নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-২৪+২৫

0
440

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৪

আরু আনমনা ভেঙে নিচে ভিড় ভাট্টার সম্মুখীন হয়। আরু নিত্যদিনের মতো নিমগাছের ডাল দিয়ে দাঁত মেজে দিঘিতে যায় মুখ ধুতে। ইতোমধ্যে সবাই খেয়ে তিস্তাকে গোসলের জন্য নামিয়েছে। দক্ষিণ দিক থেকে ধোঁয়া আসছে। বিয়ের বাড়ি উপলক্ষ্যে সকালে খিচুড়ি রান্না করা হয়েছে। দুপুরে বরযাত্রী এলো বলে। আরু শাড়িতে মুখ মুছতে মুছতে গেল সেদিকে। বড়ো বড়ো ডেক্সি থেকে দুই চামচ খিচুড়ি তুলে কলা পাতায় নিয়ে খেতে বসে কাঠের চেয়ারে।
অপূর্ব রান্নার দিকে ছিল বলে ঘেমে জবুথবু হয়ে হাজির হলো আরুর কাছে। হাতের মুঠোয় দুই টুকরো লেবু। উভয় টুকরো খিচুরিতে চিপকে দিল। আরু ডাগর ডাগর চোখে অপূর্ব-র দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। আরুর মাথায় চাট্টি দিয়ে বলে, “ঘেমে কালো হয়ে গেছি। তোর আঁচলখানা দিয়ে দ্রুত আমার নোনা জলটুকু মুছে দে। তারপরে কয়েক লোকমা মুখে তুলে দে। কাজের চাপে আজ একটুকুও খেতে পারিনি।”

আরু নিজেও খেল না, অপূর্বর মুখেও তুলে দিল না। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেবল। অপূর্ব তুরি বাজিয়ে বলে, “হা করে না থেকে খাবারটা মুখে তুলে দে জলদি। কাজ আছে আমার। দুপুর করে ঘুমানোর সময় আমার নেই।”

আরু নিজে না খেয়ে অনবরত লোকমা তুলে দিল অপূর্বর মুখে। আরু আজ হলুদ শাড়ির সাথে মিলিয়ে কাঁচের হলুদ চুড়ি পরেছে। মাঝেমধ্যে রিনিঝিনি শব্দ তুলছে সেই চুড়ি। অপূর্ব তা মুগ্ধ নয়নে দেখছে। পেট ভরে খেয়ে অপূর্ব আবার রান্নার দিকে চলে গেল। আরু এবার নিজে খেতে লাগল। খাওয়া শেষে আরু গিয়ে দাঁড়াল উঠানে। তিস্তার মাথায় পানি ঢেলেছে। তিয়াস নিজের বোনকে কোলে নিয়ে কলতলায় চলে গেল। উঠান ভিজে তাই আরু ভালোভাবে হাঁটছে যাতে পিছলে না যায়। আরুকে দীর্ঘক্ষণ অক্ষত থাকতে দিল না তুর। পেছন থেকে ছুটে এসে আরুকে ল্যাং মেরে ফেলে দিল কাঁদায়। শেফালী ছুটে এসে পা ধরে টানতে থাকে কাঁদায়। আরু বারবার বলছে, “প্লীজ আমাকে তোরা ছেড়ে দে, আমি মাত্র খেয়ে এসেছি। দৌড়ঝাঁপ করলে পেটে ব্যথা করবে।”

তুর বা শেফালী কেউ ছাড়ল না আরুকে। কিছুক্ষণের ভেতরে চিনচিন ব্যথা অনুভব করল আরু। ততক্ষণে নিজেদের কাজ শেষ করে আরুকে ছেড়ে দিয়েছে ওরা। এবার বড়োরা কাঁদায় টানাটানি করছে। আরুর কিছু একটা স্মরণে আসতেই আরু ছুটে তাদের ঘরে চলে গেল। গতকাল সে পুঁইশাকের বিচির লাল রং গুলো সংগ্রহ করে রেখেছিল। সেটা নিয়ে ছুঁড়ে দিল দুজনের শরীরে। আরু ক্ষান্ত হলো না, ওদের পেছনে দৌড়ে দৌড়ে রং ছুড়তে চাইল। পেটের ব্যথাটা অনেকটা চাড়া দিয়ে উঠতেই আরু দূর থেকে রঙ ছুড়ে দিল। সেখানে এসে উপস্থিত হলো অপূর্ব। মেহেদির পাশাপাশি লাল রঙে পুরোপুরি খরচার খাতায় চলে গেল হলুদ পাঞ্জাবিটা। দিল রাম ধমক, “দৌড়ে দৌড়ে তামাশা করা হচ্ছে এখানে? আমার কাজের বারোটা করে দিলি তিনজনে। ইচ্ছে করছে তিনটা নিয়ে..। যা গোসল করে তৈরি হয়ে নে।”

শেফালী ও তুর নিরুদ্দেশ হয়েছে আগেই। আরু পেটে‌ হাত দিয়ে অতি সাবধানে কদম ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলে, “কী হয়েছে? এভাবে হাঁটছিস কেন?”

