#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩০
সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামল সুন্দরনগরে এসেছে ইমদাদ হোসেন মৃধা। তিস্তার বিয়ের সময় তাকে ডিপার্টমেন্ট থেকে ছুটি দেওয়া হয়নি। তাছাড়া কাজের অনেক চাপ ছিল। এখন চাপ কম থাকার কারণে তিস্তার জন্য উপহার নিয়ে এসেছে। ট্রেশন থেকে সোজা ব্রিজের সামনে এসে রিকশা থামে। ইমদাদ হোসেন রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগ নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। আহসান বাড়িটা নদীর এপার বলে ব্রিজ পর্যন্ত যেতে হয় না। তবে ব্রিজের কাছে না গেলে রিকশা পাওয়া যায় না। এজন্য ব্রিজের কাছে যেতে হয়। তবে মৃধা বাড়ি ওপাড় বলে ব্রিজ দিয়ে নদী পাড় হতে হয়। ইমদাদ হোসেন প্রথমে নিজের বাড়িতে যেতে চায়। ব্রিজের দুইপাশেই সারিবদ্ধ দোকান। ইমদাদ হোসেনকে দেখে দোকানদার চা বানানো রেখে বলে, “মৃধা সাহেব, মেয়ে নিখোঁজ কাল থেকে আর তুমি আজকে আসলে?”
“মেয়ে নিখোঁজ মানে?”
“তোমার মেয়ে আরুর কথা বলছি গো। কেন তুমি জানো না? তোমার মেয়েটার ভাগ্যে কী লেখা আছে, কে জানে। গতবার তানারা তোমার মেয়েকে নিয়ে গেল। এবার একদল ছেলে তোমার মেয়েকে নিয়ে গেল। পুলিশ সকালে এসে খোঁজ করেছিল, তখনই জেনেছি।”
ইমদাদ হোসেন বাক্যরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আরুদের বাড়িতে কোনো ফোন নেই। আরুর বড় চাচার ঘরে একটা ল্যান্ডফোন আছে, সেটা দিয়ে কথা বলে ইমদাদুল। কিন্তু গতকাল কেউ তাকে ফোন করে আরু নিখোঁজের ব্যাপারটা জানায়নি। ইমদাদ হোসেন ছুটে বাড়ির দিকে চলে গেলেন। যেতে যেতে হোঁচট খেয়ে এক জোড়া স্যান্ডেজ ছিঁড়ে ফেললেন। জুতা জোড়া হাতে নিয়ে ছুটে বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। দেখতে পেলেন, অয়ন তার চাচাতো ভাইয়ের সাথে খেলাধুলা করছে। ‘বোনের দুর্দশায় ভাই হোক ছোট বা বড়ো’ – সে থাকবে টঠস্ত। কিন্তু অয়নের এমন ভাব দেখে ইমদাদ হোসেন ভাবলেন, মশকরা করেছে লোকজন। রোয়াকে জিনিসপত্র রেখে বলে, “তোর বুবু আর মা কোথায় অয়ন?”
“মা পশ্চিম পাড়ায় বুবুর জন্য কাঁদছে। পরশুদিন তিয়াস ভাই সুমি ভাবীকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। কালকে শেফালী বুবু বি/ষ খেয়েছিল। সবাই শেফালী বুবুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় বুবু পিছনে পিছনে গিয়েছিল। তখন থেকে বুবু নিখোঁজ। সবাই বলছে ওকে কেউ অ/পহ/র/ণ করেছে।” খেলতে খেলতে বলে অয়ন। পরপর তিনটি ঘটনায় ইমদাদ হোসেনের মাথায় স্বচ্ছ পরিবেশের মধ্যেও বাজ পড়ে। প্রতিবার তার আগমনে ছেলে ও মেয়ের মাঝে আনন্দের আমেজ পড়ে। ছেলের এমন গুরুত্বহীন কাণ্ডে ইমদাদ হোসেন ধরে নেয়, আরুকে হিং/সার কারণ। ইমদাদ হোসেন পশ্চিম দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস করলে একটা পেয়ারা তার মাথায় পড়ে। ইমদাদ হোসেন গতি রোধ করে উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই একটা তাবিজ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখল গাছের মগডালে। হাত বাড়িয়ে নাগালে পেল না তাবিজখানা। গাছে উঠে তাবিজখানা নামানো জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করতেই ভেসে এলো চিৎকার। ইমদাদ হোসেন স্থির না থেকে ছুটে গেলেন পাড়ায়। পারুল আরুর শোকে কাঁদছে আর বড়ো বউ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
“আমার মেয়েটা কোথা গেল ভাবী? কালরাত থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। কালরাতে অয়নকে দুধ দেয় নি, এজন্য মেয়েটাকে আমি চ/ড় মেরেছি। অনেক কথা শুনেছি। মেয়েটা মনে হয় রাগ করে কোথাও চলে গেছে।” প্রলাপ ব/কে চলেছে পারুল। বড়ো বউ সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “তাহলে মেয়েটা যখন কাছে থাকে, তাহলে কেন ওকে মারো?”
“গুনধর পুত্রকে দুধ দেয়নি, এজন্য মে/রেছে। আমার মেয়েটাকে একদম সহ্য করতে পারে না।” বিরক্ত নিয়ে বলে ইমদাদ। পারুল স্বামী দিকে তাকিয়ে কান্নায় প্রবল ভেঙে পড়ে। স্বামী স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ করে বড়ো বউ চলে গেল। পারুল তখন কাঁদতে কাঁদতে ইমদাদকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি এসেছ, যেভাবে হোক আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে এনে দাও। আমি আর কখনো ওর গায়ে হাত দিবো না।”
“কেঁদো না। আমি আছি। সব ঠিক করে দিবো। আর নিখোঁজের ব্যাপারটা তুমি আমাকে কেন জানলে না, পারুল?”
“তুমি ঢাকাতে থাকো। তুমি চিন্তা করবে, এজন্য আমি কিছু জানাইনি।”
“সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হাঁস মুরগি খোপরে ঢুকিয়ে আহসান বাড়িতে চলো। তোমাকে এখানে একা রাখতে আমার ভয় করছে এমন। ভাইজানের সাথে কথা বলতে হবে।”
“ছাগলদের গোয়ালে দিয়েছে, হাঁসমুরগির খোপরে দিয়েছি। এখন আর কোনো চিন্তা নেই। আর ভাইয়া বলেছে, যেভাবে হোক আরুকে খুঁজে নিয়ে আসবে।”
অতঃপর বাড়িতে লম্বা একটা তালা ঝুলিয়ে ইমদাদ ও পারুল আহসান বাড়ির দিকে গেল। অয়নের ভাব দেখে তার দাদির কাছে রেখে আসল।
__
চিনের তৈরি চৌচালা ঘর কালাচাঁনদের। সেই বড়ো ঘরে কালাচাঁন ও তার বৃদ্ধ মা থাকে। কালাচাঁনের আম্মা সুন্দরী ভর সন্ধ্যায় উঠান ঝাড়ু দিতে ব্যস্ত। তখন সেখানে প্রবেশ ঘটে অপূর্বদের। আশেপাশে তাকিয়ে তিস্তা বলে, “এটাই কালাচাঁন বাড়ি আর উনি কালাচাঁনের মা। আগেরবার ওনার কাছেই কালাচাঁনের নামে বিচার দিয়েছিলাম।”
“তোরা থাক, আমি ছলেবলে কথা শুনে আসছি।” বলেই অপূর্ব এগিয়ে যায়। কালাচাঁন মা সুন্দরী অপূর্বকে দেখে ঝাড়ু দেওয়া বন্ধ করে বলে, “তুমি কে বাবা, আমার বাড়িতে কী করো?”
“আমি কালাচাঁনের বন্ধু। কালাচাঁন বাড়িতে আছে চাচি?”
“না বাজান, কালাচাঁনরে বাড়িতে পাওয়া যায় না। ও সারাদিন রাস্তায় টইটই করে। শুধু ওয়াক্ত মতো একে গিলে যায়।” বলতে বলতে আবার সুন্দরী ঘর ঝাড়ু দিতে থাকে। কালাচাঁনের এই বাড়িটি একদম ভেতরের দিকে এবং এদিকে কোনো ঘর নেই। এরমধ্য লম্বা দৈত্যের মতো ছায়া বাড়ির উঠানে পড়ে। অপূর্ব কান পেতে শুনতে পারল পাতার উপরে হাঁটার শব্দ। তাই তিস্তাদের কাছে গিয়ে আড়াল হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রকট হয় কালাচাঁন। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে উঠানে এসে সুন্দরীকে বলে, “কী রান্না করেছ আম্মা?”
“ছিপ ফেলে শোল মাছ ধরেছিলাম বাড়ির পেছন থেকে। সেটাই রান্না করেছি। তুই আজ এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে এলি যে, তোকে তো রাত দশটার আগে বাড়ির আশেপাশে দেখা যায় না।”
“বিলের মাঝখানে আমাদের সে আম বাগান আছে না? লোকেরা না-কি আম পেরে বিক্রি করছে, খবর পেয়েছি। তাই একজন বন্ধুকে নিয়ে সেখানে থাকব। সেখানে তো ঘর করা আছে, আমাদের অসুবিধা হবেনা। এখন রাতের জন্য খাবার নিতে এসেছি। নিয়েই ফিরে যাবো। যা রেঁধেছ, নিয়ে এসো। হাতে একদম সময় নেই।” কালাচাঁনকে প্রচণ্ড ভয় পায় সুন্দরী। ছেলের মুখের উপর কোনো কথা না বলে ঝাড়ু রেখে ঘরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর গামছা মুড়িয়ে খাবার নিয়ে এসে কালাচাঁনের হাতে দেয়। কালাচাঁন খাবার নিয়ে পূর্বের পথ ধরে চলে যায়। পরক্ষণে ছেলের গমন পথের দিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিলেন সুন্দরী। আড়াল থেকে অপূর্বরা বেরিয়ে আসে। তুর সন্দেহ নিয়ে বলে, “আমার মনে হয়, ঐ বিলের মাঝেই আরুকে ব/ন্দি করে রাখা হয়েছে।”
তিস্তা বলে, “হতে পারে, নাহলে যে কালাচাঁন বাড়ির কোনো খবর নেয় না, কাজ করে না। সে হঠাৎ রাস্তায় আড্ডা দেওয়া রেখে কেন বিলের মাঝে থাকবে? আমাদের গিয়ে দেখতে হবে।”
কালাচাঁনদের বাড়ির পাশ গিয়ে বয়ে গেছে নদী। নদীর পানি জোয়ারের জন্য ক্ষেতে উঠে আবার ভাটায় নেমে যায়। বারো মাস ভিজে থাকে। এখন জোয়ার বইছে তাই ভিটার চারপাশের ছোটো নালাতে পানি জমে আছে। কালাচাঁন লাফ দিয়ে সেই নালা পেরিয়ে পানির মাঝে ছোপ ছোপ করে হেঁটে চলেছে। আলো বিম্ব জানাচ্ছে কালাচাঁনের গতিপথ। অপূর্বর নালা সম্পর্ক কোনো ধারণা নেই। তাই কদম ফেলে কালাচাঁনের পথ ধরতেই নালার ভেতরে পড়ে গেল। বেকায়দায় পড়ে পা মচকে ফেলেছে। অপূর্ব সেখানে পড়ে চাপা আর্তনাদ করতেই তিস্তা ও তুর ধরে তুলে অপূর্বকে। অপূর্ব পায়ের দিকে না তাকিয়ে ক্ষেতের দিকে তাকাচ্ছে। ততক্ষণে কালাচাঁন মিলিয়ে গেছে অন্ধকারে। অপূর্ব পা ফেলতে পারছে না ব্যথায়।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩১
আরু কুঁড়েঘরের একপাশে শুয়ে আছে। বিরতিহীন ধারায় কেশে চলেছে। শত হোক, ভালোবাসার মানুষ , তাকে যাতনা দেওয়া সাজে না। আরু ভার মাথা নিয়ে হেলান দেয় কুঁড়ের তৈরি দেয়ালে। ঘরে কিছু খড়কুটো ছাড়া কিছু নেই। জমানো খড়কুটোর পাশে পরে আছে অবশিষ্ট কিছু বিড়ির টুকরো। আরু হাত দিয়ে শরীরের তীব্রতা পরখ করে নেয়। সেদিন জোরজবরদস্তি করে আরুকে ডিঙিতে তোলার সময় ভিজে জবুথবু হয়েছিল। ভেজা অবস্থা থেকে ঠান্ডা তাকে আপন করে নিয়েছে। দীর্ঘক্ষণ তৃষ্ণার্ত থাকার কারণে খালি ঢোক গলা বেয়ে নেমে যেতে বাঁধা পায়। আরু ফোঁস করে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে মাটির কলসের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে যায়। কলস থেকে নারিকেলের খোলসে পানি ঢেলে নিজের তৃষ্ণা নিবারণ করে।
তখনই শুনতে পেল কালাচাঁনের মুগ্ধ করা গানের সুর। পরেনা চোখের পলক, কী তোমার রূপের ঝলক। আমি জ্ঞান হারাবো, মরে যাবো।
বাঁচাতে পারবে না কেউ।
কালাচাঁন চাবি দিয়ে তালা খুলবে এমন সময়ে দেখতে পেল আম গাছের ডালের সাথে বিঁধে রাখা একটা পাটের থলে। আরুর জন্য কবিরাজের থেকে জরিবুটি আনতে বলেছিল, তা এনে বাইরে রেখে দিয়েছে। কালাচাঁন থলে নিয়ে তালা খুলে প্রবেশ করে ভেতরে। আরুকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে স্ফুটিত হয় জোড়াল হাসি। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে খাবার বের করে কালাচাঁন। দেড় দিন না খেয়ে থাকাতে পেটে মোচড় দিয়ে উঠে আরুর। ক্লান্ত আরু নিজ থেকে খাবার কোলে তুলে নেয় খাওয়ার উদ্দেশ্যে। আরুর জীর্ণদশা দেখে কালাচাঁন খাবার নিয়ে নেয়। নিজের হাতে মেখে খাইয়ে দেয় আরুকে। আরুর চোখে পানি চলে এসেছে। সে লক্ষ্য করে কালাচাঁনের চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। তাকে এই জীর্ণদশা সহ্য হচ্ছে না বোধহয় কালাচাঁনের। সত্যিকারের সেই ভালোবাসা। কালাচাঁনকে খাওয়ানো শেষ করে পাটের থলে থেকে একটা নতুন শাড়ি আরুর সামনে রেখে বলে, “এটা পরে নিও গোলাপী। তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে আমার অন্তঃকরণ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়।”
“আমার বাইরের অবস্থা দেখে আপনার এই অবস্থা, ভেতরের অবস্থা দেখলে কী করবেন?”
“গোলাপী, আমার দোষটা আসলে কোথায়? সেই সাড়ে চার বছর ধরে একটু একটু করে তোমাকে ভালোবেসে চলেছি। আমার গায়ের রঙ কালো। বিধাতা করেছে কালো, আমি করব কী?” কালাচাঁনের অনুভূতি পূর্ণ কণ্ঠটা শুনলে মৃ/ত্যুদ/ন্ড প্রাপ্ত আ/সামী/র আদেশেও জল্লাদ পিছিয়ে যাবে। এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগে না। যার বাম পাঁজর দিয়ে নারী সৃষ্টি, সে ভালো না বাসলেও মিলন তার সাথেই লেখা। হোক সে কাঁলাচানের মতো পা/গ/লা প্রেমিক। সেখানে আরু একটা মানুষ। আরু জ্বর যখন হুরহুর করে বেড়ে যাচ্ছিল, তখন অপারক হয়ে কালাচাঁন আরুর মাথায় পানি ঢেলেছিল। জীবনে এক গ্লাস পানিও সে ঢেলে খায়নি। সে রাত জেগে প্রিয়তমার সেবায় নিয়োজিত ছিল। আরুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। বেড়ার পাশে পড়ে থাকা *দা* তুলে নিয়ে কালাচাঁনের দিকে এগিয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “নিন, এটা দিয়ে আমাকে দ্বি খণ্ডিত করে ফেলুন। দুইজন মানুষ আমাকে এত করে চায়, অথচ আরু মাত্র একটি। কারো গোলাপী, কালো পদ্মবতী। আমাকে দুই টুকরো করলে অপূর্ব ভাইও পাবেন, আপনিও পাবেন।”
“অপূর্বকে তুমি ভালোবাসো। তাহলে কেন সেদিন তুমি আমাকে বলেছিলে ‘বিয়ের কথা?’ আমি সেদিন ভেবেছিলাম, তুমিও আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছ। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আরো গাঢ় হতে শুরু করেছিল। শোনো গোলাপী, তুমি যদি আমার নাহয় তুমি কারো নয়। তুমি যদি আমার হও। তবে তুমি আমার।” আরুর হাত থেকে কালাচাঁন *দা* নিয়ে ফেলে দিল মাটিতে। কালাচাঁনের দৃঢ় গলায় আরু বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আরুর কাঁধ শক্ত করে ধরে জবাব চাইছে কালাচাঁন। আরু হাত দুটো সরিয়ে দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। গতকাল মাথায় পানি দেওয়ার কারণে পানি অনেকটা নরম। আরু সেই মাটি মুঠো করে ধরে অঝোর ধারায় অশ্রুপাত ঘটাতে থাকে। কালাচাঁনের সহ্য হয় না আরুর কান্না। ঘরের পানি ভর্তি কলসটা তুলে সম্পূর্ণ পানি ফেলে দেয় মেঝেতে। চুষে নেয় শুষ্ক মাটি। কলসের ভেতরে ঢুকলো দড়ি। একহাতে আরুর হাত ধরে, অন্যহাতে কলসখানা তুলে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। আরুর রুগ্ণ দেহ অনেকটা গিয়ে হার স্বীকার করে। কিন্তু ক্ষান্ত হয় না কালাচাঁন। আরুকে নদীর ধারে এনে বজ্রকণ্ঠে বলে, “আজ এই নদী সাক্ষী হয়ে থাকবে আমাদের ভালোবাসার। কারো মৃ/ত্যুতে কারো জীবন থমকায় না, তাই তোমাকে সাথে নিয়ে আমি দুজনের জীবন থমকাবো।”
বলেই কলস ভর্তি করে নিল নদীর পানিতে। আরুর দেহে কাঁপন সৃষ্টি হলো। জোরপূর্বক বেঁধে দিল তা আরুর গলায়। আরুর পীড়িত দেহ পেরে উঠল না কালাচাঁনের সাথে। কাতর স্বরে বলে, “দেখ কালাচাঁন, আমি চেয়ারম্যান বাড়ির ভাগ্নে। একবার যদি জানতে পারে কেউ, তুই আমাকে মে/রেছিস। তোকে কেউ আস্ত রাখবে না।”
“হা! হা! হা! হাস্যকর। আমি তো তোর সাথেই ইতি টানতে চলেছি জীবনের। আমাকে পাবে কোথায়?” অপূর্বর কণ্ঠে আরু ভীত হয়ে উঠে। জীবনের মায়া। ছুটে যায় গলায় ভারী কলস নিয়ে। বেশিদূর যাওয়ার আগেই কালাচাঁন তাকে থামায়। আরু কাতর হয়ে বলে চলেছে, “আমি ম/র/ব না, দয়া করে আমাকে ছাড়ুন।”
__
অপূর্ব তার পা নিয়ে বোনদের কাঁধে ভর করে পেরিয়ে এসেছে এতটা পথ। নদীর ধার দিয়ে সরু রাস্তা পার হওয়ার সময় কানে এলো ফিসফিস শব্দ। আলোর বিন্দুমাত্র রেখা নেই। অপূর্বর মন ছটফট করছে। অপূর্ব বিচলিত হয়ে বলে, “যেভাবে হোক আজ রাতের ভেতরে আরুকে উদ্ধার করতে হবে। আরু যে আমার অর্ধ অঙ্গ। আমি ওর কষ্ট অনুভব করতে পারছি।”
“শান্ত হন ভাই, কালাচাঁন আরুর জন্য খাবার নিয়ে গেছে। আমার মনে হয়, কালাচাঁন ওর অযত্ন করবে না। আমরা চাচাকে জানাই, কালাচাঁনদের আম বাগান সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। চাচাকে জানালে, লোক লাগিয়ে আরুকে বের করে আনতে এক মুহুর্তও লাগবে না।” তিস্তা বলে সান্ত্বনা দেয় অপূর্বকে। আরও কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই অন্তঃকরণ সিগন্যাল পাঠায়, আরু সন্নিকটে। অপূর্ব তখন উদাসীন হয়ে উঠল। পাশেই ফিসফিস কথোপকথন ও পানির শব্দ শুনতে পেল। ছুটে গেল সেখানে। টর্চের আলোটা দুজনের মুখে পড়ে। অপূর্ব দেখতে পায় অচেনা আরুকে। বাক্য হারিয়ে ফেলে। তখনই কালাচাঁন আরুর হাত ধরে ঝাঁপ দিল পানিতে। তিনজন মানুষ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। ধ্যান ভাঙতেই অপূর্ব দুই বোনের হাত ছাড়িয়ে নিজেও ঝাঁপ দিল নদীতে। অথচ সে সাঁতার জানে না। তুর ও তিস্তা অপূর্বকে ধরতে গিয়েও ধরতে পারেনা। পূর্ণিমা তিথি বলে তখন নদীর পানি তটের অনেক উর্ধ্বে। দুইজন মানুষ ছিটে গেলেও আরু বোধহয় কলসের ভারে তলিয়ে গেছে নদীর তলদেশে। কিছুক্ষণ পর অপূর্ব ভেসে উঠল। সাঁতার দেওয়ার চেষ্টা করছে। একবার তার মাথা দেখা যাচ্ছে, আরেকবার দেখা যাচ্ছেনা। অপূর্ব যে তুরের আপন ভাই। তুর ঝাঁপ দিয়ে নদীতে। পূর্ণিমা হওয়ার কারণে পানির পাশাপাশি অনেক স্রোত। তুর বহু কষ্টে অপূর্বকে তুলে আনে পাড়ে। অপূর্ব হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “ওটা আরুই ছিল। ওরা কেন ভেসে উঠছে না?”
“তুই সিউর ওটা আরু ছিল?”
“শুধু আরু নয়, কালাচাঁনও ছিল। আরুর গলায় আমি একটা কলস দেখছি। সেই কলস থেকে পানি পড়ছিল। কীভাবে ওকে বাঁচাবো আমি।” বলেই অপূর্ব কান্নায় ভেঙে পড়ে। পুনরায় আরুর জন্য নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার প্রয়াস করলে তিস্তা বাধা দেয়। টর্চ দিয়ে নদী পর্যবেক্ষণ করে বলে, “নদীতে যা স্রোত, না-জানি ওদের ভাসিয়ে কতদূর নিয়ে গেছে।”
‘তার পদ্মবতীর উচিত পদ্মের মতো ভেসে থাকা এই জলে?’ অপূর্বকে চিন্তা মুক্ত করতে সেখানে এসে উপস্থিত হলো একদল জেলে। নৌকায় করে নদীতে মাছ ধরা তাদের পেশা!
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]