গেঈ শুকিয়ে গেছে। মায়ের প্রতি চরম অভিমান নিয়ে চলে গেল রান্নাঘরে। মাটির উনুন থেকে দুই হাতে কালি তুলে নিজের শরীরে মাখতে থাকে। উপস্থিত সবাই হতভগ্ন হয়ে আরুকে থামাতে ভুলে গেছে। আরু অনবরত বলে যাচ্ছে, “এই বাড়িতে যতক্ষণ থাকব, আমি কালি মেখেই থাকব। সুন্দর হলে সমস্যা, অসুন্দর হলেও সমস্যা।”

তখন সেখানে উপস্থিত হয় আহসান বাড়ির ছোটরা। আরুকে এই অবস্থা দেখে ছুটে আসে তিস্তা। কান্নায় আরেক দফা ভেঙে পড়ে আরু। নয়নাও ধমকালো পারুলকে, “তুই এটা ঠিক করলি পারুল। বিয়ের দিন মেয়ের রূপ সবাই দেখবে, সেখানে তোর জন্য মেয়েটা কালি মেখে বসে আছে‌। কিছুক্ষণ পর মেয়েকে দেখতে আসবে গ্ৰামের লোক, মেয়ের এই অবস্থা দেখলে মন্দ বলবে। বুঝিয়ে শুনিয়ে কলতলায় নিয়ে যা।”

নয়নার কথা মেনে আরুকে ধরে পারুল বলে, “চল গোসল করবি।”

“বলেছি না, এই বাড়িতে এমনই থাকব। হাত ছাড়ো আমার।” আরু প্রবল তেজ নিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল‌। তিস্তা, তুর ও শেফালী জোরপূর্বক আরুকে ধরে টেনে নিয়ে গেল কলতলায়। ছিটকিনি তুলে দিয়ে তিস্তা বলে, “বিয়ের দিন কেউ এমন কাজ করে?”

“আমি করতে চাইনি, মা করেছে। আমি যখন বিদায় নিয়ে চলে যাবো, একটুকুও কাঁদবো না। কালাচাঁন আমাকে ভালোবাসে তাতে কি আমার দোষ? মিহির ভাই আমাকে ভালোবাসে, তাতে কি আমার দোষ? সবকিছুতে মা আমার দোষ খুঁজে বেড়ায়। তাই রাগে কালি লাগিয়েছি।
__
সকল জল্পনা কল্পনার ইতি টেনে বরবেশে মৃধা বাড়িতে উপস্থিত হলো অপূর্ব। অপূর্বর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আহসান বাড়ির একদল পুরুষ ও মেয়েরা। সাথী, সিঁথি, আঁখি, তন্বী, মিতু সাবিত ও অয়ন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। বরযাত্রীদের উপরে কঠোর নিয়ম জারি করে, “চেয়ারম্যান বাড়ির চাঁদের হাট মৃধা বাড়িতে পড়েছে। তবে এক হাজার টাকার কমে কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া হবে না।”

“ভাগ্যিস আমার এমন আয়োজন করে বিয়ে হয়নি, এত আয়োজন করে বিয়ে করলে শালিকা ও শ্যালক বাহিনী সব টাকা হাতিয়ে নিতো।” তিয়াস বলে। উপস্থিত সবাই একটু হাসে। শেফালী ব্যতিব্যস্ত হয়ে তুরের কানে ফিসফিস করে বলে, “আমরা যদি ওদের দলে থাকতাম, তাহলে ভাগ পেতাম।”

“চুপ। ওরা আমার ভাইয়ের টাকা নিয়ে যাচ্ছে আর তুই ভাগ নিয়ে পড়েছিস? কীভাবে টাকা বাঁচাতে পারব, সেটা ভাব।” চোখ পাকিয়ে শেফালীকে উদ্দেশ্য করে বলে তুর। ভাইয়ের টাকা বাঁচাতে পণ করে সবাইকেই ঠেলে সামনে চলে গেল তুর। আচমকা ধাক্কায় শেফালী গিয়ে ধাক্কা খেল কালাচাঁনের সাথে। কালাচাঁন শেফালীকে আঁকড়ে ধরে নিজের সামনে নিয়ে এলো। আরও অনেক পুরুষ এসেছে বরযাত্রী হিসেবে, তাদের স্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে সামনে নিয়ে বলে, “এত ছোটাছুটি কেন করো? বিয়ে বাড়ির এই ভিড়ের পড়ে গেলে তোমার হাড়গোড় সব ভেঙে যাবে।”

