#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৬
আরু ও তুর অপেক্ষা করছে শেফালী ও অপূর্বর জন্য। শেফালী দৃঢ় গলায় জানিয়েছে, সে তিস্তার সাথে সাক্ষাত করতে যাবে না। কিন্তু অপূর্ব কেন বিলম্ব করছে তা ঠাউর করতে পারে না ওরা। মিনিট তিন পর অপূর্ব এলো। তবে বেশ রাগান্বিত হয়ে, হাতে নতুন একটা জিন্স। আরুর সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলে, “এটা কী করেছিস তুই? সেলাই করেছিস কেন? আমাকে বলেছিলি আলমারিতে তুলে রাখবি, তোলার নাম করে কী করেছিস এটা? আমার আরও একটা স্টাইলিশ জিন্স দিয়ে তুই ঘর মুছেছিস।”
অবিলম্বে আরু অপূর্বর হাত থেকে কেড়ে নিল জিন্সটা। ভালোবাসে পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধি করে, সেই ছেঁড়া জিন্সটা। চড়া গলায় বলে, “এজন্য কারো ভালো করতে নেই। আপনাকে ব/ল/দ পেয়ে ছেঁড়া জিন্সটা গছিয়ে দিয়েছিল। ফেলে দেওয়ার চেয়ে সেলাই করে পরা ভালো। তাই নিজের হাতে সেলাই করেছি।”
“এটা ছেঁড়া?”
“উঁহু। ছেঁড়া নয়। মনে হয় এই জিন্সটা কেনার জন্য দুজনে টানাটানি করেছিল। তখন ফেসে গেছে।”
“এটা স্টাইল!”
“এটা স্টাইল?”
“জি। থাকিস তো গ্ৰামে। জানবি কীভাবে? ড্রেস সম্পর্কে তোর কোনো আইডিয়া আছে? এমনিতেই খাঁটো, আবার একটা শাড়ি পরে ঘুরঘুর করিস। একদম ফুটবলের মতো লাগে তোকে। যা, শাড়ি পালটে একটা থ্রী পিস পরে আয়।” অপূর্ব থমথমে ভঙ্গিতে কথাটা বলে। আরু চাপা রাগ নিয়ে ঘরে চলে গেল। অতঃপর পথের দিকে চেয়ে লাজুক হাসি দিল। তুর অপূর্ব-র কাঁধে হাত রেখে বলে, “ভাই, আরুকে একদমই ফুটবলের মতো লাগে না। চোখ ঝলসানো পরীর মতো লাগে। আর তুমি তালগাছের মতো লম্বা, আরু মোটেও বেঁটে নয়।”
“তা তো জানিই। কোনো ছেলেই চাস না, তার প্রিয়তমার সৌন্দর্য অন্য কোনো পুরুষের চোখে পড়ুক।” অপূর্বর কথায় প্রয়াসের কথা স্মরণে এলো তুরের। তিয়াস তো পেয়ে গেল নিজের ভালোবাসার মানুষকে। কিন্তু তুর? সে কখনোই বাবা মায়ের মুখে চুনকালি লেপে প্রয়াসের হাত ধরে পালিয়ে যাবে না। ‘এতে যদি তাকে শেফালীর মতো আগুন বুকে চেপে স্বাভাবিক থাকার ভান করতে হয়’ – এতেও অসম্মতি নেই তুরের। তুর কল্পনা থেকে বেরিয়ে অপূর্বকে রঙ্গ করে বলে, “সামথিং! সামথিং!”
“নাথিং!” বলে হাতের দিকে ইঙ্গিত দিল অপূর্ব। অবিলম্বে হাত নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তুর। আশেপাশে গভীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেফালীর সন্ধানে নামে অপূর্ব। ব্যস্ত থাকলে সবকিছু থেকে দূরে থাকবে শেফালী। অপূর্ব বলে, “শেফুকে দেখছি না যে, কোথায় ও?”
“কত করে বললাম আমাদের সাথে চল। ও যাবে না বলল।” তুর জানায়। তিয়াস তৈরি হয়ে এদিকেই এসেছে। রক্তের সম্পর্ক তিস্তার সাথে, তিয়াস না গেলে ভালো দেখায় না। তিয়াসের আপাদমস্তক নজরবন্দি করে অপূর্ব মুখ খুলে, “তোকে যেতে হবে না। কিছুক্ষণ পর সুমির বাবা ও চাচা আসবে। তুই তাদের জামাই। তোর এখানে থাকা জরুরি।”
“তিস্তা তো আমাদের অপেক্ষায় আছে!”
