#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৩
“অপূর্ব ভাই, বিদেশে এতকিছু থাকতে শুধু এই বালু ঘড়িটা কেন এনেছেন। আমার হাতঘড়ি আছে, এটা লাগবে না।” বলে আরু থামতে না থামতেই ধরাম করে চড় বসিয়ে দিল আরুর গালে। সেকেন্ড খানেকের জন্য স্থির হয়ে গেল সময়। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে অপূর্ব, “বালু ঘড়ি দেখে নেবে না, কী সাদ। এটা বিজ্ঞানের আবিষ্কার। এর মূল্য জানিস তুই? উপরের ফ্যানেলে যে মিহি বালুগুলো দেখতে পাচ্ছিস, এগুলো নিচের ফ্যানেলে ভর্তি হবে। তারপরে এই দাগগুলো দিয়ে সময় পরিমাণ করা হবে। আমাকে এটা আমার স্যার দিয়েছিলেন।”
অপূর্ব-র কথা আরুর এক কান দিয়ে প্রবেশ করে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। গালে হাত দিয়ে ক্রন্দনোন্মুখ দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে আরু। চঞ্চল হলেও প্রায় অয়নের কারণে চ/ড় থা/প্প/ড় জোটে আরুর গালে। ‘আর এক মুহূর্তও আরু এখানে থাকবে না, এই মাঝরাতে সে নদী সাঁতরে বাড়িতে চলে যাবে’ – এটা ভালোভাবে জানে সবাই। অনিতা আরুর হাত ধরে বলে, “তাল না তোর খুব প্রিয়? সকালে গাছ থেকে দুটো তাল পড়েছে। কাল সকাল সকাল তালরুটি করে দিবো।”
“অপূর্ব-র টাইসনকে তো দেখলি না। চল, তোকে টাইসনকে দেখাচ্ছি।” জাহানারা আরুকে ক্ষান্ত করতে বলে।
“টাইসন কে?” প্রশ্নসূচক দৃষ্টি।
“অপূর্ব-র ঘোড়া।” অনুদ্ধত কণ্ঠে বলে আরুর অন্যহাত ধরে নানি জান চম্পা।
হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল আরু। এক মুহুর্ত না নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে, “আমি এই বাড়িতে আর থাকব না। কখনো আসব না। মা যখন আসবে, তখন শাড়িটা নিয়ে আসবে।”
“রাগ করে না মা। ‘অবদার’ ওখানে ভুত থাকে, তুই গেলেই ঘাড় মটকে দিবে আরু।” অনিতা অনেকবার প্রচেষ্টা করেও আরুর মনে ভয় ঢুকাতে পারলেন না ঠিকই কিন্তু অপূর্ব ভয়ে কাঁপছে। অনিতা বিতৃষ্ণা নিয়ে বলেন, “দিলি তো মেয়েটাকে ভয় দেখিয়ে। এই রাতে আরু খাল সাঁতরে গেলে আপা কী মনে করবে?”
“তুমি আমাকে যে ভয় দেখিয়েছ, বাইরে তাকাতেই আমার ভয় করছে। আবার আরু খাল সাঁতরে যাবে। অসম্ভব।” অপূর্ব বলে।
তিয়াস অপূর্ব-র কাঁধে হাত রেখে হেলান দিয়ে বলে, “আরু কিন্তু আপনার মতো ভিতু নয়। ওকে দেখতে যতটা ভোলাভালা, ও ততটাই চঞ্চল। আপনাকে এক হাঁটে বিক্রি করে অন্য হাঁটে কিনে নিয়ে আসবে।”
অপূর্ব বাইরের দিকে পা ফেলতে চেয়েও ক্ষণে ক্ষণে পিছপা হটছে। আরু ফিরত এলো। চঞ্চল পায়ে শুকাতে দেওয়া ফ্রোকটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করতেই অপূর্ব টেনে ধরল আরুর বাহু। ব্যবহৃত মুঠোফোনের বাটন চেপে কল করে ফুফির ফোনে। অতঃপর বিনীত সুরে সালাম বিনিময় করে শুধাল, “ফুফি, আমার জন্য এত পিঠা পাঠালে যে, ভাগেই পেলাম না।”
বহমান তেজটুকু অবিলম্বে নিস্তেজ হয়ে করুন চোখে অপূর্ব-র দিকে তাকাল আরু। ‘ঝুন-ঝুন-ঝুন’ শব্দ তুলে অপূর্ব-র মুখ চেপে কথা বলার স্বর বন্ধ করে দিল। ফোন সরিয়ে হাতটা নামিয়ে অপূর্ব বলে, “চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়, কাল সকালে সবাই একসাথে যাবো। আমার কথার অন্যথা হলে ফুফিকে বলে দিব, তুই পিঠা ইচ্ছাকৃত ভাবে ফেলে দিয়েছিস।”
আরু জবাব না দিয়ে শিথিলভাবে ডায়ে-বায়ে মাথা নেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মাকে সে প্রচণ্ড ভয় পায়।
_
চারপাশে ঘন কুয়াশাতে দূরের বস্তু ঝাপসাও দেখা বিরল। মোরগ ‘সকাল’ চিনতে ভুল করল না। ডেকে উঠল। আরু বিছানা ছেড়ে উঠল। প্রতিদিন সকালে ময়না আরুর ঘুম ভাঙায়, অতঃপর মিঠুকে নিয়ে যায় ক্ষেতে ঘাস খাওয়াতে। আজ ভিন্ন!
আহসান বাড়ির সামনে বড় একটা নিমগাছ। আরু বের হয়ে সর্বপ্রথম গাছের ডাল ভেঙে দাঁত মাজতে মাজতে দিঘির দিকে অগ্ৰসর হলো। সারিবদ্ধ নারিকেল গাছের গোড়ায় আসনের ভঙ্গিতে কিন্তু পায়ের টাকনু উপরে তুলে অপূর্ব চোখ বন্ধ করে আছে। বৃদ্ধা ও মধ্যমা আঙুল হাঁটুর উপরে। ধ্যানে মগ্ন সে। এই সকালে অপূর্বকে দিঘির পাড়ে দেখে আরু ছুটে গেল কাছে। ‘নূপুরের ঝুনঝুন শব্দ’ অপূর্ব-র ধ্যানে বিঘ্ন ঘটিয়েছে বহু আগে। ‘অপূর্ব ভাই, অপূর্ব ভাই’ বলেও যখন পল্লব মেলাতে পারল না, তখন ধাক্কা দিল কাঁধে। অবিলম্বে তাকালো অপূর্ব। রক্তিম চোখজোড়া উদাসীন হয়ে আছে। কিছুক্ষণ লাগল নিজেকে শান্ত করতে, অতঃপর বাজখাঁই গলায় চ্যাঁচিয়ে বলে, “একটা চড়ে সবগুলো দাঁত খুলে ফেলব, ধ্যান ভাঙালি কেন?”
আরু ভীত হলো। কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আপনি ধ্যান করছিলেন? এভাবে ধ্যান করে বুঝি?”
“কেন নাম শুনিস নি, না-কি দেখিস নি। আমি মনোচিকিৎসক আর একজন মনোচিকিৎসকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, মনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাই আমি প্রতিদিন ১৫ মিনিট ধ্যান মগ্ন থেকে মনকে প্রশিক্ষণ দেই। তাছাড়া আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি প্রায়ই হেরা গুহায় ধ্যান মগ্ন থাকতেন।” অপূর্ব-র কথা আরু বুঝেছে। তাকে যতই জোর করা হোক না কেন সে ধ্যান করবে না। অবশ্য এতক্ষণ আরুকে নিশ্চুপ হয়ে একস্থানে বসে থাকতে দেখা যাবে না।
অপূর্ব টাওয়াল নিয়ে অগ্ৰসর হলো বাড়ির দিকে। আরু কি তবে একা দাঁড়িয়ে থাকবে? সে অগ্রসর হলো দিঘির দিকে। গ্ৰামের শীতকাল শহরের মতো নয়। সেখানে বাংলার মতো এত গাছ নেই, হাঁটতে বাঁধা দিতে রাতে কুয়াশা ঘাসের উপর পড়েনা।
ঘাসের উপর পা রাখতেই পিছলে গেল অপূর্ব-র পা। তড়িগড়ি করে নিজেকে সামলে উঠতে চলমান আরুর বাহু ধরল। আরু নিজেও স্থির থাকল না। অপূর্ব-র কাঁধ আঁকড়ে ধরল। চোখাচোখি হলো দু’জনার। চঞ্চল আরু এক নিমিষে স্থির হয়ে মিরে গেল।
দুজনে গিয়ে বসল মাটির চুলার কাছে। অনিতা মাটির এক চুলায় চিতই পিঠা বানাচ্ছে অন্য চুলায় চা বসিয়েছে। অপূর্ব আসতেই ছোট মামি মল্লিকা কাপ নিয়ে এলেন। ঝাঁকুনি দিয়ে পাতা আলাদা করে সবাইকে রঙ চা পরিবেশন করলেন। অপূর্বকে দিতে গিয়ে সংশয় নিয়ে বললেন, “অপূর্ব তুই কি চা খাবি, না-কি কালকের মতো কফি খাবি?”
“চা খাবো। এখন থেকে যখন গ্ৰামেই থাকব, তাহলে তোমাদের মতোই অভ্যাস করতে হবে।”
রাখাল চাচা দুধ নিয়ে হাজির হলেন। জাহানারা দুধ উনুনে রেখে তাকেও এক কাপ চা দিলেন। অতঃপর দুধ গরম করে আরুকে এক গ্লাস গরম দুধ খেতে দিল। উপস্থিত সবার হাতে চা, একমাত্র আরু ব্যতিত। সংশয় নিয়ে অপূর্ব বলে, “ওকে কেন দুধ খেতে দিলে মা?”
“আরু চা খায় না। আসলে পারুল খেতে দেয় না। আমি চা খেতে দিয়েছি শুনলে ও রাগ করবে।”
“কেন রাগ করবে?”
“কারণ পারুল মনে করে আরু চা খেলে ও কালো হয়ে যাবে। তাই খেতে দেয় না। ফর্সা রাখতে প্রতিদিন ওকে আর অয়নকে দুধ খেতে দেয়।”
অপূর্ব কাপে চুমুক দিয়েও খেল না। ওষ্ঠের সাথে ঠেস দিয়ে কাপ রেখে আরুর দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা শুধু ফর্সাই নয়, ঢের ফর্সা। গ্ৰামের মেয়েদের এত ফর্সা মানায় না, তারা থাকবে কালো বা শ্যামবর্ণের। প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে সূর্যের তাপে তাদের গায়ের রঙ ফর্সা থাকবে না-মানে থাকবে না।
আরুর চুমুক দেওয়া দুধের গ্লাসটা টেনে নিল অপূর্ব। ছিটকে পড়ল দেহে। ফাঁকা হাতে নিজের চায়ের কাপটা দিয়ে ক্ষান্ত কণ্ঠে বলে, “নে, চা খা।”
“না, আমি চা খাবো না। মা বকবে।” ভীত কণ্ঠে বলে।
“আমি খেতে বলেছি।” দৃঢ় কণ্ঠে বলে অপূর্ব।
“কী করছিস অপু। জোর করিস না। তাহলে মেয়েটা আর আসবে না।”
“হ্যাঁ ভাইয়া, এমনিতেই রাজহাঁসের ভয়ে মেয়েটা আসেনা।” তিয়াস বলে।
“তিনটা হাঁস যে একসাথে পোষে, তার বেলায়? তিয়াস সমান তিন হাঁস।” আরু স্বশব্দে বলতে পারল না, কারণ সেই ছেলেটা তার জন্য অপূর্বকে বোঝাচ্ছে। অপূর্ব যখন আরুকে আরেকটু জোর করার প্রয়াস করল তখনই ছুটে এলো আরুর বড়ো চাচার মেয়ে সিঁথি, “আরু তোর মিঠুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জেনেছি মিন্টু চাচার কলাবাগানে ঢুকেছিল বলে সে খড়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।”
আরু থেমে রইল না। চায়ের কাপটা ফেলে রেখে ছুটল অজানায়।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]