এই প্রথম কোনো পুরুষ তাকে রক্ষা করল। ঘড়ির কাঁটার মতো টিকটিক করতে করতে শেফালীর মনে শূন্য থেকে একে পৌঁছে যায় ভালোবাসার কাটা। শেফালী সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তুর একটু জোর নিয়ে বলে, “এত টাকা দেওয়া যাবে না। তোমরা সাতজন আছিস, আমি পঞ্চাশ করে সাতজনকে তিনশো পঞ্চাশ টাকার সাথে পঞ্চাশ টাকা বেশি দিয়ে তিনশো টাকা দিবো। যদি নিতে চাও, তাহলে এটাই পাবে।”

চাপা অভিমান নিয়ে করুন গলায় আঁখি বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি তো একবারই বিয়ে করবেন। শ্যালক শালিকাদের একবারই খুশি করতেন পারবেন। এক হাজার টাকা দিন না? আরুকে আমরা এত কষ্ট করে সাজিয়েছি, দরজার জন্য না হোক, আরু সাজের জন্য দিন।” এতক্ষণ অপূর্ব রুমাল মুখে নিয়ে একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। অপূর্বর দূর্বলতা আরুকে নিয়ে আসতেই অপূর্ব বুকের ছাতি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি হয়ে উঠল। শেরয়ানির পকেট থেকে পাঁচশো টাকার দশটা নোট বের করে টেবিলের উপরে রেখে বলে, “আমি চেয়ারম্যান বাড়ির বড়ো সন্তান অপূর্ব আহসান। বাবার পরে আমিই ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানরা সবসময় মাথা উঁচু করে ঢুকে, তাই ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান অপূর্ব আহসান মাথা উঁচু করে ঢুকবে। (বিরতি টেনে) ভোটটা যাতে আমার নামে যায়।”

অপূর্বর কথায় উৎফুল্ল হয়ে সবাই করতালি দিল। অতঃপর লাল ফিতা কেটে ভেতরে প্রবেশ করে অপূর্ব। তাকে খাওয়ানো হলো শরবত ও মিষ্টি। অতঃপর নিয়ে আসনে বসানো হলো। অপূর্ব যাওয়ার‌ সময় ফিসফিস করে বলে, “আরুর সাজ যদি আমার পছন্দমতো হয়, তাহলে আরও পাবে।”

তুর ছুটে তন্বীর হাত ধরে বলে, “আমাকে ভাগ দিস বান্ধুবী।”

“একদম না, তোকে এক টাকাও দেওয়া হবে না। তুই আমাদের বিপক্ষ দল।” বলে টাকা ভাগ না করে মেয়েরা ছুটে গেল আরুর কাছে। হালকা সাজে মাথায় দোপাট্টা টেনে বসে আছে আরু। পাঁচ কুমারী প্রবেশ করে আরুর মাথা থেকে খুলে ফেলল দোপাট্টা। হালকা সাজটা মুছে ফেলতেই পারুল বাক্য তোলে, “কী করছিস, অনেক কষ্টে ভাবী সাজিয়ে দিয়েছে। মুছে ফেলছিস কেন?”

“কারণ সাজটা সুন্দর না, আমরা পাঁচজনে সাজাচ্ছি।” আঁখি বলে। তারপরে আরুর সাজ ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। ‘তুর ও শেফালী’ আরুর সাথে সাক্ষাৎ করতে এসে, আরুকে সাজাতে দেখে ব্যঙ্গ করে বলে, “দরজা নিয়ে এত মেতেছিলিস যে, আরুকে সাজাতেই পারিস নি?”

“সাজিয়েছিল মা। কিন্তু অপূর্ব ভাই বলেছে আরুকে যদি সুন্দর করে সাজাতে পারি, তাহলে আরও টাকা দিবে। তাই সুন্দর করে সাজাচ্ছি।” সাথীর কথা শুনে সেখান থেকে মন খারাপ করে শেফালীকে নিয়ে চলে গেল তুর। দুই বোনকে খুঁজতে এসে মনমরা হয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো তিস্তা। চিন্তিত হয়ে বলে, “তোরা এখানে বসে কী করছিস?”

“কপাল চাপড়াচ্ছি। কনেপক্ষের মেয়েরা আরুকে সাজিয়ে টাকা নিচ্ছে, দরজা ধরে টাকা পাচ্ছে। আমরা যদি সকালে ওদের দলে যেতাম, তাহলে আমরাও পেতাম।” মন খারাপ করে তুর বলে। তুরকে বুকে টেনে তিস্তা বলে, “পাগল বোনরা, এখনো মূল আকর্ষণ বাকি। আমরা বাসর সাজিয়ে অপূর্ব ভাইয়ের থেকে ডাবল আদায় করে নিবো।”

“সত্যি?”

“হম।” তিস্তা শব্দটা উচ্চারণ করার পূর্বেই শেফালীর হাত ধরে তুর ছুটে গেল বাড়ির দিকে। বিভিন্ন ধরনের ফুলের ব্যবস্থা করতে হবে তাদের।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৮ [বর্ধিতাংশ]

“নীলপদ্ম দেনমোহর হিসেবে ধার্য করিয়া ও নগদ বুঝিয়ে পাইয়া, সুন্দরনগর গ্ৰামের চেয়ারম্যান মোতাহার আহসানের বড়ো ছেলে অপূর্ব আহসান আপনাকে
নিকাহ করিতে আসিয়াছে, বিয়েতে রাজি থাকলে, বলেন মা আলহামদুলিল্লাহ কবুল।” উপস্থিত সবাই আরুর মুখের দিকে তাকালো কবুল শোনার জন্য। আরুর অন্তরে ‘নীলপদ্ম’ শব্দর পুনরাবৃত্তি চলছে। আরু কবুল উচ্চারণ না করাতে পুনরায় হুজুর বলে, “রাজি থাকলে বলুন আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

নয়না পেছন থেকে আরুকে ঠ্যালা দিয়ে অব্যক্ত স্বরে বলে, “আরু সবাই অপেক্ষা করছে, কবুল বল।”

“আলহামদুলিল্লাহ কবুল!”

“আবার বলুন কবুল।”

“আলহামদুলিল্লাহ কবুল!”

আরও একবার কবুল বলুন।”

“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

“আলহামদুলিল্লাহ, আমরা সবাই শুনেছি। আপনারা এখন স্বামী স্ত্রী।” হুজুর বলতেই সেখান থেকে বেরিয়ে গেল বাইরে। অতঃপর ভবিষ্যৎ জীবনের সুখের আশায় নবদম্পতির জন্য দুহাত তুলে দোয়া চাইলো। পারুল আঁচলে মুখ আড়াল করে কেঁদে উঠলে সেই রোল পৌঁছে গেল আরুর কানে। কঠোর আরু উঠল ফুঁপিয়ে। নয়না একটু চাপা গলায় বলে, “পারুল কাঁদছিল কেন? আরু তোর বাপের বাড়িতে গেছে। আরুর যত্নে কোনো ত্রুটি থাকবে না। তুই এক থালা খাবার এনে আরুকে খাইয়ে দে। সকাল থেকে না খাওয়া মেয়েটা, চেয়ারম্যান বাড়ির পুত্রবধূ বলে কথা, আদৌ খেতে পারে কি-না কে জানে।”

নয়না এক থালা খাবার এনে আরুকে দুই লোকমা খাওয়াতে পারে কেবল। খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে অপূর্ব ঘরে প্রবেশ করে। মেয়ে জামাতাকে দোয়া ও দুধ খাইয়ে হাতে তুলে দিল পারুল। চোখের জলে বলে, “আমার একটাই মেয়ে অপু, ওকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমি তোকে দিলাম।”

ঝাপসা চোখে সম্মুখে দাঁড়ানো ছেলেটাকে দুই সেকেন্ড দেখে অপূর্বর হাতটা খামচে ধরল আরু। অপূর্বর দিকে একটু সেঁটে যেতেই অপূর্ব লক্ষ্য করে ফিসফিসিয়ে বলে, “কালাচাঁনকে‌ দেখে ভয় পাওয়া কিছু হয়নি, ও আহসান বাড়ির হবু জামাতা।”

“মানে?”

“মানে শেফালীর সাথে কালাচাঁনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বাড়িতে গিয়ে সময় করে সব বলব।” রুমালে অধর আড়াল করে বলে অপূর্ব। নাছোড়বান্দা আরু তবুও প্রশ্ন করে, “তাহলে আমি কিছু জানি না কেন?”

“ফুফুও জানে না। আজ সকালে হয়েছে। এই পরিস্থিতির ভেতরে কাউকে বলেনি বাবা। আমাদের বিয়ের পর্ব শেষ করে সবাইকে বলবে।” অপূর্ব নতজানু হয়ে বাক্য তোলে। বর্ষাকাল বিধায় মেঘে ঢেকে এলো স্বচ্ছ অন্তরিক্ষ। বাড়ি যাওয়া নিয়ে মোতাহার আহসান তাড়া দিতেই কেঁদে উঠল পারুল, ইমদাদ। আজকে বোনকে হারানোর কষ্ট অনুভব করে বাদ গেল না অয়ন। অপূর্ব আরুকে পাঁজাকোলা করে ঘরে থেকে নামাতেই বড়ো বড়ো কয়েকটা বৃষ্টি পতিত হওয়ার পাশাপাশি ধরা দিল সূর্যের তেজহীন ছবি। অপূর্ব তার গন্তব্যে আরুকে নামাতে আরু লক্ষ্য করল টাইসনকে। সোনালী রঙের ঘোড়াটা নতজানু হতে, অপূর্ব উঠে বসল তাতে। আরু কান্নায় ইতি ঘটিয়ে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি ঘোড়ায় চড়ে এখানে এসেছেন?”

উপস্থিত সবাই হাসল, অপূর্ব পেল খানিক লজ্জা। তিস্তা নিকটে এসে বলে, “অপূর্ব ভাই এখন তোর স্বামী। স্বামীকে কেউ ভাই বলে সম্বোধন করে? নিজেকে হাসির পাত্র বানাচ্ছিস কেন?”

আরু আড়ষ্ট হয়ে যেতেই অপূর্ব হাত বাড়িয়ে দিল। সেই হাতে নিজের হাত স্পর্শ করতেই চকিতে অপূর্ব তাকে সামনে উঠিয়ে নিল। ঘোড়ার ঘাড় ছুঁয়ে আদর করতেই তার পোষ্য ময়নাপাখির কথা মনে পড়ল। তিন ছানাকে নিয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে এসে বলে, “আরুপাখি আর আসবে না, আর আসবে না, আর আসবে না।”

“মা, ওমা। আমি ময়নাপাখিদের নিয়ে যাই?” বাবার বিটা ত্যাগ করার আগে আরু বলে। মেয়ের কথা রাখতে খাঁচা এনে, তিন ময়নাপাখি ধরে ভেতরে ঢুকালো। তারপরে তুলে দিল তিস্তার হাতে। আরুর মুখে হাসি ফুটতে অপূর্ব টাইসনকে আদেশ দেয়, “চল টাইসন। বাড়ির পথে ফিরে চল।”

টাইসন দুপায়ে ভর দিয়ে ডেকে টগবগ টগবগ করে ছুটে চলল। আশেপাশের জনগণ অবাক নয়নে দেখছে ওদের। আরু তার মাথা অপূর্বর বুকে হেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে, “আমার রাজকুমার সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এসেছে, আমাকে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়িয়ে রানী করে নিয়ে যাচ্ছে তার রাজ্যে।”
_
অনিতা বরন করা শেষ করে আরু ও অপূর্বকে ঘরে তোলার অনুমতি দিয়েছে। দুপা ফেলতেই আরুর নজরে এলো ফুল। অপূর্ব ফুলগুলো কুড়িয়ে আরুর শাড়িতে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আরুকে বসানো হলো বৈঠকখানায়, আহসান বাড়ির উত্তরসূরী বলে আরুকে দেখতে ভিড় করেছে গ্ৰামবাসীরা। অপূর্ব ততক্ষণে শেরয়ানি ছেড়ে পরিধান করেছে সাধারণ টিশার্ট ও লুঙ্গি। অপূর্বকে এমন রূপে দেখে অনিতা রাগান্বিত হয়ে বলেন, “বরবধূকে একসাথে দেখতে এসেছে গ্ৰামবাসীরা, আর তুই শেরয়ানি খুলে ফেলেছিস?”