“আমিও তো ওর ভাই? তোর মতো আপন নয়। তবে ভাই তো। চিন্তা করিস না, আমি এই বিষয়ে কিছু বলব না। মেয়েটা তাহলে ওযথা চিন্তা করবে।”
“বাঁচালেন আমায়। আচ্ছা তাহলে আমি যাই, ওনারা ব্রীজ পর্যন্ত চলে এসেছে।” তিয়াস বিদায় নিয়ে চলে গেল ব্রীজের দিকে। আরুও শাড়ি পালটে উজ্জ্বল লাল রঙের থ্রিপিস পরে এসেছে। সাজগোজ টাও আগের তুলনায় বাড়িয়ে দিয়েছে। চোখের উপরে ও নিচে মোটা কাজল লাগিয়েছে, লাল টুকটুকে লিপস্টিক, দুহাত ভর্তি চুড়ির মাঝামাঝি একটা রুপার বালা। পায়ে নূপুরের পাশাপাশি এখন আলতায় রাঙা, কপালের মাঝবরাবর একটা টিপ, হাঁটু সমান চুলগুলো খোলা। হাওয়াতে উড়ছে। ঠোঁটে ঝুলে আছে রহস্যময় হাসি। মেয়েটা কি কথাগুলো শুনে ফেলেছে? অপূর্বর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এই যে চৈত্র আসার আগেই চৈত্রের কাঠ ফাটা রোদ্দুরের তান্ডব শুরু করে দিয়েছে। কাছাকাছি আসতেই অপূর্ব দিল রাম ধমক, “চুলগুলো খোঁপা কর জলদি। মাথায় কাপড়ও দিবি। আমি শেফুকে নিয়ে আসছি।”
অপূর্ব দ্রুতগতিতে ঘরের ভেতরে চলে গেল। দুই গ্লাস পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিল। আরেকটু হলেই পানির পিয়াসে প্রাণ পাখিটা উড়ে যেত।
_
প্রথম রিকশা এসে থামল তালুকদার বাড়িতে। তুর ও আরু রিকশা থেকে নেমে অপেক্ষা করছে অপূর্বদের জন্য। অপূর্ব ও শেফালী আলাদা রিকশায় আসছে। আরুর মন বেজায় ভার। তার প্রবল স্পৃহা রিকশায় অপূর্ব হাত জড়িয়ে এত পথ পাড়ি দিয়ে তিস্তাদের বাড়িতে আসবে। পৃথিবীতে সকল প্রেমিক প্রেমিকারা চায়, প্রিয় মানুষের সাথে একান্ত সময় পার করতে। আরুও তার ব্যতিক্রম নয়! আচ্ছা আমি কি অপূর্ব ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্য নই? আমাকে তার সাথে মানায় না বলেই কি তিনি অন্য রিকশায় এসেছেন? অপূর্বর জন্য সাজগোজটা বিষের মতো লাগল আরু কাছে। সময় নিয়ে সাজটা বৃথা। সৌজন্য হেসে ওড়না দিয়ে লেপটে দিল চোখের কাজল, লিপস্টিক, ফেলে দিল টিপ। চুলগুলো খোঁপা করে ওড়না টেনে দিল মাথায়। চুড়িগুলো চেপে কয়েকটা ভেঙে ফেলল।
তখন অপূর্ব এলো। দুই রিকশার ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আড়চোখে একবার আরুকে দেখে মলিন লাগল মুখশ্রী। কিছুক্ষণ পূর্বেও প্রাণবন্ত ঠেকছিল সেই মুখ। হাতেও নেই সব চুড়ি। অপূর্ব সন্দিহান গলায় বলে, “কিরে সাজগোজ নষ্ট করেছিস কেন?”
