নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
467

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৪

“আপনার উচিত ছিল, ছেলেকে পেয়ে উপস্থিত সবার মাঝে ঠাস ঠাস করে চ/ড় বসিয়ে দেওয়া। আপনি উলটো ছেলের নামে সাফাই গাইছেন। আমাদের বাড়ির মেয়েকে আপনার ছেলের বউ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।” চোখ রাঙিয়ে কথাটা বলে অনিতা। সুন্দরী চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রী বলে দ্বিরুক্তি করার সাহস সে খুঁজে পেল না। তবুও ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বাক্য করে, “আমার স্বামী আজ নয় বছর হয়েছে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কালাচাঁন ব্যতিত আমার কোনো সন্তান নেই। একমাত্র ছেলেকে হারালে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। তাই লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ছেলের নামে সাফাই গাইছি। (বিরতি দিয়ে) আমার ছেলে আরুকে অনেক ভালোবাসে। আপনাদের আরুকে আমার ছেলের বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিবো।”

সুন্দরীর কথায় আরুর মনে ভয়ের সৃষ্টি হলো। বসা থেকে উঠে ঘরের ভেতরে পা ফেলার চেষ্টা করতে থাকল। তবে তার প্রয়াসকে হাতে ঠেলে অপূর্ব ধরে ফেলল আরুর উষ্ণ হাত। চোখে চোখ স্থায়ী করে সৌজন্য হাসির রেখা ফুটিয়ে আরুর অস্থির দূর করল। মুখে প্রকাশ করে, “একপা এখান থেকে যাবি না আরু। কালাচাঁন তোকে ডিজার্ভ করেনা। বিয়ে তো দূরের ব্যাপার। ওর মুখের দিকে তাকালে তুই ভয় পাস? ও কে? কেন ওকে তোর ভয় পেতে হবে?”

“শুনলেন না, তিনি কী বলল? আমাকে তার ছেলের বউ করে নিয়ে যাবে‌।” আরু জড়তা নিয়ে বলে। পারুল আগ বাড়িয়ে বলে, “ভাইজান, আপনি কিছুতেই এই কালাচাঁনের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করবেন না। যে ছেলের মায়ের কোল খালি করে সন্তানকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মা/র)তে চায়। সে ছেলের হাতে আমি আমার মেয়েকে তুলে দিবো না। (থেমে) ও একটা উন্মাদ। বিয়ে পর আমার মেয়ের সাথে ঝগড়া বাঁধলে যদি আরু কথা বলা বন্ধ করে দেয়, তাহলে আরুর গলা কা/ট/তেও ওর সেকেন্ড খানেক সময় লাগবে না।”

বলেই আঁচলে মুখ আড়াল করে কেঁদে উঠে। মোতাহার আহসান দিশেহারা হয়ে উঠল বোনের কান্নায়। বিরাগী হয়ে বলে, “আমি কি একবারও বলেছি ওর সাথে আরুর বিয়ে দিবো? বিয়েতে দুটো মনের পাশাপাশি দুটো পরিবারের মিলের প্রয়োজন। কালাচাঁনের সাথে আরুর মনের কোনো মিল নেই। তাছাড়া একপক্ষিক ভালোবাসা মেনে বখাটে কালাচাঁনের সাথে বিয়ে দেওয়া হলে, বখাটেরা এখন থেকে এই বুদ্ধি অবলম্বন করে গ্ৰামের রূপবতী মেয়েদের বিয়ে করবে।”

সন্তুষ্ট প্রকাশ করে সবাই। মোতাহার আহসানের কথায় সায় দিয়ে তার প্রহরীরা এগিয়ে গেল কালাচাঁনের কাছে। পাঁচটা বেত একত্রিত করে বাধা রাবার দিয়ে। তারপরে প্রহরীরা শুরু করে নির্যাতন। তিনজন প্রহরী একশো একটা আঘাতের পর থামল। কালাচাঁন যাতনায় শব্দ করে কেঁদে চলেছে। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “গোলাপী, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসা কোনো অন্যায় নয় যে, এভাবে আমাকে শাস্তি পেতে হবে। আমি সবার সামনে বাজি ধরে বলতে পারি, আমার চেয়ে তোমাকে এত ভালো কেউ বাসতে পারবে না।”

“ভালোবাসা মানে ভালো থাকার একটা সন্ধান। যার সাথে আজীবন সুখে থাকা যায়। কিন্তু আপনি যেটা করেছেন, সেটা আজীবন ওকে দুঃখে রাখার ব্যবস্থা। অকালে ওর জীবনটা হারিয়ে ফেলা।” ভাঙা গলায় অপূর্ব বলে। ডাহুক পাখিরা তখন এসে উঠানে ডেকে চলেছে ঝাঁক বেঁধে। প্রাহরীরা তার কাজে ব্যস্ত। ছেঁড়া জুতা একত্রিত করে মালা তৈরি করছে। তাদের কাজ সমাপ্ত হতেই কালাচাঁনের গলায় পরিয়ে দিল। গাছ থেকে দড়ি খুলে যখন সেখান থেকে কালাচাঁনকে গ্ৰাম থেকে বের করে দেওয়ার প্রয়াস করে তখন সেখানে হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হয় শেফালী। অসুস্থ ও ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “আপনারা কেন ওনাকে গ্ৰাম থেকে বের করে দিচ্ছেন? ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কিছু করেছে, কালাচাঁন শুধু তার ভালোবাসা প্রমাণ করতে চেয়েছে।”

শেফালীর কথাকে উটকো ঝামেলা বলে উড়িয়ে দিল অনেকে। মণি মেয়ের হাত ধরে নত অথচ ঝাঁজালো গলায় বলে, “এক চড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দিবো। যে মেয়েটার জন্য তুই আজ আমাদের মাঝে বেঁচে আছিস। সেই মেয়েটা তোর জন্য বিপদে পড়েছে। একটা ছেলে ওকে মারতে চেয়েছিল আর তুই তার হয়ে সাফাই গাইছিস? ঘরে যা।”

“ওকে অনেক শাস্তি দেওয়া হয়েছে মা। ওকে দয়া করে গ্ৰাম ছাড়া করতে বারণ করো।”

“কালাচাঁন আরুকে গলায় কলস বেঁধে মারতে চেয়েছিল। বড়মিয়া যে কালাচাঁনকে চুবিয়ে মারার নির্দেশ দেয়নি, এটা কম নয়?” মণির জোরাজুরিতে শেফালী বাধা দেয়। মণির হাত ছাড়িয়ে আরুর কাছে ছুটে যায়। আরুর দুহাত ধরে মিনতি করে বলে, “আরু, তুই অন্তত ওর মনের কষ্টটা বোঝার চেষ্টা কর। তুই তো একজনকে ভালোবাসিস। তাকে না পেলে তোর মনের অবস্থা কেমন হবে? (উদাসীন হয়ে) আমাকে দেখ, তুই জানিস আমি কেন বি/ষ খেয়েছিলাম। ভালোবাসার উর্ধ্বে কিছু নয়।”

আরুর চোখের তারায় ভেসে উঠল কালাচাঁনের সাথে কাটানো সময়গুলো। কোনো এক অদৃশ্য টানে সে সায় দিল শেফালীর সাথে। দৃঢ় এক মনোবল নিয়ে মোতাহার আহসানের কাছে মিনতি করে, “মামা, ওনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আপনি ওনাকে ছেড়ে দিন।”

আরু কালাচাঁনের দিকে তাকালে তার গভীর দৃষ্টিকে উপেক্ষা করতে পারেনা। জ্বরের মাত্রা হু হু করে বেড়ে আরু ঢলে পড়ে ঘটনাস্থলে। আরুকে আগলে নিয়ে অপূর্ব বলে, “বাবা, আপনি যা ভালো বুঝেন, তাই করুন।”

অতঃপর আরুকে পাঁজাকোলা করে অপূর্ব ঘরে চলে গেল। আরুর মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে মোতাহার আহসান বিচার কার্য সমাপ্ত করে উঠে দাঁড়ালেন।
__
ভিড় ধীরে ধীরে ছেড়ে যাচ্ছে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে। পারুল ভিড় ঠেলে ঘরে যেতে পারছে না। হঠাৎ সে শুনতে পেল এক মধ্যবয়স্ক লোক বলছে, “মেয়েটাকে ছেলেটা নিয়ে একদিন বন্দিনি করেছে। একদিন কম সময় নয়। মেয়ে আর কুমারী নেই। এই বয়সে এই জোর সহ্য করতে পারেনি। তাই ব্যথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে ঘনঘন।”

“আমার কিন্তু অন্য কিছু মনে হচ্ছে ভাইজান। আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটা পোয়াতি হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেব এখন কার কাছে বিয়ে দিবে মেয়েটাকে?” আরেকজন বলে। তার‌ প্রশ্নের জবাবে পূর্বের লোক বলে, “অনেকে আছে। চেয়ারম্যান সাহেব লুকিয়ে অনেক জমিজমা দিয়ে ভাগ্নিকে বিয়ে দিবে। লোভে সবাই মেয়েকে বিয়ে করবে। তবে যা হলো খারাপ হলো।”

“এজন্য বেশি সুন্দর হতে নেই। ছেলেদের নজর লাগে। আগে তো তানাদের নজর লেগেছিল। ভালো কথা ভাইজান, মেয়েটা না-কি অসুস্থ শরীর নিয়ে অনেকক্ষণ পানিতে ছিল। বেঁচে আছে কীভাবে?”

“তানাদের জন্য। তারা পানির অনেক গভীরে যেয়ে ফিরে আসতে পারে। তবে আরও দেরি হলে বাঁচানো যেত না। চলো সবাই। ক্ষেতে যেতে হবে।” বলেই সবাই চলে গেল। গ্ৰামবাসীদের কথায় পারুল নিজেও সন্দিহান হলো। দৌড়ে চলে গেল ঘরে। চেতনাহীন আরুকে তখন বৈঠকখানার চৌকিতে রেখেছে। মেয়ের রুগ্‌ণ মুখের পানে চেয়ে অনিতাকে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “ভাবী, আমার মেয়েটার সাথে কালাচাঁন কী করেছে? আমার মেয়েটার আর বিয়ে হবেনা।”

“থাম! আরুর এই বিপদে কী বলছিস তুই? মেয়েটা বেঁচে আছে, এটা কী কম? এইসব চিন্তা তোর মাথায় কে ঢুকিয়েছে?” সান্ত্বনা দিয়ে বলে অনিতা। পারুল দ্বিরুক্তি করে বলে, “আমি যেটা বলছি, সেটা সত্যি ভাবী? গ্ৰামবাসীরা বলাবলি করছিল। আমার মেয়ের বিয়ে হবেনা।”

“তোর মেয়ের বিয়ে না-হলে আমাকে দিস। আমি আরুকে আমার ছেলের জন্য নিয়ে আসব। একটু সুস্থ হতেই আরুকে আমি নিয়ে আসব।” অনিতা বলে আরু ও অপূর্বর দিকে তাকাল। অপূর্ব আরুর মাথায় জ্বর পট্টি দিচ্ছে। দুজনকে দেখে তার কাছে রাজযোটক ঠেকছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৪ [বর্ধিতাংশ]

আরু‌ চৌকির উপরে পা দুলিয়ে বসে আছে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ। খাবার গ্রহণের জন্য জবরদস্তি করলেও আরু তাতে অসম্মত প্রকাশ করে। জ্বরে আক্রান্ত দেহ নিয়ে মামার কাছে খিচুড়ির সাথে ভাজা ইলিশ মাছ খাবে বলে আবদার করে। একমাত্র ভাগ্নি হওয়ার সুবাদে সাথে সাথে বাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়ে লোক। আরু এখন অপেক্ষারত ইলিশ ফেরার। হঠাৎ করে ওর মস্তিষ্কে হানা দিল প্রত্যাশিত কিছু, হওয়ার হলেও আরুর জন্য ব্যাঘাত ঘটেছে তাতে। চট করে আরু বিছানা ছেড়ে হাঁটা দিল বাড়ির বিপরীত পথে। অনিতা আরুকে লক্ষ করে ডাক দেয়, “আরু, অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস মা?”