“শরীর চুলকাচ্ছে, এই ভিড়ের ভেতরে আমি থাকতে পারব না। মনে হয় গায়ের ভেতরে লেপটে যাচ্ছে মানুষ।” বলতে বলতে লম্বা টিশার্টের হাতা গুটিয়েছে অপূর্ব‌। মল্লিকার বয়স অপরিপক্ক, রঙ্গ করে বলেই ফেলে, “কিছুক্ষণ পর বউকে তো ঠিকই লেপটে রাখতে পারবে। তখন শরীর চুলকাবে না, মনে হবে আরু চুলকানির ওষুধ।”

“এত ঘটা করে বিয়ে করেছি, বউকে বুকের সাথে লেপটে রাখতে। সহ্য নাহলেও আজকে লেপটে রাখতেই হবে‌, ওয়েডিং ফাস্ট নাইট বলে কথা। তাছাড়া বয়স তেত্রিশ, এখন না লেপটালে কবে লেপটাবো?” বলে কারো মুখের দিকে না তাকিয়ে ধপাধপ পা ফেলে অপূর্ব বাইরে চলে গেল। ছেলের মুখে প্রথমবার লাগামহীন কথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল সবাই। অনিতা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, “ও বিদেশে বড় হয়েছে, এগুলো সেখানকার কমন কথা। তাই বলে মায়ের সামনে..!”

আঁচলে মুখ আড়াল করে সেখান থেকে চলে গেল অনিতা।
_
গতমাসে অপূর্বর জন্য দোতলা ঠিক করেছে। ঘরের সামনে খোলা এক বারান্দা। বিভিন্ন প্রজাতির ফুলে সাজানো হচ্ছে পালঙ্ক। অনিতা বিয়ের ভারী বেনারসি পালটে সুতি শাড়ি পরতে আরুকে পাঠিয়ে দিয়েছে অপূর্বর ঘরে। ট্রাভেলিং ব্যাগ খুলে তিস্তা আরুর জন্য লাল শাড়ি বের করতেই আরু বলে, “অপূর্ব ভাইয়ের আলমারিতে একটা বেনারসি আছে। ওটা বের করে দাও, আমি পরব।”

তুর আলমারি থেকে বেনারসিটা বের করে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে তিস্তা ও সুমিকে দেখালো। তিস্তা চট করে বলে ফেলে, “এই বেনারসিটা তো বিয়েতে কেনা হয়নি। এটা এখানে এলো কীভাবে?”

“ভাবীর জন্য বিয়ের সরঞ্জাম কেনার সময় এটা ভালো লেগেছে, এজন্য অপূর্ব ভাই আলাদা করে কিনে রেখেছেন।”

“এখনও তুই অপূর্ব ভাইকে ভাইয়া বলে ডাকবি। তখন না তোকে বারণ করলাম। ওগো বলবি।” চোখ পাকিয়ে বলে তিস্তা। অপূর্বর থেকে ভাই শব্দটা কীভাবে সরাবে? অপূর্বকে আদৌ ওগো বলা যায়? আড়ষ্ট হয়ে বলে, “আমার লজ্জা করে।”

“সমস্যা নেই, আজকে রাতের পর সব লজ্জা চলে যাবে। অপূর্ব ভাই তোমাকে সাহায্য করবে। এবার এসো তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দেই।” কথাটা বলে সুমি আরুকে শাড়ি পরাতে ব্যস্ত হলো। দীর্ঘক্ষণ পর আরুকে বেনারসি পরিয়ে ফুলের রানী সাজাতে উঠে পড়ে লাগল সকলে। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা দশে পৌঁছাতেই অপূর্ব দরজার কাছে এসে কড়া নেড়ে উঠে। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানাতেই মেয়ের দলেরা আটকে দাঁড়াল অপূর্বর পথ। তিয়াস তিস্তাদের দলে থাকলেও সুজন নিজের মত বদলে অপূর্বর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। তিস্তা রেগে বলে, “তুমি স্ত্রী রেখে শ্যালকের কাছে কেন গেলে?”

“কারণ শ্যালক দুলাভাই ভাই ভাই। এক টাকাও দেব না।” দৃঢ় ভঙ্গিতে বলে।

চোখ রাঙায় সুজনকে, “তোমাকে পরে দেখছি। (থেমে) দশ হাজার টাকা দিতেই হবে। নাহলে আজকে রাতে বউয়ের কাছে থাকার কথা ভুলে যান এবং আমরা এখান থেকে সরব না।”

অপূর্বর সুদর্শন দেহে প্রবল তেজ। এক ধাক্কায় সবাইকে ফেলে আরুর কাছে গিয়ে বসল। আরুর ঘোমটায় হাত রাখতে রাখতে বলে, “ভাইয়ের বাসরে থাকার ইচ্ছে থাকলে থাকতে পারিস।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৯

“ভাইয়ের বাসরে থাকার ইচ্ছে থাকলে থাকতে পারিস।” চোখ টিপে খানিক রঙ্গ করে ভাইবোনদের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে অপূর্ব। আরু আড়ষ্ট হয়ে আঁচলটা খামচে ধরতেই সুজন উচ্চ স্বরে হেসে উঠে। তিস্তা ললাটে ঈষৎ রাগ ঝুলিয়ে বলে, “এটা আপনি ঠিক করলেন না ভাই। আমরা এত কষ্টে আপনার বাসর সাজালাম, বউ সাজালাম‌। আপনি আমাদের সাথে অন্যায় করলেন।”

ভাইবোনদের দল অভিমানে ঘর ত্যাগ করার প্রয়াস করতেই অপূর্ব দূরত্ব রাখল আরুর থেকে। টেবিলের ছোটো ড্রয়ার থেকে শ্বেত খাম বের করে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “তোরা সবাই আমার ছোটো ভাই-বোন। তোরা যদি আমার বাসর নাও সাজাতিস, তবুও এটা পেতিস।”

ভাইবোন মহলে আনন্দের আমেজ তৈরি হলো। দ্রুত খাম ছিঁড়ে টাকাগুলো বের করে গুনলে হদিস পেল, বারো হাজার টাকার। অবিলম্বে সবার মুখে হাসি ফুটল। অপূর্ব বুকে হাত গুজে খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে বলে, “খুশি হলেই চলবে না, আগামীকাল আরেকদফা লোকজন আসবে আরুকে দেখতে। তখন ওদের হাত থেকে আরুকে বাঁচাতে হবে।”

“আগ্গে মহারাজ।” বলেই সবাই হৈচৈ করতে করতে বিদায় নিল সেখান থেকে। অপূর্ব দরজার ছিটকিনি তুলে ঘোমটা টানা আরুর পানে দৃষ্টি মেলাতেই আরু নামল বিছানা থেকে। অপূর্বর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে ঝুঁকল পায়ের কাছে‌। পা ছুঁয়ে সালাম করতেই অপূর্ব আরুর মাথায় হাত রেখে বলে, “স্বামী সোহাগী হও বধূ। আদরে আদরে ভরে উঠুক তোমার আমার সংসার।”

মৃদু ঝুঁলে আরুকে পাঁজাকোলা করে নিল অপূর্ব। অমনি ঘোমটা খুলে পড়ল মাথা থেকে, ছড়িয়ে পড়ল রজনীগন্ধার সুবাস। স্বচ্ছ আকশে হুট করে বাজ পড়ল অদূরে। অপ্রত্যশিত সময়ে আরুর ত্রাস হুরহুর করে বেড়ে আবদ্ধ করে নিল অপূর্বকে। অপূর্ব এক নাগাড়ে আরুর মুখপানে চেয়ে আছে। আরুর মাত্রারিক্ত ফর্সা মুখটা আঁধারেও অপূর্ব দেখতে পাচ্ছে। অপূর্ব এগিয়ে গেল খোলা বারান্দায়। এক দমটা হাওয়া লোমকূপ পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলল দুজনের। আকাশ ক্ষণে ক্ষণে গর্জে উঠছে। অপূর্ব হেঁটে টুলের উপর বসে আরুকে নিয়ে, তখনই শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ধারা। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি করতলে লাগাতেই অপূর্ব তার হাত আরুর হাতের নিচ দিয়ে রাখল। আরু মিষ্টি হেসে অপূর্বর বুকে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলে, “আপনাকে আমি প্রথম ঐ দিঘির পাড়ে রোদ পোহানো অবস্থায় দেখেছি। আপনি জানেন, আমি আপনার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে রাজহাঁসের বাচ্চাকে আঘাত করেছিলাম। আপনার গায়ের রঙটা কম ফর্সা নয়, এমন সুদর্শন পুরুষ আমি দেখিনি।”

অপূর্ব হিম হাতটা এনে আরুর নগ্ন পেটে রাখলে আরুও ধরল অপূর্বর হাত। সরে আসার প্রচেষ্ট করতেই অপূর্ব ফিসফিস করে বলে, “তুমি সেই নারী, যাতে প্রথম দেখে আমার হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিল। মা তোমার ছবি পাঠিয়েছিল, সেই ছবি দেখেই আমি তোমার প্রতি মুগ্ধ হয়েছিলাম। দেশে এসে তোমাকে দেখে আমি হতাশ হয়েছিল, বয়সটা কম। কিন্তু বয়স কোনো বিষয় নয়। আমার বয়স বেশি হলেও আমৃত্যু পর্যন্ত তোমাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখব।”

আরুর চোখ আঁটকে গেল বারান্দার এক কোণে।‌ বড়ো একটা পাত্রে ফুটে আছে নীলপদ্ম। আরু নীলপদ্ম ছুড়ে বলে, “আমি কখনো নীলপদ্ম দেখেনি অপূর্ব ভাই। আপনি এই পদ্ম কীভাবে পেলেন, তাও আবার বারান্দায়?”

“বিদেশ থেকে বীচ নিয়ে এসেছিলাম। বর্ষার সূচনা হতেই বপন করেছিলাম। এখন বারান্দায় এনে রেখেছি। এটাই আমাদের বিয়ের মোহরানা।”

“কবে বপন করেছেন? এতদিন দেখেনি তো।” আরুর সন্দিহান গলা। অপূর্ব উঠে ঘরে চলে গেল। নীলপদ্মের মালাটা এনে আরুর গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বলে, “আমি ছাড়া কেউ দেখেনি এতদিন, আজ তুই দেখলি।”

নীলপদ্মের সাথে অপূর্বর পছন্দ করা বেনারসিতে আরুর রূপ উতলে উঠছে। বৃষ্টির আঁচ ক্রমশ বেড়ে চলেছে, অপূর্ব সময় নষ্ট না করে আরুকে পুনরায় কোলে তুলে ঘরে ফিরে এলো। বিছানায় রেখে বাতির সুইচ বন্ধ করে পরনের টি শার্ট খুলে আলমারির উপরে রেখে দিল। প্রকট হলো আরুর প্রিয় ভাঁজ কাটা দেহ। অপূর্ব এগিয়ে আসলে হাতটা আবেগ নিয়ে বুকে রেখে তাকিয়ে রইল আরু। বিরতিহীন দৃষ্টিকে অবরোধ করতে চুলের ভাঁজে হাত রেখে আরুর অধরে অধর মিলিত করল। সূচনা হলো মধুর মুহূর্তের। মাথাটা হেলে ঝুলন্ত গাঁদাফুলের মালাটা ধরতেই ছিঁড়ে গেল তা। অপূর্বর থেকে ছাড়া পেতেই আরু ফ্যাকাসে মুখে বলে, “আহ্! ছিঁড়ে গেছে।”

“কিছুক্ষণ পর সবগুলোই ছিঁড়ে যাবে।” গভীর দৃষ্টিতে তাকাতেই লজ্জানত আরু বলে, “কেন ছিঁড়ে যাবে?”

“সেদিন তুই যেই ক্যাসেটটা দেখতে চেয়েছিলি, এখন সেটা দেখলে বুঝতে পারবি।” বলতে বলতে অপূর্ব গাঁদা ফুলের পাপড়িগুলো আরুর উপরে ফেলতে থাকল।
__
গতরাতের বৃষ্টির পর আকাশ আজ স্বচ্ছ। বহু প্রতিক্ষার পর অপূর্বর বুকের সাথে লেপটে বিড়াল ছানার ন্যায় ঘুমিয়ে আছে আরু। প্রথম সুখ নিয়ে অপূর্ব চোখ মেলে তাকিয়ে আরুকে থেকে একটু চমকে উঠে। পরক্ষণে গতরাতের দৃশ্য মস্তিস্ক গোচর হতেই অপূর্ব হাসে। আরুকে দৃঢ় করে জড়িয়ে ধরে কপালে এঁকে দেয় ভালোবাসার পরশ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আরুকে সরিয়ে উঠে যায়। ভালোভাবে কাঁথাটা প্যাঁচিয়ে শুভ্র টিশার্ট ও ট্রাইজার নিয়ে বের হলো কলতলার উদ্দেশ্যে। গোসল সেরে আরুকে তেমনই ঘুমাতে দেখে মুচকি হেসে বারান্দায় মেলে দিল পোশাক। সমস্ত ঘরের ফুলগুলো একপাশে জড় করে গুছিয়ে নিল ঘর। আলমারি থেকে জুয়েলারি বক্স বের করে আরুর ব্যবহৃত রূপার অলংকার খুলে স্বর্ণের অলংকার পরিয়ে দিল। রূপারটা রইল বাবার বাড়ির সম্পদ হিসেবে। অপূর্বর স্পর্শে চোখ মেলে তাকায় আরু। অপূর্বকে দেখে তড়িগড়ি করে উঠে বলে, “আপনি?”