“একটু আগেও না সব ঠিক ছিল?” তুর বলে।
“তিস্তা আপু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চলো।” বিষয়টা সাবধানে ধামাচাপা দিয়ে আরু আগেই হেঁটে চলে গেল। অপূর্ব তাকালো মাটির দিকে। সেখানে চুড়ির টুকরো পড়ে আছে। টিপ ও সাথে কয়েক ফোঁটা রক্ত। ভাঙল প্রেমের বান। মনে মনে আওড়াল, “এত অভিমান কেন তোমার? কেন বুঝতে পারো না আমায়? আজকাল তোমার দিকে তাকালেও নিজেকে বেসামাল লাগে। আজ তো নিজেকে সেজেছ গোলাপ রানী। নিজেকে সামলাতে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে, তা কি তুমি জানো?”
“তোরা ভেতরে যা। আমি আসছি।” মিষ্টির হাঁড়ি ও যাবতীয় বাজার দিয়ে দিল তুরের হাতে। ওরা দুজন চলে যেতেই অপূর্ব হাঁটু গেড়ে বসে। ভাঙা চুড়ির টুকরো জোড়া দিয়ে বুঝে চারটা চুড়ি ভেঙেছে। অপূর্ব দুর্বল হেসে বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে বলে, “চারটা চুড়ি ভেঙেছ তুমি গোলাপ রানী। তোমাকে চার ডজন চুড়ি কিনে দেওয়া আমার দায়িত্ব।”
_
প্রিয় মানুষদের পেয়ে আরেকদফা কেঁদে ভাসিয়েছে তিস্তা। আরুও কম যায় না, সেও কাঁদল। অভিমানে একবারও তাকাল না অপূর্ব দিকে। তিস্তাদের টিনের বাড়ি। বাড়িতে অসংখ্য মানুষ গিজগিজ করলেও বাড়ির মূল সদস্য বর্তমানে তিনজন। সুজনের মা, ভাই, সুজন ও তিস্তা। বাকিরা বিয়ে উপলক্ষ্যে আসা অতিথি।
সুজন ও সেই ছেলেটা এলো সেখানে। গতকাল যে আরুর রুপের প্রশংসা করছিল। ওর নাম দর্পণ। ইতস্তত নিয়ে বলে, “স্যরি। আসলে আমি বুঝতে পারিনি, বেয়াইদের সাথে আপনারা তেমন মিশেন না। তাহলে আমরা কখনোই এমন করতাম না।”
“সমস্যা নেই। আসলে আমাদের বংশে তিস্তা আপুর বিয়েই ছিল প্রথম। বেয়াই বেয়ানদের সাথে কেমন সম্পর্ক হয় আমরা জানি না।” তুর বলে। ছেলেটা আবার আরুর রূপের মুগ্ধতা প্রকাশ করে, “আপনাকে দেখতে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে। সাজগোজ নষ্ট হওয়ার পরেও অপূর্ব লাগছে। না জানি যখন সেজেছেন, তখন কেমন লাগছিল।”
তিস্তাদের এই বাড়ির এই ঘরটার একটা জানালা পূর্ব দিকে। তাই সূর্যের রশ্মিটা ঘরের ভেতরে পড়ছে। আরু তার বিপরীত পাশে বসেছে বলে সূর্যের রশ্মিতে তার মুখমণ্ডল সৌন্দর্যে দ্বিগুণ হয়েছে। অপূর্ব দর্পণের সব কথা সহ্য করে নেয়। আরু তা লক্ষ্য করে অপূর্বকে আরেকটু ঈর্ষান্বিত করে বলে, “আমাকে না-কি দেখতে ভালো লাগে না?”