“আপনি সবসময় আমাকে বকেন। একদম সবসময়। আমি কি ইচ্ছে করে ওদের রং মাখিয়েছি না-কি? মাত্র খেয়ে উঠলাম। কতবার বারণ করলাম তবুও কাঁদায় টেনে পেটে ব্যথা শুরু করে দিল।” আরুর অভিমানী গলা। অপূর্ব লক্ষ্য করল আরুর দুই হাতে মাত্র তিনটা চুরি। বাকিগুলো যে ওদের কারণে ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। অপূর্ব পেছন থেকে একটা আবদার করে বলে, “আমার ঘরের আলমারিতে সেদিনের নীল শাড়িটা আছে, চুড়ি, আলতা। কমতি নেই কিছুতে। আজকে পারলে একবার পরিস।”

_
দোল দোল দোলনি,
রাঙা মাথায় চিরুনি
বর আসবে এখুনি,
নিয়ে যাবে তখনি।
বর এসেছে বর এসেছে বলে বাচ্চাদের চিৎকার শোনা গেল। শেফালী ও তুর ফুলের সজ্জিত প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আরও কয়েকজন মেয়ে রয়েছে সেখানে। আরু নিজের নীল রঙের শাড়ির আঁচল তুলতে তুলতে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। নীল রঙের চুড়িগুলোর মাঝে সাদা রুপার চুড়িটা চকচক করছে। খোঁপায় গুজেছে নীলপদ্ম। সম্পূর্ণ শাড়িতে রয়েছে পদ্মের ছাপ। আরুর দুধে আলতা রঙে সর্বোচ্চ মানিয়েছে আরুকে। সুজনের সাথে তা সমবয়সী ভাই বা বন্ধু হয়েছে কয়েকজন। তাঁরাও মুগ্ধ আরুর রূপে। অপলক চেয়ে রয়েছে।
আরু গিয়ে কোমরে হাত গুজে বলে, “সুজন ভাই, শালি মানে আধি ঘরওয়ালী। শালিদের আবদার পূরণ করে তবেই আপনি পূর্ণ ঘরওয়ালী কাছে যেতে পারবেন।”

সুন্দর করে ছেলেটা রঙ্গ করে বলে, “আমি সুজনের জায়গায় থাকলে টাকা না দিয়ে আধি ঘরওয়ালীকে পুরো ঘর ওয়ালী বানিয়ে ফেলতাম।”

“যেহুতু আপনি সুজন ভাই নয়, তাই চুপ করে থাকুন। আর সুজন ভাইয়ের মতো নজর একদিকেই রাখুন।” শেফালীর উগ্র কণ্ঠ। চলে যাওয়ার প্রয়াস করে বাঁধা পায় তুরের। সামান্য একটা কথাতে রাগ করে চলে গেলে টাকা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। ফিসফিস করে বলে, “এমন একটু আধটু বলে। এতকিছুর ব্যবস্থা করে কি পানিতে ভাসিয়ে দিবো? দাঁড়া। যাস না।”

বরপক্ষের ছেলেরা টাকা দিতে অস্বীকার করে। মেয়েরা নামে টাকা আদায় করতে। অপূর্ব দূর থেকে স্পষ্ট দেখে সবকিছু। অন্যদিকে বেলা পড়ে যাচ্ছে, তাই অপূর্ব এগিয়ে এসে বলে, “ছেড়ে দে, ওনারা হয়তো জানে না কোনে পক্ষের দরজায় টাকা দিতে হবে। তাই বোধহয় আনেনি। তোরা আমার কাছ থেকে নিয়ে নিস। দরজা ছেড়ে ভেতরে যা।”

বরপক্ষের ছেলেরা একটু অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে, “এই নিন টাকাটা।”

“এতক্ষণ যখন টাকা ফেলতে পারেননি, এবার আর দরকার নেই। একটা কাজ করুন, টাকা পকেটে নিয়ে ভেতরে আসুন।” বলেই অপূর্ব ডাকে তিয়াসকে। তিয়াস এগিয়ে আসলে দুজনে ধরে টেবিল সরিয়ে রাখে পাশে। কাঁ/চিটা সুজনের হাতে দিয়ে বলে, “ফিতা কেটে ভেতরে আসো।”
__
সবে ঘোড়ার গাড়িটা শাঁ শাঁ করে বেরিয়ে গেল। বিদায়ের সময় কেঁদে ভাসিয়ে ফেলেছে আরু। মল্লিকা এখনো কাঁদছে। চারজন বাড়ির বউ কেঁদে ভাসিয়ে ফেলেছে। সেক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই পারুল। বংশের প্রথম ভাইজিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে সেও। অন্যের কান্নার চেয়ে আরু একটু বেশিই কেঁদে কেঁদে ভাসিয়ে ফেলেছে। যথারীতি শরীরে তার অজস্র কাঁদা লেগে আছে।

পারুল আঁচল থেকে চাবি খুলে আরুর হাতে দিয়ে বলে, “কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে গিয়ে হাঁস মুরগি খোপরে ঢুকিয়ে আয়। শুধু শুধু কাঁদার চেয়ে কাজ করতে করতে কাঁদ।”

আরু চাবিটা হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির রাস্তা ধরে। উপস্থিত সবাই মেয়েকে বিদায় দেওয়ার কান্না ভুলে আরুর কাণ্ডে হাসছে। তিয়াস নিজেকে একটু শক্ত করে বলে, “মেয়েটা একটু কাঁদবে, তোমার জ্বালায় কাঁদতেও পারল না। তা একা একা বাড়ির দিকে পাঠিয়ে দিলে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বটতলাটা ভালো না।”

অপূর্ব আরুর পেছনে পেছনে হাঁটা দিল। আরু তখন বটতলা পর্যন্ত এসেছে। পেছন থেকে অপূর্বর ডাক তার কাছে মনে হলো কোনো দিবা। হাঁটার সময় পেছন থেকে বারবার ডাকে, কখনোবা পেছনে পেছনে হাঁটে। আরু বামপা দিয়ে কয়েকবার ঘর্ষণ করে এগিয়ে গেল। হাঁটার তালে তালে আরুর মাথার খোঁপাটা খুলে গলার কাছে জমে রইল। সম্পূর্ণ পড়ে যাওয়ার আগেই অপূর্ব ধরে ফেলে। ভীত আরু আরেকটু কাবু হয়ে পেছনে তাকাতেই অপূর্বকে দেখতে পেল। অপূর্ব সন্তর্পনে আরুর খোপা ঠিক করে দিল।‌ পাশের লজ্জাবতী গাছটাও এতটা লজ্জা পেল না। আরুকে সন্নিকটে টেনে হাত দুটো নিজের কাঁধে তুলে দিল অপূর্ব। অতঃপর নিজের হাত দুটো কোমরে রেখে অপলক চেয়ে রইল।

“ওভাবে কী দেখছেন?”

“আমার পদ্মাবতীকে দেখছি। আজকাল তাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগে। আজকে তুই একটু বেশিই লজ্জা পাচ্ছিলিস, কিন্তু কেন? বিয়ে তো তিস্তার। তুই কেন লজ্জা পাবি? একবার মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতে দে, তোর লজ্জা ভাঙানোর দায়িত্বটা তখন আমি নিবো।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৫

আহসান বাড়ির চার ভাই একত্রে বসে আছে। তাদের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ানো তিয়াস ও সুমি। বাড়ির মেজো ছেলে অর্থাৎ তিয়াসের বাবা উঁচু গলায় বললেন, “তুমি একটা মেয়েকে ভালোবাসো। আমাদের বললেই আমরা মেনে নিতাম। সেই মেয়েকে নিয়ে চলে এলে। আজ আহসান বাড়ির মান সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে তোমার জন্য।”

“আমি যেটা করেছি, সেটা ভুল। কিন্তু এছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না।” কথাটা বলে তিয়াস সুমির দিকে ইশারা করে। অবিলম্বে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুমি। দাদিজানের পা ধরে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “আমার মা নেই, ছোটবেলায় মা মারা গেছে। বাবা আবার‌ বিয়ে করছে। আমাকে বাড়ি থেকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। চকিদারের মাতাল ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করছে। আমারে বাঁচান।”

চার ছেলের সাথে আলোচনা করলেন পিতা। কিছুক্ষণ আগে তিস্তাকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। ‘এরমধ্যে তিয়াস সুমিকে বাড়িতে নিয়ে আসবে’- এটা কারো প্রত্যাশায় ছিল না। হট্টগোল না করে তাই নিজেদের ভেতরে আলোচনা করছে আহসান পরিবার। পরিস্থিতি তখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। মোতাহার আহসান বলেন, “আমাদের একটা মানসম্মান আছে। চাইলে আমরা সব করতে পারিনা। তোমার বাবাকে খবর দেয়। কাল সকালে আসতে বলি। কথা বলে সব মিটমাট করে বলব।”

এত সময় পর সমস্যা সমাধান হতে দেখে অন্তঃকরণ ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হলো শেফালীর। সবাই প্রায় সুমিকে বাড়ির বউ হিসাবে মেনে নিয়েছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটি চিরতরে অন্যের হওয়া মেনে নেওয়া কতটা কষ্টের সেই জানে। শেফালী বাজখাঁই গলায় বলে, “না চাচা, না বাবা, না দাদা। এমন একটা চরিত্রহীন মেয়ে তিয়াস ভাইয়ের সাথে মানায় না। যে মেয়ে বংশের মুখে চুনকালি লেপে অন্য ছেলের সাথে আসতে পারে, তার চরিত্র কখনোই ভালো হতে পারে না। আপনারা ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিন।”

ভালোবাসার মানুষটির নিন্দা কি কোনো প্রেমিক সহ্য করতে পারে? তিয়াসও পারে না। শেফালীকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ঠাটিয়ে লাগল এক চ/ড়। রাগে শরীর ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তিয়াসের রাগান্বিত মুখমণ্ডল দেখে অপূর্ব তাকে সরিয়ে নিল। তবুও তিয়াস বলে, “আর একটা কথা বললে তোর মুখ আমি ভেঙে দিবো শেফু। আমাকে শাসন করার জন্য আমার বাবা চাচারা আছে। তুই মাতব্বরি করতে আসলে ভালো হবে, বলে দিলাম।”

“এবারে কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলবে না। যাতে তার চরিত্রের দিকে আঙুল উঠে।” শাহিনুজ্জামান তার মেয়েকে বলে। শেফালীর চোখমুখে রাগের আভাসে দেখা গেল। সুমির জন্য সবাই একাধারে শেফালীকে বকে চলেছে ‌। বেশিক্ষণ নিজেকে সংযত করতে পারে না শেফালী। ধুম করে ঘরে গিয়ে খিল তুলে দিল‌। তুর ও আরু এর ফলাফল জেনে ছুটে গেল ঘরের দিকে। শেফালী ততক্ষণে ভাঙচুর শুরু করে দিয়েছে। চুলগুলো টেনে ধরে ছিঁড়ে ফেলার জন্য টানতে। আরু দরজা ধাক্কা দিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “মিষ্টি কুমড়ার ফালি, দ্রুত দরজা খোল।”

“শেফু, দরজা খুলতে বলেছি তোকে। নাহলে কিন্তু বাবাকে গিয়ে বিচার দিবো।” তুর শাসায়। শেফালী দরজা খুলে আবার বিছানায় গিয়ে বসে। আরু ও তুর ভেতরে প্রবেশ করে খিল তুলে দিল দরজার। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আরু বলে, “মনের উপর কারো জোর চলে না শেফালী। তিয়াস ভাই সুমিকে ভালোবাসে।”

“তো! তাই বলে সবার সামনে আমাকে মারবে? আমার ভেতরটা কেউ বুঝতে পারছে না। তিয়াস ভাইকে আমি নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। তার পাশে ঐ শাতচুন্নিটাকে কীভাবে সহ্য করব, বল তোরা?”

শেফালী নিজের চুল ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। বিপরীত সুরে তুর বলে, “এখানে অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পারছি না আমি। ভালোবাসার মানুষের নামে কিছু বললে, কেউ সহ্য করতে পারে না।”

“তোরা এখন‌ সুমির দলে চলে গেছিস? বাহ্! গুড। যা বোঝার‌ আমি বুঝে গেছি। এবার তোরা আসতে পারিস।” শেফালী নিজের ক্ষোভ ধরে বসে থাকে। তুর ও আরু অধৈর্য হয়ে উঠে। তখনই দরজায় করাঘাত পড়ে। আরু দরজা খুলে দেখতে পেল জাহানারা এসেছে সুমিকে নিয়ে। মুচকি হেসে বলে, “তিস্তা তো চলে গেছে, এখন তোদের ঘরে সুমিকে রেখে দে। সুমি আলাদা থাকলে অস্বস্তি হতে পারে।”

“আচ্ছা।” তুর বলে সুমিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে। ঘরের ভাঙাচোরা অবস্থা দেখে সংশয় প্রকাশ করে জাহানারা। শেফালীর মুখের দিকে তাকিয়ে আভাস পায় অন্য কিছুর। এগিয়ে গিয়ে শেফালীর মাথায় হাত দিয়ে বলে, “রাগ করিস না মা, তিয়াস হঠাৎ করে এমন করে ফেলবে কে বুঝতে পেরেছে। আমি তিয়াসকে বলব তোর কথা ক্ষমা চাইতে।”

শেফালী হাতটা সরিয়ে ফেলে বিলম্বে। জাহানারা আশ্চর্যান্বিত হলো শেফালীর ব্যবহারে। চকিতে নিজের বালিশ আর কাঁথা নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, “আমি বাইরের কারো সাথে আমার ঘর শেয়ার করতে পারব না। যতদিন সে এই ঘরে থাকব, আমি ততদিন অন্য ঘরে থাকব‌।”

“এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে শেফু?”

“আমার বাবা মা আমার গায়ে হাত দেয় না, আর তিয়াস ভাই আমার গালে চড় মেরেছে এই মেয়েটার জন্য। তারপরেও আমি ওর সাথে বিছানা শেয়ার করব? কখনোই না।” বলেই শেফালী বেরিয়ে গেল। সবাই শেফালীকে আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।
অপূর্ব ক্লান্তি কাটিয়ে লম্বা একটা গোসল নিয়ে ঘরের ভেতরে যাচ্ছিল। পাশের ঘর থেকে অতিরিক্ত কথোপকথন শুনে থেমে গেল সে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরুকে আদেশ করে, “আরুপাখি, শুনে যা বাবু।”

“কী হয়েছে?” আরু ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে বলে।

“শেফালীর সম্পর্কে কেমন একটা কথা‌ শুনলাম। একটু খুলে বল।”

“আমি কিছু জানি না।” বলে আরু উলটা পথে পা রাখে। ঘরে প্রবেশের আগেই অপূর্ব তার বলিষ্ঠ হাতে বাধা দিল তাকে। মুঠো করে ধরে নিয়ে এলো বাইরে। দরজার বাইরে সিমেন্টে বাঁধানো চেয়ারে বসে বলে, “বাড়িতে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে। আমি চাইনা, এতরাতে তোকে আর আমাকে‌ একসাথে দেখে আবার কিছু ঘটুক। তার আগে বলে বিদায় হ।”

আরুর কী হলো জানে না। অপূর্বর বুকে মুখ গুজে দিল। আবদ্ধ করে নিল কোনো বন্ধনে। আগ বাড়িতে এভাবে সে কখনো অপূর্বকে ছোঁয় না। অপূর্ব আরুর পিঠে হাত রেখে আদুরে গলায় বলে, “কী হয়েছে আমার পদ্মাবতীর? মন খারাপ?”

চকিতে শুনতে পেল আরুর কান্নায় মাখা গলা। কাঁদতে কাঁদতে অপূর্বর শার্ট ভিজে গেছে। আরু ভাঙা গলায় বলে, “তিয়াস ভাইয়াকে শেফালী অনেক ভালোবাসে। শেফালী অনেকবার তাকে বুঝিয়েছে। কিন্তু তিয়াস ভাই সুমি ভাবীকে ভালোবাসে। আজ এমন ঘটনায় শেফালী অনেক ভেঙে পড়েছে।”

অপূর্ব হতভম্ব হলো। নিজেকে সামলানোর আগে আরুকে সামলানো দরকার। শেফালীর কষ্টতে ভেঙে পড়েছে আরু। পদ্মবতী যে অপূর্বকে ভালোবাস, তা জেনে অপূর্বর ঠোঁট প্রসারিত হয়। আরুর পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দেয়, “ওদের ভালোবাসা ছিল এক তরফা। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা দুজনের দিক থেকে। তোকে ঠেকানোর কোনো চান্স নেই। ঘরে গিয়ে একটা ঘুম দিবি। এইসব নিয়ে আর ভাববি না।”

আরু উঠে ঘরের ভেতরে চলে গেল। অপূর্ব বস রইল সেখানে। শেফালীর জন্য অদৃশ্য সহানুভূতি কাজ করে অপূর্ব-র। ভালোবাসার মানুষকে চোখের সামনে অন্যকারো হতে দেখা, কতটা পিড়াদায়ক। অপূর্ব তা অনুভব করে।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে