#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২২
ব্রীজ থেকে বড়ো রাস্তার দূরত্ব অনেকটা। সেই পথে পায়ে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। ছোটো সেই রাস্তাতে রিকশা অতিক্রম করে। অপূর্ব ও আরু বড়ো রাস্তায় ওঠার জন্য রিকশা নিয়েছে। পাশাপাশি বসে আছে দুজন। কারো মুখে বুলি নেই। রোদ্দুর থেকে বাঁচতে হুড তোলা।
দুজনের মাঝখানে অনেকটা ব্যবধান রেখে আরু বসেছে। অসম্ভব একটু সেঁটে গেল আরুর দিকে। বিনিময়ে আরু বিপরীত দিকে আরেকটু সরল। ঠেকে গেল হুডের সাথে। এবার অপূর্ব আর এগোল না। নিজের হাতটা সন্তর্পণে আরু শাড়ির ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিল। পরক্ষণে টেনে নিল অতি নিকটে। রিকশা ওয়ালার দিকে তাকিয়ে আরু শব্দ করে না, এতে অপূর্ব-র অসম্মান হতে পারে।
হাত সরিয়ে দিতে দিতে নত গলায় বলে, “আপনি বিদেশে ছোটো ছোটো পোশাক পড়া মেয়েদের সাথে লিভ-ইন সম্পর্কে ছিলেন। আপনি সেকেন্ড হ্যান্ড জেনেও আপনাকে গ্রহণ করে নিতে রাজি হয়েছি। অথচ আপনি আমার খুঁত নিয়ে সবার সামনে যা নয় তাই বলেছেন। আপনি আমাকে একা বলতে পারতেন। সব কাজের মতো রান্নাটাও আমি শিখে নিতাম।”
আরুর অভিযোগে অপূর্ব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে। মেয়েটা অভিযোগ করেছে মানে অভিমান শূণ্যতায় নেমে এসেছে। অন্য একটি শব্দে বড্ড চমকেছে- ‘লিভ-ইন’। নারীরা তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আগ বাড়িয়ে লিভ-ইন করতে চেয়েছে। অথচ আরু ধরে নিয়ে অপূর্ব সত্যি সে সম্পর্কে ছিল।
অপূর্ব নিজের অন্যহাত দিয়ে আরুর মাথাটা নিজের কাঁধে নিল। ঘুমে আরুর মাথা হেলে পড়েছে। লেপটে যাও কাজল মুছতে গিয়ে ছড়িয়ে গেছে অনেকটা। অপূর্ব সেই কাজল চোখে চেয়ে বলে, “সব কথা শুনতে নেই পদ্মবতী। তুমি আমার কাছে নিখুঁত। আমার পদ্মাবতী অদ্বিতীয়। পদ্মাবতীর নিখুঁত নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তা প্রদ্মরাজকে কতটা পিড়া দেয়, তাকে কি তুমি জানো?”
প্রেমময় সময়টা সংক্ষিপ্ত করে বড়ো রাস্তায় রিকশা থামে। অদূরে তিস্তা, তিয়াস, শেফালী, তুর দাঁড়িয়ে। আরু রিকশা থেকে নেমে ওদের মাঝে ছুটে গেল। অপূর্ব ভাড়া মিটিয়ে অগ্রসর হতেই চলন্ত টমটম ওদের সামনে থামল। সুজন মাথা বের করে হাতের ইশারায় সবাইকে ভেতরে আসার ইঙ্গিত দিয়ে মুখ ফুটিয়ে বাক্য তোলে, “সবাই এটায় চলে আসো, জায়গা আছে।”
আরুর আসার কথা সুজন জানত না, তাই ছয়টা সিট দখল করেছে। অন্যদিকে সুজনের কথা বলে আরুকে আনা হয়েছে। আরু চোখ পাকিয়ে অপূর্ব-র দিকে তাকাল। কেউ কিছু বলার আগেই আরু কপাট রাগ দিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। অপূর্ব-কে ব্যঙ্গ করে বলে, “ফুফু, সুজন ভাই আরুকে নিয়ে যেতে বলেছে।”
অপূর্ব পেছন থেকে আরুর হাতটা ধরে দিল রাম ধমক, “রাস্তার মাঝে চ/ড় খেয়ে মান সম্মান খোয়াতে না চাইলে বাধ্য হ।”
রিকশাটা এখনো সেই পথে দাঁড়ান। ব্রীজের যাত্রী পেলে ফিরে যাবে। অপূর্ব তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “শহরের দিকে যাবেন চাচা?”
“ভরদুপুরে ব্রীজের খ্যাপ পামু না। আপনারা গেলে যামু।” রিকশা ওয়ালার প্রত্যুত্তর পেয়ে অপূর্ব সুজনকে বলে, “তোরা দুজনে রিকশায় চলে যা, আমরা টমটমে আসছি।”
চাতক পাখি জোড়ার তৃষ্ণার নিবারণ করতে সুযোগ খুঁজে দিল অপূর্ব। সুজন হাসল অপূর্ব-র কথায়। সুজন নেমে রিকশায় বসতেই তিস্তা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। গ্ৰামেরা মেয়েরা প্রকাশ্যে প্রিয় মানুষটির দিকে তাকাতেও লজ্জা পায়। তিয়াস তাড়া দেয়, “তাড়াতাড়ি উঠ, তাড়াতাড়ি আবার ফিরতে হবে।”
সবাই যুগলদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গাড়িতে উঠতেই তিস্তা রিকশায় চড়ে। টমটম ততক্ষণে অনেকটা পথ পেরিয়ে গেছে। রিকশা ওয়ালাও রিকশা গতিশীল করছে। হুড তোলা। তিস্তা সুজনের বাহু জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। প্রেম পিয়াস মেটাতে তাকে সাদরে গ্রহণ করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। তিস্তা কেঁপে তাকাল।প্রেমপূর্ণ কণ্ঠে বলে, আর কয়েকটা দিন তিস্তা নদী। বিয়ে নামক নৌকাটা হাতে পাই। তোমার নদীতে নৌকা ভাসাতে সুজন মাঝি হাজির।”
__
আরু তিয়াসের পাশে বসেছে। টমটমের ঝাঁকুনিতে আরুর মাথা ধরেছে। পৃথিবীতে একমাত্র রিকশাতে আরুর মাথা ধরে না, তবে রিকশায় উঠলে আরুর ঘুম পায়। টমটমের হ্যান্ডেলটা অনেকটা উঁচুতে। আরুর হাত তত লম্বা নয়। সে তিয়াসকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বসে আছে। এ যাবৎকালে যতদিন শহরে গেছে তিয়াসকে কিংবা মিহিরকে এভাবে জড়িয়ে রেখেছে। অপূর্ব বসে ছিল তাদের মুখোমুখি। প্রিয় মানুষটাকে অন্য কারো বাহুডোরে দেখে অশান্ত হয়ে উঠল অপূর্ব। সহজ করে বলে, “কী হয়েছে ওর?”
“আরু গাড়িতে উঠতে পারেনা, গাড়িতে উঠলে ওর বমি পায়। রিকশায় গেলে ঘুমায়। ওর জ্বালায় ফুফু শহরে যায় না। ফুফায় যখন ঢাকা থেকে আসে তখন নিয়ে আসে।” হাসতে হাসতে বলে তিয়াস।
_
একের পর এক শাড়ি কিনতে ব্যস্ত তিস্তা। সুজন হাসি মুখে তার সমস্ত আবদার পূরণ করছে। এমনকি দামী দামী জামদানি তিনটা কিনে ফেলেছে। অপূর্ব বাধা দেয় তিস্তাকে, “তিস্তা, এগুলো সব বিয়ের জামদানি। তিনটা কিনে কী করবি? একটা নে।”
তিস্তা মন খারাপ করে রেখে উঠে দাঁড়াতেই বাধ সাধল সুজন। আরও কয়েকটা জামদানি নামিয়ে দেখতে দেখতে বলে, “তোমার যতগুলো পছন্দ ততগুলো নাও। একবারই বিয়ে হবে আমাদের, তোমার কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ থাকুক আমি চাইনা।”
তিস্তা হাসি মুখে নিজের জন্য শাড়ি পছন্দ করে। এত শাড়ি বহনের জন্য দুজন লোক দিয়েছে অপূর্ব। শাড়ি পছন্দ হলে কসমেটিকসের দোকানে গেল। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো দ্বিগুণ কিনল তিস্তা। সুজনের পূর্ণ ঘরওয়ালীর পাশাপাশি আধা ঘরওয়ালীদের কিনে দিল। আরু একাই কিছু কিনল না। অপলক চেয়ে রইল কসমেটিকসের জিনিসপত্রের দিকে। এগুলোর কোন বস্তু কীভাবে ব্যবহার করে, জানা নেই আরুর। সাজগোজ বলতে কাজল ও লিপস্টিক বোঝে আরু। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী ইমদাদ হোসেন মৃধাকে বললে সে এগুলো নিয়ে আসে। আরু তাকিয়ে আছে রংবেরঙের চুরির দিকে। দৃষ্টি সরিয়ে হাতের দিকে তাকাল আরু। তার হাতে কেবল একটিমাত্র রুপার চিকন ঝুনঝুন করা বালা। এবার বাবাকে বলবে রংবেরঙের চুড়ি আনতে।
অপূর্ব স্মিত হেসে তিয়াসকে বলে, “দেখ, আরুর কী লাগবে? চুড়ি পছন্দ হয়েছে বোধহয়।”
তিয়াস এগিয়ে চুড়ি বের করতে বলে চুড়িওয়ালীকে। রংবেরঙে রেশমি চুড়ি, কাঁচের চুড়ি বের করে। কাঁচের সাথে হেলান দিয়ে ফোন টিপতে টিপতে বলে তিয়াস, “কোন জোড়া নিবি আরু, তাড়াতাড়ি নে। রাত হয়ে আসছে, আমাদের যেতে হবে।”
আরু একমুঠো চুড়ি নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আরেক মুঠ ধরে। সৌন্দর্যে একে অপরকে পৃথক করা সম্ভব নয়। আরু মুখ ভার করে বলে, “সবগুলো সুন্দর। মন চাইছে সবগুলো নিয়ে নিতে।”
“আমার কাছে এত টাকা নেই আরু। কেবল দুই মুঠ নে।” তিয়াস বলে। আরু শাড়ির সাথে মিলিয়ে নীল রঙের দুই মুঠো চুড়ি নেয়। চুড়ি জোড়া প্যাকেট করে দিতে চাইলে নাকোচ করে আরু। কাগজ থেকে আলাদা করে দুই হাতে পরে। দুই হাত একসাথে করে ঘর্ষণ করতেই রিনিঝিনি শব্দ হলো। অপূর্ব হৃৎপিণ্ডে আঘাত করল সেই মাদক মেশানো শব্দ। বুকে হাত দিয়ে বলে, “প্রেমিকার হাতের একমুঠো কাঁচের চুড়ি প্রেমিকের বুকে এমন জোয়ারের সৃষ্টি করবে, তা জানলে বোধহয় চুড়ি কখনো আবিষ্কার হতো না।”
সবাইকে তাড়া দিয়ে বের করল মার্কেট থেকে। অতঃপর আরুর হাত মাপ অনুযায়ী সব চুড়িগুলো কিনে নিল অপূর্ব।
ফেরার পথে টমটমে গেল না কেউ। তিনটা রিকশায় সাতজনে বাড়ির দিকে রওনা হলো। আরুর ঘুমানোর অভ্যাস আছে বলে, অপূর্ব একাই নিল ওকে। হুড তোলা রিকশায় অপূর্ব আরু বসল। গতিশীল হতেই আরু ঢলে পড়ল রিকশার পেছনের দিকে। অপূর্ব হৃদমাঝারে আগলে নিল আরুকে। ঘুমের সাথে রাগটাও চাপা হয়ে গেছে ততক্ষণে। ঘুমের ঘোরে বিড়াল ছানার মতো লেপ্টে গেল অপূর্ব-র সাথে।
চলবে.. ইন শা আল্লাহ
#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৩
ভাইবোনদের বাড়ির রাস্তায় পাঠিয়ে সুজনকে রিকশায় তুলে দিল অপূর্ব। অতঃপর আরুকে নিয়ে হাঁটা দিল মৃধার বাড়িতে উদ্দেশ্যে। আরুকে আহসান বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক জোর করেছে তিয়াস, শেফালী, তুর ও তিস্তা। আরু নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থেকে বাড়িতে যাবে ঠিক করে। অপূর্ব জানে, আরুর অভিমানের কথা। মেয়েটাকে সে জোর করে শহরে নিয়ে গেছিল, এবার আর জোর করে না। সবার স্বাধীনতা প্রয়োজন।
অপূর্ব ফোনের আলো ধরে পেছনে পেছনে পা ফেলছে, আরু সামনে হেঁটে যাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আরু দ্রুত পা ফেলতে ফেলতে অপূর্বকে অনুরোধ করে, “অপূর্ব ভাই, এবার ফিরে যান। নদীর ধারে জঙ্গলের ভেতরে জোনাকিরা আমায় আলো দেখাচ্ছে। আমি সেই আলোর রেখা ধরে ঠিক পৌঁছাতে পারব। আপনি আমাদের বাড়িতে গেলে আর ফিরে আসতে পারবেন না।”
আরুর নিজের প্রতি অঢেল বিশ্বাস থাকলেও, অপূর্ব এই গ্ৰামের প্রতি নেই। রাস্তাঘাটে মানুষ বা তারা যদি আরুর উপর আছড় করে তখন? তাছাড়া পারুল মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ঠিক বলবে, আমার মেয়েটাকে একা ছেড়েছে। অপূর্ব উলটা সুরে বলে, “তোকে বলেছে বৃষ্টি হবে? চৈত্রের কাঠফাঁটা রোদে বৃষ্টি হয়। এখন ফাল্গুন মাস।”
“মাটি ও প্রকৃতির সাথে আমার সখ্যতার কথা আপনি জানেন না। দূর আকাশে ঐযে দুটো তাঁরা। এর মানে বৃষ্টি হবে। তিনটা তাঁরার বেশি থাকলে বৃষ্টি হয়না, কম থাকলে বৃষ্টি হয়। ” বলতে বলতে আরু থেমে যায়। একটা ঠান্ডা হাওয়া শরীর শীতল করে তুলে। আরু তার পায়ের স্যান্ডেল খুলে হাতে নেয়। ঠান্ডা মাটিতে হাটতে বেশ লাগে তার। আরুকে সঙ্গ দিতে অপূর্বও নিজের জোতা খুলে ফেলেছে। কিছুটা দূর যেতেই ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো। ঘন এই বৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড থাকলেও ঠান্ডা নিশ্চিত। আশেপাশে কারো অনুপস্থিত না পেয়ে অপূর্ব নিজের শার্ট খুলে ফেলল। অপূর্ব আংশিক ভিজে যেতেই আরু মুখ খোলে, “এতরাতে ভিজছেন কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে।”
“তুই সেদিন বললি না, বৃষ্টির প্রথম কয়েক ফোটাতে ঘামাচি চলে যায়, সেটাই পরীক্ষা করছিলাম।” আকাশের দিকে দুই হাত তুলে বলে অপূর্ব। আরু নিজের আঁচলটা অপূর্ব-র মাথায় দিয়ে বলে, “আমি আপনাকে দিনে ভিজতে বলেছি, রাতে নয়। আমরা প্রায় বাড়িতে পৌঁছে গেছি, আরও কিছুটা পথ আছে। তাড়াতাড়ি চলুন।”
“আর কত? কত? কত তোমার রূপের মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিবে আমায়? জলে ভাসা পদ্মও এমন মুগ্ধতা ছড়াতে পারেনা।
–
এক জোড়া মানব এলো কাক ভেজা হয়ে। দরজায় করাঘাত করার অনেক পরে পারুল বলে, “কে?”
“মা আমি আরু, দরজা খুলো।”
“এতরাতে আবার এলি কেন? ওখানে থেকে যেতি।” বলতে বলতে দরজা খুলে দিলেন পারুল। মাঝরাতে কেউ দরজা ধাক্কা দিলে খোলে না পারুল। ওপাশের মানুষের পরিচয় জেনেই দরজার খিলে হাত দেয়।
আরু দ্রুত ঘরে ঢুকে নিজের ঘরে চলে গেল। ভেজা শাড়িটা বদলে শুকনো একটা শাড়ি পরিধান করে। ভেজা শাড়িটা বালতিতে রেখে একটা বাটিতে ভাত নিয়ে খেতে বসে। অপূর্ব যাওয়ার জন্য পা ফেলতেই পারুল নাকোচ করে। বৃষ্টিতে ভিজে এসেছে, এভাবে গেলে ভাবী কী বলবে? ইমদাদ হোসেনের ইয়ং বয়সের একটা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি এনে ধরিয়ে দিল অপূর্বকে। পারুল আজ লালশাক রান্না করেছে।
পেছনের ঘরটাতে অপূর্ব আজ থাকবে। এটাতে কেবল আরুই থাকে। বিছানা ঝেরে পরিপাটি করে রাখে অপূর্ব-র জন্য। অপূর্ব ঘরে ঢুকে দেখল আরুর মুখ ভার। একটা প্যাকেট আরুর পড়ার টেবিলের উপর রেখে বলে, “এগুলো সব তোর। যখন যেটা মন চাইবে, পরে আমাকে দেখাবি।”
এটা আরু ঘরে কাটা কাটা ছবি দেখতে পেল অপূর্ব। সংশয় নিয়ে বলে, “এইতো মেহেরজান সিনেমার নায়ক পলক। এর ছবি তোর ঘরে কেন?”
“আমি অনেক সুন্দর। সবাই বলে আমি পলকের মতো জামাই পাবো। এজন্য পোস্টার কেটে ছবি এনে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রেখেছিলাম এককালে। আর তুলতে ইচ্ছে করেনি।”
__
আলোয় আলোয় সেজে উঠেছে আহসান বাড়ি। বিয়ের গান গাইছে মহিলারা একজোট হয়ে। পাতা মেহেদি বেটে তা কাগজ দিয়ে সুন্দর করে নকশা তৈরি করতে পারে আরু। হলুদ রঙের শাড়ি পরিধান করে সবাই আরুর কাছে এসেছে হাত সাজিয়ে তুলছে। আরু ধীরে ধীরে তিস্তার হাত রাঙিয়ে দিচ্ছে। তিস্তা উঠে যেতেই সেখানে বসে পড়ে তুর। অতঃপর শেফালী। সবার জন্য সুন্দর করে মেহেদি দিতে দিতে আরুর হাত ব্যথায় টনটন করে উঠে। আরু হাত ঝাড়া দিয়ে আবার দিতে থাকে। অপূর্ব-র দেওয়া সেই নীল শাড়িটা আরুর কাছে নেই, তাই বাধ্য হয়ে হলুদ শাড়িতেই সেজেছে ও।
সবার হাতে মেহেদি দিয়ে হাঁফ ছেড়ে উঠতেই তিস্তা আলতা নিয়ে হাজির হলো। আরুকে একটু নরম স্বরে বলে,
“কষ্ট করে একটু লাগিয়ে দে না। মাকে বললাম সে ব্যস্ত তাই পারবে না। তুই বল হলুদে আলতা না লাগালে ভালোলাগে?”
আরু মুচকি হাসি দিয়ে আলতার কৌটা নিয়ে মাটিতে বসে। তর্জনী কৌটায় ডুবিয়ে তিস্তার পা রাঙিয়ে দেয় লাল আলতায়। অবিলম্বে সেখানে হাজির হয় তুর ও শেফালী। তিস্তার আলতা শেষ করার আগেই তুর বলে, “আরু, আমাকে একটু দিয়ে দে না।”
“তুরকে দিলে আমাকেও দিয়ে দিবি কিন্তু।” শেফালী খালি গলাতে আরুকে শাসায়। আরু সায় দিয়ে তিনজনের পরানো সমাপ্তি ঘটায়। তুরে উঠতে গিয়ে অসাবধানতায় পা লাগে আলতার কৌটায়। আরুর শাড়িতে আলতার রং পড়ে যায়। তুর তড়িগড়ি করে হাত দিয়ে আলতা ফেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা করতেই হিতে বিপরীত হলো। হাতের মেহেদি লেপটে গেল অনেকটা। তুর করুন গলায় বলে, “আমি ইচ্ছে করে তোর শাড়িতে ফেলি নি আরু, বিশ্বাস কর পড়ে গেছে।”
“সমস্যা নেই।” আরু অবশিষ্ট মেহেদি বাটা নিয়ে ঘাটলার কাছে গেল। আলোতে ঐদিকটা একদম পরিষ্কার। আরু নিজের শাড়ির কিছু অংশ ভিজিয়ে রং দূর করে। অতঃপর শাড়িতে হাত মুখে হাতের তালুতে বৃত্তের মতো করে মেহেদি পরে। আঙুলের মাথায়ও লাগায় কিছুটা। হাত টানটান করে রাখে কিছুক্ষণ। হাতের ব্যথা একটু হ্রাস পেতেই আরু অগ্রসর হয় বাড়ির দিকে। উপর থেকে অপূর্ব ডেকোরেটের লোকদের সাথে কথা বলতে বলতে নামছিল। আরু নিজের হাত দেখতে দেখতে উঠছিল। মুখোমুখি দুজনের সংঘর্ষ হতেই আরু আঁকড়ে ধরে অপূর্ব-র পাঞ্জাবি। অপূর্ব ফোন ফেলে আরুকে ধরে। দুই মিনিট স্থির থেকে আরু দিল এক ভূষণ ভোলানো চিৎকার। হাতের এবড়োথেবড়ো মেহেদি গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। অপূর্ব নিজের পাঞ্জাবির কলার ধরে অনুভব করল সেই যাতনা। ফোনটা মাটি থেকে তুলে দেখে বন্ধ হয়ে গেছে। একটা চাপা রাগ নিয়ে বলে, “এটা তুই কী করলি? একটু দেখেশুনে..
আরুর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারে না অপূর্ব। আরু তার আঁচল দিয়ে অপূর্বর পাঞ্জাবির মেহেদিটুকু মুছে বলে, “স্যরি অপূর্ব ভাই। আমি বুঝতে পারিনি, এভাবে আপনার পাঞ্জাবিতে লেগে যাবে। আপনার পাঞ্জাবিটা আমি নষ্ট করতে চাইনি। অনুষ্ঠান শেষ হলে ধুয়ে নিবো।”
আরু দ্রুত পা ফেলে ভেতরে চলে গেল। অপূর্ব সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে। মেয়েটা তার শাড়িটা অনায়াসে শেষ করে ফেলল।
তিস্তাকে গায়ে হলুদ দিচ্ছে সবাই। মুরুব্বিদের পর গায়ে হলুদ দিল মধ্যবয়স্করা। তারপরে ভাইবোনেরা। সবাই দিলেও আরুর দিতে ইচ্ছে করল না। ওর ঘুম ঘুম পাচ্ছে। আচলটা কোমরে গুঁজে ছাদের অন্যপাশে মাদুর বিছানো ফাঁকা জায়গায় শুয়ে পড়ল। তিস্তার নানা বাড়ি থেকে অনেক লোক এসেছে। ঘরে জায়গা হবে না।
ঘুম থেকে উঠে কোমরে একটা ঠান্ডা বস্তু আবিষ্কার করল আরু। হাত দিতেই দেখল মেহেদি শুকিয়ে দলা পাকিয়ে আছে। আরুর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে মেহেদির গাঢ় রঙ, কিন্তু ছিটেফোঁটাও নেই মেহেদি। গতকাল রাতে সব মেহেদি তুলে হাত ধুয়ে ফেলেছিল আরু।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]