“মাত্র পাঁচ মিনিট দাও, আমি আসছি।” আরু পশ্চাৎ না ফিরে বলেই এগিয়ে গেল। কাঙ্ক্ষিত বাড়িতে গিয়ে সে গলা ছেড়ে ডাকে, “বাড়িতে কেউ আছে?”

ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মধ্যবয়স্ক এক নারী। সিঁথি ভর্তি সিঁদুর ও হাতে শাঁখা পলা। পান‌ চিবুতে চিবুতে আরুর কাছে এসে আশ্চর্যান্বিত হয়ে শুধাল, “তুই আরু না, চেয়ারম্যান বাড়ির ভাগ্নি? গতকাল তোকে পানি থেকে তোলা হলো, আজ আবার বিচার হলো?”

আরুর নাকে আসছে ধুপ ও ধোঁয়ার গন্ধ। আরুর রুগণ দেহ সেই অস্থির করা গন্ধ মেনে নিতে নারাজ। হাসফাঁস করতে করতে বলে, “জি আমি আরু। আমার কয়েকটা কাঁচা হলুদ লাগবে। আজ আহসান বাড়ির দুই জোড়া নবদম্পতির গোসল। আমার চিন্তায় সবার মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল, আপনি তাড়াতাড়ি আমাকে কিছু হলুদ তুলে দিন।”

“আচ্ছা, দাঁড়া।” মহিলা বলেই হাতের অবশিষ্ট চুনগুলো গাছের সাথে মুছে দিল। আরু আশেপাশে দৃষ্টি মিলিয়ে দেখতে পেল সব গাছের সাথেই কমবেশি চুন লাগানো। আরু পান খেতে পছন্দ করলেও এই স্বভাবের প্রতি সে বিরক্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে মহিলা আরুকে অনেকগুলো হলুদ দিল। আরু ওড়নায় প্যাঁচিয়ে নিয়ে পানের থালা থেকে পান বানিয়ে হাঁটা দিল। মুখে ঢুকিয়ে ফেরার পথে পাঁচ বাড়িতে গোসলের খবর পৌঁছে দিল। আরু সরাসরি বাড়িতে গেল না, দক্ষিণ পাড়ার মেহেদী গাছ থেকে অনেকগুলো মেহেদী পাতা ছিঁড়ে নিয়ে গেল বাড়িতে। অনিতা আরুর পেছনে এতজন মহিলাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বাক্য করে, “আপনার এখন এখানে?”

“মামি আমি তাঁদের নিয়ে এসেছি। আমার জন্য তিয়াস ভাই আর তিস্তা আপুদের গোসল বাদ গেছে। এজন্য আমিই ব্যবস্থা করে দিলাম।”

“কিন্তু আরু, এই পরিস্থিতিতে..

“গোসলের পাট চুকিয়ে আমি বাড়িতে ফিরে যাবো। নিজের প্রতি আমাকে যত্নবান হতে হবে। তুমি যদি গোসল না করাও, তাহলে আজকে থেকে কী করব?” আরুর একরোখা জবাবে অনিতা দ্বিরুক্তি না করে আঁচল পেতে আরুর থেকে মেহেদী ও হলুদগুলো নিয়ে নিল। তিন ঝাঁ-কে ডেকে নিল কাছে। গানের তালে তাঁরা হলুদ ও মেহেদী বাটতে বসে‌।
আরু অগ্রসর হয় বাড়ির দিকে। ঠান্ডায় নাক থেকে পানি ঝরছে। মেহেদী তোলার ঐ একই হাত দিয়ে সে নাক পরিষ্কার করতে গেলে আরুর নাকে ডগা লাল হলো খানিক। যাত্রাপথে অপূর্বর টিশার্ট নাগালে পেলে রুমাল হিসেবে ব্যবহার করতে ভুল করে না আরু। আরু খাবার ঘরে গিয়ে দেখল চম্পা সবাইকে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। আরু যেতেই আগলে নিল চম্পা। ললাটে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বলে, “অন্যের কথা ভাবলে হবে? নিজের কথাও মাঝে মাঝে ভাবতে হবে। নাহলে অসুস্থ হলে অন্যের কথা কিভাবে ভাববি?”

“ক্ষুধা লেগেছে নানি জান। ইলিশ মাছের বড়ো ডিমগুলো আমাকে দাও‌। এখন নিজের কথা ভাবি।”

“পাজি পেয়ে।” চম্পা নিজের হাতে খাবার তুলে দিতেই আরু টেবিলের উপরে বসে খেতে থাকে। গরম হওয়াতে নাক থেকে পানি ঝরতে থাকে। আরু বেজায় বিরক্ত হয়ে বলে, “ইচ্ছে করছে নাকটা কেটে ফেলে দেই। অসুস্থতা আমাকে কাবু করতে না পারলেও, একমাত্র এই ঠান্ডা লাগাটা আমার বিরক্ত লাগে। হা করে শ্বাস নিতে হয়।”

মল্লিকা তখন অপূর্বর জন্য তেল গরম করে ফিরে এসেছে। গতকাল রাতে অপূর্বর পা মচকে গিয়েছিল বিধায় ঠিকভাবে হাঁটতে পারছে না সে। অপূর্ব তেলের বাটিট নিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে আরুকে ইঙ্গিত দেয় তার ঘরে যাবার, “জ্ঞান ফিরে সবার কথা ভেবেছিস, অথচ তোর বিরহে অপূর্বর পা মচকে হাঁটতে পারছেন না – সেটা তোর চোখে পড়ছে না। খেয়ে আমার সেবা করবি।” অপূর্ব প্রস্থান করলে সবাই খাওয়াতে ব্যস্ত হলো। শেফালীর আজ ঈর্ষা জাগল, এ সাধারণ ঈর্ষা নয়। শেফালী যাকে ভালোবাসে সে তাকে ভালোবাসে না, অথচ আরুকে একসাথে দুজন মানুষ প্রচণ্ড ভালোবাসে। মৃত্যুকেও হার মানায়। আচ্ছা, শেফালী যদি আরুর মতো রূপবতী নারী হতো, তাহলে অপূর্ব ভাই তো তাকে ভালোবাসতো। দেখা যেত তিয়াসও তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকেই চাইত। ও ভাবনার মাঝে অনুভব করল, এক গ্লাস পানি টেবিলে ফেলে দিয়েছে আরু। খানিকটা ছিটে ওর দেহে পতিত হতেই উঠে ঝাঁজালো গলায় বলে, “এই বয়সে চোখের মাথা খেয়েছিস? সবাই তোকে ভালোবাসে বলে নিজেকে মহারানী ভাবছিস?”

তিস্তা বিরক্ত হয়ে বলে, “একটু পানিই তো ফেলেছে, এভাবে রিয়েক্ট করার কী আছে?”

“আছে। আমার সামান্য জ্বর আসলে কারো কিছু যায় আসবে না, তাই রিয়েক্ট করার অনেক কিছু আছে। আরুর তো অনেকে আছে।” শেফালীর ত্যাড়া প্রতুক্তিতে অসুস্থতার পর তিয়াস এই প্রথম শেফালীর সাথে তর্ক ধরল, “বে/য়া/দ/ব একটা, কারো প্রতি কৃতজ্ঞতা নেই। তোর জন্য এই মেয়েটা মরতে বসেছিল। আরেকটু দেরি হলে..! অথচ এখন তার সাথে রিষ করছে, কৃতজ্ঞতার ছিটেফোঁটাও নেই ওর। তোর কাজের পর নিজেকে ছোট মনে হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে বেশ করেছি।”

তীব্র লাঞ্ছনায় বিলম্ব করল না মুহুর্ত। ছুটে গেল নিজের ঘরে। ‘যত দ্রুত সম্ভব এই বাড়ি ত্যাগ করাই শ্রেয়’- আনমনে ভেবে লোকমা মুখে তুলে হাঁচি দিতে দিতে অপূর্বর ঘরে চলে গেল। অপূর্ব নিজেও ঠান্ডায় কুপোকাত। তেল মালিশ করতে ব্যস্ত ছিল দীর্ঘক্ষণ, আরুকে দেখে সেই কাজটা থামিয়ে দিল। আরু অপূর্বর পায়ের নিকটে বসে মচকে যাওয়া পা নিজের কোলে তুলে নেয়। উষ্ণ তেলে হাত ডুবিয়ে অপূর্বর চুলের মাঝবরাবর সিঁথি করে তালু ম্যাসাজ করে দেয়। সরিষার তেলে রসুনের মিশ্রণ থাকার ফলে ঝাঁঝ লাগে নাকে। পরনের শার্টটা টানতে টানতে বলে, “এটা খুলুন, বুকে একটু লাগিয়ে দেই, ঠান্ডা চলে যাবে।”

অপূর্ব হেলান ছেড়ে শার্টের বোতাম খুলে নগ্ন হতেই আরু সেদিক চেয়ে রইল অপলক। তার প্রিয় ভাঁজকাটা দেহ। পুনরায় তেলে হাত ডুবিয়ে ম্যাসাজ করে দিতে লাগল বুকে। অপূর্ব এক দৃষ্টিতে চাওয়া মুখপানে। আরু সেই চোখে চেয়ে চেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। অতঃপর পায়ের আঙুল দৃঢ় করে ধরে তেল লাগিয়ে ম্যাসাজ করতে থাকল। প্রথম দিকে ব্যথায় টনটন করলেও বেশ খানিকক্ষণ আরাম অনুভূত হলো। অপূর্ব আরুর রুগ্‌ণ মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “পদ্মবতীর মন ভার কেন? আমি ডেকেছি বলে?”

“না!”

“তবে?”

আরুর নিজের কাজে ব্যস্ত হওয়ার ভান ধরে অপূর্বর প্রশ্নের জবাব সে দিল না। আরুর হাতটা ধরে পুনরায় একই প্রশ্ন করলে আরু হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। টেবিলের উপরে উঠে বসে পা দোলাতে দোলাতে জবাবে জানায়, “স্বজ্ঞানে কালাচাঁন আমার কোনো ক্ষতি করেনি, করেনি আমার যত্নে কোনো কমতি। তবুও অনেকে বলছে, কালাচাঁন আমাকে কুমারী রাখে নি।”

বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। বিষয়টাকে কর্পূরের ন্যায় উড়িয়ে দিতে ভ্রু কুঁচকে অপূর্ব বলে, “তো? কী হয়েছে তাতে?”

“কেউ আমাকে বিয়ে করবে না। আর আমিও মোটা যৌতুক দিয়ে বিয়ে করব না। আমাদের ঘরের পেছনের খুঁটিটা পোকে নষ্ট করে‌ ফেলেছে। বাবাকে বলব, প্রয়োজনে ঐ খুঁটিতে আমাকে গেঁথে রাখতে। তবুও যাতে মোটা যৌতুকে আমাকে বিয়ে না দেয়।”

“এই ঘরটা ভালোভাবে দেখ আরু, টিনের চাল থেকে মাঝে মাঝে পানি পড়ে ভেসে যায়। ভাবছি এখানে পদ্ম আনব। পানিতে বেশ সতেজ থাকবে। তুই কি হবি, সেই পদ্ম! পদ্মবতী?”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৫

“কাছে আয় আরু, কীসের এত অভিমান তোর? তুই একরাত দূরে কেন, তুই যদি এক যুগ দূরে থাকতি তাহলে এই অপূর্ব তোকে কেবল দেখায় আপন করে নিত। কোনো অভিযোগ ছাড়াই। কাছে আয় আরুপাখি।” অপূর্ব হাত বাড়িয়ে আরুকে ডাকল হৃদমাঝারে। অপূর্বর ডাক উপেক্ষা করতে না পেরে ব্যর্থ আরু এলো অপূর্বর কাছে। তবে দুইয়ের মাঝে দূরত্ব রাখল অনেকটা। অপূর্ব দূরত্ব সহ্য করতে না পেরে বলে, “বিয়ে করবি না আমাকে?”

“না, আমি কাউকে বিয়ে করব না। আপনাকেও না।” বুকে হাত গুজে লুকিয়ে ফেলে দৃষ্টি। অপূর্ব পরমুহূর্তে আরুর লুকিয়ে ফেলা হাতটা টেনে ফেলল বুক পিঞ্জিরায়। খোঁপা করা চুলের গোছা খুলে ছড়িয়ে গেল অপূর্বর দেহ জুড়ে। যত্নসহকারে চুলগুলো সরিয়ে আরুর মুখ প্রকট করতে করতে বলে, “তবে আমাকে আমার প্রাপ্য বুঝিয়ে দে আরু। এমনি এমনি কেউ কারো পেছনে ঘুরে না। (বিরতি দিয়ে) আমি প্রথমবার তোর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে শ্বাস দিয়েছিলাম। আমার কামনা ফিরিয়ে দে।”

চকিতে আরুর হাত ঠেকল ওষ্ঠের উপর। চোখেমুখে তার বিস্মিত ভাব। তখনই অনিতার গলার স্বর প্রকট হওয়ার পাশাপাশি শক্ত মাটির শব্দটা স্পষ্ট হলো। আরুর মাথা চেপে বুকের সাথে ঠেকিয়ে অপূর্ব ভাঁজ বিহীন কাঁথা দ্বারা ঢেকে নিল দুইজনকে। বিলম্বে অনিতা প্রবেশ করে অপূর্ব কক্ষে নজরবন্দি করে শুধায়, “আরুকে দেখেছিস অপু? মেয়েটাকে কোথাও দেখছি না।”

“আমি খাওয়ার সময় দেখেছিলাম। এখন কোথায় গেছে জানি না।”

“সবাই বলেছে, চুনহলুদ নিয়ে এই ঘরে এসেছিল। তাই এলাম। তুই রেস্ট কর। আমি দেখি আরুকে কোথায় পাই।” বাক্য শেষ করার পূর্বেই অনিতা অগ্রসর হলেন। দরজার বাইরে একপা ফেল খুঁটি ধরে ঝুলে বলে, “অপু, তোর পায়ের নূপুরটা অনেক সুন্দর। আজকাল নূপুর পরা শুরু করে দিয়েছিস? আবার পায়ের রঙটা বেশ উজ্জ্বল ও লোম নেই। এই পা নিয়ে বাইরে নামিস না।”

অনিতার প্রস্থানের পরপর আরু বের হলো কাঁথার ভেতর থেকে। অপূর্ব মাথা চুলকে জানালার দিকে ফিরে ফোঁস করে ফেলল নিঃশ্বাস। অধর কা/ম/ড়ে চেয়ে দেখল আরু পগারপার।
_
তারপর পেরিয়ে গেল বহু মুহূর্তে। সম্পর্কের সমীকরণ বদলাতে শুরু করেছে তখন।
নিত্যদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠা আরুর যেন এক অভ্যাস। গ্ৰামের মানুষের কত কাজ, তারা তো সকালেই উঠবে। নিমগাছের ডাল ভেঙে দাঁত ঘষতে ঘষতে দিঘির দিকে গেল আরু। শানে পা রেখে মুখ ধোঁয়ার উদ্দেশ্য হাত বাড়াতেই হাওয়াতে একটা স্রোত ভেসে এলো। তাতে একটা সিলভার কার্প মাছ। আরু দৃষ্টি উঁচু করতেই নজরে এলো দিঘি ভর্তি মাছ ভেসে আছে। মাছ সচরাচর যেভাবে সাঁতার কাটে, সেভাবে নয়। নিমের ডালটা হাত থেকে খসে পড়ল পুকুরে। মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার দিল আরু, “মাআআ।”

আরুর চিৎকার শুনে নিবৃত্ত নেই কেউ। হাজির হয় দিঘির পাড়ে। পারুল অস্থির হয়ে বলে, “কী হয়েছে আরু, চিৎকার দিলি কেন?”

আরু ক্রন্দনরত অবস্থায় আঙুল তুলে দিঘির দিকে ইঙ্গিত করে বলে, “মা-মাছ। দেখো মাছগুলো মরে গেছে।”

স্তম্ভিত সবাই। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে ইমদাদ হোসেন মৃধা। তার দিঘিতে এত মাছ আছে, তা জানা হয়ে গেছে। কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না। আরু ঝাঁপ দিল পানিতে। দিঘির মধ্যিখানে একটা গ্লাস কার্প মাছ ভাসছে। দুহাতে আগলে সেই মাছটি আগলে কেঁদে উঠল আরু। এই দিঘির সবচেয়ে বড়ো মাছ এটি। পুকুরে জাল ফেললে অন্যমাছের সাথে এই মাছটি উঠলে আদর করে ছেড়ে দেওয়া হয়। মাছের দীর্ঘতা অয়নের মতো। একসাথে দাঁড় করিয়ে দীর্ঘতা মাপা হয়েছে। অয়ন ঘাটে নামতেই আরু সাঁতার কেটে মাছটি নিয়ে এলো। অয়ন মাছটিকে ছুঁয়ে কেঁদে দিল, “মা, কে আমাদের দিঘিতে ওষুধ দিয়েছে?”
গ্ৰামের মানুষ একটু সাদাসিধে দেখতে হলেও তারা অন্যের উন্নতি সহ্য করতে পারেনা। কারো পুকুরে মাছ বড় হলে/হাঁসমুরগিতে খোঁপর ভর্তি হলে ওষুধ দিয়ে মে/রে ফেলে। কখনোবা দেখা যায়, সদ্য ঘরে তোলা ধানের গোলা মধ্যরাতে আ/গু/নে দাউ দাউ করে জ্বলছে।

আরু ও অয়নের হাউমাউ করে কান্না সহ্য করতে না পারলেও ইমদাদ হোসেন ও পারুল সহ্য করতে বাধ্য। যত দ্রুত সম্ভব মরা মাছগুলো তুলে ওষুধের পানিগুলো ফেলে আবার নতুন পানি দিয়ে মাছের চাষ শুরু করবে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ইমদাদ রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখল বাড়ির দরজা দিয়ে পরিচিত কতগুলো মুখ ভেতরে ঢুকছে। ইমদাদ হোসেন অসন্তুষ্ট হয়ে এগিয়ে যেতেই মিহি ও মিহির ‘মামা’ বলে জড়িয়ে ধরে তাকে। অতঃপর তারা সরে যেতেই ইমদাদের একমাত্র বোন ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হৃদমাঝারে। ভেঙে পরে কান্নায়। ক্রন্দন ধ্বনির সাথে নির্গত করে, “ভাইজান, কেমন আছেন? কতদিন পর আপনাকে দেখলাম।”

“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি শিরীন। তুই কেমন আছিস?” বোনের পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে শুধালেন। প্রত্যুত্তরে খানিক অভিমান দিয়ে বলে, “বোন ভালো না থাকলে আপনার কী? ঢাকাতে থাকেন, একবার বোনকে দেখে আসলে কী হয়? আমিও তো প্রিয়জনদের আশায় থাকি।”

“তোর বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনলে মা কাঁদবে, তাই যাই না।”

“এবার আমি এমন অবস্থা করব যে, আপনারা মাসের আগামাথায় আমার বাড়িতে থাকবেন।” বলেই পারুলের সাথে কুশল বিনিময় করে শিরীন। তারপরে নিজেই আগ বাড়িয়ে ভাইয়ের কাছে আবদার করে, “আমার একটা আবদার আছে, আমার আবদার পূরণ করতেই হবে কিন্তু।”

শিরীনের কথায় কোনোরূপ সায় দেওয়ার পূর্বেই আরুর দাদিজান লাঠিতে ভর দিয়ে হাজির হলো পুকুর পাড়ে। মেয়ের প্রতি চাপা অভিমান নিয়ে বলে, “মা তোর এত পর হয়ে গেছে, সবার প্রথমে তুই মায়ের সাথে দেখা করলি না।”

“কীযে বলো তুমি! ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে, তাকে সরিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে যাবো?” কথাটা বলে ব্যাগপত্র নিয়ে চলে গেল আরুর বড় চাচার ঘরে। মিহির আরুর অশ্রুভেজা চোখের পানে চেয়ে আছে। মাছের তাড়নায় তার চোখে সৃষ্টি হয়েছে জলপ্রপাত। মন প্রফুল্ল থাকলে পূর্বের মতো ছুটে এসে চকলেট চাইতো। মিহির ব্যাগ নিয়ে আরুর সামনে দাঁড়িয়ে আগ বাড়িয়ে খোঁজ নেয়, “কেমন আছিস আরু?”

“ভালো, তুমি কেমন আছো?”

“ভালোই। এভাবে বেশিক্ষণ বসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবো তোর। পোশাক পালটে একবার বড়ো মামার ঘরে আসিস, তোর জন্য অনেক চকলেট এনেছি।” বলে ট্রাভেলিং ব্যাগ টেনে চলে গেল ঘরের দিকে। নয়না দাঁড়িয়ে ছিল তাদের অপেক্ষায়।
__
সূর্য ডূবে আকাশে লেগে আগে তার ফেলে যাওয়া রক্তিম আভা। গাছে গাছে ফুটে আছে কদমফুল। বৃষ্টিতে মাটিতে পানি জমে আছে। রাস্তার অবস্থা তখন বেসামাল। অপূর্ব ছাতা মাথায় নিয়ে হাঁটু সমান কাঁদা নিয়ে বাড়ির দরজায় পা ফেলে। কান উঁচু করেও শ্রবণ হলোনা আরুর খিলখিল করা মনোমুগ্ধকর হাসির রোল। বেসামাল অপূর্ব দিঘিতে গিয়ে পা ধুয়ে জোতা মাথায় ঘরের ভেতরে ঢুখে। ছাতাটা বন্ধ করে বাইরে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে তুরকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আরু আজকে পড়তে আসেনি?”

“না। আরুদের দিঘিতে ওষুধ দিয়েছে বলে ওদের দিঘির সব মাছ মরে গেছে। তাই আরু আজ স্কুলেও যায়নি, আমাদের বাড়িতেও আসেনি।” বিটিভিতে সন্ধ্যার অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে কথাটা বলে তুর। অপূর্বর বুক ছ্যাত করে উঠল। ফোন বের করে ইমদাদ হোসেনকে কল করতে যাবে তখন সুমি চা এনে টেবিলে রেখে বলে, “আজ আরুকে পাবেন কি-না সন্দেহ। শুনেছি আরুর ফুফুরা এসেছে।”

“তারমানে তো মিহিরও এসেছে?” অপূর্ব প্রশ্নটা করে নিজেও লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। প্রত্যাশিত কিছু চাইতে অনিতার কোলে মাথা রাখল অপূর্ব। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আঁচল থেকে চাবিটা খুলে সুমির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “বউমা, বিকালে তোমার চাচা শ্বশুর যে বক্সটা আমাকে দিয়েছিল। সেটা আমি আলমারিতে রেখেছি। তুমি ওটা নিয়ে এসো।”

সুমি অনিতাদের ঘরের দিকে পা ফেললে তিয়াসকে আদেশ দেয় অনিতা, “চার ভাইকে জরুরিভিত্তিতে বাড়িতে আসতে বলো। আমি চেয়েছিলাম, আগামীকাল ঐবাড়িতে যাবো। কিন্তু এখন আর থাকা সম্ভব নয়।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৬

