#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০২
“অপূর্ব ভাই, আপনি জামা কাপড় খুলে ফেললেন কেন? আমি কিন্তু চিৎকার করব বলে দিলাম।” কল চাপা রেখে স্তম্ভিত হয়ে বলে উঠে আরু। অপূর্ব সবে সাদা শার্ট খুলে রেখেছে বালতিতে। আরুর করে উঠা চিৎকার শ্রবণ হওয়া মাত্র ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। আঙুল তুলে কৌতুহলী কণ্ঠে বলে, “শার্ট খুলব জাস্ট, লুঙ্গি নয়। চ্যাঁচামেচি বন্ধ কর। নাহলে সেই কাজটাও করে ফেলব। লজ্জায় কিন্তু তুই পড়বি।”
আরু নতজানু হয়ে তার হাতের সাহায্যে একের পর এক কলের হাতল ধরে চেপে পানি উত্তোলন করার প্রচেষ্টা করছে। ক্ষণে ক্ষণে অপূর্ব-র জিম করা শরীরের দিকে তাকাচ্ছে। গ্ৰামের পুরুষের শরীরে এমন ভাঁজ কখনো দেখেনি। ভর্তি হওয়া বালতি থেকে মগ দিয়ে অনবরত পানি ঢালতে থাকে অপূর্ব। প্রবল যাতনায় ক্ষান্ত হয়ে ব্যথাহত কণ্ঠে আরু বলে উঠে, “এত কষ্ট করে পানি না তুলে দিঘিতে একটা ডুব দিলেই তো হয়।”
“দিঘির পানিতে কী কী কাজ করে – তোর ধারণা আছে? এই গোবর দিঘির জল দূষিত করবে।” ‘Sevlon’ নামের সাবানটা ঘষতে ঘষতে বলেন অপূর্ব।
“তাতে কী হয়েছে। গোবরে পানি পরিষ্কার হয়, আপনি জানেন না? আপনি তো বিদেশি মানুষ। জানাবেন কীভাবে?”
“যদি গোবরে পানি পরিষ্কার হতো, তবে আমাদের গরুগুলো কেন রাখাল চাচা নদীতে গোসল করতে নিয়ে যায়?” আরু পরীক্ষায় যথেষ্ট ভালো ফলাফল করলেও অপূর্ব-র এই প্রশ্নের উত্তর তার অজ্ঞাত। প্রত্যুত্তরের আশায় দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থেকে অপূর্ব পূর্বের ভঙ্গিতে বলে উঠে, “টিউবল থেকে পানি তুলে গোসল করবি, ভুলেও দিঘিতে ঝাঁপ দিবি না।”
অপূর্ব ভেজা পোশাক পালটে চলে গেল ঘরে। আরু ভেজা পোশাক কাচতে ব্যস্ত হলো। তুর অনিতার শাড়িটা দিয়ে গেলেই ভেজা পোশাক ছাড়বে আরু। সে যে আর পাঁচটা মেয়েদের মতো থ্রি-পিছ পরে থাকতে পারে না। শাড়িই তার ভূষণ।
__
“আরুকে তো দেখলি, কেমন লাগল তোর?” ছেলে দেশে ফেরা উপলক্ষ্যে গতকাল থেকে অনিতার ‘আনন্দ’ যেন বিদায় হতে অনিচ্ছুক। প্রতি বেলাতে বিভিন্ন ধরনের খাবারে সজ্জিত করেন টেবিল। দিঘি থেকে তোলা সলা চিংড়ি মাছের ভুনা অপূর্ব-র পাতে দিতে দিতে উপর্যুক্ত প্রশ্নটি করেন অনিতা।
‘প্রতি বেলায় মধ্যবয়স্ক থেকে উর্ধবয়স্ক পুরুষেরা প্রথমে খাবার খাওয়ার পর বাড়ির ছেলেমেয়েরা এবং তার পরে গৃহবধূরা খাবার খাবেন’ – এটাই সাত ভাই চম্পা নিবাসের অতীতের নিয়ম। জাহানারা তার ছেলে তিয়াসের পাতে ভাত দিতে দিতে অপূর্বকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তিস্তার বিয়ে খেতে এসে এবার নিজের বিয়েটা সেড়ে ফেল অপু। বয়স তো কম হলো না।”
“হ্যাঁ, এবার ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিবো। দেশে ফেরার কথা জানাজানি হওয়ার পর ঢাকা থেকে অফার এসেছে। জীবনের অর্ধেকের বেশি বয়স পরিবার ছেড়ে থেকেছি। বাকিটা তোমাদের সাথে পার করব। সুন্দরনগর শহরে একটা হাসপাতালে চাকরি নিয়েছি। বলার সাথে সাথে তারা রাজি হয়েছে।”
“আরু-কে.. অনিতা সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করার পূর্বে অপূর্ব তাকে দমিয়ে দিয়ে একরোখা কণ্ঠে বলে, “স্যরি মা। আরুর মতো একটা বাচ্চা মেয়েকে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়।”
“ও বাচ্চা নয়।” আরুর নানি চম্পা বলেন।
“কিন্তু আমার বয়সের কাছে সে নিতান্তই বাচ্চা। আরু যথেষ্ট সুন্দর আমি মানি, অন্য কোনো মেয়ে যদি হয়। তবেই.. অপূর্ব থেমে গেল। ব্রাউজ বিহীন শাড়ি পরে তারই আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে এসেছে আরু। খোঁপা বাঁধা চুলগুলো থেকে অবিরাম পানি গড়াচ্ছে আরুর নগ্ন গলা ও পিঠে। অপূর্ব পলকরহিত চেয়ে রইল সেদিক। অপরাহ্ণের সময় প্রখরতা হীন সূর্যের ফিকে রোদ আরুর দেহে সোনালী আভা সৃষ্টি করেছে। তার ধ্যান ভাঙল চম্পার কথায়, “নানুভাই এতক্ষণে এসেছ, বেলা গড়িয়ে গেছে। খাবে এসো।”
“না নানুভাই, আমার মিঠু আর ময়নাকে খেতে দিতে হবে। আমি যাই।” আরু হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে আরু।
অনিতা শুনলেন না। আরুর হাত ধরে বসালেন টেবিলে। থালাতে খাবার পরিবেশন করার পাশাপাশি সংগোপনে ফেললেন দীর্ঘ নিঃশ্বাস। ষোলটা বছর ধরে তিলে তিলে ‘আরু’ নামক মেয়েটাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি, আচমকা সেই স্বপ্নটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে।
“মামুনি, ও মামুনি। তুমি আজ এমন করে আছো কেন?”
“কোথায় কেমন? ছেলে এসেছে তো, তাই তোর প্রতি অযত্ন করে ফেলছি মা।
তুই না বললি অপূর্ব-র জন্য পিঠা এনেছিস। সেগুলো কোথায়?” অনিতার এমন কথাতে আরু ভাষা খুঁজে পেল না। তবুও কাঁচুমাচু মুখে করে বলে, “তোমাদের রাজহাঁসের লড়ানিতে সব গোবরের ভেতরে ফেলে দিয়েছি। মা জানতে পারলে আমার খুব মা/র/বে।”
“আমরা না বললে জানবে কীভাবে হ্যাঁ? আমি ফোন করে বলল, ‘পিঠাতে চিনি হয়নি। আরেকবার করে দাও ননদিনী।’ অপুর পিঠা খাওয়াও হবে। তোর দোষও হবে না।” জাহানারা বললেন। দীর্ঘক্ষণ জমিয়ে রাখা ভয়ের ছাপ উধাও হয়ে যায় এক নিমিষে। আরু হেসে উঠে। অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে বলে, “ফুফুকে আমি মিথ্যা বলতে পারব না। আমি সোজাসুজি বলব, ফুফি তুমি আরুকে জোর করে পাঠিয়েছ বলে সে পিঠাপুলি গোবরে ফেলে দিয়েছে।”
“মামুনি।” মিহি কণ্ঠে বলে অনিতার কোমর জড়িয়ে ধরে আরু। আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে অভয় দিয়ে বলেন, “অপু মেয়েটাকে আর বিরক্ত করিস না। আর শোন, তোরা খেয়ে সবকিছু গুছিয়ে রাখিস। আমি উঠলাম। ভালো লাগছে না।” অতি সাবধানে পরিস্থিতি সামলে শোবার ঘরে চলে যায় অনিতা।
বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে অপূর্ব। কখনোবা বাতির সুইচ ‘অফ অন’ করছে। তার নেত্রপল্লবে ঘুমেরা স্থগিত রেখেছে। পল্লব বন্ধ করলেই ভেসে উঠে আরুর সেই পিঠ ও গলার ছবি। ছটফট করতে করতে উঠে বসে অপূর্ব। অস্বাভাবিক কিছু নয় এটা, বরং স্বাভাবিক। মায়ের কথাতে বিগত বছরগুলোতে সে আরুকে ঘরনি করার স্বপ্নে মেতে ছিল। প্রথমবার তাকে দেখে এমন অনুভূতি অস্বাভাবিক কিছু নয়।
অপূর্ব বিছানা ছেড়ে উঠে ট্রাভেলিং ব্যাগটা নিয়ে তুর-শেফালীর ঘরের যায়। দরজায় সামনে যেয়ে আরেকদফা থমকে যায়। চৌকিতে মাঝবরাবর উবুড় হয়ে শুয়ে আছে আরু। নগ্ন পিঠের তিনটা তিল প্রবেশে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। নিচের ঠোঁট ভেতরে ঢুকে আছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় অপূর্ব-র। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ধীরকদমে এগিয়ে গেল অপূর্ব। ঠান্ডা হাত নিজের অজান্তেই স্পর্শ করল আরুর পিঠ। ঘুমন্ত আরু কেঁপে উঠল। তৎক্ষণাৎ প্রবেশ ঘটল তুরের। খোঁপা খুলে ছড়িয়ে যাওয়া চুল দিয়ে পিঠ ও পরিস্থিতি একসাথে সামলে নিল অপূর্ব।
“ভাইয়া, আপনি এখানে।” তুর বলে।
“হ্যাঁ, ঐ আরকি। তোদের গিফটগুলো দেওয়া হয়নি। ওগুলো দিতে এসেছি। আরুও আছে। দ্রুত যা সবাইকে ডেকে নিয়ে আয়।”
তুরের আগেই শেফালী ছুটে গেল ডাকতে। অপূর্ব গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, “ওকে তোল।”
তুর ডেকে ঘুম থেকে তুলল আরুকে। আরু চোখ পরিষ্কার করতে করতে উঠে বসে। আরুর ঘন চুল বিছানায় পড়েছে। ঠাওর করা গেল না এই কোঁকড়ানো চুলগুলের দীর্ঘতা। মিনিট দুয়ের মধ্যে মহিলারা উপস্থিত হলো কক্ষে। অপূর্ব চেইন খুলে গিফট দেওয়া শুরু করেছে। সবাইকে দেওয়া শেষ করে আরুর কাছে আসতেই নিশ্চুপ হয়ে গেল সে। ঘরনির জন্য সে নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছিল। সেই নীলপদ্ম আরুকে দিতে অনিচ্ছুক তাই নিজের আরেক অতিপ্রিয় বালু ঘড়িটা আরুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এটা তোর জন্য এনেছি।”
ডাগর ডাগর চোখে বালু ঘড়িটাকে পর্যবেক্ষণ করে আড়ষ্ট কণ্ঠে বলে, “অপূর্ব ভাই, বিদেশে এতকিছু থাকতে শুধু এই বালু ঘড়িটা কেন এনেছেন। আমার হাতঘড়ি আছে, এটা লাগবে না।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]