পরক্ষণে দমে গিয়ে বলে, “আমাদের তো বিয়ে হয়ে গেছে।”

“তাড়াতাড়ি ওঠ। গোসল করে নাস্তা করতে হবে।”

“হুঁ।” আড়মোড়া ভেঙে আরু উঠে বসে। হালকা গোলাপি রঙের শাড়িটা নিয়ে চলে গেল কলতলায়। অপূর্ব তৈরি হয়ে ডাইনিংয়ে বসেছে। পুরুষরা খেয়ে উঠতেই অপূর্ব তার বোনদের নিয়ে বসে। আরু ফিরে আসে তখন। গোসলের সময় শাড়ির অনেকটা ভিজিয়ে ফেলেছে। চেয়ার টেনে বসতেই অপূর্ব খাওয়া রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। থমথমে গলায় বলে, “পরে খা, রান্নাঘরে কী লাগবে দেখ। কাজে সাহায্য কর।”

“আজকে কাজ করতে হবে না। আজকে তোর সাথে খাবার খাক।” অনিতা গরুর গোশতের বাটিটা টেবিলে রেখে বলে। অপূর্ব তবুও নাকচ করে, “ও তোমার পুত্রবধূ মা। ওকে গড়ে নেওয়ার দায়িত্ব তোমার। তোমাদের পর ও এই বাড়ির বড় বউ। ওকে প্রথম থেকে তোমার মতো তৈরি করতে হবে।”

অপূর্ব লক্ষ্য করে আরুর মাথার ঘোমটা পড়ে গেছে। অপূর্ব আঁচলটা মাথায় তুলে দিয়ে বলে, “আমার মায়ের একটাই ছেলে। মায়ের কথার অবাধ্য হবি না। কেমন?”

“হুঁ।”মাথা নিচু করে অপূর্বর কথার সায় দিল। আরু বুঝে গেছে এই আঁচল কখনো মাথা থেকে ফেলতে পারবে না। অনিতা আরুকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে বলে, “আজকে আরুর শাশুড়ি আরুকে ছুটি দিল। আরু খেতে বস।”

অনিতা গেল রান্নাঘরে। তখনই হাসতে হাসতে সেখানে এসে উপস্থিত হয় চম্পা। মজার ছলে বলে, “অপূর্ব, তুই কিন্তু বড়ো নাতি। তিয়াসের আগে আমাকে তুই পুঁতি উপহার দিবি।”

মল্লিকা বলে, “আমাদের অপূর্ব সবসময় ফাস্ট হয়। আমাদের বিশ্বাস আছে, ও ফাস্ট হবে। দেখছেন না, প্রথম দিনেই আরুকে স্বর্ণে মুড়িয়ে ফেলেছে। ওর থেকে চোখ ফেরানো যায় না।”

সুমি তাল মেলায়, “তা আর বলতে? অসম্ভব সুন্দর লাগছে কিন্তু আরুকে।”

আরু হাতের ও গলায় তাকিয়ে স্বর্ণের হদিস পায়। তবে কান ও নাক দেখতে পারে না। খাওয়া শেষে ঘরে গিয়ে নতুন আরুকে দেখবে।
অপূর্ব হাসতে হাসতে নাস্তা করে‌। মল্লিকা সেজো বউ, অনেকবার সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেও তার ঘর আলো করে কোনো সন্তান আসেনি। তাই বাকি ছেলেমেয়েদের নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। অপূর্ব খাওয়া শেষ করে রঙ্গ করে বলে, “তোমাদের ঘরে কোনো সন্তান নেই। মায়ের কাজে শুনেছি তোমরা অনেক চেষ্টা করেছিলে। আমি মনোচিকিৎসক হলেও এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারব। চাচার সাথে কথা বলে পরামর্শ নিতে আমার কাছে দুজনে এসো।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে