#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১২
আরু আজ দুপাশে বেনুনি গেঁথেছে। তাতে লাগিয়েছে গাঁদা ফুল। খয়েরি গাঁদা। সকালের নাস্তা খেয়ে চম্পার পানের ডালা থেকে পান নেওয়ার জন্য পা বাড়াল আরু। মুখে তুলে যাওয়ার সময় চম্পা পেছন থেকে ডেকে উঠল আরুকে। আরু দু বেনুনি ঘুরাতে ঘুরাতে বলে, “কী হয়েছে নানি জান, পেছন ডাকলে কেন? তুমি জানো না পেছন ডাকতে নেই।”
“তোকে আমার প্রয়োজন। পেছন না ডাকলে কি তুই আসতিস?”
“কেন?” দাঁতের আগায় চুল লেপ্টে বলে।
“দেখ না, আমার মাথার চুলগুলো পেকে গেছে। তুই বেছে বেছে পাকাগুলো তুলে দে।” আরুর হাত ধরে বাসনা নিয়ে বললেন চম্পা। খানিক বিরক্ত হলো আরু। প্রতিবার এই বাড়িতে আসলে পাকা চুল তুলে দেওয়া আরুর ধরাবাঁধা কাজ। অথচ চম্পার মাথায় হাতে গোনা এক গোছা চুলও নেই কাঁচা। কোমরে হাত দিয়ে ললাট কুঁচকে বলে, “নানি জান, তোমার মাথায় পাকা চুল তুলতে গেলে নেড়ো হয়ে যাবে।”
“নেড়ো হলে আমি হবো। তুই এদিকে আয়।” আরুকে জোরজবরদস্তি করে ঘরে নিয়ে গেলেন চম্পা। ফিরি পেতে বসলেন। বিরক্তির সাথে কয়েকটা পাকা চুল তোলার পর আরুর মুখে হাসিটা গাঢ় হয়ে উঠল। পাকা চুল রেখে নানির মাথার কাঁচা চুল তুলতে আরম্ভ করল আরু।
পাকা চুল উত্তোলনের সময় আয়াশ পাওয়া যায়, কাঁচা চুলের ক্ষেতে বিপরীত। চম্পা মাথা চেপে বলে, “এখন ব্যথা পাচ্ছি কেন আরু?”
“তাড়াতাড়ি তুলছি তো তাই। ভালো না লাগলে বলো, আমি রেখে দেই।” বলতে বলতে হেসে উঠল আরু।
“না না, তুই তুলতে থাক। একটু ধীরে ধীরে তুলিস, ব্যথা যাতে না পাই।” চম্পার আদরে বলা কথায় আরুর মন গলে না। দীর্ঘ এক ঘণ্টার অধিক সময় অতিবাহিত হয়। নিজের কাজ সম্পন্ন করে উঠে দাঁড়ায় আরু। প্রতিবার চুল তুলতে দিলে অস্থির হয়ে উঠতো, আজ তেমন না হওয়াতে প্রসন্ন হলেন চম্পা। আরুর চিবুক স্পর্শ করে আঙুলে চুমু খেয়ে বলে, “আজকে যা, আবার কালকে তুলে দিস।”
ভাব নিয়ে বলে, “আজ তোমার সব চুলগুলো তুলে দিয়েছি।”
“কী বলিস, একটুকু সময়ে সব তুলে ফেলেছিস?” উদ্বিগ্ন হয়ে বলে।
যথাসম্ভব অনুদ্ধত রইল আরু। পাকা চুল থেকে বাছাই করে ফেলে দেওয়া কাঁচা চুলগুলো তুলে নানি জানকে দেখায়। বিদ্রুপ করে বলে, “হাঁ! হাঁ! হাঁ! তোমার মাথার সব কাঁচা চুল তুলে ফেলেছি নানি জান। এবার তুমি আবার চুল তোলার কথা বললে ট্রিমার দিয়ে পাকা চুল তুলে ফেলব সব।”
চম্পা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। কিয়ৎক্ষণ নিজের চুলে তল্লাশি করেও যখন সন্ধান পেল না কালো চুলের তখনই ক্ষিপ্র হয়ে উঠল। লাঠি দিয়ে মারতে চাইল আরুকে। আরু ছুটল। বৈঠকখানায় আড্ডা দেওয়া মামার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। চম্পা লাঠি নিয়ে উপস্থিত হতে দেখে উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে উঠল। মোতাহার আহসান বললেন, “মা তুমি লাঠি নিয়ে আরুকে তাড়া করছ কেন?”
“তুই ওকে ছাড়, আজ ওকে আমি ইচ্ছামতো পেটাবো।” বলতে বলতে আরুর দিকে অগ্রসর হলেন চম্পা। আরু ছুটে অপূর্ব-র কাছে গেল। অনিতা এসে ক্ষান্ত করল চম্পাকে, “এভাবে বাচ্চা মেয়েটাকে লড়াচ্ছেন কেন মা, কী করেছে ও।”
“কী করেনি, তাই কও। ওরে আমি বললাম ‘আমার মাথার পাকাচুল তুলে দিতে।’ ও কাঁচা চুলগুলো তুলে দিল। একটা কাঁচাচুলও নেই।” সবাই নিঃশব্দে হাসল। মা-কে শান্ত করতে আরু-কে কিছু বলা উচিত, “আরু তুই মায়ের কাঁচা চুল কেন তুলেছিস?”
“বাহ্-রে! প্রতিদিন আমার কাছে এসে বলে পাকাচুল তুলে দিতে। ওনার মাথায় সব পাকাচুল। মাঝে মাঝে দু-চারটা কাঁচা চুল। তাই বুদ্ধি করে কাঁচা চুলগুলো তুলে দিলাম। এরপর যদি আবার পাকাচুল তুলতে হলে, তাহলে ট্রিমার দিয়ে সব চুল তুলে ফেলব। হি! হি! হি!” অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। আরুকে বাহবা দিয়ে বলে, “মা, তোমারই দোষ। এত পাকা চুল তুলতে গেলে তোমার মাথা টাক হয়ে যাবে।”
চম্পা লাঠি দিয়ে মাটিতে আঘাত করে ঘরের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলেন, “যেমন মামা, তেমন ভাগ্নে।”
আরু বাইরের দিকে অগ্রসর হলো। সূর্য মাথা তখন মাথায় উপর উঠেছে। অপূর্ব কলতলায় পা রেখেছে গোসলের উদ্দেশ্যে। কল চেপে বালতি পূর্ণ করল। অতঃপর দরজার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে এলো বিরক্তিতে। গ্ৰামে এসে এখন অবধি সে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করেনি, মায়ের করে দেওয়া উষ্ণ পানিতে গোসল সেরেছে। নূপুরের সেই মাতাল হওয়া ধ্বনি শুনেই মুখ তুলে অপূর্ব, “আরু, এদিকে শোন।”
আরু এসে স্থির হওয়ার পূর্বেই অপূর্ব বলে, “রান্নাঘরে গিয়ে দেখত, পানি গরম হয়েছে কি-না? গরম হলে মা-কে নিয়ে আসতে বল।”
আরু না থেমে রান্নাঘরে গেল। অপূর্ব-র সাথে সে অভিমান করে আছে। একটুকুও কথা বলবে না।
পানি ফুটতে শুরু করেছে। তবুও পাতা পুড়িয়ে তাপ দিচ্ছে অনিতা। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, “মামি অপূর্ব ভাই কলতলায় বসে আছে। পানি গরম হলে আমাকে দাও। আমি দিয়ে আসছি।”
অনিতা শুকনো পাতা দেওয়া বন্ধ করে চলা কাঠটা ভুলবশত আরুর দিকে তাক করে বলে, “তোর শরীরে জ্বর। মাথা ঘুড়ে পড়ে গেলে হিতে বিপরীত হবে। আমি দিয়ে আসছি।”
আরুর কর্ণপথে পৌঁছাল না সেই কণ্ঠ। এক দৃষ্টিতে জ্বলন্ত চলা কাঠটার পাশে চেয়ে আছে। অতঃপর চিৎকার দিয়ে বলে, “নাহহ। মা মেরো না।”
উপস্থিত সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বাক্শূন্য সকলে। আরু ক্রমশ পিছু হটছে। অপূর্ব এসেছে তখন। দ্রুতি কণ্ঠে বলে, “মা পানি কতদূর?” আর কিছু উচ্চারণ হলো না। তার হৃৎপিণ্ডে ধাক্কা লাগল কোনো রমনীর। অতঃপর সেই রমনী দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল অপূর্ব-কে। আরুর কম্পিত শরীরটা অপূর্ব-র সংস্পর্শ এসেছে, সেই কম্পন অনুভব করছে অপূর্ব। হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিক নেই, ধুকপুকানি গুনতে পারছে। অনিতার দিকে চেয়ে ইঙ্গিত করল অপূর্ব। অনিতা চলা কাঠটার দিকে চেয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে, “মনে হয়, কাঠটা ওর হাতে লেগেছে।”
“তাই হবে বোধহয়।” জাহানারা সায় দিলেন। আরুর পিঠে হাত রাখল অপূর্ব। আর্দ্র পল্লব মেলে অপূর্ব দিকে তাকালো। ছ্যাত করে উঠল অপূর্ব-র অন্তঃকরণ। ডানহাতটা গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে যখন ক্ষত-র সন্ধান পেল না তখন দৃষ্টি মেলালো অন্যহাতে। ক্ষত-র সন্ধান না পেয়ে আশ্চর্যান্বিত হলো অপূর্ব। মোলায়েম গলায় বলে, “কী হয়েছে আরু? কোথায় লেগেছে দেখি।”
“লাগেনি।” সুললিত কণ্ঠে বলে আরু দূরত্ব বজায় রাখল। অতঃপর ঘরের দিকে ছুটে পালাল। ঔৎসুক্য নিয়ে অপূর্ব বলে, “কী হলো বলোতো? হাতে তো কোনো ক্ষত পেলাম না।”
“আরু চারটা শব্দ উচ্চারণ করেছে। নাহহ, মা মেরো না।” ঝোঁক নিয়ে বলেন জাহানারা।
“আমার মেয়ে কিছু করেনি তো। ওকে নিয়ে কোথায় যাবো আমি। এই বাচ্চা মেয়েটাকে চলা কাঠ দিয়েও বোধহয় মে/রেছে।” বলেই হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন চম্পা।
জাহানারা কাঠের টুকরো টা সরিয়ে রেখে বলেন, “এই সব ঐ অয়নের বুদ্ধি। পেটে পেটে শুধু শ/য়/তা/নি বুদ্ধি। আসুক একবার এই বাড়িতে। এটা দিয়ে যদি না মে/রেছি।”
“ততক্ষণে নিভে যাবে।” অপূর্ব বলে।
“আবার আগুন দিয়ে জ্বলন্ত করে নিবো।” জাহানারা বলে।”
অপূর্ব উষ্ণ পানি বহন করে অগ্রসর হলো কলতলার উদ্দেশ্যে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৩
অপূর্ব লুসমি দিয়ে গরম পাতিল কলতলায় নিয়ে এলো। হিম পানির সাথে উষ্ণ পানির মিশ্রণ করে তাকাতেই দেখল তার ব্যবহারিত স্যাবলন সাবান নিখোঁজ। গম্ভীর হয়ে ভাবার সময় শ্রবণ হলো পানি ঝাপটানোর শব্দ। অগ্রসর হলো দিঘির দিকে। শীতকালে বৃষ্টিপাত হয়না বললেই চলে, যাতে পানি শুকিয়ে গেছে অনেকটাই।অন্যদিকে দিঘি পুনরায় খনন করতে হবে। চারপাশের মাটিতে পূর্ণ হয়ে এসেছে দিঘি। হাতে গোনা কিছু মাছ রয়েছে। তিনবোন গোসল করছে। একে অপরের দিকে পানির ছিটা দিচ্ছে। সাবানটা শানের উপর রাখা। বিরক্ত হয়ে বলে, “সাবানটা নিয়ে এসেছিস, বলবি না?”
সবাই অপূর্ব-র দিকে দৃষ্টি মেলাল। অতঃপর শেফালী বলে, “ভুলে গিয়েছিলাম, নিয়ে যান এখন।”
অপূর্ব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাবান নিয়ে পুনরায় কলতলার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা করতেই আরু বলে, “অপূর্ব ভাই, এখন শীত নেই। এদিকে আসুন একসাথে গোসল করি।”
“আমি সাঁতার জানি না।” অপূর্ব থেমে বলে।
“দিঘির জলে সবাই গোসল করতে পারেনা পূর্ব ভাই। আপনি তো কখনোই পারবেন না। একমাত্র ভালো মনের মানুষেরাই দিঘিতে এভাবে ভেসে থাকতে পারে, আপনার মনে তো কাঁদা।” আরু পানি ছুড়ে ব্যঙ্গ করে বলে। অপূর্ব থেমে গেল। ধীর পায়ে হেঁটে দিঘিতে নামল। খেজুর গাছের উপর হাঁটু সমান পানিতে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর আরও কিছুটা নামতেই সে অনুভব করল, এই দিঘি তাকে ডোবাতে পারবে না।
আরুর মস্তিস্কে হানা দিল দুষ্টু বুদ্ধি। ডুব দিয়ে অপূর্ব-র খুব নিকটে ভাসমান হলো, পশ্চাৎ। নিজের পিঠে পাওয়া আঁচড়ের বদলা নিতে অপূর্ব-র পিঠে চেপে বসল। মাথাটা চেপে দিঘির জলে দিল চুব। বিশ সেকেন্ড পার হওয়ার পর একুশ সেকেন্ডের মাথায় আরু অনেক দূরে। অপূর্ব ঘনঘন শ্বাস ফেলে। নি/র্দয় পরিস্থিতি অনুভব করে শেফালীর হাতটা চেপে তুর বলে, “এখানে দাঁড়িয়ে নিজের পিন্ডি চটকানোর চেয়ে চল ভাগি। এখানে আমাদের রাজত্ব চললেও স্থলে ভাইয়ের রাজত্ব। তাছাড়া শুনলেও মা মা/রবে।”
শেফালী টু শব্দ উচ্চারণ না করে গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হলো। দুই বোন যখন স্থলে উঠে গেছে তখন ধ্যান ভাঙল আরুর। তার হাতে অপূর্ব-র লুঙ্গি। চাইলেও ওঠা অসম্ভব। স্থলের দিকে যাত্রা শুরু করে স্তব্ধ হলো অপূর্ব। আশেপাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আরুর দিকে নজরবন্দি করে তার লুঙ্গির হদিস পেল। চ্যাঁচিয়ে বলে, “আরু আমার লুঙ্গি দে বলছি। এটা কোন ধরনের অসভ্যতামি?”
“এটা আরুর শাস্তি। আপনার সাহস হয় কীভাবে ‘পূর্ব-পশ্চিম’ ভাই, আমার পিঠে আঁচড় কাটার? আপনাকে জাস্ট একটু ট্রেইলর দেখালাম।” আরুর দৃঢ় কণ্ঠ। অপূর্ব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কুলকিনারা না পেয়ে অন্য বুদ্ধি প্রয়োগ করে, “তুই আমার লুঙ্গি কেড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস। কারণ তুই আমাকে এই অবস্থায় দেখতে চাস, তাই তো? শুধু শুধু পানির ভেতরে না দাঁড় করিয়ে বলতি, সরাসরি দেখাতাম। নিজের প্রতিটি অঙ্গ তো শতবার দেখি, একবার না-হয় তুই দেখলি।”
বলতে বলতে বুক সমান পানি দেয়া কোমর সমান পানি এলো। অতি প্রিয় ভাঁজ কা/টা ও জিম করা দেহের দিকে এক নজর অপলক চেয়ে রইল। গতিরোধ করল না অপূর্ব। এগিয়ে চলেছে ক্রমশ। পরিস্থিতি অনুভব করে পল্লব বন্ধ করে পশ্চাৎ ঘুড়ে আরু। দেয় ভুবন ভোলানো চিৎকার, “নাহহ! আমি দেখব না। আর একটুও এগোবেন না আপনি।”
অপূর্ব স্মিত হাসে। বলে, “আমি থামব না, শুধু এগিয়ে যাবো। যতক্ষণ আমার লুঙ্গি আমার হাতে না-আসে, ততক্ষণ এভাবে থাকব।”
পশ্চাৎ দিকে মুখ করে থাকে আরু আর সমুখে তাকায় না। লুঙ্গি ছুড়ে দেয় অপূর্ব-র দিকে। পরিধান করে লুঙ্গি। অতঃপর অপূর্ব এগোয় ক্রমশ। জলধারা অপসারিত হয়ে দুইজন মানব অদূরে এলো। সম্পূর্ণ জলাধারাকে অপসারিত করতে পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে অঙ্গে অঙ্গে মিলিত করল দুটি দেহ। আরু থরথর করে কাঁপছে। এত জলের মাঝেও সে পিয়াসু। ওষ্ঠদ্বয় কানের লতিতে মিশিয়ে বলে, “দিলি কেন লুঙ্গি, চেয়েছি আমি? তুই তো দেখতে চেয়েছিস।”
স্পর্শগুলো আরও গাঢ় হয়ে এলো, বিচরণ করল নগ্ন কোমরে। অথচ আজ তার দেহে তুরের ব্লাউজ রয়েছে। কম্পিত আরু না-বোধক জবাব দেয়, “না, আমি দেখব না।”
অপূর্ব-র সেখানে বুক পর্যন্ত পানি, আরুর সেখানে গলা পর্যন্ত পানি। অপূর্ব পানিতে ডুব দিয়ে পাঁজাকোলা করে নিল আরুকে। আরু সাঁতার জানে বিধেয় অপূর্ব গলায় আড়কে ধরল না। ডাগর ডাগর চোখে শুধু চেয়ে রইল। নাকের সাথে নাকের ডগায় সুড়সুড়ি দিয়ে আলতো করে চুমু খেল ললাটে। আরু কেঁপে উঠল। নেত্রপল্লব গ্ৰথন করে রাখল। অপূর্ব ফিসফিস করে বলে, “এটা দিঘি নয়, নদী। প্রেমনদী। প্রেমতরঙ্গ। প্রেমতরঙ্গে বহমান প্রেমের জোয়ারে ভাসাতে অপূর্ব প্রস্তুত।”
অতঃপর অপূর্ব ঠেলে ভাসিয়ে দিল আরু-কে। আরু উলটা সাঁতারের দিল। কাতল মাছ আরুর পায়ের করতল স্পর্শ করে। সাঁতারের ফলে ঢেউয়ের সৃষ্টি হলো।
প্রেমেরও জোয়ারে, ভাসাবে দোঁহারে
বাঁধন খুলে দাও, দাও! দাও! দাও!
ভুলিব ভাবনা, পেছনে চাবো না
পাল তুলে দাও, দাও! দাও! দাও!
_
আরুর জ্বর নেমে এসেছে স্বাভাবিক মাত্রায়। মামাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা দিব্যি চলছে আরুর। শীতকালে দিনের তুলনাত্মক রাত দীর্ঘ হয়। স্কুল ছুটির পর থাকে অপরাহ্ণ। আরু ও শেফালী নদীর ধানে অপেক্ষারত তুরের জন্য। ঝোপঝাড়ের মাঝে প্রয়াসের সে কিছু বলছে, তাও দীর্ঘক্ষণ। মাগরিবের আযান ঘনিয়ে আসছে। ব্যাকুল হয়ে আরু শুধাল, “কতক্ষণ লাগবে তুর? তাড়াতাড়ি আয়-না। চিন্তা করছে সবাই।”
“কেউ চিন্তা করছে না। আমি রোজ দেরি করে যাই।” ঝোপঝাড় থেকে তুর বলে উঠে। রাস্তার মাঝে পদচারণ করছে উৎসুক হয়ে উঠল আরু। শেফালী ললাটে উগ্র ভাঁজ ফেলে বলে, “ওর জন্য রোজ রোজ বাড়িতে যেতে দেরি হয়। মনে চায় আমিও একটা প্রেম করি।”
“করবি?” আগ্রহ নিয়ে মাটির রাস্তায় বসেছে আরু। সঙ্গ দিতে শেফালীও বসেছে। কিঞ্চিৎ পর তন্বীকে দেখা গেল এই অভিমুখো হতে। সংশয় নিয়ে বলে, “তোরা দুটোয় এখানে বসে কী করছিস? তুর কোথায়?”
“জানে কে? গিয়ে দেখ, নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে দুটোতে। কতবার লুকিয়ে লুকিয়ে গেলাম দেখতে।” বিরক্ত প্রকাশ পেল শেফালীর গলায়। আরুর অগোচরে শেফালী, তুর ও তন্বী ফন্দি এঁটেছে কিছুর। অতঃপর অস্ফুট স্বরে বলে, “পরানের দোকানে ঐ ক্যাসেট টা এনেছে শুনলাম। তুর যতক্ষণে ফিরে আসবে ততক্ষণে আমরা দুজনে নিয়ে আসি।”
“কী ক্যাসেট?” আরুর সাদামাটা প্রশ্ন। কেউ উত্তর দিল না। আরুকে প্রহরীর দায়িত্ব দিয়ে ছুটে গেল দুজনে, একা দোটানা নিয়ে বসে রইল সেখানে। পেরিয়ে গেল ক্ষণ। লাল রঙের জ্ঞাত স্লিপার দৃষ্টিগোচর হতেই ঊর্ধ্বভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আরু। অপূর্ব-কে সমুখে দেখে নোনা জল সঞ্চয় হলো ললাটে। আশেপাশে তাকিয়ে দুইবোনের সন্ধান করতে করতে হুংকার দিল অপূর্ব, “ভর সন্ধ্যায় এখানে বসে বসে কী করছিস? সঙ্গি দুটোয় কোথায়?”
অপূর্ব-র হুংকারে কেঁপে উঠে আরু। দুই বোনকে গালমন্দ করছে নিরবে আরু। অপূর্ব আজ সকালে শহরে গেছে। অফার করা চাকরিটা কনফার্ম করতে। বাড়ি ফিরে তিনবোনকে না দেখে এদিকে এসেছে।
ততক্ষণে শেফালী ও তন্বী ফিরত এসেছে। আরুর তার হাত দুটো ঢেউখেলানোর ন্যায় উপর থেকে নিচে নামিয়ে ইশারা করছে দুজনকে। পুনরাবৃত্তি করছে হিস, হিস। অপূর্ব হতভম্ব হয়ে বলে, “এমন করছিস কেন?”
রাস্তার ধানে ইঁদুর গর্ত করে রেখেছে। দুইপাশে বিভিন্ন আকৃতির মাটি জমানো। আরু ইতস্তত করে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি তো ইঁদুর ভয় পান। তাই ইঁদুর লড়াচ্ছি।”
“তাহলে পেছনের দিকে তাকিয়ে কেন.. বলতে বলতে পশ্চাৎ ফেরার প্রয়াস করে অপূর্ব। সেই বাক্যকে মাঝপথে দাঁড়ি টেনে হুট করে অপূর্ব-র হৃদমাঝারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আরু। হিতাহিত ঘটনায় অপূর্ব নির্বাক। হুট করে সাজানো মিথ্যা কথাগুলো অপূর্ব-র হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির কাছে হেরে গেল। দ্বি মুহূর্ত এভাবে অতিবাহিত হলো। অপূর্ব ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। ধমক দেয়, “মাঝরাস্তায় কী হচ্ছে এইসব আরু? তুই তো এমন বেপরোয়া ছিলি না।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৩ (বর্ধিতাংশ)
“অপূর্ব ভাই, আসলে আমি একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভুলে গেছি।” চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে আরু।
“কী সেটা? বলার আগেই ভুলে গেলি?” অপূর্ব-র ফিরতি প্রশ্ন। আরুর তার হাতটা রাখল অপূর্ব-র বুকের পাপাশে। রুপার বালা শব্দ করল মৃদু। হাতটা মৃদু ভর প্রয়োগ করতেই অপূর্ব-র হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দটা ঘোড়ার মতো টগটগ করতে ব্যস্ত হলো। ছ্যাকা লাগল বুকে। প্রেমতরঙ্গে নিজেকে ভাসিয়ে আরু কণ্ঠে হয়ে উঠে আসক্ত, “ধুকপুক ধুকপুক ধুকপুক। এই শব্দটা আমায় অগোছালো করে দেয়। মনে হয় আমার স্থান এখানে। ঠিক এখানে। যেই হাড়টা আপনার নেই, সেই হাড়টা আমি। মনে হয়, আমি আপনার বাম পাজরের অধিকারিণী।”
“কীসব বলছিস?”
অপূর্ব পিছিয়ে গেল কদম। আরুর হাতে হাওয়া প্রবেশ করল। অপূর্ব-র ডানহাতটা নিজের বুকে রেখে বলে, “বিশ্বাস না হলে দেখুন। আপনার স্পর্শ আমার স্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।”
আরুর সেই স্পন্দন অপূর্ব অনুভব করতে পারছে। তার সিক্সসেন্স বলছে, এটা অস্বাভাবিক। সে যে মনের ডাক্তার, মনোচিকিৎসক। মনের ভাষা বোঝাই তার পেশা।
মুহুর্তে হাতটা পরিণত হলো কোনো ইট, পাথর বা শক্ত কোনো ধাতুতে। নিজের হাতটা সরানোর ভরটুকু অপূর্ব-র নেই। অব্যক্ত স্বরে বলে, “হাত ছাড় আরু।”
“কেন? আপনি অন্য পুরুষদের থেকে চার ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছেন। আপনার থেকে নয়।”
বিদেশে অবস্থানরত সময়ে বহু নারীর সংস্পর্শে গিয়েছিল। ‘হাত ধরেছে, জড়িয়ে ধরেছে’ তখন তো এমন অগোছালো অনুভূতির সম্মুখীন হতে হয়নি।
ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এসেছে তুর। অপূর্ব-র ভয়ে নদীর তীরেই বসে আছে। শেফালী ও তন্বী অতি নিকটে। তিন সই একত্রিত হয়ে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি এখানে?”
হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল অপূর্ব। চেতনা ফিরত এলেই হাত নিজের কাছে টেনে যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় হলে, “কয়টা বাজে এখন? চারটা বাজে স্কুল ছুটি হলে বাড়িতে যেতে লাগে পনেরো মিনিট। এখন সময় সাড়ে পাঁচটা। এতক্ষণ এখানে কী করছিস?”
“ভাইয়া, আমরা প্রতিদিন দেরি করেই বাড়িতে ফিরি। আজ একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে। নদীর পাড়ের হাওয়া খেতে ভালো লাগে।” তুর সাহস সঞ্চয় করে বলে। পুনরায় প্রশ্ন করে, “নদীর পাড়ে হাঁটতে ভালো লাগে। তাহলে আরু এখানে কী করছে?”
“আমার পা ব্যথা করছিল। তাই যাইনি। এসে দেখলেন না, বসে ছিলাম?” আরু বলে। অপূর্ব-র মন হতে সন্দেহে দূর হয়নি। সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলে, “হম, চল। (আরু-কে একান্ত ভাবে বলে) জড়িয়ে ধরে কী জানো বলতে চেয়েছিলি। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সময়। উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ না পেলে, ঢেউ খেলা দেখিয়ে যে ইঁদুর তাড়াচ্ছিলি। সেই ইঁদুরের গর্তে আমি তোকে রেখে মাটি চাপা দিয়ে দিবো।”
আঁতকে উঠল আরু। কী করবে ভেবে পেল না। বাংলা সিনেমায় দেখেছে নায়িকা আঘাত পেয়ে স্মৃতিশক্তি লোপ পেলে পরবর্তী আ/ঘা/তে ফিরে আসে। কিন্তু আরু তো ভুলে যায়নি। আচ্ছা অপূর্ব হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির শব্দে বিস্মৃত হয়েছে কথা, আবার ঐ ঝড় তোলা বুকে মাথা রাখলে মনে পড়বে সেই কথা?
“এনেছিস ক্যাসেট?” ফিসফিসিয়ে বলে আরু। তুর নক টাকতে টিকতে বলে, “কীসের ক্যাসেট?”
আরু উত্তর দিতে পারেনা, কারণ সে জানে না। শেফালী বলে, “এনেছি, আরুর বইয়ের ভেতরে রেখে দিয়েছি।”
আরু ও অপূর্ব মধুর সময়ে অগোচরে লুকিয়ে রেখেছে ঘাসের উপর রাখা আরুর বইয়ের ভাঁজে। কৌতূহল নিয়ে বইয়ের পাতা উলটায় আরু। ক্যাসেটের উপরে লাগানো পোস্টারে নজর যেতেই গলা শুকিয়ে গেল। অপূর্ব-কে খেয়াল না করে আচমকা বলে ফেলে, “ছিঃ, এগুলো কী এনেছিস তোরা?”
অপূর্ব-র কদম থেমে গেল। ঘাড় কাত করে তাকাল চারজনের দিকে। আরুর মুখ চেপে ধরেছে তিনজনে। ডাগর ডাগর চোখ করে কেবল চেয়ে আছে। বলে নিজেও নির্বোধ হলো আরু। থমথমে গলায় বলে, “তোরা ওর মুখ চেপে আছিস কেন?”
পরক্ষণে হাত ছেড়ে নতজানু হয়ে গেল দুই জোড়া কিশোরী। অতঃপর অপূর্ব বলে, “মাত্র কী বললি? কী এনেছিস তোরা?”
তন্বী দাঁড়াল না। অপূর্ব-কে অতিক্রম করে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে গেল। অপূর্ব চাইলে ধরতে পারত হাত, কিন্তু অচেনা অজানা মেয়েকে স্পর্শ করা বেঠিক। প্রয়াসের এনে দেওয়া চানামুঠ দেখিয়ে বলে, “এগুলোর কথা বলেছে। আসলে আরু খায়না তো তাই।”
আপাদমস্তক চেয়ে থেকে বলে, “তোদের তিনটাকে আমার বিশ্বাস হয়না। সামনে সামনে এগো।”
মাটির রাস্তা সরু হওয়াতে তিনজনে এক লাইনে হাঁটতে পারছে না। ধাক্কা লাগছে। দুপাশের ঝোপঝাড়ের মাঝে সাপ থাকা অবাস্তব বিষয় নয়। হাঁটার সময় সামনে পেছনে যাওয়া আরুর বামহাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে নিল অপূর্ব। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের অনুভূতি সম্মুখীন হলো সে। মাগরিবের আযানে মুখরিত হচ্ছে। গলায় প্যাঁচিয়ে রাখা ওড়নার শেষ কোণাটা আরুর মাথা তুলে দিয়ে বলে, “আযান দিচ্ছে অথচ দেঙ্গি মেয়েরা মাথায় কাপড় না দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
সুন্দরনগরে সূর্য ডুবে মৃদু অন্ধকারে আবৃত গ্ৰাম। আরু দিঘি থেকে ডুব দিয়ে কলতলায় গেছে পোশাক পালটাতে। শেফালী ও তুর রাত নেমে আসার কারণে হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পালটে নিয়েছে আরও আগে। সাঁতার না জানার দরুণ কলতলার উদ্দেশ্য এগোল অপূর্ব। টিনের দরজাটা ফাঁক করে একপা বাড়াতেই থমকে গেল অপূর্ব। আরুকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে তার গলা শুকিয়ে এলো। আরু উলটো হয়ে দাঁড়ানো। দ্বি মুহুর্ত একধ্যানে তাকিয়ে থাকার পর যখন চেতনা ফিরে এলো সময় অপচয় না করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। দরজা তখনও অপূর্ব-র হাতে বন্দি। ছেড়ে দিতেই খ্যাক খ্যাক শব্দে ভিড়ে গেল। আরু সেই শব্দ শুনে বলে উঠে, “কে এখানে?”
অপূর্ব জবাব দিল না। উলটো পথে অগ্রসর হলো। আজ সে আর কলতলায় আসবে না। প্রয়োজনে মায়ের টেনে রাখা পানি দিয়ে হাত মুখ ধুবে।
অপূর্ব ঘরে যেয়ে দেখল, বাড়ির গৃহিনীরা তৈরি হয়ে নামছে ঘর থেকে। বৈঠকখানায় বসে টিভি দেখছে শেফালী ও তুর। অপূর্ব সন্দিহান গলায় বলে, “তোমরা সবাই কোথায় যাচ্ছ?”
অনিতা চাপা গলায় বলে, “পানি আনতে গিয়ে পড়ে পারুল কোমরে ব্যথা পেয়েছে। ওকে দেখতে যাচ্ছি সবাই।”
“আরু যাবে না?” অপূর্ব-র ফিরতি প্রশ্ন। অনিতা সাজিয়ে রাখা উত্তরটা দিলেন, “না, ওকে নিয়ে গেলে সব কাজ ওকে করতে হবে। গিয়ে দেখি, প্রয়োজনে একটা কাজের লোক ঠিক করে দিবো। কিন্তু আরুকে দেওয়া যাবে না। তুইও আরুকে বলিস না।”
অপূর্ব সায় দিল। আরু নিজের জামাটা নিগড়াতে নিগড়াতে এলো। অপূর্ব-র মতো সেই প্রশ্ন করে, “কোথায় যাচ্ছো তোমরা?”
“একটু হাঁটতে যাচ্ছি।” অনিতার হাস্যোজ্জ্বল জবার। আরুও বায়না ধরে তাদের সাথে হাঁটতে যাওয়ার। তুর ও শেফালীর জন্য অসফল হয় আরু। তিস্তা শরীরের অসুস্থতার বাহানা দিয়ে রয়ে গেল সুজনের জন্য। সুজনকে চাচার কথাটা বলতে হবে।
সুন্দরনগর গ্ৰামে একমাত্র সাত ভাই চম্পা নিবাসে বিদ্যুৎ রয়েছে। চেয়ারম্যান বাড়ি বলে কথা, অস্বাভাবিক কিছু নয়। শেফালী ল্যান্ডফোনে ডায়াল করে বাড়ির পরিবেশ জানায় তন্বীকে। কিছুক্ষণ পর তন্বী এলো। তিস্তা তখন সুজনের ঘরে কথায় সাম্পান ওয়ালার সাথে ব্যস্ত কথায়। আরুর বইয়ের ভাঁজ থেকে ক্যাসেট এনে চালু করতেই আরু উঠে দাঁড়ালো। করুণ গলায় বলে, “আমাকে ছেড়ে দে-না, আমি এইসব দেখতে পারব না।”
“চুপ থাক, বিয়ের পর বর যখন জোর করে দেখাবে তখন দেখতে পারবি ঠিকই। এখন তোর বাহানা।” তুর বলে।
“তোকে কে বলেছে, বর বিয়ের পর এগুলো দেখায়?” কৌতূহলী কণ্ঠ আরুর।
“নাইনে ফেল করা মিতু বলেছে। ফেল করার পর চাচা তো ওকে জোর করে বিয়ের পিরিতে তুলে দিয়েছে। বিয়ের পর না-কি রোজ এগুলো দেখাতো। শুনে আর থাকতে পারলাম না। কবে না কবে বিয়ে করব। চুপচাপ দেখ।” বলেই দেখতে মন দিল তন্বী। সবাইকে অনুসরণ করে আরুও টিভির পর্দায় চোখ বুলিয়ে নিল। পরক্ষণে অস্বস্তিতে কুঁচকে এলো পল্লব।
আরুকে এই অবস্থা থেকে রক্ষা করতে আগমন ঘটল অপূর্ব-র। পায়ের শব্দ শুনে ব্যাকুল হয়ে উঠল তুর। চ্যাঁচিয়ে বলে শেফালীকে “তোকে আমি দরজা বন্ধ করতে বলেছিলাম। করেছিস?”
নক কাটতে কাটতে শেফালী বলে, “এই যা ভুলে গেছি। কে আসছে বল-তো।”
“বারণ করেছিলাম, শুনলি না। এবার কি হবে?” আরু বলে।
“থাকবি তোরা, মনে হয় তিস্তা আপু এসেছে। তিনি ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। আমি দেখছি।” বলতে বলতে দরজার দিকে অগ্রসর হলো তুর। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিতেই তার ধারণা ভুল প্রমানিত হলো। তিস্তা নয়, তিয়াস ও অপূর্ব এসেছে। তিয়াস শহরে গিয়েছিল চাকুরিতে, কিন্তু অপূর্ব যে মৃধা বাড়িতে গিয়েছিল। তুর নিচু অথচ উদ্বিগ্ন গলায় বলে, “টিভি বন্ধ কর তাড়াতাড়ি। অপূর্ব ভাই ও তিয়াস ভাই এসেছে।”
বলা মাত্র সবাই টিভি বন্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। রিমোট খুঁজে পাচ্ছে না। রিমোট খুঁজবে না-কি ক্যাসেট খুলবে বুঝতে পারছে না। চট করে তুর বুদ্ধিমান হয়ে উঠল। প্ল্যাকের সকেট খুলে ফেলল। অতঃপর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ততক্ষণে তিয়াস ও অপূর্ব ঘরে প্রবেশ করেছে। হাতে নতুন ফোনের প্যাকেট। সদ্য কিনে আনা নিজের বাটন ফোনটা বের করে চার্জে দিতে দিতে বলে, “তোর ফোনের মতো স্মার্টফোন কিনতে চেয়েছিলাম। রাজধানী ছাড়া পাওয়া যাবে না।”
“এটা ফেরার সময় নিয়ে এসেছি। তুই যদি তখন বলতিস, তোর জন্যও নিয়ে আসতাম। ফেলেও যা দাম চাইবে।” অপূর্ব বলে। প্লাকে চার্জার দেওয়া পরেও সংযোগ আসছে না দেখে বিভ্রান্ত হলো তিয়াস। লাল রঙের তীক্ষ্ণ আলোটা প্ল্যাকে জ্বলছে না দেখে সন্দিহান হয়ে সকেটের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। অতঃপর বলে, “এই সকেটটা কেন খুলেছিস?”
তিয়াস বাড়িতে ফেরার আগে তার সদ্য কেনা নতুন ফোন দিয়ে অপূর্ব-র ফোনে কল করে সিস্টেম পরীক্ষা করছিল। তখনই জানতে পারে, আহসান পরিবার পারুলকে দেখতে যাচ্ছে। মহিলামহলকে মৃধা বাড়িতে পৌঁছে অপূর্ব-কে ফিরে আসতে বলে, কারণ তিয়াস নিজেও মৃধা বাড়িতে যাবে। পোশাক পালটাতে বাড়িতে এসেছে। সকেটটা বোর্ডে দিতেই তন্বী এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল। তিনবোন একসাথে মাথায় হাত দিল।
অনাকাঙ্ক্ষিত গোঙানির শব্দ শ্রবণ হতে তিয়াস চার্জের পিন লাগিয়ে বলে, “কীসের শব্দ হচ্ছে রে?”
অপূর্ব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে টিভির সেই দৃশ্য মস্তিষ্কে ধারণ করছে। নেত্রপল্লব একবারের জন্যও ফেলছে না। দাঁতে দাঁত চেপে আছে। রোষের সাথে খুঁটিটা চেপে ধরে। তুর সৌজন্য হেসে ছুটে গেল। তিয়াস টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে গেল। চক্ষু তার চড়কগাছ। অতঃপর বলে, “ছিঃ, এইসব কী ছেড়েছিস?”
আরু বেতের সোফার নিচে উবুড় হয়ে আছে। শেফালী একাই নড়তে পারে না। অবিলম্বে চ/ড় বসিয়ে দিল তিয়াস, “শেফু, এইসব টিভিতে এলো কীভাবে? ক্যাসেট পেয়েছিস কোথায়?”
শেফালী নতজানু হয়ে রইল। তিয়াস আরও কয়েকটা চড় বসাতেই ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “আমি কি একা কিছু করেছি না-কি? তুর তো সায় দিয়েছে।”
অপূর্ব নিবৃত্ত কণ্ঠে বলে, “তুই কেন সায় দিলি? পাই একবার তুরকে। তোদের তিনজনের খবর আছে। (তিয়াসকে উদ্দেশ্য করে) তাড়াতাড়ি পোশাক ছেড়ে আয়। ওনাদের আনতে যেতে হবে তো।”
তিয়াস মাথা নেড়ে চলে গেল ঘরের দিকে। শেফালী তার পেছনে পেছনে ছুটল। তিয়াসের হাত ধরে বলে, “আমি ভুল করে ফেলেছি। আমি আর জীবনেও ঐসব দেখব না। প্লীজ রাগ করো না।”
“হম। যা এখন।”
“শোনো না?” শেফালীর আবদারে দাঁড়িয়ে যায় তিয়াস। উত্তরের আশায় চেয়ে থাকে। পায়ের টাকনুতে ভর দিয়ে তিয়াসের সমান হওয়ার প্রচেষ্টা করে শেফালী। কিঞ্চিৎ সম্ভব হয়। নাকে সংস্পর্শে নাক এনে প্রেমপূর্ণ কণ্ঠে বলে, “আমি আপনাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি তিন হাঁস ভাই। আপনি যদি আমার উপর রাগ করে থাকেন। আমি সহ্য করতে পারিনা।”
আলতো ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরত্ব বাড়াল। ঠাটিয়ে চ/ড় বসিয়ে দিল। অতঃপর তেজস্রী গলায় বলে, “কতদিন তোকে বলেছি, আমার সাথে এইসব কথা বলবি না। তুই শুধুই আমার বোন। আমি শুধু সুমিকে ভালোবাসি। বের হ আমার ঘর থেকে।”
“আপনি আমাকে শুধু শুধু মা/র/লেন। আমি আপনাকে অ/ভি/শা/প দিচ্ছি, সুমিকে নিয়ে আপনি একদিনও সংসার করতে পারবেন না।” ক্রন্দনরত অবস্থায়।
কিয়ৎক্ষণ পূর্বের চ/ড়ে আঘাত থাকলেও অভিমান হলো এখন। ছুটে চলে গেল ঘরে। দরজাটা ভিড়িয়ে কেঁদে উঠল শেফালী।
_
শেফালী ও তিয়াস দৃষ্টি আড়াল হতেই অপূর্ব বেতের সোফার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, “তুই কি বের হবি আরু, না-কি আমি বের করব? আমি জানি তুই এখানে লুকিয়ে আছিস।”
আরু কচ্ছপের গতিতে বের হলো। তখনও টিভির পর্দায় চলছে সেই দৃশ্যগুলো। দুহাতে গাল ধরে করুণ গলায় বলে, “বিশ্বাস করুন, আমি দেখিনি। আমি শুধুই বসে ছিলাম।”
“অপরাধ করা আর সহ্য করা, সমান” হাত ঘুড়িয়ে বেতের সোফার উপর বসে আরুকে নিয়ে। চঞ্চল আরু ইদানীং অপূর্ব-র স্পর্শে আজকাল বোকা হয়ে যায়। দিশেহারা হয়ে উঠে। লজ্জায় তার চোখে জল উপস্থিত হয়। তবুও অপূর্ব-র ধমকানিতে চেয়ে থাকে অপলক। অপূর্ব হাসে। আরুর চোখ মুখের লালচে ভাবটা নজরে আসতেই ছ্যাত করে উঠে অপূর্ব-র অন্তঃকরণ। রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করে আরুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলে, “তোর এই মুখের ভঙ্গিমা আমাকে জানিয়ে দেয়, তুই কেমন। ক্ষমা করে দিলাম।”
লজ্জা, অস্বস্তি ও অভিমানে মুখ তুলে চাইল না আরু। আরুর চিবুকে হাত রেখে ঈষৎ উঁচু করে আদুরে অপূর্ব শুধাল, “রাগ করে ছিলিস কেন?”
“আপনি আমার পিঠে আঁচড় দিয়ে রক্ত জমাট করে ফেলেছিলেন তাই।” উদাসীন আরুর অভিমানী কণ্ঠ। অপূর্ব অপ্রসন্ন হয়। আদরে মাখা গলা আরও আদুরে করে বলে, “তাই? আমি যে তখন হামি দিলাম তার বেলায়? আঘাত করলেই কথা বলা বন্ধ, আদর করলে উলটা কেন?”
“আপনি তো কপালের মধ্যিখানে হামি দিয়েছিলেন, বুঝব কীভাবে?” আরুর অস্বস্তির মাত্রা বাড়িয়ে অপূর্ব একটু নির্লজ্জ হলো, “তাহলে যেখানে আঘাত করেছি, সেখানে দেই। পেছনে ফের।”
আঁতকে উঠল আরু। এই অজপাড়া গাঁয়ে হয়তো স্বামীও তার স্ত্রীকে এরুপ মন্তব্য করেনা, লজ্জায় জড়সড়ো হয়ে বলে, “ছিঃ!”
“ছিঃ কীসের? তোর এই গ্ৰামে কেউ না বললেও, বিদেশে এসব সাধারণ বিষয়। মেয়েরা বিয়ে না করে লিভিং করতে চায়। আমার বান্ধবী সামিরা। আমাকে বলেছিল, তার সাথে লিভিং-এ যেতে। দেশে আসার আগে লিভিং শেষ করে অন্য একজনের সাথে পুনরায় লিভিং-এ যাবে।”
“লিভিং কী?”
“বিয়ে না করে বিবাহিতদের মতো থাকা।” অপূর্ব-র উত্তরে আরু বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। চোখমুখ কুঁচকে ঘরের দিকে যাওয়ার প্রয়াস করতে অপূর্ব বলে, “বালিশের নিচে তোর জন্য একটা প্যাকেট আছে।”
অপূর্ব সিডির ভেতর থেকে ক্যাসেট বের করে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলল। মৃদু কেঁপে উঠে আরু। উঠে ছুটে ঘরে দিকে গেল আরু। বালিশের নিচ থেকে ব্যাগটা নিয়ে বুকে আবদ্ধ করে নিল, “অপূর্ব ভাই, আপনার মতো করে কেউ আমাকে বোঝে না।
আপনি লিভিং-এ ছিলেন? এর শা/স্তি আপনাকে পেতে হবে। আগামীকাল সকালে যদি এর শাস্তি আমি না দিতে পারি, তবে আমার নাম আরু নয়, গরু।”
আরুর অবুঝ মন আ/সা/মি বানিয়ে দেয় অপূর্ব-কে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]