“কে বলেছে? আমি বলব তার চোখ খারাপ। আপনার মতো সুন্দর মেয়ে আমি আর দেখিনি। তাহলে সেদিন বললাম, আমি হলে ভাবীকে রেখে আপনাকে বিয়ে করতাম?” বলেই দর্পণ ছেলেটা হাসল। আরুর ওর সাথে তাল মেলালো। অপূর্ব সবকিছু সহ্য করে উঠে দাঁড়ায়। ইতোমধ্যে বেতের টেবিলটাতে খাবারে ভর্তি করে ফেলেছে। একপাশে অপূর্বর নিয়ে আসা বাজার। অপূর্ব বাজারগুলো তিস্তার হাতে দিয়ে বলে, “এগুলো ভেতরে নিয়ে যা। বাড়িতে জরুরি কাজ আছে। আমাকে যেতে হবে। চিন্তা করিস না, আগামীকাল আমি গাড়ি নিয়ে এসে তোদের নিয়ে যাবো।”
তিস্তার মনে বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। প্রিয় মানুষগুলো চলে যাবে ভাবতেই মলিন হয়ে এলো তার মুখমণ্ডল। বাজারগুলো নিয়ে ধীর পায়ে ভেতরে দিকে পা বাড়াল। অপূর্ব গেল তার পিছু পিছু। সবার অগোচরে একটা চিঠি তিস্তার হাতে গুজে দিয়ে বলে, “যখন একা থাকবি, তখন এটা পড়বি। বাকিটা বাড়িতে এসে জানবি। (কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে) মহারানী রেগে ঢোল হয়ে আছে। যখন তখন তোর ভাইয়ের গর্দানের আদেশ দিতে পারে। ভাইকে বাঁচাতে চাইলে, ওকে একটু সাজিয়ে দে।”
তিস্তা শুধু আরুকে নয়, তিনজনকেই সাজিয়ে দিল। তবে আশ্চর্যের বিষয়, এবার অপূর্ব নিজেই আগ বাড়িয়ে আরুর রিকশায় উঠে। শেফালী ও তুরকে আদেশ দেয়, “তোরা আগে আগে যা। বলা তো যায় না নতুন কোনো জ্বীন, পরীর রূপে মুগ্ধ হয়ে আবার ভর করে।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৭
মোতাহার হোসেন ফোন করে কাজি সমেত বাড়িতে যেতে বলেছে অপূর্বকে। অপূর্ব বাবার আদেশ মেনে কাজি বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ফেরেনি বাড়িতে। আরও একটা গুরু দায়িত্ব পড়েছে। সুমির বিয়ের জন্য আপাতত লাল বেনারসি ও হালকা জুয়েলারি নিয়ে যেতে বলেছে।
তুর ও শেফালীর রিকশাটা মার্কেটের বাইরে রেখে আরুকে নিয়ে ভেতরে গেল অপূর্ব।
একেক পর এক শাড়ি দেখাচ্ছে। শাড়ি সম্পর্কে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই আরু ও অপূর্বর। তাই দোকানদারের দেওয়া শাড়িটাই পছন্দ করে নিল অপূর্ব। বিল মিটিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করল আরু একটা লাল বিয়ের বেনারসির দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। আরুর কাঁধে হাত রেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে অপূর্ব, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? পছন্দ হয়েছে?”
“শাড়িটা সুন্দর না? একদম সিম্পল, কিন্তু মনকাড়া।” আরু শাড়ির মিহিন দেহে স্পর্শ করতে করতে অপূর্বকে প্রশ্ন করে। অপূর্বও ভালো লাগল। অপূর্ব ও আরুর বিয়ে হতে বহু প্রহর অপেক্ষা করতে হবে, ততদিনে কোনো নারী এই বেনারসি অঙ্গে জড়িয়ে কোনো পুরুষের অর্ধাঙিনীর স্বীকৃতি নিবে। অপূর্ব শাড়িটাকে দেখিয়ে জড়ানো গলায় বলে, “এটাও প্যাকেট করে দিন।”
আরও কিছু শাড়ি কেনার পাট চুকিয়ে নিয়ে গেল জুয়েলারি দোকানে। আরুকে দায়িত্ব দিল গহনা পছন্দ করার। আরু পছন্দ করার ফাঁকে প্রশ্ন করে, “আপাতত আজকে পরার জন্য এই বক্সটা নিন। সাথে নরমাল জুয়েলারিগুলো। বক্সটার গহনাগুলো আজকের জন্য, আর এগুলো রোজকারের জন্য। তারপরে নাহয় সুমি ভাবী আর তিয়াস ভাইয়া পছন্দমতো কিনে নিবে।”
অপূর্ব আরুর কথা মেনে শাড়ি ও অলংকার
কিনে নিল। আরুকে সবকিছু বুঝিয়ে অপূর্ব মিষ্টি কিনতে গেল। শেফালীর হাতে একটা ছোটো কাঁচের কৌটা দেখতে পেল আরু। উচ্চ স্বরে বলে, “তুর ওর হাতে কী? যাওয়ার সময় তো দেখলাম না।”
“মাত্র কিনে নিয়ে এসেছে। ওর সাদা গোলাপ ফুলের গাছে না-কি পোকামাকড় বাসা বেঁধেছে। এজন্য এনেছে।” তুর বলে। ততক্ষণে মিষ্টি কিনে ফিরে এসেছে অপূর্ব। শেফালীও লুকিয়ে নিয়েছে সেই ওষুধটা। আরুর বুক কেঁপে উঠছে। শেফালী উলটাপালটা কিছু বলে বসবে না-তো?
__
সন্ধ্যা হতে না হতেই চাঁদের মৃদু প্রতিবিম্ব দেখা গেল জলে আর আয়নাতে দেখা গেল সুমির লজ্জায় মাখা বধূবেশের প্রতিবিম্ব। আরু লাল ওড়নাটা সুমির মাথায় তুলে দিয়ে বলে, “ভাবী, তোমরা কতদিন ধরে প্রেম করছিলে? প্রেম হলো কীভাবে?”
“একদম ছোট থাকতে। আমি তো তোমাদের ভাইকে পাত্তা দিতাম না। সে নিজেই আমার স্কুলের সামনে গিয়ে ঘুরঘুর করতো। সবার দেখাদেখি ভাবলাম আমিও নাহয় প্রেম করি। তবে এতটা কাবু হয়ে যাবো ভাবিনি।” বলেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠল সুমি। শেফালী তখন এলো দুধের গ্লাস নিয়ে। সুমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “খেয়ে নাও ভাবী।”
আরুর সন্দেহ লাগল ব্যাপারটা। যে মেয়েটা সহ্য করতে পারেনা সুমিকে, তার থেকে এমন মিষ্টি ব্যবহার প্রত্যাশার বাইরে। সুমি খাওয়ার জন্য হেসে গ্লাস তুলতেই আরু বাধা দেয়। গ্লাসটা ফিরিয়ে দিয়ে বলে, “এখন খেলে বাসর ঘরে স্বাদ পাবে না। পরে খেও। চল ভাবী। কাজি ডাকছে।”
তুর ধরে ধরে সুমিকে নিয়ে গেল ড্রয়িং রুমে। তবে আরুকে যেতে দিল না। বাহু ধরে টেনে ঘরের দ্বার বন্ধ করে দিল। হুংকার দিয়ে বলে, “তুই কেন সুমিকে দুধ খেতে দিলি না আরু? তুই কি আমার ভালো চাস না?”
“তারমানে আমার ধারণা সত্যি। তুই ওটা দুধে মিশিয়ে ছিলিস?”
“হ্যাঁ, মিশিয়েছি। ওকে মে/রে ফেলতাম আমি। আমার সামনে ও নেচে নেচে বিয়ে করে নিবে আর সেটা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব। এতটা মহান আমি নই।”
“দেখ শেফু, সুমি ভাবী ও তিয়াস ভাই দুজন দুজনকে ভালোবাসে। ওদের সুখী হতে দে।” আরুর কথার প্রেক্ষিতে শেফালী বাক্য তোলে না। শেফালী গ্লাসটা নিয়ে পান করার প্রয়াস করল। চকিতে গ্লাসটা নিজের আয়ত্বে নিয়ে সরে গেল আরু। শেফালী ক্রমশ আরুর দিকে এগিয়ে আসার পাশাপাশি গ্লাস ফেরত চাইছে। চট করে দরজার ছিটকিনি খুলে আরু বেরিয়ে গেল দুধের গ্লাস সমেত। ভীত শেফালী সেদিক যাওয়ার স্পর্ধা দেখায় না।
পারুল বাড়ির কাজ শেষ করে অয়নকে নিয়ে এসেছেন। পারুল উঠানে জাহানারা অনিতার সাথে কথা বলছেন। ছেলেদের বিয়ে মায়ের দেখতে হয় না বিধায় চাচিরা উঠানে বসে আছে। অয়ন ছুটে ভেতরে এসে লক্ষ্য করে আরুর হাতে দুধের গ্লাস। অয়ন আরুর থেকে গ্লাসটা নিতে নিতে বলে, “বুবু, তুই একা এই গ্লাস ভর্তি দুধ খাবি? আমাকেও একটু দে।
“না! একদম না।” হতভম্ব হয়ে আরু দ্রুত হাতটা উপরে তোলে। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উচ্চতা বৃদ্ধি করে আরুর হাত থেকে নেওয়ার প্রয়াস করে। অনবরত বারণ করে চলেছে আরু। তবুও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে অয়ন। আরু অধৈর্য হয়ে দেয় ধমক, “এক চড়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দিবে অয়নের বাচ্চা। বলেছি না, এটা দেওয়া যাবেনা। সামনে থেকে সর।”
অয়ন ছুটে গেল পারুলের কাছে। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “মা, বুবু আমাকে দুধ খেতে দিচ্ছে না। এক গ্লাস দুধ। আমি বলেছি একটু দিতে। দিবে না, আরও আমাকে মারতে চায় বাবু।”
“আরু ওকে দুধের গ্লাস দে। আমার বাপের বাড়িতে দুধ কম পড়েনি যে, তোর ভাগ্যে জুটবে না। ওকে গ্লাসটা দিয়ে তুই আরও এক গ্লাস নিয়ে আয়।” বলতে বলতে গ্লাস নিতে অনেকটা এগিয়ে এলো পারুল। আরুর হাত থরথরিয়ে কাঁপছে। শেফালীর ব্যাপারটা বলা শোভা পায় না, অন্যদিকে গ্লাস দিলে অয়ন খেয়ে ফেলবে। পারুল গ্লাস ধরার পূর্ব মুহুর্তে আরু হাত ছেড়ে দিল। অবিলম্বে তা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। কাঁচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। ক্ষোভের গোঙানি তুলে আরুর দিকে তাকায় পারুল। তিন সেকেন্ড পর তার হাতটা আপনাআপনি গিয়ে ঠেকে আরুর গালে। আরু বুঝতে পারিনি এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আরও একটা চড় মারার জন্য হাত নাড়াতেই এগিয়ে এলেন অনিতা। আরুকে যথাসম্ভব আড়াল করে বলে, “মেয়েটাকে মারছ কেন পারুল? তোমার জোরাজুরিতে গ্লাসটা হাত ফসকে পড়ে গেছে। ভালোভাবে বললে আরু নিশ্চয়ই দিয়ে দিতো।”
“আমি গ্লাসটা ধরার আগেই ও ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছে। অয়নকে দুচোখে সহ্য করতে পারেনা মেয়েটা। ভাই হয় ওর, একটুখানি দিলে কী হতো?” তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আরুর পানে নিক্ষেপ করে প্রত্যুত্তর করে পারুল। পারুলের প্রশ্নের ফিরতি জবাব দেয় জাহানারা, “অয়ন যখন দেখছে, আরু ঐ গ্লাসে দুধ খাচ্ছে। তাহলে ওর কেন ওটাতেই খেতে হবে। ডেক্সিতে আরও দুধ ছিল। আমাকে বললে আমিই দিতাম। তোমার মেয়ে নয়, তোমার ছেলে আরুকে সহ্য করতে পারে না। (অয়নকে উদ্দেশ্য করে) আয়, তোকে দুধের ভেতরে চুবিয়ে জীবনের মতো দুধ খাওয়া শেখাচ্ছি।”
সবাই ঘরের দিকে চলে গেল। আরু একা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দিঘির দিকে গেল। নারিকেল গাছের নিচে বসে নিঃশব্দে অশ্রু ফেলতে লাগল।
সুমি ও তিয়াসের বিয়ের কাজ শেষ। মাগরিবের নামাজ আদায় করতে দিঘির পাড়ে এসেছে অজু করতে। অজু করে উঠে উপরের দিকে দুই পা ফেলতেই নারিকেল গাছের দিকে তার চোখ পড়ল। আবছা অন্ধকারে মানুষের মতো ঠাওর করতে পারে অপূর্ব। তাই গলা ছেড়ে ডাকে, “কে ওখানে?”
আরু একটু নড়েচড়ে উঠে অপূর্বর ডাকে। ভাঙা গলায় সাড়া দিতে চেয়ে অনুভব করে তার গলায় কোনো স্বর নেই। অপূর্ব ততক্ষণে টর্চ নিয়ে এগিয়ে গেছে। আরুর মুখের দিকে তাকাতেই খণ্ডিত হলো নিজের বুক। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “এখানে বসে কাঁদছিস কেন মেয়ে? কেউ কিছু বলেছে?”
আরুর প্রত্যুত্তর হীন মুখ আভাস দেয় সম্মতির।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]