পারুল মাটির উনুনে চা তৈরি করছে। রান্নাঘরের দিকটাতে বাতির ব্যবস্থা নেই বিধায় একটা হ্যারিকেল জ্বালিয়ে কাজ করছে পারুল। আরু তাকে সঙ্গ দিতে কাঁচের চায়ের কাপগুলো নামিয়ে ধোয়ার জন্য দিঘির দিকে যেতেই পারুল থামায় তাকে। চা’পাতা দিয়ে রঙ পরীক্ষা করতে করতে বলে, “দিঘিতে ওষুধ দিয়েছে, ভুলে গেছিল? দিঘিতে নতুন পানি না ফেলা পর্যন্ত কোনো কাজ করা যাবে না। নাহলে রোগব্যাধি হবে।”

অমনি আরুর মন বিষণ্ন হলো। সন্ধ্যার আগে টেনে আনা পানিতে কাপগুলো ধুতে থাকে। পারুল চায়ের ডেক্সি উনুন থেকে নামিয়ে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলে, “আজকে স্কুলেও গেলি না, পড়তেও গেলি না। পড়াশোনার করার ইচ্ছে নেই তোর?”

“কাল থেকে যাবো। বকো না প্লীজ।”

“আমার সাথে ইংরেজিতে ফুটানি করবি না। প্রতিবার পরীক্ষায় সবার সেরা হয়ে প্লেট নিয়ে আসিস। এবার যদি লাড্ডু নিয়ে আসিস তাহলে তোর খবর আছে।” কড়া গলায় শাসায় পারুল। আরু চাপা রাগ দেখিয়ে হারিকেন নিয়ে ঘরে চলে গেল। ততক্ষণে পারুলের চা ঢালা শেষ। অন্ধকার হয়ে যেতেই চ্যাঁচিয়ে বলে, “আরু। হারিকেন নিয়ে গেলি কেন? আমি এই অন্ধকারে চা নিয়ে যাবো কীভাবে? অপূর্ব আমাকে এই চায়ের কাপের সেট বিদেশ থেকে এনে দিয়েছে। অন্ধকারে কিছু সাথে বেঁধে যদি পড়ে কাপ ভেঙে যায়। তোর খবর আছে।”

অতঃপর আরু খালি হাতেই এলো রান্নাঘরে। লাকড়ি না দিলেও আগের লাকড়িতে মৃদু আলো জ্বলছে। ধপাধপ পায়ে এসে পারুলের হাত থেকে কাপের ট্রেটা কেড়ে একই গতিতে চলে গেল। বৈঠকখানায় আরুর দুই চাচি ও চাচাতো ভাইবোন বসে আছে। অতিথিরাও বাদ নেই। আরু সবার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। টিনের ঝাড় থেকে খই বের করে দুই থালাতে ঢেলে সবাইকে দিল। তারপরে আবার চলে গেল নিজের ঘরে। বইটা খুলে পৃষ্ঠা উলটে মনযোগী হওয়ার প্রচেষ্টা করছে। কিন্তু বোনদের জ্বালায় বারবার বিঘ্ন ঘটছে পড়াতে। ওর ছটফটে মন নিবদ্ধ বৈঠকখানায়। তখন সন্তর্পনে সেখানে প্রবেশ ঘটে মিহিরের। আরুর জন্য আনা চকলেট বক্সটা টেবিলের উপরে রেখে বলে, “এটা তোর।”

“ধন্যবাদ।”

“কোনো কারণে তোর মন খারাপ আরু? আমার সাথে কথা বলছিস না। আগে আমি আসলে তুই অনেক খুশি হতি।” বলতে বলতে খানিক ঝুঁকল আরুর উপর। আরু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ‘তোমাকে একটা চুমু খেয়েছিলাম, এজন্য অপূর্ব ভাই ছলেবলে কৌশলে একশোর বেশি চুমু আদর করে নিয়েছে। চার ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছে। আর কোনো ভুল করতে চাইনা।’ মনে মনে পুনরাবৃত্তি করে বাক্য। তৎক্ষণাৎ কানে এলো একদল লোকের কথা। মনে হলো আহসান বাড়ির চাঁদের হাট মৃধা বাড়িতে বসেছে। চকিতে আরু সেদিকে যেতে চাইলেও দমিয়ে নিল। তাদের সামনে নিজেকে পড়াকু প্রমাণ করতে হবে।

পারুল স্বামীর ভিটাতে আপনজনদের দেখে অসন্তুষ্ট হলো ব্যাপক। উত্তেজিত হয়ে বলে, “এই বৃষ্টিবাদলের দিনে এলে, পা ধুতে দেওয়ার মতো পানিও নেই।”

“শুনেছি তোদের দিঘিতে ওষুধ দিয়েছে। চেয়ারম্যানের জামাইর বাড়ির দিঘিতে কে ওষুধ দিয়েছে, অনেক খোঁজ করেছি। এখনো ধরা পড়েনি। চেষ্টা করছি যাতে ধরা পড়ে যায়।” আরুর নানাজান বলে‌। যার জন্য এত ঘটা করে এসেছে আহসান পরিবার তার দেখা নেই তাই চম্পা আরুর সন্ধান করে, “আরুকে দেখছি না, কোথায় ও?”

“চা দিয়ে ঘরে গেছে। পারুলের সাথে মনে হয় ঝগড়া হয়েছে, মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।” নয়না থামলে ইমদাদ বলে, “মেয়েটাকে তোমার সবসময় ব/কতেই হবে?

“স্কুলেও যায়নি, পড়াশোনাও করেনি আজ। বলেছি তাই পড়তে গেছে.. পারুলের বাক্যে দাড়ি টেনে নিজ ঘর থেকে আরু চ্যাঁচিয়ে বলে, “শুধু এটা বলো নি, ‘প্লেটের বদলে লাড্ডু নিয়ে আসলে খবর আছে’ – বলো নি?”

পারুল পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। তাকে সেই ফ্যাসাদ থেকে রক্ষা করতে মোতাহার আহসান ইমদাদ হোসেন মৃধাকে নিয়ে বাইরের ছোট রোয়াকে কথা বলতে গেলেন। তুর শেফালী ও সুমিও থেমে নেই, অনিতার ইশারায় চলল আরুর ঘরে। তিনজনের প্রবেশে বেরিয়ে গেল মিহির। আরু দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় করতেই তুর আরুর আকর্ষণীয় শাড়িটা বের করল। আরু ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে, “শাড়ি নামাচ্ছিস কেন?”

“তুই পরবি তাই।”

“আমি বর্ষাকালে শাড়ি পরি না। ঠান্ডায় শাড়ি শুকাতে চায় না।” আরুর সিদ্ধান্তকে ঠেলে দিয়ে ওড়না কেড়ে নিল শেফালী। শহরের কায়দা শাড়ি পরাতে শুরু করল।
_
মিহিরকে আরুর ঘর থেকে বের হতে দেখে মেজাজ হলো ক্রুব্ধ। ঠোঁট চেপে সামলানোর প্রয়াস করল অপূর্ব। এই ঘরে এখন মিহিররা ছাড়া কেউ নেই, সবাই পারুলকে সাহায্য করতে ব্যস্ত। আধঘন্টা সময়ের মধ্যে বাহারি খাবারে টেবিলে সাজিয়ে ফেলল পারুল‌। শরবতের গ্লাস নিয়ে ধীর চুমুকে পান করছে দেখে পারুল রঙ্গ করে বলে, “অপু তুই আজ লজ্জা পাচ্ছিস কেন? লজ্জা পাওয়ার কথা নতুন বউয়ের। সুমি এই প্রথম এসেছে। ও চারপাশে ঘুড়েও দেখছে।”

“নতুন জামাইরা তো লজ্জা পাবেই।” অপূর্বর চোখ রাঙানো দেখে থেমে গেল তিয়াস। আরুকে ধরে ধরে নিয়ে এলো ওরা। সুমির ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র উঠে দাঁড়ায় তিয়াস। অপূর্বর পাশের জায়গা আরু গ্ৰহণ করতেই আহসান বাড়ির বড় কর্তা পারুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমার মেয়েকে আমি ইমদাদের হাতে তুলে দিয়েছে অনেক আগে, এখন আমার নাতিকে ফিরিয়ে নিতে চাইছি। ইমদাদের এক্ষেত্রে আপত্তি নেই। তোর কী মতামত?”

“ও গেলে পুরো বাড়ি ফাঁকা লাগবে। মাঝে মাঝে কাজেও আমাকে সাহায্য করে।”

“তারমানে মেয়েকে বিয়ে দিবি না?” মোতাহার আহসানের প্রশ্নে এতক্ষণে সবকিছু মস্তিষ্কে গোচর হলো। পারুলের চোখে পানি এলেও আরুর মুখে ফুটে উঠে হাসি। মাথার ঘোমটা টেনে লজ্জানত হয়‌। দ্বিধান্বিত হয়ে বলে, “আরুল সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার পর বিয়ে..

“বিয়েতে আরুর উপরে কোনো প্রভাব পড়বে না। সে ভাগ্নি হিসেবে থাকবে। অপূর্বর কাছে পড়ে আবার ফিরতে হয়। বিয়ে হলে অপূর্ব সবসময় পড়াতে পারবে। তাছাড়া অপূর্বর বয়সটাও তো বেড়ে যাচ্ছে।” উপস্থিত সবাই তখন পারুলের মতামত শোনার জন্য আগ্রহী। পারুল ‘হ্যাঁ’ জানাতেই একদল লোক ঘর ছেড়ে চলে গেল। পারুল থামানোর চেষ্টা করলেও শিরীনেরা থামল না।
__
জড়তায় আড়ষ্ট হওয়া আরুর পানে করতল মেলে দিলেই আরু ঘোমটার আড়াল থেকে একঝলক দেখে হাত বাড়িয়ে দিল। আরুর সেই হাতে বাম হাত রাখলে অনিতা জুয়েলারি বক্স খুলে অপূর্ব দিকে এগিয়ে দিল চকচকে আংটি। চকচক করা স্বর্ণের মাঝে এক পাথরের আংটি তুলে আরুর অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিল। অতঃপর হাতটা নিকটে এনে আরু নিবৃত্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকল। এটা যেন তার জন্য সৃষ্টি। তদানীং আরুর লাজুক ভাব বাড়িয়ে দিতে অপূর্ব বলে, “পদ্মবতী, পরে দেখো। আংটিটা আগে আমাকে পরিয়ে দিয়ে নাও পাখি।”

আরু দেখল অপূর্ব হাত বাড়িয়ে রেখেছে। অনিতার থেকে আংটি নিয়ে অপূর্বকে স্পর্শ না করেই পরিয়ে দিল অনামিকায়। সাথে পড়ল একফোঁটা অশ্রু, তা আনন্দের না-কি বিষাদের? গুরুজনদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরু দ্বি মুহূর্তে ছুটে গেল ঘরে। কাঠের দরজা ভিড়িয়ে পিঠে ঠেকিয়ে ঘনঘন শ্বাস ফেলতে থাকে। এরপরে বিছানায় গিয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে হেসে উঠে।

‘খুশি করল অপূর্ব, জড়িয়ে ধরে কোলবালিশ। দিস ইজ নট ফেয়ার আরু।’ বলে বুকে হাত গুজে অপূর্ব। আরু শোয়া থেকে উঠে নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলে, “আপনি গতকালকেও বললেন না, আজকে আংটি বদল করে ফেলবেন।”

“আমি নিজেই জানতাম না। হঠাৎ মা তাড়া দিল বিয়ের জন্য। (বিরতি টেনে) শুনেছি, এই শুক্রবার আমাদের বিয়ে সেড়ে ফেলবে। কিছুদিন আগে তিস্তার বিয়ে গেল। এই মুহূর্তে এত খরচ করে বড়ো করে বিয়ের ব্যবস্থা করা ঠিক হবেনা।” বলতে বলতে আরুর পাশে বসে অপূর্ব। অপূর্বর গলা জড়িয়ে কোলে বসে আরু। আজ আলাদা এক অধিকার বোধ খুঁজে পাচ্ছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে